[ফের এবছর ভয়াবহ বন্যার কবলে নিম্ন দামোদর এলাকা। ১৯৭৮ এবং ২০০১ সালের বন্যাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এর তীব্রতা। তীব্র প্রশ্নের মুখে পড়েছে ডিভিসি-র বাঁধগুলির কার্যকারীতা এবং পরিচালনা। একটি বড়ো দৈনিকে হেডিং হয়েছে, ঝাড়খণ্ডের জলে ডুবল বাংলা। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দুটো প্রশ্ন তুলেছেন, এক) ডিভিসির জলাধারগুলোতে ড্রেজিং করছে না কেন কেন্দ্র সরকার? দুই) জল ছাড়ছে ডিভিসি। এই অবস্থায়, বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ‘ডিভিসি-র ছাড়া জলে বন্যা হলো’ – এটা লব্জে পরিণত হয়ে গেছে যেমন, তেমনি সম্ভবতঃ সামনের দিনে আরেকটি লব্জ তৈরি হতে চলেছে, ‘ঝাড়খণ্ডের জলে বন্যা বাংলায়’। মুশকিল হলো, এই কথাটা বলা আর ‘সূর্যের তাপে খরা বাংলায়’ বলার মধ্যে কোনো তফাত নেই। এই ধরনের কথা, সমস্যাটি ঠিক কী, তা গুলিয়ে দেয়। সমস্যাটির সমাধান করার উদ্যোগ নিতে বাধা দেয়। এবং একইসাথে ভেতরে ভেতরে, এটা কোনো সমস্যা না, এই বোধও তৈরি করে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল নিষ্ক্রিয়তা।
আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি, সমস্যাটি ঠিক কী, তা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তুলে ধরার। এবং তা এখনও পর্যন্ত দামোদরের বন্যা নিয়ে যা যা গবেষণা হয়েছে, সেগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে। তার মধ্যেই থাকবে, কী করা যায়, কতটা করা যায়, সেসবও। আমরা অবশ্যই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ানোর পক্ষপাতী। সমস্যাটিকে বর্তমানের নিরিখে বোঝার পক্ষপাতী। এবং আমরা প্রশ্ন তীক্ষ্ণতর এবং সূক্ষতর করার পক্ষপাতী, যাতে ফারাকটিকে চেনা যায়। মোটা দাগের কোনো মতামতের তুলনায় সূক্ষতর প্রশ্নের মধ্যেই সমস্যাটি এবং তার মোকাবিলার ভবিষ্যৎ নিহিত বলে আমরা মনে করি। তাই পাঠকরাও যদি পারেন, সাহায্য করুন, সূক্ষতর প্রশ্ন করে। বা তার উত্তর দিয়ে।
একইসাথে আমরা মনে করি, যারা বছর বছর নিম্ন দামোদরের বন্যায় আক্রান্ত হন, তাদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ ছাড়া সমস্যাটির সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব না। আর সেই হস্তক্ষেপের পূর্বশর্ত, সমস্যাটি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা গড়ে তোলা। সমস্যাটির সম্যক ধারণা তৈরি করতে গেলে তাতে আক্রান্তদের অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণালদ্ধ জ্ঞানের ওপর দাঁড়ানো ব্যতিরেকে কোনোভাবেই সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক ধারনা করা যাবে না। সমাধান তো দূর অস্ত। — বসুন্ধরায় আজাদি]
ভগবানচক-এর জলমগ্ন একটি বহুতল বাড়ির ছবি ৩০ জুলাই, ২০১৭ রবিবার তোলা। পাঠিয়েছেন নীলকমল বেরা।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ব্রিটিশ আমলে নিম্ন দামোদরের বন্যা এবং বন্যানিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা এই অংশের মূল বিবেচ্য। তিনটি প্রশ্নের মাধ্যমে তা বিবৃত হয়েছে। যে গবেষণার সাহায্য নেওয়া হয়েছে, তা প্রখ্যাত দামোদর-গবেষক কুমকুম ভট্টাচার্যের। তাঁর লেখা ২০০২ সালে "প্রতীতি" পত্রিকায় (চুঁচুড়া, হুগলি) বাংলায় প্রকাশিত প্রবন্ধ, “দামোদর : বাঁধ নির্মাণের সেকাল ও একাল” থেকে। প্রসঙ্গতঃ তাঁর লেখা একটি গবেষণা-পুস্তক আছে ইংরেজিতে, ২০১১ সালে প্রকাশিত, “The Lower Damodar River, India : Understanding the Human Role in Changing Fluvial Environment” নামে। তিনি আমেরিকার মিশিগান ইউনিভার্সিটির ‘স্কুল অব ন্যাচারাল রিসোর্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট’ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত।
ক/ দামোদরের বড়ো বড়ো ড্যামগুলো দেওয়ার আগে কি নিম্ন দামোদর অববাহিকায় বন্যা হত? বন্যার প্রকোপ এবং তীব্রতা কি একই ছিল, না বাড়ছিল?
দামোদরের বড়ো ড্যাম চারটি : তিলাইয়া, কোনার, মাইথন, পাঞ্চেত। এছাড়া আছে তেনুঘাট জলাধার এবং দুর্গাপুর ব্যারেজ। প্রখ্যাত দামোদর-গবেষক কুমকুম ভট্টাচার্য ২০০২ সালে হুগলির চুঁচুড়া থেকে প্রকাশিত ‘প্রতীতি’ পত্রিকায় লিখছেন,
“দামোদরের বিধ্বংসী বন্যার জন্য এই নদের পরিচিতি ছিল ‘দুঃখের নদী’ বলে। হান্টার সাহেব তার ১৮৭৬-এর রিপোর্টে বলেছেন যে দামোদরের হঠাৎ বন্যা বড় মারাত্মক ছিল। এই ধরনের বন্যাকে “হড়কা বান” বলা হত। দামোদরের জল বন্যার সময় স্তুপাকারে প্রায় ১.৫ মিটার উঁচু হয়ে বিনষ্ট করত বহু গ্রাম নগর ও কৃষিখেত (হান্টার, ১৮৭৬) । হান্টার সাহেবের বহুপূর্বে এক তরুণ ধর্মোপাসক ১৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে ‘দামোদরের বন্যা’ শীর্ষক একটি কবিতায় সেই সন হাজার বাহাত্তর (১০৭২)-এর প্রথম আশ্বিনের অর্থাৎ ইংরাজি ১৬৬৫ সালের বন্যার উল্লেখ করেন (মিত্র, ১৯৪৮)। যদিও রেকর্ড অনুযায়ী দামোদরে প্রথম বন্যা হয়েছে ১৭৩০ সালে (ভুরভুইন, ১৯৪৭)। ১৭৩০ থেকে প্রায় প্রতি আট দশ বছর অন্তর অন্তর বিভিন্ন জলপ্রবাহের বন্যা এসেছে দামোদরে। [অন্ততঃ] প্রায় ৮,৪৯৬ কিউমেকের সর্বোচ্চ প্রবাহ এসেছিল ১৮২৩, ১৮৪০, ১৮৫৫, ১৮৬০, ১৮৬৪, ১৮৬৫, ১৮৬৬, ১৮৭৭, ১৯১৩, ১৯১৬, ১৯১৭, ১৯৩৪, ১৯৩৫, ১৯৪০, ১৯৪১, ১৯৪২, ১৯৪৬, ১৯৫০, ১৯৫১, ১৯৫৬, ১৯৫৮, ১৯৫৯ ও ১৯৭৮ সালে। ১৮২৩, ১৮৪০, ১৯৫৮, ১৯৫৯, ও ১৯৭৮ এ প্রবাহ এসেছিল ১৬,৯৯২ কিউমেক। ১৯১৩, ১৯৩৫ ও ১৯৪১-এ সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ এসেছিল প্রায় ১৮,৬৭৮ কিউমেক। (ভট্টাচার্য, ১৯৯৮)। বর্তমান শতাব্দীতে ১৯৭৮-এর বন্যা সর্বকালীন রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। …
… ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যায়, এই নদে ১৭৩০ থেকে ১৮১৬ সাল অবধি স্বাভাবিক বন্যার ব্যবধান ছিল ১৩ বছর। পরবর্তীকালে বন্যা আসে ৭ এবং ১১ বছরের ব্যবধানে অর্থাৎ ১৮২৩ ও ১৮৩৪ সালে। তারপরের বন্যাটি আসে ছয় বছর পর ১৮৪০ সালে। তারপরে ব্যবধান ক্রমশ কমতে থাকে। দামোদরে বন্যা হয় ১৮৪১, ১৮৪৪ ও ১৮৪৫ সালগুলিতে অর্থাৎ ১১৫ বছরের মধ্যে ১৩টি বন্যা হয় প্রথম ৮৫ বছরে ও ৬টি হয় পরের ৩০ বছরে। সুতরাং, দামোদর নদের বন্যা-প্রবণতা ক্রমশই বাড়তে থাকে। (সেজ প্রমুখ, ১৮৪৬)।"
বর্ধমানের জামালপুরে দামোদরের বাঁধ। ২৬ জুলাই। সুরমান আলি মল্লিকের ফেসবুক পৃষ্ঠায় পাওয়া।
খ/ ব্রিটিশ আমলের শুরুতে জমিদারি শাসন কালে দামোদরের বন্যা ও বন্যা প্রবণতা বাড়ার কারণ কী?
ইংরেজ শাসন, জমিদারি ব্যবস্থা (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত), এবং চাষি-সাধারণের হাত থেকে জমিদারদের হাতে খাল-নদী-মাটির বাঁধের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া দামোদরের বন্যা প্রবণতার জন্য দায়ী। কুমকুম ভট্টাচার্য লিখেছেন,
“… খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত মৎস্যপুরাণে দামোদরকে মহাগৌরী বলা হয়েছে। দামোদরকে দুর্গম নদও বলা হয়েছে সেখানে (আলি, ১৯৬৬)। ভারতের অন্যান্য পৌরাণিক গ্রন্থে এই নদের বন্যার ভয়াবহতার কোনও উল্লেখই নেই। ইজিপ্ট-এর জলসেচ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার স্যার উইলিয়াম উইলককস ১৯৩০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার একটি বক্তব্যে নিম্ন দামোদরের মাটিকে পৃথিবীর উৎকৃষ্ট অঞ্চলের মাটির সঙ্গে তুলনা করেছেন। উনি এ কথাও বলেছেন যে ১৬৬০ সালে ভুপর্যটকগণ মধ্যবঙ্গকে বলেছেন মিশরের মতোই উন্নত। ১৮১৫ সালে হ্যামিল্টন সাহেব বর্ধমান, হাওড়া ও হুগলি অঞ্চলকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের উৎকৃষ্ট কৃষি অঞ্চল বলে বর্ণনা করেন (উইলককস, ১৯৩০)।
কিন্তু ১৮১৫ সালের পর দামোদর ও তার পরিত্যক্ত খাতগুলির যথাযথ ব্যবহার বা সংস্কার সাধন বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই অবহেলা শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মারাঠা আফগান যুদ্ধের সময় থেকেই [(১৭৭০-১৭৮৩)]। তখনই এই রাজ্যের শাসনভার নেয় ইংরাজ বণিক সম্প্রদায় [১৭৬৪ সালের বক্সার যুদ্ধের পর বাংলায় আনুষ্ঠানিক শাসন শুরু বৃটিশের। ১৭৯০-৯৩ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূচনা]। তৎকালীন ইংরেজ বণিক শ্রেণীর পক্ষে দামোদরের শাখা নদী বা খালের শুরুত্ব বোঝা সম্ভব ছিল না। তারা ভাবতেন এইগুলি নৌ-পরিবহণের জন্য রয়েছেন। ইংরেজদের তৈরি আইনে দামোদরের বাঁধগুলি জমিদারদের অধীনে চলে গেল যা ছিল সাধারণের নিয়ন্ত্রণাধীন [(১৭৯০-৯৩)] । ১৮৩৬ সাল থেকে বাঁধ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। এই সময় কঠিন বাঁধ ভেঙে গিয়ে গ্রাম বসতি, কৃষিজমি, মানুষ, পশু ভাসিয়ে দিতে শুরু করল। ১৮৪০ সালে বর্ধমান শহর সেই প্রথম এক বছরে তিনবার বন্যা প্লাবিত হয়। নদীর ডানদিকের বাঁধ ১১৩ জায়গায় ফাটল সৃষ্টি করে ভেঙে পড়ে। এই ঘটনাগুলি মানুষের কাছে দামোদরের প্রবল বন্যার ধ্বংসলীলা বলে পরিচিত। যদিও স্যার উইলিয়াম উইলককস বলেছেন যে এগুলি সবই কৃত্রিমভাবে তৈরি ফাটল। চাষিরা বাঁধে ফাটল করে পলি সমৃদ্ধ জল নিয়ে যেত তাদের জমির উর্বরাশক্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে (উইলককস, ১৯৩০)। এই বাঁধ কেটে জল নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আজও নিম্ন দামোদরে দেখা যায়।”
অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে দামোদরের বাঁধ, এবং খাল ও নদ নদীর ভার চাষি-সাধারণের হাত থেকে জমিদারদের হাতে চলে যাওয়ায় বন্যা-বাঁধ-জলনিষ্কাশন বন্দোবস্ত পুনর্গঠিত হয়। বাঁধ নির্মাণে চাষির স্বার্থের চেয়ে অন্যান্য স্বার্থ (যেমন জমিদারদের ব্রিটিশকে কম খাজনা দেওয়ার স্বার্থ) বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে। দামোদরের জল বেরিয়ে যাওয়ার খাল ইত্যাদির রক্ষণাবেক্ষণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং দামোদরের ওপর চাপ পড়ে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, অর্থাৎ, ব্রিটিশদের বকলমে জমিদার-রাজ ছিল ১৮৩৩ অবধি।
কুমকুম ভট্টাচার্য লিখেছেন,
