অপ্রতিরোধ্য উষ্ণ জীবনের আবেগ নস্যাৎ করে দেয় হিমঠাণ্ডা সুসভ্য সমাজের কাঠামোকে যে কাঠামোয় সমসাময়িক শাসকবর্গ কর্তৃক পরিবর্তনের প্রচেষ্টা বারবার প্রহসনে পরিণত হয়। নবারুণের কবিতা তারই বলিষ্ঠ প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ নাকি উচ্চকণ্ঠ হওয়ার নিবিষ্ঠ অনুশীলনে ব্যস্ত। কবি মূলত আবিষ্কার করেছেন দেশ তথা পৃথিবীর যাবতীয় অসাম্যের আত্মধিক্কারকেই।
নবারুণের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ – ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ (১৯৮৩), ‘পুলিশ করে মানুষ শিকার’ (১৯৮৭), ‘মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা’ (২০০৬), ‘রাতের সার্কাস’ (২০০৯) এবং ‘বুলেটপ্রুফ কবিতা’ (২০১৩) আমাদের সামনে উন্মোচিত করে তাঁর তত্ত্ব-বিশ্বকে।
নবারুণ কাব্য পরিক্রমণের সূচনাপর্বে ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় লিখছেন, ‘দুনিয়াব্যাপী যে আধিপত্যের রাজনীতি আজ অপ্রতিরোধ্য অসভ্যতায় পর্যবসিত হয়েছে তার চাপে অন্য অনেক মানুষের মতো আমারও অবস্থা নাজেহাল। অথচ এই চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করা লেখক হিসেবে নিজেকে শেষ করে দেওয়া।’ কবি স্পষ্ট করেই বলেছেন কোথায় হতে চলেছে তাঁর অবস্থানক্ষেত্র। অবশ্য, সেখানে বিচার বা বহুকৌণিক বিশ্লেষণের সুযোগ আছে।
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না...
তাহলে নবারুণ দেশকে কীভাবে চান?
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম্
অগণিত হৃদয় শস্য রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছেমতো
অথচ সেই মুহূর্তে বাস্তব তার ‘ইন্টারোগেশন’ নিয়ে তাঁর সমস্ত ইচ্ছেকে ধূসরিত করছে, না মানলেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার কলঙ্ক লাগানো শহীদদের প্রতি বর্বরোচিত আক্রমণের নগ্নতায় বিপন্নতা দেখা দিচ্ছে। কবিতাকে সশস্ত্র করছেন আদিবাসীর বল্লম, চর দখলের সড়কি, বর্শা, তীক্ষ শর, বন্দুক ও কুরকি দিয়ে। আবার কয়লাখনির মিথেন অন্ধকারে হিরের মতো জুলন্ত চোখের শাসানির যে ভয় শাসককে দেখালেন তা দেশকালের সীমানার বাইরে চির প্রতিস্পর্ধী এক কবির। নবারুণ স্থির থাকবেন কী করে, তিনি যে দেখেছেন তরাই থেকে সুন্দরবনের সীমা সারা রাত্রি কান্নার পর শুষ্ক দাহ্য হয়ে আছে। (এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না)
শব্দ আমার কাছে চুয়িংগাম...
মনোপলি দৈনিকের অশিক্ষিত
সম্পাদককে খুশি করার পাসপোর্ট বা প্রসাধন নয়...
(ভিয়েতনামের ওপর কবিতা)
সেই শব্দ দিয়ে যে কবিতা-শরীর তা তো স্বতন্ত্র হবেই।
নবারুণের শ্লেষ বিপজ্জনকভাবে তীক্ষ্ণ। সার্কাসের আপাতমজার আড়ালে বীভৎসতা আছে। সমাজের হৃদয় আজ সেই সার্কাসের মঞ্চ। চলছে জটিল বীভৎস অথচ মজাদার খেলা। কেননা দেশের রাত্রিকে যখন বারুদ মনে হয়, যখন মোমবাতি না থাকলে একজন হরিজনকে জ্বালানো যায় তখনই প্রার্থনা শুনতে পান কবি – 'আমার একটা মোটরগাড়ি চাই।’ (আমার একটা মোটরগাড়ি চাই)
নবারুণ দেখেন –
ল্যাম্পপোস্টের ওপর থেকে
হতভাগ্যেরা গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলে...
