হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল অরুণাভ; মুখ তুলে সবাইকে দেখল। “একটা রিকোয়েস্ট, এই প্যাকেট তোমরা খুলবে আমি এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর।” এক এক করে সবার হাতে গিফট আর মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিল এজিএম, এবার রামাকৃষ্ণানের নাম এল আভিধানিকভাবে ঠিক জায়গাতেই। আর তার বদলে একদম শেষে নাম এল সেক্রেটারি কবিতার। সবাই জিনিস পেয়ে গেলে অরুণাভ চলে গেল নিজের ঘরে। আর তার পরেই সবাই গিফট প্যাকেট খুলে ফেলল, দেখা গেল ভেতরে রয়েছে দামী কলমের সেট - প্রত্যেকের জন্য একই জিনিস। কিন্তু প্রতিটা প্যাকেটে ভাঁজ করা সাদা কাগজটা কি? ... ...
ইন্দ্রনীলের একটা কথা মনে পড়ে গেল বিনীতার; একবার সে ইঙ্গিত করেছিল যতদিন এই প্রোজেক্টের কাজ শেষ না হবে, ততদিন তার ভালমন্দ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। ব্যাপারটা অনেকটা পর্বতারোহীদের মত - এই অভিযাত্রীরা বেশিরভাগ সময়ে দুর্ঘটনায় পড়েন চূড়ায় আরোহন করার পর। তার একাধিক কারণ থাকে - শিখরে পৌঁছাতে প্রচুর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করার পর তারা যখন নামতে শুরু করেন, ক্লান্তি তাদের গ্রাস করে, ফলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। অনেকেই আবার আত্মতুষ্টির শিকার হন, ভুল করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর একটা বিষয় হল সামনে কোনও বড় লক্ষ্য না থাকা। যে কাজ করার জন্য এত কষ্ট করা, তা শেষ হয়ে গেছে, এখন ফিরে যেতে হবে প্রতিদিনের গতানুগতিক জীবনে। এই মন খারাপ থেকেই আসে অবসাদ। ... ...
যাঁরা একটু আলবোড্ডে টাইপের, যাঁরা তাঁদের মানুষটিকে প্রাণ ভরে বিশ্বাস করেন, চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন এবং স্বামীর প্রতিটি কথাই বেদবাক্য বলে মনে করেন, তাঁরা কী করবেন? ... ...
“থ্যাঙ্কস ডাক্তার, তুমি এসেছো। বাইরে তোমার গাড়ি দেখলাম। কখন এলে?” সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করে অরুণাভ। “এই তো, একটু আগে,” জবাব দেয় ইন্দ্রনীল। “তোমার চা-ও বলে দিই। একবারে হয়ে যাবে,” বিনীতা রান্নাঘরের দিকে যায়। “কেমন আছেন?” ইন্দ্রনীল জানতে চায়। “ফার্স্ট ক্লাস। রিপোর্ট কমপ্লিট, কাল সাবমিট করবো।” “বাহ... দারুণ খবর। তারপর?” বিনীতা ঘরে আসে, শোনে তার স্বামী বলছে, “ছুটি নেব। তোমায় তো বলেছিলাম ডাক্তার, কাজ শেষ হলে তারপর ছুটি নেব।” বিনীতা বলল, “ছুটি নেবে? ভূতের মুখে রামনাম। ক'দিনের?” অরুণাভ বলল, “দেখি... ... ...
গতকাল মহাবিদ্যালয়ে নতুন টিচার্স কাউন্সিলের প্রথম মিটিং ছিল। পুরোনো সম্পাদকই পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। ... ...
মহাবিদ্যালয়ের এই চুঙ্কুমনা হনুধ্যক্ষ নিয়ে দু কলম লিখলে আগামী পাঁচ পুরুষের আর গয়ায় যেতে হয় না। ... ...
হনুধ্যক্ষ ও হনুধ্যাপকেরা শ্যাম্পু করে ল্যাজ ফুলিয়েছেন। ফুরফুরে বাতাসে উড়ছে ল্যাজের শেষপ্রান্তের ক-গাছি সারবস্তু। ... ...
খক্ষকের সঙ্গে কীসে কীসে মিল হয়? রক্ষক শিক্ষক ভক্ষক তক্ষক ... ...