“১৮৪৬ সালে তৎকালীন সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী বঙ্গের সমস্ত নদনদীকে বাঁধ মুক্ত করার কথা বলা হয়। প্রশ্ন ওঠে, নদীতে বাঁধ দেওয়ার জন্য নদীতে পলি জমে নদী বক্ষ অগভীর হচ্ছে, জলপরিবহণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে এবং লাগোয়া কৃষি জমি পলি সমৃদ্ধ জল থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে অনুর্বর হচ্ছে। তৎকালীন জমিদারেরা বাঁধকে নদীর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দুরে করার কথা ভেবেছিলেন যেহেতু বাঁধ ও নদীর মধ্যবর্তী জমি পলি সমৃদ্ধ ও উর্বর বলে বিবেচিত হত (রিকেটস, ১৮৫৩; ভট্টাচার্য, ১৯৯৮)। অপরপক্ষে, বাঁধের পিছনের জমি পলি সমৃদ্ধ ও উর্বর না হলেও জমিদারদের বেশি খাজনা দিতে হত। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠল যে [খাজনার স্বার্থ মাথায় রেখে তৈরি] বাঁধগুলি ভেঙে ফেলা হােক। ইতিমধ্যে ইংরেজ সরকার একে একে রাজপথ ও রেলপথ তৈরি শুরু করেন। হাওড়া ও হুগলি জেলায় শিল্প বাণিজ্য প্রসারে নদীর ধারে কলকারখানা গড়ে উঠতে থাকে।”
পাঠিয়েছেন নীলকমল বেরা। ৩০ জুলাই।
গ/ ১৮৫০ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে নিম্ন দামোদরের হাল কী দাঁড়ালো? কীভাবে ডিভিসি প্রকল্পের বাধ্যবাধকতা তৈরি হলো?
কৃষকের স্বার্থকে উপেক্ষা করে জমিদারদের খাজনার স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নদীপাড়ে বাঁধ নির্মাণের জমিদারি-ব্যবস্থার পর এলো বৃটিশদের বাণিজ্য ও শিল্পায়ন-উন্নয়নের স্বার্থ। বর্ধমান ইত্যাদি শহর, রাস্তা, রেলপথ, শিল্পায়ন, খনি — সবই নিম্ন দামোদরের বামদিকে। এবার এলো বাঁধ নির্মাণে দামোদরের বামদিককে গুরুত্ব দেওয়া ও ডানদিককে অবহেলা করার দিন। কুমকুম ভট্টাচার্য লিখেছেন,
“দামোদরের ডান দিকের বাঁধ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে। দামোদরের বাম দিকে অবস্থিত বর্ধমান শহর, রেলপথ, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ও শিল্প নগরীকে দামোদরের বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ডান দিকের বাঁধ ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এই সময়ে বন্যার দিনগুলিতে দামোদরে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ আসত ১৮,২৭৫ কিউবিক মিটার। সেই জলপ্রবাহ বহন করার জন্য ৩.২ কিলোমিটার চওড়া ও ছয় মিটার গভীর নদের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দামোদর কোথাও ৩.২ কিলোমিটার চওড়া ছিল না। বর্ধমানের ২৫.৬ কিলোমিটার পশ্চিম থেকে আমতা পর্যন্ত জল পরিবহণ ক্ষমতা ক্রমশ কমে গিয়েছিল। সেই সময়ে [অধুনা ঝাড়খণ্ডের] উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল থেকে যে বিপুল জলরাশি প্রবল বন্যায় দামোদরে আসত তার ৮ ভাগের ১ ভাগ দামোদর নিয়ে যেতে পারত। তার আমতা খাত দিয়ে এই সব নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে ডান দিকের বাঁধ ভেঙে দিলে বর্ধমানের ৮ কিলোমিটার পশ্চিম থেকে নিচের দিকে বন্যার জলের স্তর ২.৪৪ মিটার থেকে কমে হবে ১.২২ মিটার। ফলত ডানদিকের বাঁধগুলি রক্ষা পাবে। অবশেষে বর্ধমান শহর, রেলপথ, রাজপথ, শিল্পনগরী রক্ষা করার জন্য ডানদিকের প্রায় ৩২ কিমি পাড় বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয় ১৮৫৫ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে। সেই সঙ্গে বামদিকের বাঁধ আরও উচু ও সুদৃঢ় করা হয়।”
কিন্তু ডানদিকের বাঁধ ভেঙে বামদিকের বাঁধ উঁচু ও শক্তপোক্ত করার ফল কী দাঁড়ায়?
