এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বই

  • এসো কবি, এসো বাধা দাও, মা নিষাদ...

    Debraj Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বই | ০৩ এপ্রিল ২০২২ | ১৩৩৭ বার পঠিত
  • সময় যত যাচ্ছে, উষ্ণতা বাড়ছে শহরের। বাড়ছে মানুষের ভিতরকার অনমনীয়তা, অসহিষ্ণুতা।প্রত্যেক দৈনন্দিন জীবনে আমরা তা উপলব্ধি করি।এই অসহিষ্ণুতার বিরোধিতা করতে গিয়ে জন্ম নেয় অপরাপর হিংসা।প্রত্যেকদিন জীবনযাপনের সঙ্গে আপোষ করতে গিয়ে প্রতিবাদের ভাষা হারাই।খুন, জখম, দাঙ্গার আগুনে দগ্ধ হয়ে থাকে শহর।নেমে আসে কালোরাত্রির চাঁদ। তার আলোতে মা দেখে নেয় সন্তানের রক্ত, অথবা সন্তানের চোখের সামনে পড়ে থাকে ধর্ষিতা মায়ের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ।আর এই সবকিছুর মাঝখান দিয়ে পথ চলতে চলতে কবিতা খুঁজে নেয় তার প্রতিবাদের ভাষা। কবি জয় গোস্বামীর বিগত তিন দশকের কবিতার দিকে তাকালে বোঝা যাবে, তার লেখা কখনও শাসক বা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেনি, বরং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জীবনধর্মকে নিয়ে গেছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকে, বারবার দেখিয়েছে কীভাবে ওই ছিন্নভিন্ন মানুষগুলোর পাশে একইভাবে ছটফট করে ওঠে তার কবিতা।

    সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত কবির "দগ্ধ" কবিতাপুস্তিকাটির মধ্যেও বিগত দশকের কাব্যধারাটিকে বয়ে এনেছে, যা বাংলা কবিতার ইতিহাস তথা সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাড় করায়। কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়, কবি যেন এসে শরনিক্ষেপ করার মতো কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সভ্যতার দিকে।শুধুমাত্র "দগ্ধ"-র ক্ষেত্রে নয়, এ চর্চা দেখতে পাই তার "সন্তানসন্ততি", "মা নিষাদ", "শাসকের প্রতি"র কবিতাগুলির মধ্যে। যেখানে জয় তার কবন্ধের চোখ কবিতায় লিখছেন-"সে শুধু বলতে চায়/তিনশো হাজার টন ভেঙে পড়া লোহা আজ আমার কবিতা/সে শুধু স্তূপের নীচে এখনও বাল্মীকি, বসে বসে 'মরা মরা মরা' জপ করে" অথবা "শব" কবিতায়-"কী-ই বা আকাশ?/সূর্যাস্তে সন্তানরক্ত ঝরে/কে কার সন্তান?/মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে গুলি করল যাকে/পশ্চিমবাংলার গ্রামে সে কেউ না তোমার আমার/পাঁচটি বুটের লাথি যাকে মারল ট্রাম লাইনে ফেলে/সে কেউ না তোমার আমার/রিকশায় চাপানো লাশ ফিরে এল যাদের বাড়িতে/তারা কেউ ভাই নয়, বন্ধু নয় পড়শি নয় তোমার আমার/ কী-ই বা মানুষ আর কী তার মানব অধিকার/প্রতিদিন আবিষ্কৃত কাদামাখা শব-তার/হত্যাসূত্র,বিচার, প্রমাণ/শহরে শহরে গ্রামে-ছুটে যাওয়া তদন্তধুলোয়/পথে পথে ভেঙে ভাসমান"।যেখানে দেশের সীমানা পার কবিতা চলে যাচ্ছে হাজার হাজার মাইল দূরের যুদ্ধ বিদ্ধস্ত কোনো মানুষের ঘরে। তেমনই শহরের বুকে ক্ষতচিহ্ন তৈরি করা প্রত্যেক ঘটনা কবিতার আশ্রয় নেই।একটি সাক্ষাৎকারে জয় গোস্বামী জানিয়েছিলেন, এই বিশ্বে ঘটে চলা প্রত্যেকটি ঘটনাই তার আত্মজীবনীর অংশ, তাই "কাপুরুষ ও মহাপুরুষ", "অজাতাক", "বাপি সেনের মৃত্যু" অথবা "মহানগর" কবিতায় যেখানে কবিতা কবিকেও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। কবিতার বিষয় ও বাস্তবতা এত জোরালো হয়ে ওঠে যে কবির পরিবারও হাত ধরে পাশাপাশি দাঁড়ায় সেই কবিতার। সামাজিক সংকটের মুহুর্তে, খাতা খাতা কবিতা লেখার পরেও কবির চোখ এড়ায় না তার ঘুমন্ত সন্তানের বিপন্নতা-"কাছে কোথাও বাজ পড়লে ঘুম ভেঙে এখনও যখন/বুকুন চিৎকার করেঃ 'জয়দাই কোথায়?'যখন এ ঘরে এসে/আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায়,/বুঝতে পারি, ওইটুকুই আমার পৃথিবী।/বুঝতে পারি, কবিতাও এর বেশি আর কিছু পারে না-/সেও তার শীর্ণ দুটি হাতে/ধ'রে আছে চিরকাল/ভয়ে নীল সন্তানপৃথিবী।"

    একজন প্রকৃত কবির জীবনধর্ম এই যে সময়োচিত প্রত্যেক ঘটনার প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে নিজের অভিব্যাক্তিকে ভাষায় ধরে রাখা।বিগত দশকের কবিতায় যে ভাষাপ্রদেশ আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিককালে তা দেখা গেল রামপুরহাটের বাগটুই গ্রামের ঘটনায়।যে কবির কবিতা কোনো রাজনৈতিক তরজায় যায় না, নৃশংস আততায়ীদের প্রতি কোনো শ্লেষ বা অসূয়া প্রকাশ করে না। বরং তার কবিতা ওই বদ্ধ ঘরের মধ্যে পুড়ে যাওয়া মানুষগুলির সঙ্গে পুড়তে থাকে।পুড়তে থাকে কবির সমগ্র চেতনা।কলমে সাহসী হলেও ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল কবি যেন তার কাছে মানুষদের কে দেখতে পান সেই আগুনের মধ্যে, পুড়ে কাঠ হয়ে আসা শব দেহগুলির মধ্যে- "শনাক্ত করাই যাচ্ছে না /এতই বিকৃত হয়ে গেছে /দগ্ধ দেহগুলি/আমি কি শনাক্ত করতে যাব?/কিন্তু যদি গিয়ে চিনে ফেলি/ওইসব দেহ আসলে তো/অভীক সুমিত অর্ক অভিরূপদেরই?/ভয় করে ভয় করে ভয়/যদি দেখি লাশগুলোর মধ্যে শুয়ে আছে/বুকুন? কাবেরী?"(বিকেল ৫টা ১০)।আজ থেকে দুইদশক আগের ঘটনাগুলির ওপর লেখা 'ত্রাণশিবির' কবিতাটির দিকে যদি তাকাই-" সাতাশ দিনের বাচ্চা ওর/মুখ থেকে দই তুলতে তুলতে মরে গেল/ও তখনও বিশ্বাস করছে না-/ওর এখন মনে নেই তিনদিন আগেই ওকে সাতজন মিলে.../অন্য অন্য পুরুষ মেয়েরা-/জোর করে কোল থেকে নিয়ে/মাটি দিতে চলে গেল হাত-মুঠো কাঠ বাচ্চাটাকে/রোদে জ্বলছে মাঠের ত্রিপল"। কবিতাটির প্রথম তিনটি স্তবক এখানে শেষ হয়ে যায়, এবং কবিতাটির মাস্টারস্ট্রোক শেষ লাইনগুলিতে যেখানে কবিতাটি শেষ হয়ে গেলেও ঘটনার স্রোত থেমে থাকে না,ঘটনান্তরে এবং সময়ান্তরে তা বারবার ফিরে আসতে থাকে, যে শেষলাইনে কিছু প্রশ্নই নিক্ষেপিত হয়- "সে দলে ক'জন ছিল?কী পোশাক?/মুখে কী শ্লোগান?/স্বামীর কী নাম ছিল?"কোথা ছিল বাড়ি?"/কথা নেই/মেয়েটা নিশ্চল/প্রশ্ন করে করে ব্যর্থ হয়ে/আরেকটি মেয়ের দিকে চলে গেল/সরকারি প্রতিনিধিদল"। 

    স্বাভাবিকভাবেই দগ্ধ কবিতার রচনাকাল নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কীভাবে একজন কবি এত দ্রুততায় সাম্প্রতিক ঘটনার ওপর তার লেখা সম্পুর্ণ করেন।আর এখানেই প্রমানিত হয় কবিতার ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব ও কালজয়ী হয়ে ওঠার প্রবণতা। ঠিক যেমন "ত্রাণশিবির" কবিতাটির সন্তানহারা ধর্ষিতা মেয়েটির নীরবতা মিশে যায় বাগটুই গ্রামের পুড়ে যাওয়া পরিবারটির শব দেহগুলির সঙ্গে। অথবা, সেই সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটি যে আরও আরও মৃত শিশুর সঙ্গে একইভাবে মরে মিশে যায় গ্রামবাংলার মাটিতে-"সাত বছরের বাচ্চা আগুনের মধ্যে ব্যর্থ ছুটোছুটি করে/শেষ রাত্রে হাসপাতালে চলে গেছে লাশ হয়ে---/জানি শুধু এই(সন্ধ্যা ৭টা ৩০)। 

    কবি জয় গোস্বামীর কবিতায় মহাকালের স্বাক্ষর রচিত হয়ে যখন তার "মা নিষাদ" কাব্যগ্রন্থে আবহমান বাংলার বাউল-ফকিরদের কথা, যুগে যুগে তাদের অত্যাচারিত হওয়ার কথা উঠে আসে, তবু তার গান থামে না। সারা পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের দামামা বাজলেও একা কবিতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলে।মানবসভ্যতা।যার মূল ধর্ম ভালোবাসা, ক্ষমা।শরীরে শত আঘাতের চিহ্ন নিয়েও আগামী নতুন বছরে পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের ভিতর থেকে উঠে আসে।যে কবির কবিতা আজ "দগ্ধ" পুস্তিকার পাতায় পাতায় উঠে আসছে, তার শরীরে "মা নিষাদ"-এর ছাই লেগে আছে---

    "নিষাদ, তোমার অস্ত্রের মুখে এসে
    আমাদের গ্রাম হোক ধুলো, হোক ছাই
    স্তূপাকার সেই ছাইয়ের ভিতর থেকে
    ওঠে নিরস্ত্র আমরা দেখতে পাই" 
    -----------------------------
    লেখাঃ দেবরাজ চক্রবর্তী।
    উপরে উল্লিখিত কবিতাগুলি কবি জয় গোস্বামীর রচিত।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৩ এপ্রিল ২০২২ | ১৩৩৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন