এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • একক

    Debayan Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৪ জুন ২০২১ | ৩০১৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • ভদ্রলোক কবি। পড়নে ধূসর কান অবধি কলার তোলা লম্বা গরম কোট। বাসে উঠে, মোটা ব্যাগটা কোলে রেখে ড্রাইভারের ঠিক পেছনের সিটে বসলেন। কপাল মন্দ নয়, সিটটা পুরোটাই খালি থাকায় জানলাটাই পেয়েছেন।


    কত বছর পর গ্রামে ফেরা! নিরানন্দ, ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। শীতকাল, তায় শেষ কয়েকটা সপ্তাহ হলো বেজায় বরফ পড়ছে। পথরেখা দেখা যায়না। রাস্তার দু'পাশে, দূরের পাহাড়ের গায়ে - মোটা বরফের কম্বল। আকাশে কালো মেঘ, মেঘের ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা বরফের ছিটেফোঁটা। শেষ বিকেলে পড়া শুরু হল যখন, তখন সারারাত আর থামবে না।


    ভদ্রলোক মনে মনে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন। একটা লাইনও ভেবে ফেলেছেন। The silence of the snows। কিন্তু পুরোটা ভাবা হল না। পাহাড় বেয়ে, বরফে ঢাকা দিকনির্দেশের সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে বাস চলতে শুরু করেছে। কালো আকাশে সাদা বরফ দেখতে দেখতে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন।


    - - -


    বেশ কিছুদিন হলো এক নিকটাত্মীয়ের দাঁতে একটা সমস্যা হচ্ছে। মাংসের হাড় চিবুতে গিয়ে চোয়ালে কোথাও একটা চোট লেগেছে। একজন ডেন্টিস্টকে দেখিয়ে নিলে ভাল হয়।


    গ্রামে থাকি। নামে আধা-শহর হলেও, আদপে গ্রাম-ই। ডাক্তার-বদ্যি একেবারেই নেই, তা নয় - তবে যারা বসেন, তারা সপ্তাহে এক-দু'দিন চেম্বার করেন, তাতে বহু লোকের ভিড়। চিকিৎসাও যে খুব উঁচু দরের, তাও নয়।


    এখান থেকে সবচেয়ে কাছের শহর বাসে এক ঘন্টা। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। আজ রবিবার। বাসে ভিড় আছে। মাছ, মিষ্টি, সবজি বেচেন এমন অনেক ছোট ব্যবসায়ী আজ শহরে গিয়ে দু'পয়সা লাভ করেন। এখানকার বড় বাজারে তাই বাসটার পনেরো-কুড়ি মিনিট স্টপেজ।


    এক মিষ্টি বিক্রেতা দু'হাতে করে তিনটে তিনটে ছ'টা মিষ্টির ডেকচি নিয়ে বাসে উঠে, ঘাম মুছে সিটে বসতে যাবেন - এমন সময় উল্টোদিকের কেবিনের সিটে চেনা কাউকে দেখতে পেয়ে মহা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। যে দোকান থেকে এই বিক্রেতা মিষ্টি নিয়েছেন, সেখানে আজ মিষ্টির ভ্যারাইটি দেখলে নাকি মাথা খারাপ হয়ে যাবে। চেনা ভদ্রলোকটিকে এ জিনিস দেখাতে না পারলে তার মিষ্টি বেচাই বৃথা। বাস তো দাঁড়িয়েই আছে, এখন দাঁড়াবেও - এই ফাঁকে চট করে দেখে আসা যায়। চূড়ান্ত জোরাজুরি শুরু হলো। চেনা ভদ্রলোক সিট ছেড়ে উঠবেন না, বহু কষ্টে সিট পেয়েছেন। তাছাড়া, খাওয়াবে না যখন - শুধু দেখতে যাওয়ার কি মানে? এদিকে ইনিও ছাড়ার পাত্র নন। বেশ মজার, তাই না?


    শহরে পৌঁছে প্রথমে আরেক আত্মীয়ের বাড়ি যাবো। সেখানে জলখাবার খেয়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে। তারপর বোধহয় চশমার দোকানেও একবার যেতে হবে, নিকটাত্মীয়ের একটা চশমা বানানো দরকার।


    যে আত্মীয় শহরে থাকেন, তিনি অর্থবান, পরিশ্রমী। শহরের পশ্ এলাকায় ফ্ল্যাট। রোববার ছুটি হলেও ফোনের বিরাম নেই। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই তার ড্রাইভার সেলাম করে উঠে দাঁড়ালো।


    বেলা দশটা। চেম্বারে প্রচন্ড ভিড়। তিন নম্বরে নাম ছিল, কিন্তু আত্মীয়ের সঙ্গে ডাক্তারবাবুর আলাপ থাকায় দু'জনকে টপকে সুড়সুড় করে প্রথমেই ঢুকে পড়লাম।


    ডাক্তারবাবু মাঝবয়েসী। টেবিলে বসে চা খাচ্ছেন, আর মাঝে মাঝে হেঁচকি তোলার মতন একটা ভঙ্গি করছেন। আলাপ হলো। ওনার এক ছেলে, এক মেয়ে। দু'জনেই ডাক্তারি পড়ছে। ছেলে আসছে বছর বিদেশ যাবে। মেয়েও যাবে বোধহয়, তারপর। উনি বলে দিয়েছেন, এদেশে পড়ে থেকে বুড়ো বাপের সেবা করার কোনো দরকার নেই। তারা রয়াল কলেজে পড়াবে, রিসার্চ করবে, ভালো সোসাইটিতে মিশবে। শুধু এদেশ থেকে মৃত্যুসংবাদ গেলে যেন করপোরেশনে ফোন করে বডিটাকে ডিস্পোজ্ করে ফেলার অনুমতি দিয়ে দেয়।


