…...
এই পর্ব শুরু করছি সোমনাথেরই কথা ধার করে। "এই জৈব চাষ তখনই লাভজনক হবে, যখন আমরা সবাই জীবনটাকে প্রকৃতি সাথে মিশিয়ে দিতে পারবো। আমি কৃষক হিসাবে চাষ করি কারণ এখন একটু কষ্ট হলেও এই পদ্ধতিতেই খালি আগামীদিনে চাষের খরচ কমতে পারে। ….ক্রেতারা আজকাল এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন, সব অর্গ্যানিক না খেলে অনেক বড়ো বিপদ হয়ে যাবে। তাই নুন পর্যন্ত অর্গানিক চাইছে ।
এটা অবশ্যই খুব ভালো লক্ষণ। তবে বাজার ধরতে গিয়ে অনেকেই নিজেদের কাজকাম ছেড়ে চাষ করতে নেমে গেছে। আর দুদিন চাষ করে লাভ এর হিসাব কষতেও শুরু করেছে। ... এটা কিন্তু একদিনের কাজ নয়। ক্রেতা যেদিন সত্যিই বুঝবে, জৈবচাষের ফসল তার সুস্থ থাকার জন্য জরুরী, সেদিন চাহিদা বাড়বে…আর মাঠ থেকে ফড়ে হয়ে নয়, বরং ক্রেতার কাছে সরাসরি ফসল পৌঁছতে হবে।… তাই আলোচনা আসুক কৃষক কেনো এখনো জৈব চাষ এ ফিরছে না।"
তবে পুরোপুরি জৈবচাষ করে সফল হওয়া সোমনাথ মাইতি তো আর চাষবাস করে একলা ধনী হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ওয়ার্ডবয়ের চাকরি ছাড়েনি। শুরু থেকেই তার বুকে লুকানো ছিল সাথী চাষিভাইরা সহ বৃহত্তর সমাজকে সঙ্গে নিয়ে জৈবকৃষির পথ ধরে সামনের দিকে এগোনোর আরো কিছু নাছোড় স্বপ্ন। তাই ও একদিকে তৈরি করে ফেলে 'ইনোভেটিভ অ্যাগ্রো ফার্ম' আর অন্যদিকে এবাংলা হোক বা ওপার বাংলা; 'আপনজন যৌথ সমবায়ের' মতো প্রাকৃতিক চাষ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নানান প্রতিষ্ঠান, সমাজকর্মী আর চাষীদের সঙ্গেও এক নিবিড় সমন্বয় গড়ে তুলতে শুরু করে। চাষ হোক বা অন্যত্র জলের অপব্যবহার আর নদীদূষণ বন্ধ করার উদ্যোগগুলোতে সোমনাথ সামিল হয়ে যায়। সামিল হয়ে যায় লোকশিল্পের প্রসারের মাধ্যমে গ্রামস্তরে রোজগার তৈরির চেষ্টাতেও।
আসলে নিজেকে 'চাষা' বললেও সোমনাথ নিজে এক পুরোদস্তুর সমাজকর্মী। তাইতো ২২এর অক্টোবরে বাল্যবিবাহরোধ আর দেশীয় বীজ সংরক্ষণের বার্তা জনমানসে ছড়িয়ে দিতে সাইকেলে চেপে নিজের গ্রাম, দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরবেড়িয়া থেকে পাঁশকুড়া পর্যন্ত দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার আগে ও লিখে যায়,
"প্রয়োজন তো এইটুকুই ছিল। খাবার - পোষাক আর একটু মাথা রাখার ঠিকানা। কিন্তু এর জন্য এতোটাই কী আধুনিক হবার প্রয়োজন ছিল? যার জন্য আজ বাতাস দূষিত, জলের জন্য হাহাকার, একটু পুষ্টিযুক্ত খাবারও নেই। জীবনে যতটা এগিয়েছি, তার থেকে হয়তো অনেকটাই পিছিয়েছি আমরা। … তাই চেষ্টা করছি সবার পাতে একটু পুষ্টিযুক্ত খাবার কীভাবে মিলবে। পরিবর্তন কতটা করতে পারব জানিনা, তবু আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে যাব আমি…"।
…….
সোমনাথ বা ওদের মত তরুণ উদ্যমী চাষীরা, যাঁরা কৃষিকে আর পরিবেশ-প্রকৃতিকে ভালোবেসে চাষের ক্ষেতে নেমেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কয়েকটি লক্ষ্য খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়—--
প্রথমত, এঁরা নিজেদের কাজের মধ্যে দিয়ে সমাজে কৃষকদের হারিয়ে যাওয়া সামাজিক সম্মানকে আবার ফিরিয়ে আনতে চান।
দ্বিতীয়ত, ছোট কৃষকরা গরিবদুঃখী, অসহায়,ঋণগ্রস্ত, সর্বদা পরকৃপাপ্রার্থী… শহুরে জনতার এই ভুলভাল ধারনাকে এঁরা আগাপাশতলা বদলে দিতে চান।
তৃতীয়ত, এঁরা নিজস্ব কৃষিপণ্যের প্ৰাকৃতিক গুণমানের বজায় রাখার পাশাপাশি জরুরী জোর দিয়ে থাকেন, পণ্যের বিপণন কৌশল আর গোটা প্রক্রিয়ার বাস্তবভিত্তিক ম্যানেজমেন্টের ওপর।
এই যেমন সোমনাথ বলে, "কৃষক চাষ করতে পারে না বলে লাভ পায় না এমনটা নয়। আমরা যদি, ফসল চক্র, জমির চাষ নকশা আর বীজ সংরক্ষণ ও বপন ব্যবস্থার প্রতি একটু মনোযোগ দিতে পারি, তাহলেই আমরা অনেকটা সফল হতে পারি…"।
আসলে এই নতুন চাষীরা চাষের সমস্ত অনিশ্চয়তা স্বত্ত্বেও নিজেদের পেশাটিকে নিয়ে যতখানি গর্বিত, ততখানিই প্ৰাকৃতিক কৃষিক্ষেত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা ভরপুর আত্মবিশ্বাসী। তাইতো এঁদের একজন হিসেবে সোমনাথ নিজেকে এক সফল ''উদ্যোক্তা কৃষক'' রূপে পরিচায়িত করতে চেয়েছে সবসময়।
…….
তবে , এই নবীন কৃষকটি কিন্তু নিজের ধারালো চিন্তার মতোই স্পষ্টবাক। ফলে চাঁচাছোলা ভাষায় ও জিজ্ঞেস করে, "গ্রামে অর্গ্যানিক চাষ হলেও এখন সমস্ত ফসলই শহরে চলে যায়। তাহলে আমরা গ্রামের লোকগুলো খাব কি? হাটবাজার থেকে কিনে আনা সেই বিষ দেওয়া খাবার?..." এই ব্যতিক্রমী নীতিবোধ থেকেই সোমনাথ তার ফসলের সিংহভাগ প্রতিটা দিন বিক্রি করে থাকে পাথরবেড়িয়া গ্রামবাসীদেরকেই।
সঙ্গে অবশ্য আমাদের মতো শহুরে লোকদের পাতেও নিখাদ পুষ্টিকর খাবার পৌঁছনোর কথাও ভেবেছে সোমনাথ। সেই লক্ষ্যে দক্ষিণ কলকাতা আর শহরতলীতে 'প্রকৃতির ঝুড়ি' নামের একটি অভিনব প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে ও। গাঁ থেকে দীর্ঘ রাস্তা সাইকেলে পাড়ি দিয়ে 'প্রকৃতির ঝুড়ি' নামের দুখান ব্যাগে ভরে সপ্তায় দুদিন নির্বিষ শাক-থোর-মোচা-অন্য সবজি-কাঁঠালি কলা-মাশরুম-ওর নিজের হাতে তৈরি করা ফার্মের হাস-মুরগীর ডিম বা কখনো সখনো দিশি মাছ-মাংসও স্বল্পদামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসে সোমনাথ আর ওর সঙ্গীরা। কেবল জৈবচাষের ফসল বিক্রিই নয়, এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে শহুরে ক্রেতারা তাঁদের পাতের ভাত-সবজি-ফল-ডিম উৎপাদকদের নাম-সাকিনের খুব জরুরি তথ্যগুলোও জানতে পারেন, সে দিকেও নজর রাখে আমাদের এই চাষীভাইটি ।
……
সঙ্গে অবশ্য রয়েছে ছাদবাগানও। হ্যাঁ, এই শহর আর শহরতলীর বুকে সোমনাথের সেই উদ্যোগও চলছে হৈ হৈ করে। ও নিজেকে যেমন ছাত্র বলতে ভালোবাসে, তেমনি আগ্রহী শহুরে মানুষের ডাকে সে প্রায় রোজই নানান স্কুল-কলেজ-প্রতিষ্ঠান,গৃহস্থের ঘরে ঘরে কৃষিবিজ্ঞান শিখিয়ে বেড়ায় বড় যত্ন করে মতে। সোমনাথ প্রশ্ন করে, খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া এই ২১ শতকে এসেও কেবল চাষীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? কেন প্রতিটি ঘরে মানুষ নিজস্ব খাদ্যের কিছুটা অন্তত উৎপাদন করতে সক্ষম হবেনা? ফুল বা শৌখিন ফলগাছের বাইরের প্রকৃতিকে কেনই বা তার খাদ্যের নিখাদ সম্ভার সহ ছাদে-বারান্দায় আদরের বসত করে দেবেনা শহরের লোক?
সোমনাথ পরম যত্নে ছবি আঁকে শহুরে ছাদের শাকসবজি বাগানের। ছবি এঁকে ও সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আনাড়ি বাগানিদের শিখিয়ে দেয়, ফ্ল্যাটের এককুচি বারান্দাতেও হরাইজন্টাল-ভার্টিকাল-এমনকি ফোল্ডিং বাগিচার প্রায় অসম্ভব এক কৃষিক্ষেত্র কিভাবে সস্তা, সহজ অথচ সম্পূর্ণ জৈব পথে, সামান্য খরচে ভরপুর ফলবতী হয়ে উঠবে!
যেমন নিজের দেহটাকে সোমনাথ মানুষের জন্য দিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে সই করে ফেলেছে সেই কবে, ঠিক তেমনই অবাক করা সমাজ সচেতনতা আর আন্তরিক শ্রমের পুঁজি নিয়ে সোমনাথ আগামীর স্বপ্ন দেখে। ও স্বপ্ন দেখে চাকরিবাকরিহীন এই 'নেই রাজ্যে' কৃষিকে ভালোবেসে কৃষির পথে নিকট আগামীতে ওর প্রশিক্ষণে ওর মতো করেই এক "গর্বিত উদ্যোক্তা কৃষক" হিসেবে স্বচ্ছল-স্বনির্ভর উঠবে অজস্র তরুণ-তরুণী। তবে বলি, কেবল স্বপ্ন দেখাতেই কিন্তু থেমে নেই ও, বরং সত্যিই শিখিয়ে পড়িয়ে বেশ কিছু উদ্যমী ছেলেমেয়েকে সোমনাথ রোজগেরেও বানিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
……
আমার মতোই আজ বহু মানুষ আজ এক ডাকে চেনেন, সম্মান করেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরবেড়িয়া গ্রামের 'এন্টারপ্রেনিওর ফার্মার' তথা এক আদ্যন্ত ব্যতিক্রমী চরিত্র সোমনাথ মাইতিকে। একদিকে ছাদে-বারান্দায় সফল কৃষিক্ষেত্র গড়ে তোলার এক প্রায় অসম্ভব প্রয়াসকে বাস্তবায়িত করে নিরাপদ উদ্ভিজ্জ খাদ্যের যোগানকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দেওয়ার প্রয়াস আর অন্যদিকে বহু কষ্টের বিনিময়ে নিজের অধীত প্রাকৃতিক কৃষিবিদ্যাকে অল্পবয়সীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে অতি সামান্য পুঁজিতে বড়সড় কর্মসংস্থান করার জোড়া লক্ষ্যের ধক নিয়ে সোমনাথ মাইতি এগিয়ে চলুক এ বাংলার শহরে-গ্রামে-সমতলে-পাহাড়ে। আমরাও আসুন না, কিছুটা নড়েচড়ে বসি আর প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ওর-ওদের যাত্রাপথের সঙ্গী হই।।
…..
আমার সঙ্গে অজস্র কথা মনে খুলে বলে যাওয়ার জন্য আমি সোমনাথ ভাইয়ের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
এই লেখার প্রতিটি তথ্য আর সঙ্গের ছবি সোমনাথের অনুমতিক্রমেই দেওয়া হয়েছে কিন্তু।