বাঙালি মদ্যপায়ী প্রাণী। এইটা তার জিউভা দেখলেই বুঝা যায়। অর্থাৎ যেই লোক মাগনা পেলে আলকাতরা পান করে, একটু লবণ ছিটিয়ে কিঙবা লেবু চিপে, সেই লোক মদ্যপান হতে নিজেকে বিরত রাখবে, এ হতে পারে না। এই সূত্র মোতাবেক, বাঙালি কেবল মদ্যপায়ী নন, যে কোনও ধরনের পান-ভোজনেই তার প্রিয় হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে মালের দাম জলের দামাপেক্ষা হাজার গুণ বেশি হওয়ায় নিত্যি মদ্যপানের কথা ভাবতেই পারে না বাঙালি। ওই ঈদে, পার্বণে, চাঁন রাইতে কিংবা বেতনের পয়সাটা পেলেই কেবল শুড়িবাড়িপানে তাঁর পা টানে। কিন্তু পকেটের দশা আর মাসিক বাজারের ফর্দের কষাভাব মাথায় থাকে সর্বক্ষণ। ঝেড়ে তাড়াতে পারে না। তাই তাকে নানাবিধ আঁক কষতে হয়। আঁক কষে দেখা যায়, হচ্ছে না। পকেটের এই না কুলোনি দশা তাকে ভিড়িয়ে দেয় তার মতো আরও কিছু পাজির দলে। এভাবে তিন চারজনের একটা দলবেন্ধে তারা মাসের পয়লা সপ্তার বিষ্যুৎবারে শুঁড়িবাড়ি ঢোকে।
লোকে লোকারণ্য শুঁড়ি বাড়ি, বসবার জায়গা দূরস্থান, দাঁড়ানোরই ঠাঁই নাই। এমতাবস্থায় পূর্বপরিচিত ওয়েটার কাবুলই কেবল ভরসা। এদিন কাবুলেরও ফুরসত নেই। এই ডাকে তো সেই ডাকে। এই ঝাড়ি মারে তো সেই ঝাড়ি মারে। পকেটে কিছু জোটে বলে কাবুলও এদিন আপন ভাই বাবুলের মতো আচরণ করে। ফলে মদ্যপায়ী প্রাণীর দলটি কোনও না কোনওভাবে একটা বসার টেবিল পেয়েই যায়। আর বসার টেবিল পেয়ে গেলে তারে আর পায় কে। সেই জগতের শেঠ, দুনিয়ার রাজা। বিরাট হাঁক ডাক শুরু করে... বড় দেইখা একটা জরিনা আন। পাতলা কইর্যা পিঁফি কাইটা সালাদ বানিয়্যা দে। শশাও কাটপি পাতলা কইর্যা। বেশি কইরা কাঁচা মরিচ মারবি। ঝাল না হইলে কিন্তু মালের পইসা পাবি নারে কাবুইল্যা।
কোনও কথা না বলে কাবুল ঝড়ের বেগে চলে গেলে দলের সবচেয়ে খেকো লোকটা মুখ ফুটে বলেই ফেলে... একটা মুরগি ভাজার অর্ডার দিলা না বন্ধু? এইক্ষণে অর্ডারদাতার মাথা খারাপ হয়ে যায়। সে প্রায় চিল্লিয়ে ওঠে, টেকা কি তর আব্বা দিব? কিন্তু খেকো লোকটা বেজায় রসিক, সুন্দর কথা ঘুরিয়ে দেয়, একটা জ্যাব মেরে, মদ খাওয়ার সুমায় তুই আব্বা আম্মারে ডাকস ক্যা? বিল যা আইব ভাগ কইরা দিলেই হইব। এমতাবস্থায় অন্যরা হ্যাঁ হ্যাঁ বলে সায় দিলে অর্ডারকর্তার জিব ও দাঁত জেগে ওঠে একটা ভাজা মুরগির শরীর চেটে ও কেটে খাওয়ার জন্য।
আর তখনই কাবুল আসে। জরিনার বোতল নিয়ে। গ্লাস আর আইস নিয়ে। অর্ডারদাতা মোচড় দিয়ে জরিনার মোখা খুলতে যায়, কিন্তু পারে না। এইক্ষণে অন্যেরা দেখি দেখি বলে হামলে পড়ে। একে একে সবাই চেষ্টা করে ফেল মারার পর অর্ডার দাতা শেষজনের কাছ থেকে প্রায় ছিনিয়ে নেয়, আমিই পারলাম না... তো আর তরা? দে ..আমার কাছে, বলে শার্টের কাপড় চেপে ধরে এবার কড়া মোচড় দেয়ার আগেই বোতলের মুখ খুলে যায়, কারণ অন্যরা ইতিমধ্যেই মোখা খোলার আশি ভাগ কাজ সেরে রেখেছে।
কিন্তু শেষ মোচড়টা যেহেতু অর্ডারদাতাই দিয়েছে, ফলে রোয়াব নেয়া শুরু করে... দেখলি তো কেমনে বোতল খুলতে অয়? চুদানির পুলারা এতদিন ধইরা মদ খাছ, এহনতুরি বোতলের মুকা খুলাই শিকলি না..
অন্যরা ফিক ফিক করে হাসে আর গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে, বেশি কইরা দেইছ। কিন্তু অর্ডারদাতা বেশি করে দেয় না, ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে প্রত্যেকের গ্লাসে মাল ঢেলে দিয়ে নিজের গ্লাসও ভরে নেয় একই মাপে।
গেলাসে গেলাস ঠুকে তারা শুরু করে। ইতিমধ্যে ঝাল ঝাল বাদাম আর পাতলা করে কাটা পেঁপে আসে। এবার সবাই বাদাম আর পেঁপের উপর হামলে পড়ে। কিসের মদ্য পান, পেঁপে আর বাদামপানে ক্ষুধার্ত বাঙালি এইবার মশগুল হইয়া পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই দুই পেলেট বাদাম উধাও হইয়া যায়, কাঁচা মরিচের ছোট ছোট টুকরা বাদে পেঁপের পাতলা ফালিগুলিও বিরল হইয়া যায়। তবু কেউ কেউ কাঁচামরিচের টুকরাই খেতে থাকে। ঝালে শুশায় তবু।
আরেক পাত্তর চড়ে। এবার মুরগি ভাজি চলে আসে। আবার শুরু হয় একই দশা। আবার পাত্তর চড়ে। কথা হাউকাউ, ব্যথা বিনিময়, প্রেম, কাব্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান থেকে পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় শেষে বোতল খালি হলে একজন আরেকজনের উপর রাগ ঝাড়ে। ক্ষোভ ঝাড়ে। মারামারি করে। গলা ধরে কাঁদে, হাসে। তারপর একে একে বাড়ি ফেরে।
কপাল ভাল থাকলে, বউ কিছু কয় না। কপাল খারাপ থাকলে বউ ধরে প্যাদায়, তুমি আবারও মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছো? অমুক, তমুক নানান বালছাল।
সকালে উঠে নাস্তার টেবিলে রুটি আর ভাজি মারতে মারতে পকেটের হিসাব আর মেলাতে পারে না মদ্যপায়ী প্রাণিটি। ফলে মাসের বাকি দিনগুলো তাকে শুকনো গলা নিয়েই চলতে ফিরতে হয়। এ সময়টা তার জন্য কষ্টকর ও বেদনাবহ।এসব দুঃখ কষ্ট ভুলতেই সে সস্তায় গাঁজায় দম দেয়। দম দিয়ে একটু হাল্কা হয়। কিন্তু মালের বোতলে গলা ভেজানোর জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় পুরো একটি মাস। এই দিনগুলো অর্থহীন ও হ্যাংওভারে ঠাঁসা। তখন মদ্যপানের স্মৃতি আউড়ে কিছুটা দুঃখ ভোলা।
দ্বিতীয়াংশ বা মদ্যপানের স্মৃতি
আমরা তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রিত। পড়ালিখারে ভ্রান্ত জ্ঞান করিয়া এধার ওধার ঘুরে বেড়াই। আর জনমনে ভ্রান্ত ধারণা ছড়াই। হাতে কিছু পয়সাপাতি এলে বন্ধু বান্ধব মিলে বুড়ির বাড়ি দৌড়াই।
দিলীপ প্রচুর ঠকাতো বলে বুড়ির বাড়িই হলো আমাদের শেষ ঠিকানা। আহা বুড়ির বাড়ি। সে একটা বাড়ি ছিল বাহে। নিকোনো উঠান, ছায়াঘেরা মায়াঘেরা একটা বাড়ি। একটা ইয়া বড় মূলা ক্ষেত এবং আরও চার পাঁচটা সর্ষেক্ষেত পেরিয়ে বুড়ির বাড়ি। তার আগে অবশ্য আপনাকে একটা মজা খাল পেরুতে হবে। এবং এর আগে পেরুতে হবে খিস্টানদের কবরস্থান ও সাধু পৌলের গির্জা। রাত দুটোর সময়। রাজাসন বাজার থেকে। সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে যার দূরত্ব প্রায় দু/তিন কিলো। প্রেম এক্কার মতো একজন একচোখা দৈত্য যখন রিকশাওয়ালা। অত রাতে কেবল চাঁদ আর প্রেম এক্কা সঙ্গী। আপনার আর কোনও বন্ধুই যেতে চাইবে না। তখন আপনার বুকও খামচে ধরতে পারে ভূত এবং অজানা আশঙ্কার ভয়। চারপাশ শুনশান। সামনে সাধু পৌলের গির্জা, ভয় জাগানিয়া। পাশ দিয়ে মাটির রাস্তা। পেঁয়ারা বাগান আর কবরস্থান। পার হয়ে রিকশা চলে যাবে পিটারদের বাড়ি। প্রেম এক্কা নেমে রিকশাটাকে ভাল করে বাঁধবে ওদের বাড়ির সুপারি গাছের সঙ্গে। তারপর বললেন, দাদা চলেন।
আপনাকে তখন একচক্ষু দৈত্য প্রেম এক্কার সঙ্গে চলবেন কি চলবেন না, সে নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হবে। গহীন রাত আর থালার মতো সোনালি চাঁদ আপনাকে আয় আয় করে ডাকার পরও। কারণ প্রেম এক্কার চেহারা ভয়ঙ্কর, বিপজ্জনক। সে যা ইচ্ছে তাই করার সামর্থ্য রাখা চেহারার মালিক। তবুও আপনি ঝুঁকিটা নেবেনই। তবে চলার আগে অতি অবশ্যই গলার মাফলারটা খুলে নেবেন, নিরাপত্তার খাতিরে। তারপর হেলেদুলে চলতে শুরু করবেন, ভয় তাড়াতে গান ধরবেন, প্রাণে প্রাণ মেলাবই বলে রাখি।
চলছেন তো চলছেনই। মেঠো পথ, দু পাশে মানুষের বাড়ি, সারি সারি গাছ, সামনে অজানা পথ। প্রেম এক্কা চলছে, আপনিও চলছেন। হুশ করে সামনে পড়ে যাবে একটা মড়ানদী। এইবার আপনি চমকাবেন, প্রেম এক্কাকে বলবেন, এবার কীভাবে পার হব?
প্রেম এক্কা অভয় দেবে, দাদা... পানি তো বেছি না। বলে নিজেই নেমে যাবে জলে, খলবল করে এগুতে থাকবে। আপনিও স্যান্ডেল খুলে হাতে নিতে জলে নামবেন। আর তখনই ঠান্ডা জল আপনাকে কামড়ে দেবে। আপনি প্রায় জলের উপর দৌড়ুতে শুরু করে দেবেন। কিন্তু জল আপনাকে ছাড়বে না। খলবল করে জানিয়ে দেবে, তাকে ছাড়া সহজ না। তবু তাকে আপনি একসময় ছাড়িয়ে দেবেনই। এরপর খাড়া পার বেয়ে আপনাকে উঠে যেতে হবে, প্রেম এক্কার পিছু পিছু। প্রেম এক্কা তখন আপনার দৃষ্টির আড়ালে, আপনি তখন কেবলই একা। তাই আরও জোরে আরও জোরে আপনি উঠে যাবেন পাড়ে। আর তখনই আপনার চোখের সামনে ফুটে উঠবে হাজারো ফুল, ফুলের ক্ষেত। কমলাপুর গ্রাম। সর্ষে আর মূলা ফুলের ক্ষেত পেরিয়ে আপনি পৌঁছে যাবেন, বুড়ির বাড়ি। বুড়ির বাড়ির নিকোনো উঠানে অফুরন্ত চাঁদের আলো।