    ডাক্তারবাবু আড্ডাপ্রিয়। তিনি আমাদের সঙ্গে বসে আলাপ করেন, ওদিকে চেম্বার সামলান অন্য আরেকজন। মুশকো চেহারা, চওড়া কব্জিতে বিপত্তারিণীর লাল তাগা, কানে ফোন। ডাক্তারবাবু রোগীর মুখ খুলে টেনে ধরে রেখে আমাদের সঙ্গে দেশের রিজার্ভেশন সিস্টেম নিয়ে আলোচনা করেন। সহকারী ভদ্রলোক কাঁধ দিয়ে কানে ফোন চেপে রেখে কাউকে চেম্বারের দিকনির্দেশ দেন, আর দু'হাতে রোগীর দাঁতে কসমেটিক ফিলিং করেন।


    - কোথায়? চৌমাথা থেকে সোজা এগিয়ে গেছেন? ডানদিকে ঘুরতে হতো তো!


    - ......


    - এক কাজ করুন, রাস্তার পাশের ঝুপড়িগুলোতে জিজ্ঞেস করুন কিরীটি মুখার্জির বাড়ি কোনটা -


    - ......


    - একটা গেরুয়া বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন কি? পাশে জোড়া মন্দির থাকবে। একটা হনুমান, একটা শনি। পাচ্ছেন?


    - ......


    - কি? কুকুর? কুকুর কোথা থেকে পেলেন? ধ্যার!


    চুপ করে শুনি, দেখি। কোনো কথা বলিনা। কোনোরকম রিয়্যাক্ট করিনা, শুধু মাঝেমধ্যে দাঁতক্যালানে হাসি ছাড়া।


    সে যাইহোক। চশমার দোকানে ভিড় ছিলনা। বেশি দেরি হয়নি। দুপুরে আত্মীয়ের ফ্ল্যাটে ফিরে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। বিকেলেই বাড়ি ফিরবো।


    এসি চলছে। বাইরে দুর্দান্ত রোদ। নিকটাত্মীয় পাশে শুয়ে, দেখি তার চোখ লেগে গেছে। কম্পিউটার রাখা টেবিলটার ওপরে একটা বুকশেলফ আবিষ্কার করলাম। অধিকাংশই আত্মীয়ের মেয়ের পড়ার, বা প্রাইজ পাওয়া বই। একদম ডানদিকের কোনায় আমি সেই বইটা খুঁজে পেলাম। দু'পাতা পড়লাম। একজন কবির গল্প। বহু বছর রাজনৈতিক বন্দি থাকা, জেল খাটা এক কবি তার গ্রামে ফিরছেন। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কে জানে।


    ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছি। চারটে নাগাদ উঠে পড়লাম। এবার বেরোতে হবে। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি, বইটা ধার চাইবো। দু'পাতা পরেই পছন্দ হয়েছে।


    মুখ ধুয়ে, জামাকাপড় পড়ে উসখুশ করছি আর ভাবছি - বইটা যে চাইবো, সেই অনুরোধের থ্রো-টা ঠিক কেমন হলে ভালো হয় - এমন সময় আমার নিকটাত্মীয় স্বভাবসিদ্ধ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন - বইটা কোথায় রাখা ছিল?


    মনটা দমে যেতে গিয়েও দমল না। বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। এই তো, এইখানে - বলে বইটা তাকের যেখানটায় ছিল, সেখানে রেখে দিলাম। বইটা এখানেই থাক।


    বইটা আমি নিয়ে যাবোনা। ও এখানেই থাকবে, এসি ঘরে কাঁচের বাক্সের মধ্যে বন্দি হয়ে। ও থাকবে আমার রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে - চুপ করে, শান্ত হয়ে। সবকিছু দেখবে, সবকিছু শুনবে, ব্লটিং পেপারের মতো সমস্ত রকম অভিজ্ঞতা শুষে নেবে, জাজ্ করবে। ও এখানে থাকবে, এতো সব কিছুর মাঝে এক কবির এক পাহাড় বরফ পেরিয়ে বাড়ি ফেরার গল্পের বই হয়ে।


    আমি যদি ওকে নিয়ে যাই, তাহলে কি ও এত কিছু হতে পারবে?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৪ জুন ২০২১ | ৩০১৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ০৫ জুন ২০২১ ১১:১৪494573
  • ভাল লেগেছে, এ  লেখার জাত আলাদা। 

  • dc | 122.174.***.*** | ০৫ জুন ২০২১ ১১:২৫494574
  • একক কে নিয়ে লেখা পড়তে আমার এমনিতেই খুব ভাল্লাগে, কারন একক ভারি ইন্টারেস্টিং একজন ক্যারেক্টার। ওর সাথে দিব্যি বন্ধুত্বও করা যায়। 

  • &/ | 151.14.***.*** | ০৫ জুন ২০২১ ১১:২৯494575
  • লেখার নামটা একক বলেই পড়লাম।

  • Debayan Chatterjee | ০৫ জুন ২০২১ ১৮:০৫494593
  • মতামতের জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ।


    হিমালয়ান্ ব্লুজ লেখাটার শেষ পর্বে রঞ্জনবাবুর মতামত মিস্ করেছি ;)

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন