আবার আমার লেখা আসছে না কলমে।
আবার আমার কুয়াশা জমেছে মননে।
তাই বাধ্য হয়েই, সব্য থেকে নিরীহাসুরে পরিণত হয়ে গেলাম। সব্যর কাছে লেখনীর অভাব থাকতে পারে, নিরীহাসুরের সেসব বালাই নেই।
এ লেখা তাই, আমার "টুকটাক" লেখা,
লেখা ফেরানোর লেখা।
বর্ষা যখন প্রথম আমার হাসপাতালে আসে, তখন ওর বয়স ছিলো আট। ডিগডিগে রোগা ক্যাংলা হাকুচ একটা মেয়ে। মাথার চুলগুলো শনের নুড়ির মতো অপুষ্টিতে ভোগা। জরি ওঠা একটা ফ্রক। বগলে ছেঁড়াখোঁড়া ব্যাগ। পায়েতে,হাঁটুতে, গোড়ালিতে, ধুলো-ফোস্কা-খড়ি।
বর্ষার টি বি হয়েছে। তাই ওর বাবা ওকে এখানে নিয়ে এসেছে ভর্তি করাবে বলে।
বর্ষা যে এখানে আসবে,এ খবর আমার কাছে ছিলো আগে থেকেই। আমাদের এসব থাকে টাকে। এই খবর টবর আর কি!
টি.বি ডিপার্টমেন্টের নেটওয়ার্ক খুব স্ট্রং। কার কখন রোগ ধরা পড়লো, কে ওষুধ না খেয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে লাথ মেরে বের করে দিয়েছে...সমস্ত রকমের খবর আমাদের কাছে মজুদ।
তো বর্ষারটাও ছিলো। বর্ষার বাবা বন্ধ চা বাগানের টেম্পুরারি শ্রমিক। পার্মানেন্ট হলে তবুও কথা ছিলো। টেম্পুরারি। তাই বাগান বন্ধ মানেই, উপার্জনের পথটাও গায়েব। অবশ্য উপার্জনই বা এমন কি হতো ঘোড়ার ডিম! সপ্তাহ গেলে ছ সাতশো টাকা মেরেকেটে। তবু তাই দিয়েই তো চলতো। দু তিন বছরে একটা শস্তা জামা, পুজোয় পিড়িং পাড়াং চুলের ক্লিপ, থালায় চাট্টি নুন-ভাত। এবার সেটাও বন্ধ হলো।
বর্ষার বাবা অবশ্য এসব কথা আমায় বলে নি। এসব জেনেছিলাম অন্য অন্য চা-বাগান পেশেন্টদের কাছ থেকে। হিস্ট্রি নিতে গিয়ে বলেছিলাম--" মোবাইল নাম্বার নেই? হ্যাক...ফাল্তু বোকো না...তোমাদেরই তো আজকাল বেশী মোবাইল..এক এক জনের দুটো তিনটে চারটে...নাম্বারটা দেবে না সেটাই বলো!"
লোকটা শুনে কিরম ভেবড়ে গিছলো--" চাইরটা ফোন? ছার, হামদের কারেনই নাই ঘরে, তায় ফোন..দুইহাজার মাসমাইনা..কি যে বলো আপনি!"
