জল-জঙ্গল-জমিন-এর কাজ শুরু হয় তিন বছর আগে। ঝাড়খণ্ডের জদুগোড়া দিয়ে। ওখানে যে দীর্ঘদিনের ইউরেনিয়াম মাইন্স এর তেজস্ক্রিয়তার জন্য যে ব্যাপক হারে শারীরিক সমস্যা তৈরি হয় আবালবৃদ্ধবনিতার, তার জন্য নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্প দিয়ে। শহুরে মানুষজন বইয়ের পাতায় “রেডিওএক্টিভ পলিউট্যান্টস” পড়ে তার ক্ষতি বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে পারে না। জদুগোড়াতে খুব কমই শিশু আছে যারা বিকলাঙ্গ নয়। জল-জঙ্গল-জমিন জদুগোড়া-র জল সংগ্রহ করে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ দিয়ে আসে, বলে যে খেয়ে দেখুন। এবং তথ্য বলছে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটা জেলার জলে আর্সেনিক এর পরিমাণ ভয়াবহ। প্রত্যেকটি প্রাণীর জীবনে অক্সিজেন এবং জল এই দুই একদম ফান্ডামেন্টাল চাদিহা। যত আমরা “সভ্যতা’র” মই বেয়ে উঠছি, তত আমাদের মইটা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। তাই শুধুমাত্র ৫ জুন একটু বিশ্ব পরিবেশ দিবস বলে ফেসবুকে শেয়ার করার ট্রেন্ডটা মানুষকে বার করার প্রচেষ্টা চালানো শুরু করে, একদম ফিল্ড ওয়ার্ক না করলে, পরিবেশ এর অবস্থাটা বুঝতেই পারবে না।
যশোর রোডের যে চার হাজার শতাব্দী প্রাচীন গাছগুলি “উন্নয়ন” এর নামে কেটে ফেলার চক্রান্ত চলছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। জল-জঙ্গল-জমিন ছাড়াও অনেক সংগঠন, অনেক ব্যক্তি মানুষ,এই গণ আন্দোলনে সামিল। এবং সেখানে বিকল্প মডেল এর প্রস্তাবও দেওয়া হয়, যেই মডেলে গাছ না কেটেও উন্নয়ন সম্ভব সেটা পরিষ্কার। এছাড়াও গাছগুলির রক্ষনাবেক্ষন এর প্রয়োজনে, ঋতব্রত ঘোষ ওরফে পাভেল তৈরি করে গাছ বাড়ি। গাছের সাথে যাপন না করলে কেমনে বোঝা যাবে তাদের ভাষা? এবং এই চার হাজার গাছ। কাটা মানে শুধুই গাছ নয়। এক একটা মহীরুহ ঘিরে রয়েছে বিশাল বায়ডাইভার্সিটি। অজস্র নাম না জানা পাখি, পোকা মাকড়, লতা পাতা.. এবং ঐ অঞ্চলের রেইন-বেল্ট।
পুঁজিবাদের আগ্রাসন যত বাড়বে, তত পরিবেশ ধ্বংস হবে, এবং হচ্ছেও। যেমন ধরুন এই যে বাজারে এত ধরণের আইসক্রিম, রকমারি মিল্ক সেক, ইত্যাদি দুগ্ধ জাতীয় জিনিসের চাহিদা বেড়েছে, তার জন্য দুধের যোগান বাড়ানোর জন্য ডেয়ারিগুলো তে গরু,মোষ কে ডিকলফেনাক ( cow aspirin) দেবার হুজুগ বেড়েছে। মুস্কিলটা হল, এই গরু মোষগুলি যখন মারা যায়, এবং যখন তাদের মৃতদেহ শকুনিরা খায়, এই ডিকলফেনাক পয়জনিং এর ফলে তাদের মধ্যে অসুস্থতা বেড়েছে, এবং অকালমৃত্যুর হার ও বেড়েছে। শকুনি পরিবেশবান্ধব এক পাখি। ইকোলজি রক্ষার্থে এদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুঁজিবাদ শুধু বোঝে পুঁজি। একটা মিনিটও নষ্ট হতে দেয় না। আমাদের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে মুনাফা লাভ করতে চায়। ঠিক যেমনই এই যে পেপসি, কোকাকোলা, নেস্টলে এই বহুজাতিক বড় কর্পোরেটরা যেভাবে আমাদের দেশের সম্পদ লুট করে নিচ্ছে, তা ভয়ঙ্কর।
গত জুন মাস থেকে জল-জঙ্গল-জমিন এর পক্ষ থেকে ‘বর্ষামঙ্গল’ কর্মসূচির সূচনা করে। কেষ্টপুর খালের এক অংশ পরিষ্কার করে, তার পাশে গাছ বসানো হয়। এবং আবর্জনার বেশিরভাগটাই প্লাস্টিক। তারপর প্রত্যেক সপ্তাহে আহিড়ীটোলা ঘাট পরিষ্কার করা। রানাঘাটের চূর্ণী নদীর যা বেহাল অবস্থা , তার একটা অংশ সংস্কার করা হয়। উল্টোডাঙ্গার মুরারিপুকুর এর একটা অংশ পরিষ্কার করা হয়। বাঁকুড়াতে এক জমিতে নতুন গাছ বসানো হয়। এবং গ্রামে গ্রামে কর্মশালা করা হয়। উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা, অশোকনগর অঞ্চলে ১২টি স্কুলে একটা অঙ্গীকারপত্র নিয়ে যাওয়া হয় , যার বক্তব্য গুলি হল, সাইকেল চালানোর অভ্যাস বাড়ানো, প্লাস্টিক, থার্মোকল, রাংতা ব্যবহার না করা, পরিবর্তে চটের ব্যাগ ব্যবহার করা, ব্যাগে টিফিন বক্স রাখা, যেকোনো অনুষ্ঠানে গাছের চারা উপহার দেওয়া, এসি ব্যবহার না করার চেষ্টা করা, ডাস্টবিন ছাড়া অন্য কোথাও আবর্জনা না ফেলা, কষ্ট হলেও শৌচালয় ব্যবহার করা। এছাড়াও স্কুলে সেমিনার করা হয়। হুগলির এবং মুর্শিদাবাদের কিছু স্কুলে আগস্টে সেমিনারের ডেট ফিক্স করা হয়েছে। হুগলির কিছু স্কুলে পরিবেশ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রবন্ধ রচনা, আঁকা, কুইজ, ডিবেট প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে।
অনির্বান দাস এবং অরূপ বিশ্বাস বহু জায়গায় মাটির বোতল,জগ, কাপ,ইত্যাদি পৌঁছে দিয়ে আসে। নিজেরাও ব্যক্তিজীবনে চেষ্টা করে প্লাস্টিক না ব্যবহার করে, বিকল্প পরিবেশ বান্ধব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবহার করা, এবং আশপাশের মানুষকেউ করানো।
ভারতবর্ষ যে একটি তীব্র জল সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তা নিয়ে এখন আর কোনো সংশয় নেই। নীতি আয়োগের একবছরের পুরানো রিপোর্ট সামনে আসতেই হইচই বেঁধে গেছে সারা দেশজুড়ে। প্রধানমন্ত্রী থেকে আমলা সকলেই জল নিয়ে এই মুহুর্তে খুবই চিন্তিত। সোশাল মিডিয়া জুড়ে তীব্র জল সংকটে ভোগা চেন্নাই-এর অবস্থা আমরা দেখছি। একটি চলন্ত গাড়ি থেকে তোলা দৃশ্যও আমরা দেখেছি, যেখানে মাইলের পর মাইল জুড়ে রঙ-বেরঙের প্লাস্টিকের কলসি সার দিয়ে সাজানো জল-ভর্তির অপেক্ষায়। কখন সরকারি জলের ট্যাঙ্ক আসবে। রেস্টুরেন্ট বাথরুম বন্ধ করে দিয়েছে, অফিসে আসতে বারণ করা হয়েছে কর্মচারীদের। ২০ টাকার জলের বোতল বিকোচ্ছে ৪০০ টাকায়। জলের জন্যে হাহাকার সর্বত্র। চেন্নাই দিয়ে শুরু! ২০২০ সালের মধ্যে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই এবং হায়দ্রাবাদ সহ ভারতের ২১টি শহরের ভূগর্ভস্থ জল ফুরিয়ে যাবে। ২০২২ সালে এই তালিকায় আরও শহর যুক্ত হবে, ২০২৫ সালে সংখ্যাটি আরও আরও বাড়বে — বলছে নীতি আয়োগ। নীতি আয়োগের রিপোর্ট আরও বলছে, বর্তমানে ভারতের ৬০ কোটি মানুষ মৃদু থেকে তীব্র জল সংকটে ভুগছেন। তথ্য বলছে, ভারতে প্রতি বছর প্রায় দু’লক্ষ মানুষ শুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে মারা যান।
গত ১৪ জুলাই সুবর্নবনিক সমাজহলে জল সংকট, বৃষ্টির জল ধারণের পন্থা, ভূগর্ভস্থ জল জল সংরক্ষণ নিয়ে সেমিনার আয়োজন করা হয়। বক্তা ছিলেন সমীররঞ্জন শিকদার(বোস ইনস্টিটিউট) এবং অভ্র চক্রবর্তী(জল ও কৃষি বিশেষজ্ঞ)। ওই দিনই প্রকাশ করা হয় জল সংকটের উপর একটি ছোটো পুস্তিকা "ভারতবর্ষের তীব্র জলসংকট ও আমরা"। আগামী দিনের লড়াইটি আমাদের সবাইকে যৌথভাবে লড়তে হবে..