ইন্দ্র স্লিপটা রেখে দেয়। বলে, “একটা কথা বলুন তো।” হঠাৎই অরুণাভর চোখমুখ উজ্বল হয়ে ওঠে, “বল… বল…” “ইয়োর অ্যাকশনস আর স্ট্রেঞ্জ। ইউ অ্যাকটেড লাইক আ ড্রাংক হোয়েন ইউ ওয়্যার নট সো। ইউ ডিড সামথিং ভেরি চাইন্ডিশ দ্যাট পিকনিক ডে। কী চান বলুন তো আপনি?” অরুণাভ বলে, “আমি কী চাই?” ইন্দ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। রোগী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আগাথা ক্রিস্টি বলেছিলেন, ‘জীবন যা যা ভাল জিনিস দিতে পারে তার মধ্যে একটা হল সুন্দর ছোটবেলা।’ আমি ছোটবেলাটা এক বার ফিরে পেতে চাই। আসি।” দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকায় সে। “অনেক দিন আমাদের বাড়ি যাওনি ডাক্তার। এস একদিন।” ... ...
ঘড়ি দেখে অনিকেত। ফালতু ফৈজতে আধ ঘন্টা নষ্ট হয়ে গেলো। সটান উঠে গেলেই হয়। কিন্তু কৌতুহল হচ্ছে। কী এতো শুটিং চলে আজকাল। কারা করে? কেই-বা এসব করাচ্ছে?? ... ...
বাবা-মায়ের কথা কাটাকাটি শুনতে অভ্যস্ত নয় রঙিন, মাকে একতরফা বকে যেতেই সাধারণতঃ দেখেছে সে। একটা পড়ার বই হাতে ভয়ে ভয়ে নিজের ঘরের দরজায় কাছে এসে দাঁড়ায় সে। শোনার চেষ্টা করে কী কথা হচ্ছে, তবে হাতের পেনসিলটা পড়ে গিয়ে একটু শব্দ হয়। তাড়াতাড়ি পেনসিলটা তুলতেই সে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে ওই ঘরের দরজায়। “ভেতরে গিয়ে পড়ো, আমি একটু পরে আসছি।” মায়ের কথায় রঙিন ফিরে যায় পড়ার টেবিলে, তবে পড়ায় মন দিতে পারে না। ... ...
আমাদের মেয়েরা সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে একে একে সেই জাল বেয়ে আকাশের কাছে পাড়ি জমানোর জন্য। তাদের কারোর চোখে অভিযাত্রীর আহ্লাদ তো কারোর করুণ দৃষ্টিতে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির আকুতি। দেখলাম পেল্লাই গাছেদের শরীর আর শক্ত শক্ত খুঁটির সঙ্গে বাঁধা ঐ জাল, দুপাশে দক্ষ ট্রেনারদের বজ্র মুঠি আর তীক্ষ্ণ নজরের আওতায় রয়েছে। পান থেকে চুন খসার জোটি নেই। দর্শক আমরা চারজন - বড় মাতাজী, ছোট মাতাজী, সঙ্গে বৈশাখী আর আমি দুই দিদিজী। সেদিন মাঠা পাহাড়ের আকাশ বড় নীল, পাহাড় বড় সবুজ, কাঁচা হলুদ সর্ষে ফুলের মত রোদ বুঝি সবার কানেই বাঁশি বাজাচ্ছিল। একটা মিঠেকড়া ঠান্ডা বাতাস সোয়েটার চাদরের ভিতর দিয়ে খালি লুকোচুরি খেলছিল। বাতাসে বন তুলসীর ঝাঁজ - এমনি দিনে মানুষের মুখোশ খুলে মুখ বেরিয়ে পড়ে। পাকা চুলের পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়ায় কিশোরী মন। ২০২৫ কে সরিয়ে রেখে এতদিন বাদে বেরিয়ে পড়ে ১৯৮৫। কালোদি, লক্ষ্মীদি, বড় মিনুদি, প্রভাতীদি, মানসীদি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দুপাশে পুঁচু পুঁচু বেণী বেঁধে তাতে অপটু হাতে লাল ফিতে বাঁধা শারদা মেয়েদের লাইনে দাঁড়ায় জাল বাইবে বলে। ... ...
“এদিকে এস,” বিরক্তি লোকানোর কোনও চেষ্টাই করে না এজিএম। সমসের টেবিলের সামনে এগিয়ে এলে তার দিকে একরকম ছুঁড়েই দেয় ফ্ল্যাট ফাইলটা। “ডু ইউ অ্যাপ্লাই ইয়োর মাইন্ড হোয়াইল ওয়ার্কিং, সমসের? কী লিখেছ এখানে?” সমসের বুঝতে পারে না কী ভুল তার হয়েছে। অস্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে সেটা। “কী ভুল হয়েছে দেখতে হলে তো ফাইলটা তুলতে হবে, না কি?” বলে অরুণাভ। স্যারের এমন কণ্ঠস্বরের সাথে একেবারেই পরিচিত নয় সমসের, ফাইলটা ধীরে ধীরে হাতে তুলে নেয় সে, এবার কী করবে বুঝতে না পেরে অরুণাভর দিকে তাকায়। “পেজ নাম্বার থার্টিন, এনট্রি নামবার ফর্টি-টু, বার করো।” অরুণাভর আদেশ পালন করে সমসের, তবে ভুলটা বুঝে উঠতে পারে না। “স্যার, আমি… ঠিক…” “ডু ইউ নো দ্য ডিফারেন্স বিটুইন বাকেট হুইল এক্সক্যাভেটার অ্যান্ড বাকেট চেন এক্সক্যাভেটর?” ঢোঁক গেলে সমসের, “স্যার…।” “ইয়েস অর নো?” “ইয়েস স্যার।” “তো কী লিখেছ এখানে? ডোন্ট ইউ চেক হোয়াট ইউ রাইট? কে চেক করবে এ সব? ডু ইউ থিংক উই হ্যাভ প্লেন্টি অফ টাইম ইন আওয়ার হ্যান্ডস?” ... ...
পর্দায় তখন উত্তমকুমার। প্রসাদ, উল্টোরথ,নবকল্লোলের পাতায় ছবি দেখা উত্তমকুমার, জিজির মুখে শোনা শিঙাড়া স্টাইলের চুলওয়ালা উত্তমকুমার। ঘন্টা দেড়েক পরে ভাই আর দাঁড়াতে না পেরে আস্তে করে গিয়ে মা'র কোলে শুয়ে পড়ে। মা পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই জিগ্যেস করে কিরে সব পড়েছিস? ভাই দিব্বি ঘাড় নেড়ে আরাম করে শোয় যেন কতই ঘুম পেয়েছে। আমি একটু এগিয়ে দাঁড়াই ভাল করে দেখার জন্য। এদিকে কোথা থেকে কে জানে প্রায় জনা পনেরো বাচ্চা ছেলে, মেয়ে বড় মহিলা চলে এসেছেন টিভি দেখার জন্য। বড়মাইমা তাঁদের জন্য মেঝেতে ঢালা শতরঞ্চি পেতে দিয়েছে। সাড়ে সাতটায় বাংলা খবর হয়, খবর পড়েন ছন্দা সেন। ছোটদি খুব বিজ্ঞের মত বলে ‘জান তো ছন্দা সেনের মাথায় পরচুলা, ওঁর মাথায় এমনিতে চুলটুল বিশেষ নেই।' টিভি দেখতে আসা ছোট ছেলেমেয়েগুলো অবাক হয়ে একবার পর্দায় দেখে একবার ছোটদির দিকে। কেউ কেউ নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে নেয়, কেউ কেউ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। দাদু বিরক্ত হয়ে গলাখাঁকারি দেয়, দিদা আরো বিরক্ত হয়ে দাদুকে বলে ‘চুপ কইর্যা শুইয়া থাহো, ভালা না লাগলে পাশ ফিইর্যায় শোও।' আরো কতদিন যেন, প্রায় বছর চার পাঁচ, এরকম অনেক চেনা অচেনা লোক আসত টিভি দেখতে, সিনেমার দিন কিম্বা বিশেষ কোনও খেলা দেখানোর দিনে। কোনও কোনওদিন ঘর ভরে গিয়ে বাইরের বারান্দায়ও লোক বসে কিম্বা দাঁড়িয়ে দেখত জানলা দরজার ফাঁক দিয়ে। মস্তবড় প্রায় অচল রেডিওটা তখনও বসানো দাদুর আলমারীর মাথায়, দুপুরে কেউ হয়ত চালিয়ে মহিলামহল শুনল, কিম্বা সকাল সাতটা চল্লিশে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কখনও দিনের পর দিন রেডিও চালালেই ঘরঘর করে আওয়াজ হয়, গান বাজে সঙ্গে বাজে ঘ্যাঁওওও আওয়াজ। কেউ না কেউ তখন কান মুচড়ে থামিয়ে দেয় রেডিওটাকে। প্রায় অচল দাদুও কখনও বসে কখনও শুয়ে থাকে। ঘরে অতিরিক্ত লোক, তাদের কথাবার্তা, উজ্জ্বল নীল আলো, কল্পজগতের হাসিকান্না মেলোড্রামায় বিরক্ত হয়ে, অতিষ্ঠ হয়ে কখনও কখনও বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলে। কেউ না কেউ ততোধিক বিরক্তি প্রকাশ করে কিংবা ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দেয় দাদুর বিরক্তি অসুবিধে, এসবই এখন নিতান্তই মূল্যহীন। চলে ফিরে বেড়ানো লোকগুলির অসুবিধে সৃষ্টি কেবলমাত্র। ছানিপড়া ঘোলা চোখে শুন্য দৃষ্টি নিয়ে টিভির দিকে পিছন ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকে দাদু, মেরুদন্ড সোজা রেখে। অল ইন্ডিয়া রেডিও ছেড়ে আমরা কলকাতা দূরদর্শন, দিল্লী দূরদর্শনের যুগে ঢুকে যাই। ... ...
পুরাতন গালিচাটি ---ফুল লতাপাতা, জটিল বিমূর্ত নকশা --- না বলা,বা বলে যাওয়া কথা। কারা কারা মিলেছিলো, কারা কারা করেছিল আড়ি --- কারা কারা ঘরে এলো, কারা কারা ছেড়ে গেল বাড়ি। এখানেই শেষ তবে? কিছু স্থান রয়ে গেছে ফাঁকা। নতুন সুতোর ফোঁড় বলে দেবে কার সাথে কার হবে দেখা। ... ...
সেই রাতটা মনে এল ইন্দ্রর। বৃষ্টি পড়ছিল খুব, বাজও পড়ছিল মাঝে মাঝে। তার মধ্যেই অনেক রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে এল সে। সন্ধ্যায় বাড়ি এসেও আবার যেতে হয়েছিল এক রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়াতে। ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢুকে দেখে বাইরের ঘরে সোফায় বসে আছে অঞ্জলি। ঘরে টিউব লাইট নয়, কম পাওয়ারের একটা আলো জ্বলছে। “এ কি! তুমি শোওনি কেন এখনও?” জিজ্ঞাসা করে ইন্দ্রনীল। “এত রাত করে কেউ এই অবস্থায়?” একটু বিরক্ত গলাতেই বলে সে। উত্তর দেয় না অঞ্জলি, অদ্ভুত ভাবে তাকায় স্বামীর দিকে। সে দৃষ্টিতে কী ছিল আজও জানে না ইন্দ্রনীল – ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, রাগ – সব কিছুই মনে হয় মেশানো ছিল তাতে। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়, ইন্দ্রনীলকে একরকম উপেক্ষা করেই সে উঠে চলে যাচ্ছিল শোবার ঘরের দিকে। ... ...
ওদিকে ফেরার পথে মনটা অশান্ত হয়ে আছে ইন্দ্রনীলের। স্বাভাবিক রাস্তায় না ফিরে এলোমেলো গাড়ি নিয়ে ঘুরতে থাকে সে, তবে শহরের দিকে যায় না। রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকান দেখতে পায় সে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে দোকানে যায় সে। ছোট্ট টিনের চালের দোকান, চারপাশে গাছপালা। নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চ। ইন্দ্র বেঞ্চে বসে এক গ্লাস চা নিয়ে। তার সামনে চাষের ক্ষেত। তার ওপারে সূর্য ডুবছে। চায়ে চুমুক দিয়ে সে ভাবতে থাকে চার দিন আগে আচমকা রাঁচী ছোটার কথা। শুধু বন্ধু নয়, আরও একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওই হোটেলে, যার কথা বিনীতাকে বলেনি সে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ার কারণ হলেন তিনি। ... ...