সেই থেকে আমি এদের খবর জানি। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সংখ্যাগুরু মানুষজনদের কথা। বর্ষাকে তাই ফোন নাম্বার জিগ্যেস করি নি। ভর্তি নিয়ে নিয়েছিলাম চুপচাপ। জানতাম, ওষুধ খাওয়ার জন্য নয়, বর্ষা ভর্তি হতে এসেছে দুবেলা ভাত ডাল খেতে পাবে বলে। ভর্তি করার পর,মেয়ের মাথায় হাত টাত বুলিয়ে, বাপটা চলে গেলো। বলে গেলো---" থোড়া দেখেন.." ।
ব্যাস। সেই থেকে বর্ষা আমার কাছে রয়ে গেলো। যে সময়কার কথা বলছি, তখনও টি.বি র চিকিৎসায় এখনকার মতো বিপ্লব আসে নি। মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির বিষয়ে তখন আমরা জানতে শিখছি সদ্য। ওষুধ পত্র, যন্ত্রপাতি, ইত্যাদির উন্নতিকরণ চালু হচ্ছে দেশজুড়ে।
আমাকে সেসময় প্রায়শই দিল্লি যেতে হতো। কখনো কখনো আমেদাবাদ। সারা ভারতের হাতে গোনা জনাকয় চিকিৎসক আমরা তখন " অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান করতাম" সেখানে বসে। আর তাই দিয়ে তৈরি হতো নতুন গাইডলাইন, পরীক্ষামূলক " ড্রাগ রেজিম" । আমার সে সময়কার সহযোদ্ধাদের মধ্যে জনা তিনেক টিঁকে আছেন এখনও টিবি ডিপার্টমেন্টে।
ড: Saha, ড: Mukherjee, ড: Toufique।
এ কাহিনী, আমার মতো, তাঁদেরও জয়ের কাহিনী।
বর্ষা প্রথম প্রথম কান্নাকাটি করতো খুব। পালাবার চেষ্টা করতো গেট টপকে। একবার তো পালিয়েওছিলো। বাসসট্যান্ডের কাছ থেকে কিছু সহৃদয় মানুষ ধরে নিয়ে এসে জমা করে গিছলেন। তারপর আস্তে আস্তে বর্ষা " সেট" হয়ে গেলো। এখানে টিভি আছে, ক্যারামবোর্ড আছে, লুডো আছে। আর সবচাইতে বড়ো কথা, খাবার আছে। পেটভরা খাবার। বর্ষা মানিয়ে নিলো।
মুশকিলটা হলো অন্য জায়গায়। বর্ষার রোগ সারছিলো না। কিছুতেই না।
প্রথমবার কারোর টিবি হলে, আমরা তাকে "ক্যাটাগোরি ওয়ান" দিতাম। ওয়ানে না সারলে, "ক্যাটাগোরি টু"। ব্যাস। এইই ছিলো আমাদের তৎকালীন অস্ত্র। ক্যাটাগোরি ওয়ানের কোর্স ছ-সাত মাসের। টু এর আট-নয় মাস।
বর্ষা একবার ক্যাটাগোরি ওয়ান খেলো, দু বার ক্যাটাগোরি টু খেলো, তাও রোগ সারে না। বর্ষার আসপাশের সমস্ত রোগীর ছুটি হয়ে গেলো। তাদের জায়গায় নতুন রোগী এলো। তাদেরও ছুটি হয়ে গেলো...বর্ষা যেই কে সেই।
রোজ রাউন্ডে গেলেই রিনরিনে গলায় শুনতে পেতাম--" এ ভাইয়া, মেরা ছুট্টি কব হোগা? এএএএএ ভাইয়াআআ..." ।
আমি আগড়ুম বাগড়ুম বলতাম--" হোগা হোগা..অগলে হপ্তা..ঘর যা কে করেগি কেয়া? এঁহা পে টিভি হ্যায়.." ।
বর্ষা কাঁদতো। আমি, সিস্টার, গ্রুপ ডি রা ওকে পালা করে জামা কাপড় এনে দিতাম। বাড়ির লোক সেই যে গেছে তো গেছেই। লোকজন দিয়ে খবর পাঠালেও আসে না। বলে পাঠায়--" বাস কা ভাড়া নেহি হ্যায়" ।
এ সবেরই মাঝে, বর্ষার থার্ড টাইম ক্যাটাগোরি টু চালু হলো। এবং নতুন গাইডলাইন অনুযায়ী, বর্ষার কফ পাঠানো হলো কলকাতায় পরীক্ষার জন্য। ওখানে ওর কফের নমুনা কালচার করে দ্যাখা হবে। কালচার মানে হলো চাষ। মাছ চাষে যেমন খাবার-দাবার দিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি পোনা থেকে এইয়া গোবদু মৎস্য তৈরি করা হয়, এখানেও তাই। কফে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়াগুলোকে খাইয়ে দাইয়ে নাইয়ে ধুইয়ে সংখ্যায় বাড়ানো হবে। তারপর সেগুলোর ওপর প্রয়োগ করা হবে একটার পর একটা ওষুধ।
যে ওষুধে ব্যাকটেরিয়াগুলো মরে যাবে, সেইটেই হলো রোগ মুক্তির প্রতিকার। অন্তত,তখনও অব্দি তাইই জানতাম।
এ পরীক্ষায় সময় লাগতো ছয় থেকে সাত মাস। অধিকাংশ রোগীই তদ্দিনে ফুটে যেতো। বর্ষা কিন্তু বেঁচে রইলো। বর্ষা কিন্তু তদ্দিনে বাংলাও শিখে গেলো। -- অঅঅঅঅ দাদাআআ..আমার কবে ছুটি হবে?"
রেজাল্ট এলো-- মাল্টি ড্রাগ রেজিসস্ট্যান্ট ( MDR) টি বি। এ রোগের চিকিৎসার মেয়াদ মিনিমাম দু'বছর। প্রথম ছয় থেকে নয় মাস রোজ রোজ রোজ ইঞ্জেকশন ( রোববার বাদে) । বর্ষা মুখ বুজে নিতে শুরু করলো। একটু আধটু কান্নাকাটি করতো বটে মাঝেসাঝে। কিন্তু দুটাকার চকলেট দিলেই চুপ করে যেতো হাসিমুখে।
এবং MDR এর ওষুধ প্রায় বছর দেড়েক চলার পরও যখন দ্যাখা গেলো, বর্ষার শারীরিক উন্নতি হচ্ছে না,তখন আরো একবার কফের নমুনা পাঠানো হলো ল্যাবরেটারিতে। এই ল্যাবরেটারিটি বেঙ্গালুড়ুতে। ন্যাশানাল লেভেল ল্যাবরেটরি। ভারতের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ। এবারে ধরা পড়লো, রোগটা আরো গভীর। এক্সেটেনসিভলি ড্রাগ রেজিসস্ট্যান্ট টি.বি। সংক্ষেপে, XDR টি.বি।
শুরু হলো নব উদ্যমে, নতুন চিকিৎসা।
সারা ভারতে যে কয়জন এক্স ডি আর রোগী, অদ্যবধি চিকিৎসা পেয়েছেন, বর্ষা তাঁদের প্রথম কয়েক জনের মধ্যে।
আর এই এক্স.ডি.আর মেডিসিন চালু হয়ার সময়েই একদিন, একটা পকেটমার টাইপের দেখতে ছেলে এসে আউটডোরে হাজির হলো। হাত টাত কচলে বললো--" হামি বর্ষার দাদা। চেন্নাই মে কাম করতে গিছলাম..কাল ভাই-দুজ আছে। বর্ষাকে ঘর লেকে যাবো দো দিনের জন্য" ।
শুনে আমি এই মারি কি সেই মারি--" ফাজলামি মারছো? এতদিন পাত্তা নেই, বোন বাঁচলো কি মরলো, আজ ভাইদুজ দ্যাখাচ্ছো?"
এরকম পেশেন্ট পার্টি আমি আগেও দেখেছি। সারা বছর খোঁজখবর নেয় না। তারপর হঠাৎ একদিন হাজির হয়ে আদর দেখিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। এবং দুদিন পরেই আবার বের করে দ্যায় লাথ মেরে। উদ্দ্যেশ্য একটাই---সই। স্বাক্ষর। তোতাই পাতাই করে, জমিজিরেতের দস্তাবেজ হাতিয়ে নেওয়া। মাঝখান থেকে এতদিন ধরে চলতে থাকা চিকিৎসার পুরো দফা গয়া।
কিন্তু এ ছেলেটা মনে হলো সরল সাদা। ওর কাছেই শুনলাম, বর্ষার বাপ মরে গেছে দিন পনেরো আগে। এ ছেলে আজ বেশ ক'বছর হলো চেন্নাইতে আছে।
বর্ষার খবর টবর কিছুই জানতো না। এখানে এসে শুনেছে। হাত জোড় করে বললো--" দো দিন কা ছুট্টি দিজিয়ে ডক্টরসাব, " ।
ভাইটিকে সাথে নিয়েই রাউন্ডে গেলাম। দেখি বর্ষা ঝাঁপাচ্ছে--" আমার ছুটি হোই গ্যাছে, দাদা এসেছে"।
বর্ষার চুল স্টাইল টাইল করে বাঁধা, নখে নেলপালিশ। বর্ষা ব্যাগ গুছিয়ে রেডি। বললো--" ওই মুন্নি চুল বাঁইন্ধে দিছে..ঘর যাই? ও দাদা? "
ছেড়ে দিলাম।
বর্ষা ঝাঁপাতে ঝাঁপাতে চলে গেলো।
এবং ফিরে এলো ঠিক দু'দিন পরেই মুখ নীচু করে। ভাই-দুজ, শেষ।
এক্সডি আর মেডিসিনের কোর্স হলো দু'থেকে তিন বছরের। বর্ষার ক্ষেত্রে আমায় তিন বছরই দিতে হয়েছিলো। রোগ বাসা বেঁধেছিলো বড্ডো বেশি গভীরে। এই তিনবছর বর্ষার দাদা নিয়ম করে প্রত্যেক ভাই-দুজে বর্ষাকে নিয়ে গেছে। আবার কথা মোতাবেক ফেরতও দিয়ে গেছে।
বর্ষার এখানে থাকা প্রায় সাত বছর হতে চললো। বর্ষা যখন এসেছিলো, তখন খড়ি ওঠা শনের নুড়ি জড়োসড়ো একটা রোগে ভোগা বাচ্চা।
সেই বর্ষাই এখন আমার ওয়ার্ডের সবথেকে স্টাইলিশ মেয়ে। রাউন্ডের সময় সবথেকে টিপটপ হয়ে বসে থাকে। ঝকঝকে হাসি, পনিটেইল চুল, নেলপালিশ পা। আমি খুনসুটি করি--" হেব্বি লাগছে তো রে ভাই.." , বর্ষা সরস্বতী পুজোর দিনের মেয়েদের মতো হাসে।
বর্ষা প্রায় পুরোপুরি সুস্থ এখন। এবং এইটাই ছিলো আমার কাছে বড়ো রকমের চিন্তার একটা বিষয়। আমি খাই দাই,আড্ডা মারি, ফুক্কুড়ি কাটি, গল্প লিখি, বালিশ ঠেঁসে ঘুমাই...এই সবকিছুর মাঝে, সব সময়, সর্বদা মাথার মধ্যে কেবলই ঘুরতে থাকে বর্ষার কথা।
মেয়েটা এবার যাবে কোথায়? দাদা যে ওকে পার্মানেন্টলি নিয়ে যাবে না, সেটা কথাবার্তা বলেই বুঝেছি। ছেলেটি এখন কাঠ বেকার। ইনকাম বলতে--"ডেলি হাজিরা"। তাতে খুব বেশি হলে মাসে হাজার খানিক। ওর নিজেরই পেট ভরে না, তায় বর্ষা।
মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিলাম, অনাথ আশ্রমে যোগাযোগ করতে হবে এবার। মাঝে একবার কোলকাতা গিছলাম। বাসুদার সাথে দ্যাখা হয়েছিলো। ওখানেও দুঃখ করছিলাম আড্ডা মারতে মারতে--" ঝকঝকে একটা মেয়ে, সাত বছর লড়লো বাঁচবো বলে.." ।
তারপর সবটা পাল্টে গেলো রূপকথার মতো।
পুজোর ঠিক মাস দুয়েক আগে, আবার বর্ষার দাদা হাজির।--" স্যার কাম মিল গ্যায়া..বর্ষা কো ঠিক হোনে পে, লেকে জায়েঙ্গে..."
এবং সত্যি সত্যিই পুজোর ঠিক পাঁচদিন আগে নিয়ে চলেও গেলো হাত ধ'রে।
বর্ষার এই সাতবছরে মেলা সম্পত্তি জমে গিছলো। খেলনা, চুলের ক্লিপ, বালতি, জামা কাপড়, জুতো। আমরাই দিয়েছিলাম সক্কলে।
সেই সব বগলে পুরে, বর্ষা একঝটকায় ধাঁ হয়ে গেলো।
এরম সাধারণত হয় না। আমার পেশেন্টরা যাওয়ার আগে গড় করে প্রণাম করে যায়। কাঁদে। থ্যাঙ্কু বলে। ছবি তোলে।
বর্ষা সেসবের ধারই ধারলো না।
আউটডোরের চেয়ারে বসে, পেশেন্টদের ভিড়ের মাঝখান দিয়ে লক্ষ্য করলাম, ওইইইই বর্ষা চলে যাচ্ছে তিড়িং বিড়িং করতে করতে।
এ বছর, বর্ষার সত্যিকারের ভাই-দুজ।
ভালো থাকিস রে মেয়ে।
আমার মুখ দর্শন যেন এ জীবনে আর কখনো করতে না হয় তোকে।
( পুঃ--বর্ষার এক্স.ডি.আর ধরতে আমাদের সময় লেগেছিলো মোট সাড়ে চার বছর। এখন "এক্স.ডি.আর" রোগ নির্ণয় করতে খুব বেশি হলে এক মাস লাগে। )