[ফের এবছর ভয়াবহ বন্যার কবলে নিম্ন দামোদর এলাকা। ১৯৭৮ এবং ২০০১ সালের বন্যাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এর তীব্রতা। তীব্র প্রশ্নের মুখে পড়েছে ডিভিসি-র বাঁধগুলির কার্যকারীতা এবং পরিচালনা। একটি বড়ো দৈনিকে হেডিং হয়েছে, ঝাড়খণ্ডের জলে ডুবল বাংলা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দুটো প্রশ্ন তুলেছেন, এক) ডিভিসির জলাধারগুলোতে ড্রেজিং করছে না কেন কেন্দ্র সরকার? দুই) জল ছাড়ছে ডিভিসি। এই অবস্থায়, বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ‘ডিভিসি-র ছাড়া জলে বন্যা হলো’ – এটা লব্জে পরিণত হয়ে গেছে যেমন, তেমনি সম্ভবতঃ সামনের দিনে আরেকটি লব্জ তৈরি হতে চলেছে, ‘ঝাড়খণ্ডের জলে বন্যা বাংলায়’। মুশকিল হলো, এই কথাটা বলা আর ‘সূর্যের তাপে খরা বাংলায়’ বলার মধ্যে কোনো তফাত নেই। এই ধরনের কথা, সমস্যাটি ঠিক কী, তা গুলিয়ে দেয়। সমস্যাটির সমাধান করার উদ্যোগ নিতে বাধা দেয়। এবং একইসাথে ভেতরে ভেতরে, এটা কোনো সমস্যা না, এই বোধও তৈরি করে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল নিষ্ক্রিয়তা।
আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি, সমস্যাটি ঠিক কী, তা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তুলে ধরার। এবং তা এখনও পর্যন্ত দামোদরের বন্যা নিয়ে যা যা গবেষণা হয়েছে, সেগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে। তার মধ্যেই থাকবে, কী করা যায়, কতটা করা যায়, সেসবও। আমরা অবশ্যই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ানোর পক্ষপাতী। সমস্যাটিকে বর্তমানের নিরিখে বোঝার পক্ষপাতী। এবং আমরা প্রশ্ন তীক্ষ্ণতর এবং সূক্ষতর করার পক্ষপাতী, যাতে ফারাকটিকে চেনা যায়। মোটা দাগের কোনো মতামতের তুলনায় সূক্ষতর প্রশ্নের মধ্যেই সমস্যাটি এবং তার মোকাবিলার ভবিষ্যৎ নিহিত বলে আমরা মনে করি। তাই পাঠকরাও যদি পারেন, সাহায্য করুন, সূক্ষতর প্রশ্ন করে। বা তার উত্তর দিয়ে।
একইসাথে আমরা মনে করি, যারা বছর বছর নিম্ন দামোদরের বন্যায় আক্রান্ত হন, তাদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ছাড়া সমস্যাটির সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব না। আর সেই হস্তক্ষেপের পূর্বশর্ত, সমস্যাটি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা গড়ে তোলা। সমস্যাটির সম্যক ধারণা তৈরি করতে গেলে তাতে আক্রান্তদের অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণালদ্ধ জ্ঞানের ওপর দাঁড়ানো ব্যতিরেকে কোনোভাবেই সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক ধারনা করা যাবে না। সমাধান তো দূর অস্ত। — বসুন্ধরায় আজাদি]
৩০ জুলাই ২০১৭, ভগবানচক সংলগ্ন বড়ো রাস্তা। ছবি নিলকমল বেরার সৌজন্যে।
দ্বিতীয় কিস্তিতে আমরা আলোচনা করব দুটি প্রশ্ন নিয়ে। মুখ্য উদ্দেশ্য, ডিভিসি জলাধারগুলোর নিম্ন দামোদরের বন্যার সঙ্গে সম্পর্ককে উন্মোচিত করা। বলাই বাহুল্য, প্রশ্ন দুটির মধ্যে দিয়ে নিম্ন দামোদরের বন্যার পূর্ণাঙ্গ কারণ ব্যাখ্যা হবে না, বা ডিভিসি জলাধারগুলোর লাভ-ক্ষতির-ও পূর্ণাঙ্গ বিচার হবে না। আমাদের সেটা উদ্দেশ্যও নয়। এই আলোচনারও সূত্র কুমকুম ভট্টাচার্যের গবেষণা।
১) ডিভিসি জলাধারগুলো হবার ফলে দামোদরের বন্যার তীব্রতা ও প্রকোপ কি বেড়েছে, নাকি কমেছে?
ডিভিসির প্রধান দুই জলাধার, মাইথন ও পাঞ্চেত, যা ১৯৫৮ সালের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছিল। কুমকুম ভট্টাচার্য ডিভিসি জলাধারগুলো তৈরি হবার আগের ১৯৩৩-৫৬ অর্থাৎ ২৪ বছর এবং পরের ৪৮ বছর (১৯৫৯-২০০৭) এর মধ্যে তুলনামূলক বিচার করেছেন। ব্রিটিশ আমলের আর্কাইভ ঘেঁটে, ইউনেস্কোর বন্যা সংক্রান্ত তথ্য ঘেঁটে এবং ডিভিসি-র গড় ও সর্বোচ্চ জলপ্রবাহের তথ্যাদি ঘেঁটে এই তুলনা তিনি তৈরি করেছেন। বন্যা-তত্ত্বে সুপ্রতিষ্ঠিত গামবেল এক্সট্রিম ডিস্ট্রিবিউশন নামক গাণিতিক পদ্ধতির মাধ্যমে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহের ওপর ভিত্তি করে দামোদরে কত বছর পর বন্যা আসতে পারে তার হিসেব করা হয়েছে। এই হিসেবগুলি বিস্তারিতভাবে পাওয়া যাবে ২০১১ সালে প্রকাশিত তাঁর গবেষণা-পুস্তক, “The Lower Damodar River, India : Understanding the Human Role in Changing Fluvial Environment” এ। সেখানে প্রয়োজনীয় রেফারেন্সগুলোও পাওয়া যাবে।
তাতে তিনি দেখিয়েছেন, রন্ডিয়ার কাছে কূল ছাপানো ৭,০৮০ ঘন মিটার / সেকেন্ড (আড়াই লাখ কিউসেক) এর বন্যা আসার পৌনঃপুনিক ব্যবধান ছিল ১.৭ বছর, অর্থাৎ প্রায় প্রতি বছরই কূল ছাপিয়ে বন্যা আসত। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের পর ওই কূল ছাপানো পরিমাণ জলপ্রবাহ তৈরি হবার পৌনঃপুনিক ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ১৪ বছর। অর্থাৎ, ডিভিসি জলাধারগুলি নির্মাণের পরে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়ায় প্রতি চৌদ্দ বছরে একবার নিম্ন দামোদরে কূল ছাপিয়ে বন্যা আসতে পারে, যা কি না অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় বা জলাধার নির্মাণের আগের সময়ে প্রতি ১.৭ বছরে একবার করে আসত।
স্বাভাবিক অবস্থায়, অর্থাৎ ডিভিসি জলাধারগুলি না থাকা অবস্থায়, দামোদরে গড় বাৎসরিক বন্যা (q2.33 অর্থাৎ ২.৩৩ বছর ব্যবধানে ফিরে আসার মতো সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ) এবং সম্ভাব্য বাৎসরিক বন্যার (q1.58 অর্থাৎ ১.৫৮ বছর ব্যবধানে ফিরে আসার মতো সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ) মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৮,৪১৭ ঘন মিটার / সেকেন্ড এবং ৬,৭২৮ ঘন মিটার / সেকেন্ড। অর্থাৎ কূল ছাপানো বন্যার মাত্রা (৭,০৮০ ঘন মিটার / সেকেন্ড) -র তুলনায় একটি বেশি এবং অন্যটি প্রায় ছুঁই ছুঁই। এর থেকে বোঝা যায়, প্রতি বছরই আগে বন্যা আসত। জলাধার নির্মাণের পর এই দুটির মাত্রা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৩,৬৩০ ঘন মিটার / সেকেন্ড এবং ২,৬০৪ ঘন মিটার / সেকেন্ড। অর্থাৎ, তা কূল ছাপানোর মাত্রার তুলনায় অনেক কম।
শুধু কূল ছাপানো বন্যার সম্ভাবনা অনেক কমেছে, অর্থাৎ বন্যার প্রকোপ কমেছে, তাই নয়। একইসাথে মারাত্মক বন্যা (রন্ডিয়ার সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ১০,০০০ ঘন মিটার প্রতি সেকেন্ড যার মাত্রা) আসার পৌনঃপুনিকতা ডিভিসি জলাধারগুলি নির্মাণের আগে ছিল প্রতি চার বছরে একবার। জলাধারগুলি নির্মাণের পর তা দাঁড়িয়েছে ৬৬ বছরে একবার। ১৯৭৮ সালের বন্যাকে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যা বলা হয়। ডিভিসি-র জলাধারগুলি না থাকলে দুর্গাপুর ব্যারেজের নিচে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহের পরিমাণ দাঁড়াত ২২,৯৩৯ ঘন মিটার / সেকেন্ড, যা মাইথন ও পাঞ্চেতের জলাধারগুলোর জন্য কমে দাঁড়ায় ৪,৬১৬ ঘন মিটার / সেকেন্ড (২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮)। উল্লেখ্য, এখনও অবদি দুর্গাপুর ব্যারেজের কাছে ঐতিহাসিক সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ১৮,৪০৬ ঘন মিটার / সেকেন্ড, অর্থাৎ যদি জলাধারগুলি না থাকত, তাহলে ১৯৭৮ সালের বন্যার চেহারা দাঁড়াত দামোদরের এতাবৎ কালের জানা ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম। অর্থাৎ, বন্যার তীব্রতাও কমেছে।
১৯৫৮ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত বন্যার বছরগুলিতে, মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার মিলিতভাবে, ঘোরতর বর্ষার মাসগুলোতে (জুন-অক্টোবর), সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ হ্রাস করেছে (এবং তার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করেছে) ৩২ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। যেমন ১৯৭৮ সালের এই নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ ছিল ৭৯ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে ৫৯ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে ৬৭ শতাংশ। ২০০০ সালে ৪৭ শতাংশ। ২০০৬ সালে ৫২ শতাংশ। ২০০৭ সালে ৩২ শতাংশ।
বন্যা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ কমিয়ে দেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মেনে নেওয়া হয়। সেদিক দিয়ে শুধু বিচার করলে বলা যায়, ডিভিসির জলাধারগুলি নির্মাণের পর নিম্ন দামোদরে বন্যার প্রকোপ এবং মাত্রা, দুই-ই কমেছে অনেকটাই।
কিন্তু নিম্ন দামোদরে বন্যা কি আটকে দিতে পেরেছে? না। প্রকোপ এবং তীব্রতা কমলেও বন্যা এসেছে ১৯৫৯, ১৯৭৮, ১৯৯৫, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০৬ এবং ২০০৭ এ। কুমকুম ভট্টাচার্য বলছেন, হঠাৎ করে আসা ভয়ঙ্কর বন্যায় ডিভিসি জলাধারগুলি খুব একটা কিছু করে উঠতে পারে না। এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ডিভিসির মূল পরিকল্পনায় যে উচ্চ দামোদরের উপত্যকায় ৫০৮ মিমি পর্যন্ত বৃষ্টি হলে, অর্থাৎ, সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ২৮,৩২১ ঘন মিটার / সেকেন্ড পর্যন্ত উঠে গেলেও তা কমিয়ে নিম্ন দামোদরে কূল ছাপানো মাত্রার নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছিল, তাতে মোট আটটি জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যাদের সম্মিলিত জলধারন ক্ষমতা থাকবে ৩৫৯৫.৬ মিলিয়ন ঘন মিটার। বদলে ডিভিসি তৈরি করেছে দামোদর ও তার উপনদীগুলির ওপর চারটি জলাধার, তিলাইয়া, মাইথন, পাঞ্চেত ও কোনার, যাদের সম্মিলিত জলধারন ক্ষমতা ১২৯২ মিলিয়ন ঘন মিটার। তেনুঘাটে একটি সেচবাঁধ আছে, আছে দামোদর ব্যারেজ। পাঞ্চেতের কাছে আরো দুটি জলাধার নির্মাণের পরিকল্পনা আছে ডিভিসি-র।
উচ্চ দামোদরের উপত্যকায় হঠাৎ করে অনেক বৃষ্টি হলে ডিভিসি জলাধারগুলি কেন বন্যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তা কুমকুম একটি কাল্পনিক উদাহরনের মাধ্যমে দিয়েছিলেন, তার ২০০২ সালে প্রকাশিত বাংলা প্রবন্ধটিতে —
“ডিভিসি-র চারটি জলাধারে উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল থেকে যে জল এসে জমা হয় তাদের আবহাক্ষেত্র হল ১৭,১৪৬ বর্গকিলোমিটার। যদি কখনও এই অঞ্চলে তিন দিন গড়ে ৪০-৬৪ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এবং কিছু জল বাষ্পীভবনের ফলে শোষিত হলেও তিনদিনের মধ্যে প্রায় ২৪.৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টির জল নদীপথে জলাধারগুলিতে আসবে বলে অনুমান করা হয়। ৭২ ঘন্টায় ওই প্রবাহিত জলের পরিমাণ হবে প্রায় ৪.৩ লক্ষ হেকটর মিটার (৩৫ লক্ষ একর ফুট)। ঘন্টা প্রতি যদি গড়ে ০.০৬ হেকটর মিটার (০.৫ লক্ষ একর ফুট) জল নেমে আসে তা হলে দামোদরের গড় প্রবাহমাত্রা হবে ১৬,৯৯২ কিউমেক [ঘন মিটার /সেকেন্ড] (৬০০,০০০ কিউসেক)। জলাধারগুলি থেকে তখন ৮,৪৯৬ কিউমেক [ঘন মিটার /সেকেন্ড] (৩০০,০০০ কিউসেক) হারে জল ছাড়া হলেও জলাধারগুলি ও দুর্গাপুরের মধ্যবর্তী অঞ্চলের বাড়তি জলের জন্য দুর্গাপুর বাঁধের [ব্যারেজের] কাছে দামোদর নদের প্রবাহমাত্রা হবে প্রায় ১১,৩২৮ কিউমেক [ঘন মিটার /সেকেন্ড] (৪০০,০০০ কিউসেক)। জলাধারগুলিতে ৮,৪৯৬ কিউমেক [ঘন মিটার /সেকেন্ড] হারে জল থাকায় ঘন্টা প্রতি জলাধারগুলির ০.০৩ হেকটর মিটার (০.২৫ লক্ষ একর ফুট) ভরে যাবে। জলাধারগুলির জলধারণ ক্ষমতার মধ্যে যে অঞ্চল বন্যা নিয়ন্ত্রণে খালি রাখা হয় তা মাত্র ৪২ ঘন্টায় ভরে যাবে এবং পরবর্তী ৩০ ঘন্টা বন্যা নিয়ন্ত্রণে জলাধারগুলির কোন ক্ষমতা থাকবে না (বেরা, ১৯৮২)।”
তবে একথা নিঃসন্দেহ, ডিভিসি জলাধারগুলির ফলে উপরিউক্ত বন্যাটির ভয়ঙ্করতা কমবে বিস্তর। ৭২ ঘন্টার বন্যার বদলে ৩০ ঘন্টার বন্যা।