কুমকুম লিখেছেন,
“স্যার উইলিয়ম উইলককস এই বাঁধকে শয়তানি বাধ’ আখ্যা দিয়েছেন (সাহা, ১৯৪৪)। ড: বেন্টলি, স্যার উইলিয়ম অ্যাডামস ও স্যার উইলিয়ম উইলককস প্রমুখ বিশেষজ্ঞেরা পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গে ম্যালেরিয়ার প্রধান কারণ হিসাবে এই শয়তানি বাঁধকেই দায়ী করেছেন। তাদের মতানুযায়ী আষাঢ়ের বন্যায় দামোদর অসংখ্য মাছের ডিম ও চারা মাছ ধানের খেতে ছেড়ে দিত। তারা বাড়তি মশার লার্ভা খেয়ে। ফলস্বরূপ ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল না। কিন্তু এই শয়তানি বাঁধ জলকে প্রতিহত করার ফলে এবং মূল নদের সঙ্গে শাখানদীগুলিকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার জন্য কৃষিজমির উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে, মাছের জোগানও কমে গেছে এবং এই গোটা অঞ্চল ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ে ১৮৫০ থেকে ১৯২৫ অবধি। এই সমস্যাগুলি এখনও থেকে গেছে (বিশ্বাস ও বর্ধন, ১৯৭৫; ভট্টাচার্য, ১৯৯৮)।”
অন্যদিকে ডানদিকের অঞ্চল হয়ে যায় চিরকালের জন্য বন্যাদুর্গত। তখন ডানদিকের বন্যা সমস্যা প্রতিরোধে নানা খাল কাটা শুরু হয়, কিন্তু তাতে হয় হিতে বিপরীত। এই সময় নিম্ন দামোদরে ওই ডানদিকে একটি খাল কেটে জলনিকাশী তৈরি করতে গিয়ে দামোদরের গতিপথই পাল্টে যায়। কুমকুম ভট্টাচার্য লিখেছেন,
“… দামোদরের এই শেষ পথ পরিবর্তনের জন্য মানুষ কিছুটা দায়ী। জামালপুর থানার নুইদিপুরে ১৮৫৬ সালে দামোদর থেকে একটি ৬ মিটার চওড়া খাল কাটা হয়। এর নাম মুচি খাল। উদ্দেশ্য ছিল দামোদরের পশ্চিম পাড়ের রেললাইন, পাড়াবাঁধ সহ বিস্তীর্ণ জনপদকে দামোদরের বন্যার হাত থেকে বাঁচানো। দামোদরের কিছু জলপ্রবাহ এই পথে প্রবাহিত করলে দামোদরের বাঁধ রক্ষা পাবে এবং মূল নদেন্তে জলের চাপও কম হবে। এই মুচিখাল ভাঙতে ভাঙতে মূল নদে পরিণত হয় এবং মূল দামোদর শীর্ণ হতে শুরু করে। এই খালের নিচে একটি বাঁধ দিয়ে খালটিকে তখন বাধা হয়। এই বাঁধটি ভেঙেই বেগুয়াহানার উৎপত্তি হয় ও জলরাশি বেগুয়াহানা দিয়েই প্রবাহিত হতে শুরু করায় নিকটবর্তী অঞ্চল সমূহ বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে।”
যদিও খাল কাটার ও জলদ্বার নির্মাণের পরিকল্পনা থমকে যায়নি। দামোদরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া খাতগুলি (যেগুলি সম্ভবতঃ দামোদরের পুরনো গতিপথ) পুনরুজ্জীবিত করে সেখান দিয়ে বাড়তি জল পাঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো কিছুতেই আটকানো গেল না ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ বন্যা। বামদিকের বাঁধ ভেঙে গেল। দামোদর তার এককালে পরিত্যক্ত পথ দিয়ে কালনার কাছে ভাগীরথি গঙ্গার সাথে মিলতে চাইল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কলকাতা সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল এক সপ্তাহ। তারপরই এল ডিভিসি মেগা ড্যাম প্রকল্প। অর্থাৎ, খাল, জলদ্বার, বাঁধ ইত্যাদির মাধ্যমে জলের খাতকে দিশা দিয়ে দামোদরের বন্যা নিয়ন্ত্রণের লাইন ছেড়ে দিয়ে উচ্চ দামোদরে জলাধার নির্মাণ করে দামোদরের জল সঞ্চয় করার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের লাইন, যার কথা ইংরেজদের ইঞ্জিনিয়ার মহলে ১৮৬৪-৬৬ সালে একবার আলোচিত হয়েছিল। কুমকুম ভট্টাচার্য লিখছেন,
“১৮৮১ সালে বর্ধমানের নিকট ঝুঝুটিতে একটি জলদ্বার (sluice gate) নির্মাণ করা হয় দামোদরের জল বাঁকাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দামোদরের উদ্বৃত্ত জল ঝুঝুটি জলদ্বার দিয়ে বাঁকা নালায় প্রবেশ করে ১১ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বর্ধমানের কাছে কাঞ্চন নগরে একটি ছোট বাঁধের (anicut) মাধ্যমে ইভেন খালে যেত। দামোদরের ডানদিকের পাড়ের সমান্তরালে অবস্থিত ইডেন খাল দিয়ে সেই জল প্রায় ৩২ কিলোমিটার নিচে গিয়ে জামালপুরের কাছে কানা নদীতে এসে পড়ত। এই নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য ছিল যে বাঁধ নিমাণের ফলে দামোদরের সঙ্গে বিছিন্ন হয়ে যাওয়া খাতগুলি পুনরুজজীবিত করা। জামালপুরের নিয়ন্ত্রকটি নির্মিত হয় ১৮৭৪ সালে। কানা নদী ও সরস্বতী গোপালনগরের কাছে একটি ছোট খালের দ্বারা যুক্ত ছিল সেই সময়ে (বসু ও ভট্টাচার্য, ১৯৯২: ভট্টাচার্য, ১৯৯৮)”।
“১৯৩৩ সালে পানাগড়ের কাছে রান্ডিয়াতে একটি উইয়্যার ও খাল করা হয় জলসম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের উদ্দেশ্যে। পরবর্তী কালে ১৯৪৩ সালে দামোদরে আবার প্রবল বন্যা হয়। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট এই বন্যার পরেই দামোদরকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবেন। ১৯৪৩-এর সর্বোচ্চ প্রবাহ ছিল মাত্র ১৯৯১২ কিউমেক। কিন্তু তার ফলে বর্ধমানের আমিরপুরের কাছে বামদিকের পাড়ে ফাটল সৃষ্টি করে দামোদর তার পূর্বের পরিত্যক্ত খাত দিয়ে কালনার নিকট ভাগীরথীর দিকে ছুটে যায়। সেই সময় প্রায় ১.৮৩ থেকে ২.১৩ মিটার উচু জলস্তর সমস্ত জলপথ, রেলপথ ও টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। বেঙ্গল গভর্নমেন্ট তখন দামোদর বন্যা তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ১৯৪৪-এর ১০ মার্চ সেই কমিটি তাদের প্রস্তাব পেশ করেন এবং বর্ধমানের রাজা বাহাদুর উদয়চাঁদ মহতাব-এর নেতৃত্বে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন করার কথা ভাবা হয়। অবশেষে আমেরিকার টেনিসি ভ্যালি প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ার ডবলিউ.এল.ভুরিভুইন সাহেব-এর পরিকল্পনা মাফিক ১৯৪৮ সালের ৭ জুলাই ভারতের ব্যবস্থাপক সভা দামোদর উপত্যকা প্রকল্প রূপায়ণের জন্য ডিভিসি আইন প্রণয়ন করেন এবং টেনিসি ভ্যালি অথরিটির অনুকরণেই গড়ে তোলা হয় একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সংস্থা দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন।”
সূত্র :