প্রেম এক্কা তখন তার শাশুড়িকে ডাকছে, ওই বুড়ি... ওই বুড়ি বলে। আপনি উঠানো দাঁড়িয়ে। বুড়ি শেষমেশ ঠিকই উঠে আসবে, রূপকথার মোটা বুড়ি সেজে। প্রেম এক্কা বুড়ির সঙ্গে কী কী যেন কথা বলবে। তারপর বুড়ি একটা গ্লাস প্রেম এক্কাকে ধরিয়ে দেবে, আরেকটা গ্লাস আপনাকে। প্রেম এক্কা হুড়ুত করে, পুরো গ্লাসের জল গলায় ঢেলে দেবে। আপনিও তাকে অনুসরণ করবেন, একটা তরল আগুন আপনাকে গিলে খাবে।
এরপর দাম দস্তুর হবে, এত সস্তা দেখে আপনি দু ঠোঙা মাল বেশিই কিনবেন। বুড়িও খুশি হয়ে আপনাদের আরও দু গেলাশ বাড়তি দেবে। অসুরের মতো প্রেম এক্কা আবারও তা এক ধাক্কায় গলায় ফেলে দেবে, আপনিও তাকে অনুসরণ করবেন। এবার ফিরতি পথ। কিন্তু আপনি হাঁটার বদলে উড়ছেন কেন?
কারণ মাতাল চাঁদ আপনাকে গিলে ফেলেছে। আপনি গিলে ফেলেছেন মাঠের সব ফুল ও ফুলের সৌরভ। নদী ডিঙিয়ে যাবেন, চোখের নিমিষে, খাড়া পাড় পেরুবেন ঝড়ের বেগে, তারপর কখন যে রিকশায় চেপে বসবেন, আপনিও নিজেও জানেন না। কবরস্থানের ভূতকে মনে হবে আপন মায়ের পেটের ভাই, আপনি তাদের আয় আয় বলে ডাকবেন। তারা ভয়ে আপনার কাছ মাড়াবে না, কারণ আপনিই তখন সাধু পৌল।
আপনি ফিরে যাবেন, রাজাসনে, যেখানে বন্ধুরা আপনার জন্য অপেক্ষায় বসে আছে। আপনি বন্ধুদের দিকে ছুড়ে দেবেন মদের ঠোঙ্গাগুলি, তারা আপনাকে জড়িয়ে ধরবে, আপনি তাদের জড়িয়ে ধরবেন, তারা মাল খাবে, আপনিও আরেক পাত্তর চড়াবেন। তারপর এক বুনো মোষের মতো দাপড়ে বেড়াবেন পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তর। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হবে, আপনাদের কোরাস চিৎকারে।
পরের দিন হ্যাঙওভার কাটিয়ে আপনি লিখবেন,
হাসপাতাল
পরাজিতরা মাথা হেঁট করে চলে যাবে আর বিজয়ীরা আনন্দে লাফাবে
লাফাতে লাফাতে যখন মুষড়ে পড়বে
আমি তখন আনন্দের ক্ষণস্থায়িত্ব দেখে মুচকি হাসি
চোখ কথা বলে। বহু কথা না বুঝে বুঝে প্রেমে পড়েছি বহুবার
আর তাতে আমার এ অগোছালো জীবন আরও বেশি ঝড়ো কাক হয়েছে
টিনের চালে বৃষ্টি .. পতনের শব্দ অধঃপতনেরো.. গড়িয়ে গড়িয়ে কতদূর?
তবু আমি ঠিকই টের পাই বৃষ্টি আর রঙিন প্রজাপতির শত্রুতা
আর সেই ছোট্ট মেয়েটা...যার আদরের বাড়াবাড়িতে ঘর ছাড়তে চায় না বেড়ালটা
অথচ বাড়ির সব্বাই তাকে বের করে দেয় রাস্তায়
সেই মেয়েটা..যার হুহু কান্নায় অভিভূত মুগ্ধ হয়ে আমি তাকে পড়াই .. রবারি মানে ডাকাতি।
আর এই ঘোর আধুনিক কালেও
জানি, আমার পায়ের আঙুলের ক্ষত ঢের বেশি কষ্ট দেবে
তবু আমি হাসপাতালে যাব না।