এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • দেশ এবং জাতীয়তাবাদ

    Arkady Gaider লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২২ জুলাই ২০১৭ | ২০০৭ বার পঠিত
  • স্পিলবার্গের 'মিউনিখ' সিনেমায় এরিক বানা'র জার্মান রেড আর্মি ফ্যাকশনের সদস্যের (যে আসলে মোসাদ এজেন্টে) চরিত্রের কাছে পিএলও'র সদস্য আলি ঘোষনা করে - 'তোমরা ইউরোপিয়ান লালরা বুঝবে না। ইটিএ, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস, আইরিশ রিপাব্লিকান আর্মি, আমরা - আমরা সবাই ভান করি যে আমরা তোমাদের আন্তর্জাতিক বিপ্লব কে সমর্থন করি, কিন্তু আমরা ওসব নিয়ে ভাবি না। We want to be nations.'
    Nation - এটা খুব মজার শব্দ।
    Nationalism মানে জাতীয়তাবাদ। Nationality মানে জাতি।
    ভারতের National / জাতীয় পশু, সংগীত, ফুল রয়েছে।
    আমাদের nationality হলো ভারতীয়।
    তাহলে 'ভারতীয়' কি একটা জাতি? এইখানেই ব্যাপারটা একটু ঘেঁটে যাচ্ছে। মানে জার্মানরা একটি জাতি। তাদের দেশ জার্মানি। ডাচরা একটি জাতি। তাদের দেশ নেদারল্যান্ডস। এমনকি ব্রিটিশরাও একটি জাতি। তাদের দেশ গ্রেট ব্রিটেন। কিন্তু ভারতীয় বলে তো কোন জাতি হয় না। বাঙালি জাতি হয়। তামিল জাতি হয়। পাঞ্জাবী জাতি হয়। তাহলে ভারত নামক nation এর বাংলা করতে গেলে যা দাড়াচ্ছে - বহুজাতিক জনসমষ্টি। আরেকটু সুন্দর ভাষায় বলতে গেলে - মহাজাতি।
    তাহলে আমরা 'ভারত' দেশ নামক রাজনৈতিক সত্তার সদস্য হলাম কি করে? আমাদের দেশের যারা বাঙালি, জাতিগত ভাবে তারা আমাদেরই দেশের তামিলদের থেকে বাংলাদেশের বাঙালিদের অনেক বেশি কাছের। আবার আমাদের দেশের যারা পাঞ্জাবী, জাতিগত ভাবে তারা একজন তেলেগুর থেকে পাকিস্তানের একজন পাঞ্জাবীর অনেক বেশি কাছের। তবুও, এই একজন বাঙালি, একজন পাঞ্জাবি, একজন তেলেগু, একজন তামিল, আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন জাতি হয়েও সবাই 'ভারতীয়'। পৃথিবীতে এরকম আরও কয়েকটিমাত্র দেশ রয়েছে - আমেরিকা, সুইৎজারল্যান্ড।
    তাহলে এমনকি কারন আছে যার জন্যে আজকে আমরা সবাই 'ভারতীয়'?
    উত্তর - সংবিধান।
    বা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, কিছু ধারনা, কিছু মত, কিছু আদর্শ, কিছু উদ্দ্যেশ্য, যার বেশিরভাগের সাথে আমরা একমত হয়েছি এবং সমষ্টিগতভাবে অংশগ্রহন করতে সম্মত হয়েছি। এই shared ideas কে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে আমাদের সংবিধানে। এই যে একটি কাগজের টুকরো - এতগুলো ভাষা, জাতিকে এক জায়গায় এনেছে, এই কাগজের টুকরোটাই শুরু আর এটাই শেষ। এই সংবিধানকে স্বীকৃতি দেওয়া - এটাই এক এবং একমাত্র ব্যাপার যা আমাদের 'ভারতীয়' করে তোলে। দেশ হিসেবে ভারতের যে ধারনা - সেটার মূর্ত রুপ হলো সংবিধান। যদি বিশাল সংখ্যায় মানুষ মনে করে তারা এই ধারনাকে পালটাতে চায় - সেটাও সাংবিধানিক উপায় সম্পন্ন করবার সম্ভাবনা রয়েছে।
    এবং যখন আমরা এই সংবিধানের মধ্যে দিয়ে নিজেদেরকে দেশ বলে স্বীকৃতি দিলাম, তখন অনেকে আড়ালে মুচকি হেসেছিলো। যেখানে প্রতি ৫০০ কিলোমিটার গেলেই জাতি, ভাষা, খাদ্যভাস পালটায়, সেই দেশ কখনও টিকতে পারে নাকি? আমরা দেখিয়েছি - পারে। জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছুকে টেক্কা দিয়ে সফল হতে পারে যে ম্যাজিক, তার নাম - আইডিয়া। আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া। একটা শক্তিশালী ধারনা, যার বলে ৭০ বছর আর ৭০ হাজার বাধা বিপত্তি পেরিয়েও আমরা টিকে রয়েছি। এই ধারনার হয়তো বাস্তবায়ন হতে অনেক দেরি, কিন্তু এই ধারনাকে উদ্দ্যেশ্য করেই আমরা প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছি। যদি কোনদিন এই ধারনাকে এমনভাবে পালটে ফেলা হয় যাতে দেশের একটা বিশাল অংশের আপাত নির্লিপ্ত মানুষ এর প্রতি বিরুপ হয়ে পড়ে, তাহলে এই 'আইডিয়া', এবং তার সাথে 'ইন্ডিয়া; ধ্বংস হয়ে যাবে।