নিম্ন দামোদরে বন্যার জন্য শুধু সর্বোচ্চ জলপ্রবাহমাত্রা দায়ী নয়, হঠাৎ টানা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ (উচ্চ ও নিম্ন দামোদরে), দামোদরের নিম্নাংশের জলধারণ ক্ষমতা, দামোদরের বাড়তি জল নিষ্কাশনের বন্দোবস্তের হাল, জলাধারের ধারণক্ষমতার হ্রাসবৃদ্ধি, জলাধারের জল ছাড়ার ম্যানেজমেন্ট ও অভিলক্ষ্য ইত্যাদিও দায়ী। এগুলোর কোনো কোনোটার ওপর ডিভিসি-র জলাধারেরও প্রভাব আছে।
৩০ জুলাই ২০১৭, ঘাটালের কাছে ডুবে যাওয়া বাড়ি। ছবি নিলকমল বেরার সৌজন্যে।
খ) নিম্ন দামোদরের বহনক্ষমতা কি ডিভিসি জলাধারের কারণে কমছে?
ডিভিসি বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনার সময় নিম্ন দামোদরের বহনক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে রন্ডিয়াতে কূল ছাপানো মাত্রা ৭,০৮০ ঘন মিটার / সেকেন্ড সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ধরা হয়েছিল। কিন্তু ডিভিসি জলাধারগুলো তৈরি হবার পর নিম্ন দামোদরের বহনক্ষমতা কী দাঁড়িয়েছে। বাস্তবতঃ দেখা যাচ্ছে, ২,৬০৪ – ৩,৬৩০ ঘন মিটার / সেকেন্ড মাত্রার সর্বোচ্চ জলপ্রবাহতেই নিম্ন দামোদরের নিম্নাংশে বন্যা হয়ে যাচ্ছে। যদিও নিম্ন দামোদরের ঊর্দ্ধাংশে বন্যা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল ডিভিসি জলাধারগুলি, মত প্রকাশ করেছেন কুমকুম।
যদিও জলাধারগুলি নির্মাণের ফলে উচ্চ দামোদর থেকে আসা পলির পরিমাণ অনেক কমে গেছে, কারণ সেগুলো ডিভিসি জলাধারগুলোতে আটকে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, দামোদর ব্রিজের কাছে জলাধার নির্মাণ পূর্ববর্তী পর্যায়ে পলি থাকত ০.২-০.৬ গ্রাম / লিটার এর মতো এবং গড় জলপ্রবাহ বাড়ার সাথে সাথে সেগুলো বেড়ে যেত। আমরা জানি, এই পলি তৈরি হয় উচ্চ দামোদরের নদীবক্ষ ও আশপাশ ক্ষয়ে গিয়ে। বিশেষতঃ প্রথম বর্ষায়, যখন সদ্য ফুটিফাটা রোদে মাটি ঝুরঝুরে হয়ে থাকে। যাই হোক, জলাধারগুলি নির্মাণের পর দামোদর ব্রিজের কাছে পলির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ০.১-০.৩ গ্রাম / লিটারের মতো, অর্থাৎ কমে গেছে। কেন? পলি আটকে গেছে জলাধারগুলোতে। যা জলাধারগুলির জল ধারন ক্ষমতা কমিয়েছে। এ বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।
কিন্তু নিম্ন দামোদরে ঝাড়খন্ড থেকে আসা পলির পরিমাণ ডিভিসি জলাধার গঠনের কারণে কমে গেলেও নদীর নাব্যতা দ্রুত কমে যাচ্ছে কেন? কুমকুম ভট্টাচার্য বলেছেন, ডিভিসি জলাধার নির্মাণের পর জলাধারের নিচের জায়গাগুলো থেকে প্রচুর পলি আহরন করে দামোদর। রাণিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে জলাধার নির্মাণের পরের বছরগুলিতে। ফলে কয়লা-ধোয়ার জায়গা ইত্যাদি থেকে পলি আসে, আবার দুর্গাপুর আসানসোল শিল্পাঞ্চলের জলের একমাত্র সোর্স এই দামোদর (ডিভিসির ক্যানেল), তাছাড়া দামোদর থেকে চাষে জল সরবরাহ তো হয়ই। তাই শুধু পলি আহরন নয়, জলের পরিমাণও কমতে থাকে। আসানসোলের নুলিয়া নালা ও দুর্গাপুরের তামলা নালা দিয়ে শিল্পের বর্জ্য ঢোকে দামোদরে। বার্ণপুরের ইসকো, রাণিগঞ্জের পেপার মিল, ওয়ারিয়াতে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে -র বর্জ্য নালাবাহিত হয়ে আসে দামোদরে। এছাড়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে বর্জ্য-জল আসে, যা দামোদরে পড়া মোট দৈনিক বর্জ্য জলের প্রায় আশি শতাংশ। এছাড়াও দামোদরে পড়ে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফ্লাই অ্যাশ। সব মিলিয়ে যে পরিমাণ পলি জলাধারগুলো আটকায়, তার চেয়ে বেশি পলি জলাধারের নিচের শিল্পাঞ্চলগুলো থেকে জমা হয় দামোদরে। দামোদরের জলাধারগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল, দামোদরের বামদিকের শিল্পাঞ্চলকে বাঁচানোর জন্য। ফলে শিল্পাঞ্চলগুলি থেকে পড়া বর্জ্যের দায় পরোক্ষভাবে হলেও ডিভিসি-র। কিন্তু জলাধারগুলোর কারণে, দামোদরে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ অনেক কমে গেছে। যেমন, আগে ২ বছর পৌনঃপুনিকতার সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ছিল ৭,৮০০ ঘন মিটার / সেকেন্ড। এখন সেই ২ বছর পৌনঃপুনিকতায় সর্বোচ্চ জলপ্রবাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩,২৫৫ ঘন মিটার / সেকেন্ড। মোট সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ কমেছে ৫৩-৫৮ শতাংশ। যার কথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু, সর্বোচ্চ জলপ্রবাহের মাত্রা আগের অর্দ্ধেকেরও বেশি হয়ে যাওয়ায় দামোদর নদী আর তার জলাধারের নিচের আহরিত পলি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। নিম্ন দামোদরের নাব্যতা কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড়ো কারণ নিম্ন দামোদরের সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ কমে যাওয়া, যার জন্য দায়ী জলাধারগুলি। যদিও অন্যান্য কারণও আছে, সেগুলো পরে আলোচনা করা হবে।
অর্থাৎ, দেখা গেল, ডিভিসি জলাধারগুলো গঠিত হবার পর নিম্ন দামোদরে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ কমেছে, এবং তা বন্যার তীব্রতা ও প্রকোপ, দুটোই কমিয়েছে। কিন্তু, সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে জলাধারের পর থেকে সংগৃহিত পলি আর ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না নিম্ন দামোদর, যা নদীর নাব্যতা কমিয়ে দিয়ে নিম্ন দামোদরের কূল ছাপানো জলপ্রবাহের পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ফলে কম সর্বোচ্চ জলপ্রবাহতেও কূল ছাপানো বন্যা বেড়ে যাচ্ছে।
বলা যায়, ডিভিসি জলাধারগুলো নিম্ন দামোদরে বন্যার প্রকৃতিকে পাল্টে দিয়েছে। হয়ত তার ধ্বংসাত্মক দিকটিকে কমিয়েছে কিছুটা।
"বসুন্ধরায় আজাদি" ওয়েব পোর্টাল (azadi.live) থেকে অনুমতিক্রমে গৃহীত।