অথচ
ভিড় ঠেলে সাইরেন বাজিয়ে
পুলিশ ভ্যান চলে যায়।
(খারাপ সময়)
নিজেকে কুষ্ঠরোগী বললেও আদতে তিনিই নীরোগ। তেজস্ক্রিয় চাটা জিভে শহরের জৌলুসের বিরুদ্ধে অপ্রতিহত প্রতিবাদের ঔৎসুক্য তো শহরের চোখে কুষ্ঠরোগই। তাই এই শহরে তার নিরাময় সম্ভব নয়, একমাত্র অলৌকিকতা ছাড়া। সেই অলৌকিকতা সম্ভব হলে শহরের অরণ্যে তাকে চিতার মতো দেখাবে। (কুষ্ঠরোগীর কবিতা)
কোনো এক কুঠুরিতে লণ্ঠনের নিবে আসা আঁচে যখন দেখা যায় নিজের কাপড় গলায় বেঁধে এক মেয়ে একলাই ঝুলে আছে তখন সহসা রেডিওতে বেজে ওঠা জাতীয় সঙ্গীতকে অদ্ভুত এক বিদ্রুপ বলে মনে হয়। মনে হয়, এই মেয়েটি শূন্যে দুই পা রেখে রাষ্ট্রকে তার পাওনা সম্মান জানাচ্ছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের কুৎসিত রূপ এভাবেই নবারুণের চোখে কৌতুকবহ হয়ে ওঠে। (পটভূমি - ১৩৮৮)
দেহে শীতের চরম সাবধানতা কিন্তু এর মধ্যেই নবারুণ দেখেন ক্রমপ্রকাশমান নগ্নতা। আবার তীব্র ভিড়ের মধ্যেও আবিষ্কার করেছেন মানুষে মানুষে ক্রমবর্ধমান দুরত্ব। এভাবেই তো একজন প্রকৃত কবি অস্তিত্বে বিশ্বাসের মধ্যেও অনাত্মাকে ব্যাধির মতো অবাধে প্রসারিত হতে দেখেন − যা এই শহরের তথা যে কোনো বিপণন-মানসিকতা সম্পন্ন শহরের আদত রূপ। (শীত সন্ধ্যার পার্ক স্ট্রিট)
এই বৈপরীত্যে, এই ভয়ানক তামাশায় ত্রস্ত কবি, যিনি কিনা কবিতাকে হাতিয়ার করতে চান তিনিই আবার গভীর উচ্চারণে বলেন −
আমি জানি
খুব ভালো লিখলেও
একটাও ফাঁসি
থামানো যাবে না
আমি জানি...
তাই তীব্র চিৎকার ‘একদিন পেট্রল দিয়ে সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব...’। সে পেট্রলে আগুন উসকাবে না, সব অপরাধের আগুন নিভে যাবে, সেই পেট্রল নবারুণের প্রতিবাদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। (পেট্রল আর আগুনের কবিতা)
আমৃত্যু শুধু প্রতিবাদ লিখলেও হয় না। উন্মত্ত, হিংস্র, ক্রুদ্ধ এই সমাজে প্রতিবাদটাও যেন অনেক সময় হাস্যকর মনে হয় নবারুণের। (সমাজবিরোধিতার কথা) কোনো সংগঠনই কি পারে একটি মানুষের সমস্ত দায়বদ্ধতাকে নিজেদের করে, ভাগাভাগি করে নিতে?
একজন শ্রমিক
হায় কী দুর্বল তার ইউনিয়ন
রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে
আত্মহত্যা করলে কি বাঁচা যাবে?
(দুটি প্রাথমিক প্রশ্ন)
বোঝা যায় আদ্যন্ত বামপন্থায় বিশ্বাসী হয়েও তাঁর দৃষ্টি ছিল কতটা নির্মোহ।
প্রচারের আলোর আড়ালে যে কোনো কীর্তিই অখ্যাত কেননা তা অনালোকিত। একজন অনামি কবির মৃত্যুর পর দুমিনিটের নীরবতাই তার প্রাপ্য। যে কবি ‘বুলেটে বুক ফুটো’ মানুষের জন্য কলম ধরেন, তাঁর শোকসভায় নবারুণ দেখেছেন ‘ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেনি কিছু গাছ...’। এই গাছ আলোকিত, প্রতিষ্ঠিত, মাধ্যম-প্রযোজিত বিশিষ্ট কবিকুল − যাদের বার্তাই ঝড়। (সুভাষকাকা)। কী কৌতুক অথচ বাস্তব। আসলে ‘দরিদ্র দর্শনের থালা চেটে’ খাওয়া কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি নবারুণের স্বাভাবিক উপেক্ষা। (ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির একশো বছর)
তার আস্থাভূমি মায়াকোভস্কি, ব্লক, বুলগাকভ, আখমাতোভার পাশাপাশি আলি সরদার জাফর এবং অরুণ মিত্র। এই অন্বয়ে স্ববিরোধ নেই। এঁদের প্রসঙ্গ এবং প্রাসঙ্গিকতা উত্থাপনের কারণ এঁরা এঁরাই, সেভাবে ‘মেঘেরা হল মেঘ।’ (মেঘ)
আবার প্রতিটি ভিন্ন পথগামী বিশিষ্ট মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেন তারা মৃত ঘাস, মৃত প্রজাপতি, মৃত পোষা বিড়ালের মতো অকিঞ্চিৎকর − কেউ তাদের মনে রাখে না। এমনকী যারা বিপ্লব চেয়েছে তাদেরও। অতএব সর্বশেষ সমীকরণ, সকলেই অনুপস্থিতির জন্য লড়ছে। এভাবে উপস্থিতিটা চাইলেও প্রকৃতপক্ষে অনুপস্থিতিই যে শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায় তা বলে নবারুণ সতর্ক করে দিলেন। সীমা-অতিক্রমী চাহিদার প্রতি বরাবরই তার বীতরাগ। (অমরতা)
ব্লেডের পাখি, যুদ্ধ-বিমান তছনছ করে দিচ্ছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সভ্যতাকে। নবারুণের হৃদয়-আকাশে যুদ্ধের এই প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও তার ফলাফল ছায়া ফেলে যায়। (ব্লেডের পাখি)
ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি নগরের অন্যতম যানগুলির বঞ্চনা মূলত প্রয়োজন সত্ত্বেও প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার না করার মতো কৃতঘ্ন মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের প্রতি জেহাদ। (ট্রাম। ট্যাক্সি আর ট্যাক্সি ড্রাইভার। বাস)
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যে চকোলেট ভক্ষণের মতো সহজ কথা নয় তা তারা বুঝবে না যারা দেখে পূর্বপুরুষের শবচেতনা নিয়ে আকাশে উড়ছে আকাশ-প্রদীপ বা আন্দ্রেই তারকোভস্কির আত্মা চলছে আত্মানুসন্ধানে। নবারুণের চোখে যে কোনো রাষ্ট্রসঙ্ঘের পতন অন্য যে কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের ধ্বংসের অভিমুখ রচনায় সাহায্য করে। (মানুষ, হে অবিকল মানুষ)
বুদ্ধিজীবী যারা মূলত সমকালীন শাসকশ্রেণীর হাতে লালিত, পালিত ও পরিবর্ধিত তাদের প্রতি তামাশামিশ্রিত বিদ্রুপ সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের বিপন্নতাকে স্পষ্ট করে। তাঁর চোখে −
একটা টিকটিকি কবিতা পড়ছে
শুনছে মুগ্ধ মাকড়সা
এবং বেশিরভাগ স্থির ও অচল দৃশ্যে
মন্ত্রীদের দেখা যায়—ব্যস্ত মাছি।
(সেলিব্রেটি)
নবারুণ এটা বলতে পারেন কেননা তিনি বুঝে ফেলেছেন—
পাঁচশো বা হাজার টাকার জাল নোটের মতো
নাম করা করা জাল কবিতাও রয়েছে
যতদূর জানা গেছে এ ব্যাপারে কোনো বিদেশি হাত নেই
(কবিতাবিষয়ক বক্তব্য)
বাঘের মুখোশ এঁটে ঢোলডগর বাজিয়ে যে থিয়েটার চলে রঙ্গমঞ্চে তাতে নবারুণ মনে করেন লোডশেডিং অবধারিত। বাতি জ্বালাবার সুযোগ থাকলেও জ্বালানো হবে না। তাহলে থিয়েটারের গরিবিয়ানা দেখানো হবে না। আর এইসব থিয়েটারে মাথা ঘামাতে হয় না, কেবলই গা ঘামে। (বেপর্দা করে দাও)
প্রতিবাদী চেতনার আড়ালে লুকিয়ে আছে দপদপে প্রেমিক-হৃদয় যিনি শহরের আলো নিবে যাওয়ার পর অর্থাৎ কৃত্রিমতার নির্বাপণে প্রেমের প্রদীপন সম্ভব বলে মনে করেন।
নিভে গেল শহরের আলো
জ্বলে ওঠে ফুলতারা হার
দিন গেছে গাঢ় অবসাদে
ছুঁড়ে ফেল বিরহ তোমার
(নিভে গেলে...)
সেই বিরহ ছুঁড়ে ফেললেই মনের ছায়ায় দেহের আকাশে মিলন সম্ভব। তাই চাহিদা জোরদার −
চাঁদ বা সূর্য থাক বা না থাক
একবার দেখা হতেই হবে
(একবার দেখা ...)
নবারুণ আদ্যন্ত প্রেমিক-কবি। সেই প্রেম বিশেষকে ছাড়িয়ে অনিঃশেষে যাত্রা করছে। মানুষকে ভালোবেসেই না এত যন্ত্রণা, এত প্রতিবাদ। তাঁর সমস্ত সৃজনকর্মের চালিকাশক্তি এই ভালোবাসা।
এত চুম্বন কাকে দিয়ে যাব?
প্রস্তরীভূত ওষ্ঠে?
রাধাময়ী মাঠ থাক পড়ে একা
কালো ছেলে গেছে গোষ্ঠে।
(রাধাময়ী মাঠ)
(অনিন্দ্য রায়, কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী ও পার্থসারথী চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘দিশা সাহিত্য’ পত্রিকার অক্টোবর ২০১৪ সংখ্যায় পূর্ব-প্রকাশিত)
পাঠসহায়ক হিসেবে আলোচনায় ব্যবহৃত কবিতাগুলির শিরোনাম উল্লেখ করে দেওয়া হল।