এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপার বাংলা

  • গান যখন হাতিয়ার : মানভূমের বিস্মৃত টুসু সত্যাগ্রহ

    Suchetana Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    অপার বাংলা | ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৩০৬ বার পঠিত
  • আন্দোলনের শুরুতেই কবি ভজহরি মাহাত লিখলেন সপাট লড়াকু এক টুসুগান,
    "শুন বিহারী ভাই
    তোরা রাখতে লারবি ডাঙ্গ দেখাই।
    তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি
    বাংলা ভাষায় দিলি ছাই।
    ভাইকে ভুলে করলি বড়
    বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই।
    বাঙালী বিহারী সবাই
    এক ভাষাতে আপন ভাই।
    বাঙালীকে মারলি তবু
    বিষ ছড়ালি হিন্দী চাই।
    বাংলা ভাষার দাবীতে ভাই
    কোন ভেদের কথা নাই।
    এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে
    মাতৃভাষার রাজ্য চাই।"

    ভজহরির গান দ্রুত উদ্বেল করেছিল তখনো পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরে থাকা বাঙালিদেরও। গানে তাঁদের থিতিয়ে থাকা আত্মাভিমান আন্দোলনের দৃপ্ত অভিমুখ পেল। অরুণচন্দ্র ঘোষের সম্পাদনায়
    ভজহরি মাহাতো, মধুসূদন মাহাত, বৈদ্যনাথ মাহাত, অরুণচন্দ্রের রচনা সমেত 'টুসুর গানে মানভূম' নামের ১৬পাতার পুস্তিকাটি আন্দোলনের পবিত্র গ্রন্থে পরিণত হয়েছিল। প্রতিবাদী বাঙালির মধ্যে আকাশসমান জনপ্রিয়তা পাওয়া এই বইটির এক লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যে। 
    প্রত্যাশিতভাবেই গানটিকে নিষিদ্ধ করলো বিহার সরকার আর গ্রেপ্তার হন ভজহরি মাহাত। তাঁর গ্রেফতারির প্রতিবাদে তাঁরই লেখা টুসুগান গাইতে গাইতে মিছিল বের করলেন লোকসেবক সংঘের সত্যাগ্রহীরা পুরুলিয়া সহ মানভূমের প্রায় সমস্ত শহরে-গ্রামে-
    ‘'সবাই মোরা চাইরে মন
    বাংলা ভাষায় কাজ চলে।
    কত সুখে দিন কাটাবো 
    মাতৃভাষায় গান বলে।
    সুখের আইন গড়ে দিবো
    বাংলাভাষায় রাজ পেলে।
    ভজহরির মনের আশা
    পুরে যাবে সেই কালে…।।"

    সত্যাগ্রহীরা গাইলেন,
    "( পাছে ) এই নীতিতে জেলা হারা। 
    বিহারের এই ভীতিরে। 
    মানভূমেরই মাতৃভাষা 
    বাংলা ভাষা চারধারে। 
    সেই কারণে বাংলা দমন 
    চালায় বিহার সরকারে।
    হোক না যতই পীড়ন দমন 
    হিন্দী রাজের অত্যাচারে।
    লোকসেবকের অটল গাড়ী
    টলবে নাকো কোনো ধার।
    ভাষার নীতি করতে বিচার 
    কমিশনে ভার দিল ।
    হিন্দী রাজের মাথায় 
    এবার বিষম বিপদ পড়বে। 
    বাংলা বিহার মামলা দায়ের
    ভাষা ভিত্তিক স্টেশনে।
    জনমতের বাজবে বিগুল
    বিচারের কমিশনে। 
    চলল এবার ইঞ্জিন ঐ
    পুরু আছে কয়লাজল।
    ( এবার ) মিথ্যাচারীর টলবে আসন
    মিথ্যা হবেরে বিকল।
    ভাষা নীতির টিকিট আছে
    যাবিরে আজ কোন খানে।
    হওরে এবার জংশন পার
    লোকসেবকের ইঞ্জিনে‌।”
    টুসুকবি তথা শীর্ষনেতা 'মানভূম কেশরী' অতুলচন্দ্র
    ঘোষের ছেলে অরুণচন্দ্র ঘোষ লিখলেন বাঙালির রোজকার জীবনে প্রাণের বাংলাভাষার বহুমুখী গুরুত্বের কথা,
    "আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে।
    (ও ভাই) মারবি তোরা কে তারে।।
    বাংলা ভাষা রে।।
    এই ভাষাতে কাজ চলছে
    সাত পুরুষের আমলে।
    এই ভাষাতেই মায়ের কোলে
    মুখ ফুটেছে মা বলে।
    এই ভাষাতেই পরচা রেকর্ড
    এই ভাষাতেই চেক কাটা।
    এই ভাষাতেই দলিল নথি
    সাত পুরুষের হক পাটা।
    দেশের মানুস ছাড়িস যদি
    ভাষার চির অধিকার।
    দেশের শাসন অচল হবে
    ঘটবে দেশে অনাচার।।"

    অন্য একটি টুসুগানে অরুণচন্দ্র লিখেছিলেন বাংলাভাষার মাধুর্যের কথা - 
    "আমার মনের মাধুরী।
    সেই বাংলা ভাষা করবি কে চুরি।
    আকাশ জুড়ে বিষ্টি নামে।
    মেঠো সুরের কোন্ ঢুয়া
    বাংলা গানের ছড়া কেটে 
    আষাঢ় মাসে ধান রুয়া। 
    মনসা গীতে বাংলা গানে
    শ্রাবণে জাত-মঙ্গলে 
    চাঁদ-বেহুলার কাহিনী পাই
    চোখের জলে গান ব’লে।
    বাংলা গানে করি লো সই 
    ভাদুপরব ভাদরে।
    গরবিনীর দোলা সাজাই
    ফুলে-পাতায় আগরে।
    বাংলা গানে টুসু আমার 
    মকর দিনের সাক্ রাতে।
    টুসু ভাসান পরব টাঁড়ে
    টুসুর গানে মন মাতে।।"

    সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে বাঁশবুরুর কবি মধুসূদন মাহাতো লেখেন, 
    "মন মানে না রে হিন্দি সইতে।
    ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দীতে।
    মাতৃভাষা হরে যদি
    আর কি মোদের থাকে রে।
    (তাই) মধু বলে মাতৃভাষার
    ধ্বজা হবে বহিতে।"

    ওদিকে লোককবি জগবন্ধু ভট্টাচার্য এসময়ে রচিত তাঁর নির্ভীক গানে একসারিতে ফেলে দেন পূর্বতন ব্রিটিশ এবং স্বাধীনতা উত্তর কংগ্রেসি সরকারের আগ্রাসনকে- 
    "প্রাণে আর সহে না
    হিন্দি কংগ্রেসীদের ছলনা।
    ইংরেজ আমলে যারা গো
    করতো মোসাবিয়ানা
    এখন তার হিন্দি-কংগ্রেসি
    মানভূমে দেয় যাতনা।

    আমবাঙালিকে সজাগ করে আন্দোলনে সামিল করার উদ্দেশ্যে জগবন্ধু লিখে প্রচার করতে থাকেন, আন্দোলন আর সরকারি দমন-বঞ্চনার অসাধারণ সব টুসুগান-
    "মানভূমবাসী থাকবে সতরে।
    ধলভূমবাসী থাকবে সতরে।
    (হিন্দীর) ফন্দি এলো জিপগাড়ী ভরে। ধু:।
    যতটাকা কেবল ফাঁকা
    বাঁধ কুয়ারই খবরে।
    (মিথ্যা) চালানকাটি নিচ্ছে লুটি।
    হিন্দী ভাষার প্রচারে।
    (তাই) এদের তরে চাষের অন্ন
    দাও এখন বাঁধা দরে।
    নইলে পরে কেমন করে
    মরবি ক্ষুধায় ভাদরে।
    সেদিন এরা কেউ ছিলনা
    থাকবেনাকো এর পরে।
    (এখন) এত ব্যথা গোপন কথা
    (শুনায়) কমিশনের ডরে।।"
    এদিকে আবার কাননবীহারি ঠাকুরের টুসুগানে উঠে আসছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মূলমন্ত্র, 
    "স্বাধীন জীবনে
    এবার মিলবে জনে জনে।
    সত্যপথে চলরে সবাই
    গান্ধীবাণী রাখ মনে।
    কানন বলে পাবি আরাম
    বাংলাভাষার জীবনে।।"
    কিন্তু টুসুগানকেই কেন সত্যাগ্রহীরা বেছে নিয়েছিলেন তাঁদের একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে? 

    আসলে টুসুগান বহুকালই ধরে মানভূমের নিত্যদিনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এই লোকগান কেবল মকর পরবেরই নয়, এ গান রাঢ়বাংলায় রচিত এবং গীত হতো বা হয় আমজনতার রোজ-জীবনের সমস্ত ছোট বড় মাঝারি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। টুসুর সহজ সুরে বাঁধা ছিল তাঁদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য। টুসুগান আসলে গানভূম মানভূমের আত্মপরিচয় আত্মমর্যাদারও এক প্রশ্নাতীত প্রতীক। তাই প্রাদেশিক বিহার সরকারের আগ্রাসী হিন্দিনীতি আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজেদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং পরবের ছত্রছায়ায় বাঙালিকে একজোট করে সত্যাগ্রহকে শক্তিশালী করে তোলার জোড়া লক্ষ্যেই অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ বা মকরসংক্রান্তি পর্যন্ত চলা ১মাস ব্যাপী এই লোকউৎসবের সময়কে   
    আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বের জন্য বেছে নিয়েছিলেন আন্দোলনের মূল পরিকল্পকরা। 

    ১৯৫৪ সালে সময় শুরু হয় মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে অনন্য পর্যায়; 'টুসু সত্যাগ্রহ'। ১৯৫৪'র ৯ - ১৯ জানুয়ারী, ২০ - ২৬ জানুয়ারি এবং ২৭ জানুয়ারী থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনটি পর্যায়ে 'টুসু সত্যাগ্রহ' চলেছিল। আজ পৌষ বা মকর সংক্রান্তির ভোরবেলায়, ১ মাস ব্যাপী টুসু উৎসবের শেষ দিন রাঢ়বাংলার বিশেষত পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের গ্রামীণ মেয়েরা দলবদ্ধভাবে যখন টুসুগান গাইতে গাইতে টুসুদেবীর ভাসানের জন্য চলেছেন জলাশয়ে বা নদীতে। যখন টুসুর জাগরণের শেষ দুই রাত জেগে গান গেয়ে গেয়ে ঘরে ঘরে তাঁরা তৈরি করেছেন গড়গড়্যা বা বাঁকা বা উধি পিঠা, পুর পিঠা আর নানারকম মিষ্টি । 
    ঠিক এরকমই এক সময়ে আজ থেকে ঠিক ৭দশক আগে মানভূমের আপামর বাঙালি আর বাংলাভাষী ভূমিজনেরা তাঁদের টুসুপরবকে উদযাপন করেছিলেন মাতৃভাষার মর্যাদা আর স্বীকৃতির দাবিতে লেখা অসংখ্য রাজনৈতিক টুসুগানের কথায় সুরে। খেটে খাওয়া গরিব গ্রামীণ মানুষের এই সর্বতোভাবে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনটির একমাত্র হাতিয়ার ছিল টুসুগান। আর ঠিক এ কারণেই এই আন্দোলন আজও অনন্য হয়ে রয়েছে 'টুসু সত্যাগ্রহ' নামে।
     
    'মানভূম' নামটির সাথেও কমবেশি আমরা অনেকেই পরিচিত। ১৮৩৩ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে বিরাট ছোটনাগপুর মালভূমির বাংলা সংলগ্ন অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিল মানভূম জেলা। বাঙালী অধ্যুষিত এই জেলাকে ১৯১১ সালে জোর করে বিহারের সাথে জুড়ে দিয়ে মানভূমের জাতীয়তাবাদী বাঙালিদের বিরুদ্ধে সফলভাবে নিজেদের 'divide and rule' নীতি কার্যকর করেছিল ব্রিটিশ সরকার। 

    একদিকে মাত্রাছাড়া ব্রিটিশ দমননীতি, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দিভাষী ভারতীয় নেতাদের তরফ থেকে ধেয়ে আসা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জোড়াফলার বিরুদ্ধে ১৯১২ থেকে মানভূমের মাটিতে বাঙালিরা শুরু করলেন মাতৃভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার এক মহিমময় আন্দোলন। জানলে অবাক হতে হয়, ১৯১২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে চলা মানভূমের এই ভাষা আন্দোলন সময়ের নিরিখে পৃথিবীর দীর্ঘতম মাতৃভাষা আন্দোলন হিসেবে আজও অনন্য হয়ে আছে।

    আদমশুমারি অনুযায়ী মানভূমের ৮৭% মানুষ বাঙালি হলেও বাংলাভাষা সরকারি ভাবে সবসময়ই ছিল বৈষম্যের শিকার । ১৯১২ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত স্থানীয় স্তরে প্রচুর বাংলা স্কুল, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, আলোচনা চক্র ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের একজোট করার জরুরি কাজটি করেছিলেন মানভূমের বাঙালিরা। ১৯৩৫ এ বিহারে নতুন কংগ্রেসি সরকার গঠিত হওয়ার পর, বিহারের নামিদামি নেতারা তাঁদের ওপর হিন্দি ভাষা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া শুরু করেন। 'মানভূম বিহারী সমিতির' মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির উল্টোদিকে ১৯৩৫-এই 'মানভূম সমিতি' গড়ে তুলে ১৯৪৬ অবধি নিজেদের মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ অথচ জোরালো আন্দোলন জারি রাখেন বাঙালিরা।

    কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের পূর্বঘোষিত নীতি থেকে সরে আসছিল ভারত সরকার। আর ওদিকে ১৯৪৬ থেকে 'বিহার নিরাপত্তা আইনের' অজুহাতে ভাষা আন্দোলনকারী বাঙালিদের ওপর আরো বেশি করে ভেদনীতি চাপিয়ে দিচ্ছিল বিহারের প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকার। সরকারের অঙ্গুলিহেলনে বাংলা স্কুলগুলিকে পরিণত করা হয় হিন্দি স্কুলে, সমস্ত সরকারি দফতরে বাধ্যতামূলক হয় হিন্দি ভাষার ব্যবহার, সমস্তধরনের আইনি ও প্রশাসনিক কাজে হিন্দিভাষাকেই সরকারীভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়, প্রতিবাদকারী বাঙালি আমলা-কর্মী- আইনজীবীদের ওপর নেমে আসে হিন্দিবলয়ে বদলি বা সাসপেনশন সহ সরকারি নানা শাস্তি।  

    পাশাপাশি বাংলা রাজ্যের সঙ্গে মানভূম জেলাকে যুক্ত করার জন্য বাঙালিদের দীর্ঘদিনের দাবিকেও নস্যাৎ করেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার। মানভূমের বাঙালি জনতা বুঝলেন, নিজেদের অস্তিত্ব, ভাষা আর সংস্কৃতিকে রক্ষার লক্ষ্যে যে কোন মূল্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে তাঁদের। ১৪ জুন, ১৯৪৮ পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা গ্রামে সমবেত কয়েক হাজার বাঙালির উপস্থিতিতে অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, ভজহরি মাহাতো, অতুলচন্দ্র ঘোষ, সত্যকিঙ্কর মাহাতোর মানভূমের সাবেক গান্ধীবাদী নেতারা জাতীয় কংগ্রেস ত্যাগ করলেন ও গড়ে তুললেন 'লোকসেবক সংঘ'। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য বিহারের সচ্চিদানন্দ সিংহ, মোহাম্মদ ফকরুদ্দিন, দীপনারায়ণ সিংহর মত মানুষেরাও কিন্তু মানভূমের হিন্দিকরণের বিরুদ্ধে ছিলেন। এই দীপনারায়ণ সিংহ পরে বিহারের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হন।

    আন্দোলনের দ্রুত প্রসারে ভয় পাচ্ছিল বিহার সরকার। তাই বাঙালিদের মিছিল ও সম্মেলনের অধিকারকে বেআইনি ঘোষনা করলো তারা। যার প্রতিবাদে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত মানভূমের সর্বত্র লোকসেবক সংঘের নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা  অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করলেন। গান্ধীবাদী আন্দোলনের পাশে সক্রিয়ভাবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন জেলার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরাও। জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র 'মুক্তি' পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করলো মানভূমের বাঙালিদের সমস্যা ও অন্যায় হিন্দি আধিপত্যবাদ সংক্রান্ত সম্পাদকীয় ও ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন খবরাখবর।  

    কিন্তু ক্রমেই বিহার সরকারের অত্যাচার চরমে উঠছিল। পুরুলিয়া, সাঁতুরি আর ঝালদায় সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশ লাঠি চালায়। বাঙালিদের বাড়িঘর, দোকান, খেতখামার তো বটেই, সরকারি বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হন বাঙালি মহিলারাও। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যসরকারের অনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে বাঙালি জনতার ক্ষোভে ক্রোধে উত্তাল হয়ে ওঠে মানভূম। আন্দোলনের এই কঠিন সময়ে জেলার প্রত্যন্ততম অঞ্চল পর্যন্ত সমস্ত বর্ণের বাঙালিকে সংগঠিত করে জনজাগরণের লক্ষ্যে অতুলচন্দ্র ঘোষ,ভজহরি মাহাত প্রমুখ নেতারা মানভূমের একান্ত নিজস্ব টুসুপরবকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। 

    ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ শেষ হওয়ার পর ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর সরকারি অত্যাচার আরও তীব্র হয়। স্বৈরাচারী বিহার সরকারের স্বৈরাচারী হিন্দি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তবু টুসুগান বেঁধে মানভূমের গ্রাম গ্রামান্তরে বাঙালিদের প্রতিরোধ চলতেই থাকে। মাতৃভাষায় প্রদেশ গঠন গোটা দেশের নীতি। 
    ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ অবধি জবরদস্তিমূলক হিন্দিনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের টুসুগান গেয়ে গ্রেফতার হন অসংখ্য সত্যাগ্রহী। নিষিদ্ধ টুসুগান গেয়ে মিটিং- মিছিল- এমনকি নানা মেলাউৎসবেও বিহার পুলিশের লাঠি- বেয়নেটের ঘায়ে আহত হন,আরো অগণিত বাঙালি। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এত যাতনার পরেও বাঙালিরা অহিংস পথেই আন্দোলন জারি রেখেছিলেন। মানভূমের অশান্ত পরিস্থিতি ক্রমে জটিল করে তুলছিল জাতীয় রাজনীতিকেও। ওদিকে দক্ষিণ ভারতেও ভাষাভিত্তিক রাজ্যের দাবিতে চলছিল চরম অশান্তি। ভাষার ভিত্তিতে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুনর্গঠনের জন্য ১৯৫৬'র শুরুতে শুরু হোলো সীমা কমিশনের কাজ।

    হঠাৎ করেই এসময় পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের তৎকালীন দুই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারকে যুক্ত করে এক নতুন পূর্বপ্রদেশ গঠন করার পরিকল্পনা করেন। বিহারের বিধানসভায় প্রস্তাবটি পাশও হয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই মানভূম থেকে কলকাতা সর্বত্র মুখ্যমন্ত্রীদের এই অবাস্তব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্রতম প্রতিবাদ শুরু হয়। এর পরের ঘটনা ছিল মানভূম তথা ভারতের বাংলাভাষা আন্দোলনের এক মহিমময় অধ্যায়।

    বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণ, মানভূমে বাংলাভাষার সম্মানহানি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদে অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে শুরু হয় অভিনব এক 'লং মার্চ'। ১০ জন মহিলা সহ ১০০৫ জনের একটি সত্যাগ্রহী দল কাকভোরে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি তুলে পাকবিড়রা গ্রাম ২০ এপ্রিল পদযাত্রা টানা ২১ দিন ধরে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে কলকাতায় পৌঁছান। 

    গোটা সফরপর্বে ধামসা মাদল খোলের তালে সত্যাগ্রহীদের গলায় ধ্বনিত হয়ে চলেছিল, "বাংলা আমার প্রাণের ভাষা রে''র মতো অপরূপ সব টুসুগান। কখনো তাঁরা দিয়েছিলেন ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি, কখনো গেয়েছিলেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। কলকাতায় তখন আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। ৬মে কলকাতায় তাঁদের অহিংস শান্তিপূর্ণ মিছিল পৌঁছতেই পরদিন গ্রেফতার করা হয় প্রায় সবাইকেই।

    তবে দমনপীড়ন করেও যে মানভূমবাসীর আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়া যাবেনা, সেই বার্তা এতদিনে স্পষ্টভাবে পৌঁছে গেছিল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের ঘরে। ফলে জনমতের চাপে বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব চিরতরে বাতিল হয়। বঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন এবং সীমা কমিশনের রিপোর্টের হাত ধরে, আরো নানা আইনি পথ পার হয়ে ১৯৫৬'র ১লা নভেম্বর ২৪০৭ বর্গ মাইল এলাকার ১১,৬৯,০৯৭ জন মানুষকে নিয়ে তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গের নতুনতম জেলা পুরুলিয়া। যদিও মানভূমের বাকি অংশ বাঙালিপ্রধান ধানবাদ মহকুমা হিসেবে বিহার রাজ্যেই রয়ে যায়।

    অন্যতম তিনটি তথ্যসূত্রঃ
    ১) ভাষা আন্দোলন ও টুসু গান - ডক্টর শান্তি সিংহ,
    ২) গানের ভাষায় ভাষা আন্দোলন - অলোক কুমার চক্রবর্তী
    ৩) লোক-চেতনার আন্দোলন:টুসু সত্যাগ্রহ - ডঃ চন্ডীচরণ মুরা
    ৪) টুসু গানে গানে টুসু সত্যাগ্রহ- সূর্যকান্ত মাহাতো
    ৫) মানভূমের অতীত কথা:ভারতে প্রথম বাংলা ভাষা বিজয় - পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপার বাংলা | ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৩০৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন