একদিন সুযোগ পেয়েও যাই। ছোটমামারা তখন ফেরত চলে গেছে, দিদাকে নিয়ে ব্ড়মামা, মাইমা গেছে পুর্বাশায় মেজমামার বাড়ী। সেদিন আমি দোতলার ঠাকুরঘরে এসে ঢুকি, ভেতর থেকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ছোট্ট খাট থেকে নামিয়ে আনি রামকৃষ্ণ, সারদামণি, অন্নদা ঠাকুর, কালীঠাকুর, গনেশঠাকুরের ছবি। দেয়াল থেকে পেড়ে আনি কৃষ্ণরাধার ছবি। তারপর একটা একটা করে ছবির ওপরে উঠে দাঁড়াই, ছবির কাচ যাতে ভেঙে না যায় তাই ঐ ঠাকুরদের বিছানার তোষক নিয়ে ফটোর ওপরে রেখে তার ওপরে দাঁড়াই। সব ফটো জায়গামত রেখে ধার থেকে টেনে আনি লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মূর্তি। এই দুটো ঠাকুরের মূর্তি এনে পুজো হয়, ভোগ দেওয়া হয় আর পুজোর পরের দিন আগের বছরের ঠাকুরের বিসর্জন দেওয়া হয়। এই বছরের ঠাকুর ঠাকুরঘরে থাকে। এগুলো মূর্তি ছবি নয়, এগুলোর ওপরে দাঁড়ানো যায় না, তাই পা দিয়ে ওদের শাড়ি ডলে দিই, পায়ের আঙুল দিয়ে মূর্তির মাথার চুলগুলো রগড়ে দিই। তারপর আবার উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসি আর মনে মনে বলি, যে ঠাকুরের দোহাই দিয়ে দিদারা এত মিথ্যে বলে, এতবার অন্যায়ভাবে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখে, সেই ঠাকুরকে পা দিয়ে ডলে রগড়ে দিলাম। ওদের দেখানো 'ঠাকুর দেখবেন ওপর থেকে' এই ভয় আমি করি না। ওদের উত্তরাধিকার আমি বহন করি না, কোনওদিন করবও না। ... ...
২২শে এপ্রিল ২৫ এর পহেলগামে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারত কী পদক্ষেপ নেয়, তার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আমরা। যতদিন গেছে - ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক শক্তির তুচ্ছতা নিয়ে বহু কথা বলা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের প্রতিটি শাখায়। জনগণেশ বারবার বলেছে - এত অপেক্ষার কী আছে - ভারত তো নিমেষে গুঁড়িয়ে দিতে পারে বিরুদ্ধ দেশকে। দীর্ঘ পনেরদিন অপেক্ষার পর ভারত সরকার দুর্দান্ত আঘাত হেনেছে। পাকিস্তানের সীমানার বাইরে থেকেই ভারত নটি জঙ্গী ঘাঁটি বিধ্বস্ত করেছে মোট একুশটি মিসাইলের আঘাতে। অর্থাৎ নিখুঁত এবং নিশ্চিত আঘাত হানার জন্যে ভারত মাত্র চোদ্দদিন সময় নিয়েছে প্রস্তুতির জন্যে। সরাসরি রণাঙ্গনে নামার আগে এই যুদ্ধ প্রস্তুতির কথাই চিন্তা করেছিলেন যুধিষ্ঠির। বনবাস এবং অজ্ঞাতবাসের তের বছরে ধৈর্য ধরে নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিলেন - কী ভাবে যুদ্ধ জয় নিশ্চিত করা যায়। সেই আলোচনাই করেছি - মহাভারতের ... ...
এতগুলো কথা গুছিয়ে বলতে বিনীতাকে শান্ত থাকতে হয়েছে, নিজের ইমোশন চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে, আর আগে কয়েকবার নিজের মনে মনে বলে রিহার্সাল দিয়ে নিতে হয়েছে। মেয়ে প্রশ্ন করল “বাবা আর আসবে না?” উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না বিনীতা, গায়ত্রী বলল, “বাবা হয়তো আর আসবে না, কিন্তু আমরা সবাই তো আছি। আমরা সবাই তোমার কাছে থাকব, তোমার পাশেই থাকব।” এইবার বিনীতা বলল, “বাবা কত ভিডিও করেছেন সেগুলো দেখব আমরা, বাবার কত বই আছে সেগুলো পড়ব।” রঙিন চুপ করেই রইল। বিনীতার মনে পড়ল অরুণাভর লেখা চিঠিতে মেয়ের কথা - “রঙিনকে ব’লো আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে তাই চলে গেছি।” এগুলো মেয়েকে বলতে গিয়েও বলল না সে, “কাজ ফুরিয়ে যাওয়া” ব্যাপারটা সে কী ভাবে নেবে জানা নেই। আর এই ধারণা ও পরে কার ওপর কেমন ভাবে প্রয়োগ করবে সেটাও অজানা। ... ...
ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। দুনিয়া বদলাচ্ছে। ইউরোপীয়রা একের পর এক ভূখণ্ড দখল করছে।ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া—তাদের কাছে তখন ‘সভ্যতা’ মানে আধুনিকতা, বিজ্ঞান, শিল্প, জাতীয়তাবাদ।আর মুসলিম দুনিয়া? ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে। এক সময় যে অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপের দরজায় কড়া নেড়েছিল, সেই সাম্রাজ্য তখন নিজেকে টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। মিশর, পারস্য, উত্তর আফ্রিকা, ভারত—যেখানেই তাকানো যায়, দেখা যাচ্ছে পরাধীনতা, বিক্ষোভ, আত্মসমালোচনা। এই পটভূমিতেই মুসলিম সমাজের কিছু মানুষ ভাবতে শুরু করলেন—কেন আমরা পিছিয়ে গেলাম? এবং এখন কী করণীয়? ... ...
“ভাবি, স্কুল যাবেন না?” ঘড়ির দিকে তাকায় বিনীতা, “হ্যাঁ, যাব।… স্কুল থেকে ফিরে রঙিন যদি কিছু জিজ্ঞেস করে ব’লো বাবা অফিস গেছে।” বিসপাতিয়া মাথা কাত করে জানায় তাই হবে, তারপর চলে যায় ডাইনিং রুমের দিকে। বিনীতাও উঠে শোয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিল, খেয়াল হল চিঠিটা রয়ে গেছে টেবিলের ওপর বই-এর মধ্যে। ফিরে এসে সেটা আবার তুলে নেয়। বেড রুমের দিকে যাচ্ছিল বিনীতা, দেখে ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিসপাতিয়া। “ভাবি, এখন কী করবেন?” বিনীতা উত্তর দিল, “অপেক্ষা।” ... ...
“আগে ম্যামথ, ডাইনোসর এরাও ছিল বিরাট বড় বড় প্রাণী। দাঁড়াও দেখাচ্ছি,” অন্য একটা বই এনে ওই দুই লুপ্ত হয়ে যাওয়া জন্তুর ছবি মেয়েকে দেখাল অরুণাভ। “এত বড় বড় অ্যানিম্যাল কোথায় থাকত?” “এখানেই থাকত।” “কুসুমবনিতে?” খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল রঙিন। হাসল অরুণাভ, “হ্যাঁ, কুসুমবনিতেও হয়তো ছিল। তবে ডাইনোসররা যখন ছিল, তখনও পৃথিবীতে মানুষ আসেনি। ম্যামথের টাইমে অবশ্য মানুষ ছিল।” অবাক হল রঙিন, “মানুষ আসেনি মানে?” “আমাদের পৃথিবী তৈরি হতে অনেক অনেক বছর সময় লেগেছে, তারপর আস্তে আস্তে এসেছে গাছপালা, পোকামাকড়, মাছ, কচ্ছপ… ডাইনোসর… ম্যামথ… এই রকম করে করে সবার শেষে মানুষ।” “ডাইনোসররা কোথায় গেল?” অরুণাভ বলল, “একটা মিটিওরাইট... যাকগে, ওটা এখন বুঝবে না।” “না না, আমি বুঝব… বল না,” বায়না করল রঙিন। “আসলে… আসলে ওদের কাজ ফুরিয়ে গিয়েছিল, তাই চলে গেল।” “ওদের কী কাজ ছিল?” “অনেক কাজ - খাওয়া, ঘুমানো, মারামারি করা…” “কাজ ফুরিয়ে গেল, তাই চলে গেল…” উত্তরে ইসারায় হ্যাঁ বোঝাল অরুণাভ। রঙিন একটু ভেবে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কাজ ফুরিয়ে গেলে সবাই চলে যায়?” “সবাই নয়, কেউ কেউ যায়,” মেয়েকে বলল বাবা। দু’জনের কেউই খেয়াল করেনি কখন বিনীতা এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে, সে চুপচাপ বাবা-মেয়ের কান্ড দেখছিল। এই বার এগিয়ে এসে বলল, “রঙিন, একটা নতুন রান্না করেছি, টেস্ট করবে নাকি?” ... ...
রঙিনের ঘরে লুডো খেলতে বসেছে বাবা আর মেয়ে। খেলতে খেলতে হঠাৎই “আসছি” বলে উঠে গেল অরুণাভ, ফিরে এল তার মোবাইল ফোনটা নিয়ে। তারপর ভিডিও ক্যামেরা অন করে রেকর্ড করা শুরু করল। “আমি আর রঙিন এখন লুডো খেলছি, তোমরা কেউ বিরক্ত করবে না।… রঙিন, চাল দাও… দেখি ছক্কা ফেলতে পারো কি না…” কমেন্টারি করতে লাগল সে। ছক্কা পড়ল না, পড়ল তিন। তবে খেলার মধ্যে ভিডিও ঢুকে যাওয়ার ব্যাপারটা রঙিনের দারুণ পছন্দ হল, বাবাকে আগে কোনও দিন ফোনে ছবি বা ভিডিও তুলতে খুব একটা দেখেনি সে। অরুণাভ খানিক ভিডিও করে, তাতে সব কিছুর ছবি তোলে - মেয়ের, লুডোর বোর্ডের, ঘরের নানা জিনিসের, নিজেরও; তারপর কিছুক্ষণ বন্ধ রাখে, আবার চালু করে। একটু পরে রঙিন জিজ্ঞাসা করল সে নিজে একটু ভিডিও করতে পারবে কি না। বাবা সম্মতি দিলে সেও ভিডিও করা শুরু করল। অরুণাভ উৎসাহ দেওয়াতে কমেন্টারিও শুরু করল সে, তবে বেশিক্ষণ পারল না, ক্যামেরা চলতে চলতে বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছিল সে, এমনিতেই তো বাবার মত কম কথা বলে সে। ... ...
ক্ষমতালিপ্সু তথাকথিত সমাজসংস্কারকরা ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে সেই ধুরন্ধর পুরাণকারদের ট্র্যাডিশানেই আজও যে ইতিহাসের অশুদ্ধি ঘটাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু তাতেও কী আর অমৃতসমান মহাভারতের অশুদ্ধি ঘটতে পারে? ... ...
হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল অরুণাভ; মুখ তুলে সবাইকে দেখল। “একটা রিকোয়েস্ট, এই প্যাকেট তোমরা খুলবে আমি এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর।” এক এক করে সবার হাতে গিফট আর মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিল এজিএম, এবার রামাকৃষ্ণানের নাম এল আভিধানিকভাবে ঠিক জায়গাতেই। আর তার বদলে একদম শেষে নাম এল সেক্রেটারি কবিতার। সবাই জিনিস পেয়ে গেলে অরুণাভ চলে গেল নিজের ঘরে। আর তার পরেই সবাই গিফট প্যাকেট খুলে ফেলল, দেখা গেল ভেতরে রয়েছে দামী কলমের সেট - প্রত্যেকের জন্য একই জিনিস। কিন্তু প্রতিটা প্যাকেটে ভাঁজ করা সাদা কাগজটা কি? ... ...
ইন্দ্রনীলের একটা কথা মনে পড়ে গেল বিনীতার; একবার সে ইঙ্গিত করেছিল যতদিন এই প্রোজেক্টের কাজ শেষ না হবে, ততদিন তার ভালমন্দ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। ব্যাপারটা অনেকটা পর্বতারোহীদের মত - এই অভিযাত্রীরা বেশিরভাগ সময়ে দুর্ঘটনায় পড়েন চূড়ায় আরোহন করার পর। তার একাধিক কারণ থাকে - শিখরে পৌঁছাতে প্রচুর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করার পর তারা যখন নামতে শুরু করেন, ক্লান্তি তাদের গ্রাস করে, ফলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। অনেকেই আবার আত্মতুষ্টির শিকার হন, ভুল করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর একটা বিষয় হল সামনে কোনও বড় লক্ষ্য না থাকা। যে কাজ করার জন্য এত কষ্ট করা, তা শেষ হয়ে গেছে, এখন ফিরে যেতে হবে প্রতিদিনের গতানুগতিক জীবনে। এই মন খারাপ থেকেই আসে অবসাদ। ... ...
যাঁরা একটু আলবোড্ডে টাইপের, যাঁরা তাঁদের মানুষটিকে প্রাণ ভরে বিশ্বাস করেন, চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন এবং স্বামীর প্রতিটি কথাই বেদবাক্য বলে মনে করেন, তাঁরা কী করবেন? ... ...
“থ্যাঙ্কস ডাক্তার, তুমি এসেছো। বাইরে তোমার গাড়ি দেখলাম। কখন এলে?” সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করে অরুণাভ। “এই তো, একটু আগে,” জবাব দেয় ইন্দ্রনীল। “তোমার চা-ও বলে দিই। একবারে হয়ে যাবে,” বিনীতা রান্নাঘরের দিকে যায়। “কেমন আছেন?” ইন্দ্রনীল জানতে চায়। “ফার্স্ট ক্লাস। রিপোর্ট কমপ্লিট, কাল সাবমিট করবো।” “বাহ... দারুণ খবর। তারপর?” বিনীতা ঘরে আসে, শোনে তার স্বামী বলছে, “ছুটি নেব। তোমায় তো বলেছিলাম ডাক্তার, কাজ শেষ হলে তারপর ছুটি নেব।” বিনীতা বলল, “ছুটি নেবে? ভূতের মুখে রামনাম। ক'দিনের?” অরুণাভ বলল, “দেখি... ... ...
গতকাল মহাবিদ্যালয়ে নতুন টিচার্স কাউন্সিলের প্রথম মিটিং ছিল। পুরোনো সম্পাদকই পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। ... ...
মহাবিদ্যালয়ের এই চুঙ্কুমনা হনুধ্যক্ষ নিয়ে দু কলম লিখলে আগামী পাঁচ পুরুষের আর গয়ায় যেতে হয় না। ... ...
হনুধ্যক্ষ ও হনুধ্যাপকেরা শ্যাম্পু করে ল্যাজ ফুলিয়েছেন। ফুরফুরে বাতাসে উড়ছে ল্যাজের শেষপ্রান্তের ক-গাছি সারবস্তু। ... ...