    খুব গোদা ভাবে এই ধারনার বর্ণনা দিতে চেষ্টা করবো - গনতন্ত্র, সমাজবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রতিটি জাতি এবং ভাষার স্বাতন্ত্র্য বিকাশ এবং অর্থনৈতিক সাম্য। কেউ কেউ হয়তো এর মধ্যে কিছু বদল আনতে চান। কেউ কেউ হয়তো মনে করেন এই ধারনাকে সাধন করতে অনেক লড়াই লড়তে হবে। এই বিভিন্ন দ্বন্দ, পরস্পর বিরোধী চেতনাকেও পরিসর দিয়েই আমাদের দেশের ধারনার অস্তিত্ব।
    এবার আসি মানুষের কথায়। ধরুন আপনার বাড়ি দক্ষিন কলকাতায়। আপনার বাড়িতে রোজ সকালে যে মহিলা কাজ করতে আসেন, তাকে যদি জিজ্ঞ্যেস করেন - তোমার দেশ কোথায়? উত্তর পাবেন - ক্যানিং। বা সোনাটিকারি। বা আপনার অফিসের কর্মচারী ছুটির দরখাস্ত দিতে এসে বলবে - একটু দেশের বাড়ি যাবো। আচ্ছা, একটা গল্প শুনি চলুন। ধরুন একজন ব্যাক্তি। বাঙালি। তার নাম ধরে নিলাম 'ক'। 'ক' বাবুর জন্ম ১৯৪০ সালে, ঢাকায়। এই সময় তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা। ১৯৪৭ এ তিনি হয়ে গেলেন পাকিস্তান দেশের নাগরিক। ১৯৭১ এই আবার তিনি হয়ে গেলেন বাংলাদেশের নাগরিক। এবার সামরিক শাসনের আমলে অন্য অনেকের মতন তিনিও এলেন ভারতে, হয়ে গেলেন ভারতের নাগরিক। এর মধ্যে তার বয়েস হয়েছে, সন্তান হয়েছে, তারা রয়েছে বিদেশে, ধরুন আমেরিকায়। তাদের কাছে 'ক' বাবু চলে গেলেন। সেখানে কয়েক বছর কাটিয়ে তিনি হয়ে গেলেন আমেরিকার নাগরিক। অর্থাৎ পরিস্থিতি এবং ক্ষমতার খেলার ফল হিসেবে তার জীবনকালে তিনি পাচটা আলাদা আলাদা 'দেশের' নাগরিক হলেন। কিন্তু যেটা কেউ তার কাছে থেকে কেড়ে নিতে পারলো না - তার জাতিপরিচিতি। বাঙালি। এবার 'ক' বাবুর জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেম প্রদর্শনীর প্রশ্ন উঠলে উত্তর খুজতে মুশকিলে পড়তে হবে। কার প্রতি তিনি জাতীয়তাবাদের সাক্ষ্য রাখতে দায়বদ্ধ?
    এর উত্তরও খুব সোজা। দেশ মানে যদি মহাজাতি হয়, তাহলে জাতীয়তাবাদের প্রমান হিসেবে আমাদের আনুগত্য কিছু রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক সীমানার (যা আজ বাদে কাল পালটে যাবে) প্রতি নয়, আমাদের দায়বদ্ধতা কেবল মাত্র মানুষের প্রতি। যেহেতু বাস্তবের নিয়ম মেনে একটি অপরের নির্নয় করে দেওয়া সীমানা আমাদের বিচরনক্ষেত্র, তাই প্রাথমিক ভাবে এই ভৌগলিক পরিসর, যার রাজনৈতিক নাম 'দেশ', এর মানুষের প্রতি আমরা দায়বদ্ধ। এবং যেখানে যেখানে সম্ভব, সেখানে আমাদের কাজের প্রভাব বিস্তার করে এই সীমানার বাইরের প্রত্যেকটা মানুষের প্রতিও আমরা দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতা থেকেই ব্রিটেনের শ্রমিক ইউনিয়নরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে দাড়িয়েছিলো। এই দায়বদ্ধতা থেকেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকার রাস্তায়, ইউনিভার্সিটিতে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী পুলিশের ব্যাটনের সামনে দাড়িয়েছিলো। কারন তারা নিজেদের দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতো। তাদের চেতনায় তাদের দেশের যে ধারনা, সেই ধারনা কে আহত হতে দেখে, তাকে রক্ষা করতেই তারা এই লড়াই লড়েছিলো।
    তাই, আমাদের দেশের যে ধারনা, যার ভিত্তিতে আমরা আজকে 'ভারতীয়', সেই ধারনাকে রক্ষা করা, তার বাস্তবায়ন করা, এটাই দেশপ্রেমের কর্মসূচী। 'জাতীয়তাবাদ' যদি সেই ধারনার পরিপন্থী হয়, তাহলে সেই জাতীয়তাবাদ মেকি, তা আমাদের দেশকে ধ্বংস করবে। সেই মেকি জাতীয়তাবাদকে ত্যাজ্য করাই আসল দেশপ্রেম

    https://www.facebook.com/ArkadyGaider/posts/274137026399814
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২২ জুলাই ২০১৭ | ২০০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ২৩ জুলাই ২০১৭ ০২:৪৪61412
  • তেলেগু নয় "তেলুগু"

    আর বানান ভুল! বাপরে! অতি সাধারণ সাধারণ বানানও ভুল!
    উফফ!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন