এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  স্বাস্থ্য

  • কোভিড-১৯, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং ভ্যাক্সিনের কুহকী সন্তোষ

    ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য
    আলোচনা | স্বাস্থ্য | ২১ ডিসেম্বর ২০২০ | ৬২০৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (২ জন)
  • আমরা যে ভাইরাসটিকে নিয়ে কথা বলছি সে ভাইরাস বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের চেনা ধ্রুপদি ডোজ-রেসপন্স সম্পর্ক (অর্থাৎ, যত কম ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করবে তত কম উপসর্গ দেখা দেবে – এই নিয়ম) মেনে চলেনা। স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা প্রতি ১ মিনিটে ৩০০০ ১-মাইক্রন সাইজের ভাইরাস পার্টিকল বাতাসে ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে অতিমারি কালে এবং, খুব সম্ভবত, আগামীদিনেও আমাদের সুরক্ষার জন্য নাক-মুখ ঢাকা মাস্ক ব্যবহার করা সম্ভবত জীবনের অঙ্গ হতে যাচ্ছে, যার আদুরে নাম “নিউ নর্ম্যাল”। ফলে ভাইরাস এবং সামাজিক জীবন এক নতুন ঢং-এ জুড়ে গেল, যা এর আগে কখনো ঘটেনি। অর্থনীতিতেও এরকম সুদূরপ্রসারী প্রভাব অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ভারতের জিডিপি প্রথম ত্রৈমাসিকে প্রায় ২৪% সংকুচিত হয়েছে। আবার এই ভাইরাস-জনিত কারণে দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের মতো ঘটনা চুপিসারে নতুন কৃষি বিল, ২০২০-র মতো এবং সমধর্মী অনেক আইন ভারত রাষ্ট্র পাস করিয়ে নিতে পারছে।


    সম্মিলিত যোগফলে এ ভাইরাসকে শুধু বায়োলজির চোখ দিয়ে প্রাণী-অপ্রাণীর মাঝে অবস্থান করা একটি কণা হিসেবে দেখা যাবেনা। এর অভিঘাত বহুদূর বিস্তৃত। এমনকি এ ভাইরাসের ভ্যাক্সিনের প্রাথমিক প্রয়োগের সাথে সাথে ঊনবিংশ শতাব্দীর অ্যান্টি-ভ্যাক্সিনেশন আন্দোলনও শুরু হয়েছে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর বহু অংশে। এ ঘটনা কি একধরনের জাতীয়তাবাদের প্রকাশ? উত্তর জানা নেই। ল্যান্সেট-এ খবর প্রকাশিত হচ্ছে “The online antivaccine movement in the age of COVID-19” (অক্টোবর, ২০২০) শিরোনামে। অ্যান্টি-ভ্যাক্সারদের অনুগামী সংখ্যা ৭৮ লক্ষের ওপরে। এরকম সময়েই মানব ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য ফাইজারের ভ্যাক্সিন বাজারে এলো ১১ মাস সময়ে – যেখানে গড়ে একটি ভ্যাক্সিন বাজারে আসতে সময় নেয় ১০.৭ বছর। এরকম সব অদ্ভুত ঘটনার জন্মদাত্রী বা দাতা (ভাইরাসের লিঙ্গ নিয়ে নিশ্চিত নই) সার্স-কোভ-২ বা করোনাভাইরাস। এগুলোই বিস্তারে আলোচিত হয়েছে সংকলনে বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধ সমূহে।


    ল্যান্সেট পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে (৫.০৯.২০২০) “Is India missing COVID-19 deaths?” শিরোনামে। এই প্রতিবেদনে সরকারের তরফে দেওয়া মৃত্যুর সংখ্যার তথ্য নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছেন। এখানে বলা হয়েছে – “জনতার তরফে চাপ এবং মিডিয়ার রিপোর্ট বিভিন্ন রাজ্যকে “কম করে দেখানো” মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে আবার ভাবতে বাধ্য করছে।” মৃত্যু ভারতবাসী এবং বিশ্ববাসীর কাছেও অজানা কোন বিষয় নয়, বরঞ্চ গা সহা হয়ে গেছে, বিশেষত সুযোগ-সুবিধে বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষদের কাছে। কিন্তু মৃত্যুরও তো রকমফের থাকে! সেরকমই এক ইতিহাস জানবো আমরা।


    ১২ ডিসেম্বর, ১৯৯১, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামার্স একটি গোপন নোট তৈরি করে সহকর্মীদের মধ্যে বিলি করেন, মতামত চান। ১৯৯২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিখ্যাত পত্রিকা The Economist নোটটি প্রকাশ করে দেয় “Let Them Eat Pollution (ওদেরকে দূষণ খেতে দাও)” শিরোনামে। নোটটির মোদ্দা কথা ছিল, ধনী বিশ্বের সমস্ত প্রাণঘাতী, দূষিত আবর্জনা আফ্রিকা বা  কম উন্নত দেশগুলো তথা LDC (Less Developed Countries)-তে পাচার করতে হবে। এজন্য একটি স্বাস্থ্যের যুক্তিও দিয়েছিলেন সামার্স। তাঁর বক্তব্য ছিল আমেরিকার মতো দেশে ১,০০,০০০ জনে ১ জনেরও যদি দূষিত বর্জ্যের জন্য প্রোস্টেট ক্যান্সার হয় তাহলেও এর গুরুত্ব আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে যেখানে ৫ বছরের নীচে শিশুমৃত্যুর হার ১০০০ শিশুতে ৫ জন তার চাইতে বেশি। এবং সেখানেই প্রথম বিশ্বের দেশের এই দূষণ পাচার করতে হবে, পাচার করতে হবে এই বিষাক্ত বর্জ্য। এরকম “চমৎকার ও অভিনব” ধারণার পুরস্কার হিসেবে ক্লিন্টন প্রশাসনে ৭ বছর U.S. Treasury Secretary পদে ছিলেন। সে মেয়াদ শেষ হলে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এসব পুরস্কারের কথা থাক। সামার্স এখন সদ্য নির্বাচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। 


    এরকম একটা প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যের চোখ দিয়ে যদি আমরা দেখি তাহলে এটা বোঝা দুঃসাধ্য নয় যে স্বাস্থ্যের জগতেও দু’ধরনের নাগরিকত্বের (health citizenship) অবস্থান আছে। একটি পূর্ণ রাশি ১, আরেকটি ০। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও এরকম integer দেখা হয় – হয় ০ কিংবা ১। এখানে ভগ্নাংশের কোন জায়গা নেই। যেমনটা আজকের ভারতে এবং বিশ্বে দেখছি আমরা। স্বাস্থ্য নাগরিকত্বের প্রশ্নটিতে আমাদের মনোযোগ দেবার প্রয়োজন এ জন্য যে বিশ্ব স্বাস্থ্যের দুনিয়ায় একজন নাগরিক নৈতিকভাবে স্বাস্থ্যের সমস্ত সুবিধে ভোগ করার অধিকারী, “স্বাস্থ্য আমার অধিকার” এই শ্লোগানের বাইরে। এরকম স্বাস্থ্য নাগরিকত্বের অবস্থান থেকে মান্য জনস্বাস্থ্য গবেষক এবং দার্শনিক (যিনি social determinants of health বা স্বসাথ্যের সামাজিক নির্ধারক-এর ধারণার প্রবক্তাও বটে) মাইকেল মার্মট প্রশ্ন করেন – “রোগীদের কেন চিকিৎসা করছো এবং যে পরিস্থিতিতে থেকে তাদের অসুখ শুরু হয়েছিল সেখানে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছ?” প্রশ্ন করেন সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য – “আমরা কি হয় ব্যক্তি চিকিৎসক কিংবা ডাক্তার-সমাজ হিসেবে যুক্ত হবোনা?” (“Shouldn’t the doctor, or at least this doctor, be involved?”) (The Health Gap, 2016) সংবেদী, মানুষকে চিকিৎসার ভরকেন্দ্রে রাখা চিকিৎসকদের কাছে সত্যিই কি এসব প্রশ্নের যথাযথ সদুত্তর আছে?


    ২০০৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বা হু থেকে প্রকাশিত হয়েছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক Closing the Gap in a Generation: Health Equity Through Action on the Social Determinants of Health (Geneva, 2008)। এ পুস্তকের প্রস্তাবনায় বলা হল – “সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পলিসিসমূহের নির্ধারক ভূমিকা রয়েছে এসব ক্ষেত্রে যে  একটি শিশু বেড়ে উঠতে পারে কিনা এবং বিকশিত হয়ে পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে সতেজ, কর্মশীল জীবন যাপন করতে পারবে কিনা, কিংবা জীবনের অঙ্কুর অকালে বিনষ্ট হবে।” ২০০৮ সালেই হু-র তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল মার্গারেট চান “Impact of the global financial and economic crisis on health” শীর্ষক প্রেস বিবৃতিতে (১২.১১.২০০৮) বলেছিলেন – “১৯৭৮ সালে চালু হয়েছিল একটি উদ্যোগ যেখানে স্বাস্থ্যকে আর্থসামাজিক বিকাশের একটি রাস্তা হিসেবে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এর পরেই ১৯৮০-র দশকের শুরুতে বিশ্বে তেলের সংকট তৈরি হয়, হু হু করে তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে এবং ঋণের বাজারে সংকট দেখা যায়। এসব সংকটের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বৃহৎ ভুল করা হয়। সামাজিক ক্ষেত্র থেকে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে, লগ্নী সরিয়ে নেওয়া হয়, অবহেলিত হয়। এখনো বহু দেশ এর বিষময় ফল ভুগছে।” কিমাশ্চর্যম! শুনে মনে হয় ২০২০-র ভারতের কথা বলছেন মার্গারেট চান। উল্লেখযোগ্য, এরকম সময় দিয়েই “ইন্টারন্যাশনাল হেলথ” শব্দবন্ধ রূপান্তরিত হল “গ্লোবাল হেলথ”-এ।


    আমাদের দেশে এবং সমগ্র বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো করোনা-কাহিনী স্বাস্থ্য নাগরিকত্বের এই দ্বিত্বতা প্রকট করেছে। ইউরোপ আমেরিকায় একভাবে প্রকটিত, ভারতবর্ষে আরেকভাবে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এর মতো বিশ্ববন্দিত মেডিসিনের জার্নালে আমেরিকায় কালো এবং অন্যান্য গোত্রভুক্ত মানুষের স্বাস্থ্যের সাথে সাদা মানুষদের প্রকট স্বাস্থ্য বৈষম্যকে বলা হয়েছে “স্ট্রাকচারাল রেসিজম” বা সমাজের কাঠামোগত বর্ণবিদ্বেষ। এই জার্নালে প্রকাশিত “Structural Racism, Social Risk Factors, and Covid-19 — A Dangerous Convergence for Black Americans” প্রবন্ধে (২২.০৭.১০১০ বলা হল – “গঠনগত বৈষম্য স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বিভিন্নভাবে। এর মাঝে পড়ে চাকরির সুযোগের রাস্তা অগম্য হয়ে পড়া, অগম্য হয়ে পড়া বাসস্থান এবং শিক্ষার সুযোগ। একইসাথে পরিবেশগতভাবে অসাম্যের শিকার হয়, শিকার হয় নেশার প্রতি আসক্ত হবার। অপ্রতুল স্বাস্থ্য পরিষেবা পায়, দৈহিক ক্ষত এবং মানসিক ট্রমা বা তীব্র আঘাতের শিকার হয়। এগুলোর কারণ রাষ্ট্র অনুমোদিত হিংসা যেমন পুলিসের নৃশংসতা এবং ক্রমাগত সামাজিক বিভাজনের উৎকট স্বরূপ দেখার জন্য। এর পাশাপাশি চলে ক্রমাগত স্বাস্থ্যকর behaviour (আচরণ)-এর পরিবর্তে অস্বাস্থ্যকর behaviour-এর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া (যাকে coping mechanism বলে)।” আমরা এ বর্ণনাকে ভারতের বলে ভাবলেও ভুল কিছু হবেনা হয়তো।


    একই জার্নালে “Politics and Pandemic” শিরোনামের প্রবন্ধে (৬.১২.২০১৮) বলা হয়েছিল – “বিচ্ছিন্ন হবার ঝোঁক (isolationism) এবং তীব্র জাতিবিদ্বেষের (xenophobia) একটা উঁচু হয়ে ওঠা ঢেউ দেখা যাচ্ছে – বহুসংখ্যক উচ্চ আয়ের দেশে যেমন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে। একটি জাতীয়তাবাদী মানসিকতা (mindset) – নেতারা আমাদের বলছেন বিশ্বের ভালোমন্দ আমাদের ব্যাপার নয় এবং ক্রমাগত আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রস্তাব করছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এরকম বিচ্ছিন্নতা এবং সংযোগহীনতা পৃথিবীর সবদেশকেই নিরাপত্তাহীন করে তুলবে, বিশেষ করে অতিমারি প্রতিরোধ ও উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে।” আবারও ভারতের সাথে আবছায়া মিল চলে আসে চিন্তনের ভাঁজে ভাঁজে।


    ল্যান্সেট-এ (এপ্রিল ২, ২০২০) প্রকাশিত হচ্ছে “Why inequality could spread COVID-19”। এ প্রবন্ধে বলা হচ্ছে – “কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে অসমান প্রতিক্রিয়া খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ... কোভিড-১৯-এর পুরো ফলফল এখনো আমাদের দেখা বাকী আছে ... বিশ্ব অর্থনীতি যতবেশি করে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে প্রবেশ করছে সরকারের তরফে ‘bailout’ বা বাঁচিয়ে তোলার প্রোগ্রাম তত বেশি করে প্রাধান্য দিচ্ছে শিল্প ও শিল্পপতিকে। কিন্তু আমাদের অপ্রতুল সম্পদ ব্যবহারের জন্য সে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার যা অসাম্যকে অতিরিক্ত বৃদ্ধি করার পরিবর্তে কমিয়ে আনবে।” 


    এরকম এক প্রেক্ষাপটে মূল করোনা আখ্যানে প্রবেশের আগে আমরা কয়েক দশক আগের আন্তর্জাতিক চিত্র একবার দেখে নেবো, বর্তমান সময়কে বোঝার জন্য। এ ইতিহাসের কয়েকটি মূল বিষয়ে প্রথম থেকেই আমাদের নজরে রাখতে হবে আমাদের বর্তমানের মূল্যায়নেরর জন্য।  


    (১) ১৯৮১ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ কংগ্রেসের ৩৪তম অধিবেশন বসেছিল জেনেভাতে, ৪-২২ মে, ১৯৮১ সালে। সে সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, “আমাদের অবশ্যই অসামান্য আধুনিক হাসপাতাল প্রয়োজন।” তাঁর পরবর্তী বক্তব্যই ছিলো, “স্বাস্থ্যকে মানুষের কাছে পৌঁছুতে হবে। কেন্দ্রাভিমুখী হবার বদলে প্রান্তাভিমুখী হবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা।” আরও বললেন, ”স্বাস্থ্য কোন পণ্য নয় যা পয়সা দিয়ে কেনা যায় কিংবা এটা কোন ‘সার্ভিস’ নয় যা দেওয়া হবে। “এটা জানার, বেঁচে থাকার, কাজে অংশগ্রহণ করার এবং আমাদের অস্তিত্বসম্পন্ন হবার চলমান একটি প্রক্রিয়া”। আরও বলেছিলেন, “আমাদের স্বাস্থ্যসেবা শুরু হবে সেখান থেকে যেখানে মানুষ রয়েছে, সেখান থেকে যেখানে রোগের সমস্যার শুরু”। আধুনিক সময়ের পূর্ণত পণ্যায়িত ঝকমকে, চোখ-ধাঁধানো স্বাস্থ্য পরিষেবার (স্বাস্থ্য নয় কিন্তু, এই ভুল করবেন না) যুগে ৪০ বছর আগের এ উচ্চারণ এবং উপলব্ধি বৈপ্লবিক বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।


    (২) ক্লিনিক্যাল হেলথ তথা ব্যক্তির স্বাস্থ্য এবং পাব্লিক হেলথ তথা জনস্বাস্থ্য এ দুয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক – দুটি আলাদা দর্শনের জগৎ। আমরা আমাদের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ৫-৭ বছর বা তার বেশি সময় ধরে যা শিখি তা হল একজন ব্যক্তি রোগীকে সবচেয়ে ভালোভাবে কি করে চিকিৎসা করা যায়। এখানে জনস্বাস্থ্য বা জনতার স্বাস্থ্য একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে পাস করে বেরনো চিকিৎসক সমাজের মানসিক অবস্থানে এবং সামাজিক দর্শনে ক্লিনিক্যাল হেলথের ছাপ রয়ে যায় কিংবা এ ছাপ রয়ে যায় চিকিৎসকের চেম্বারে অথবা সরকারি কিংবা প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে রোগীর চিকিৎসার মাঝে – এক দুর্মর ছাপ। পাবলিক হেলথ এখানে দুয়োরাণী। একটা উদাহরণ হচ্ছে, এ মুহূর্তে ভারতে ৩০,০০,০০০-এর বেশি মানুষ মারাত্মক এবং মারণান্তক সিলিকোসিস রোগে ভুগছে। এ রোগ আমাদের প্রায় পড়ানো হয়না বললেই চলে। এ রোগ দরিদ্র হবার রোগ, দারিদ্র্যের অভিশাপের রোগ – কৃষিতে সংকুলান না হবার জন্য পেটের দায়ে খাদানের কাজ কিংবা বিভিন্ন ক্রাশার নিয়ে কাজ করার রোগ। ক্লিনিকাল হেলথের শিক্ষা আমাদের কাছে এ রোগকে অদৃশ্য (invisible), অশ্রুত (indiscernible) করে রেখেছে। একে দৃশ্যমানতা বা visibility এবং শ্রুতিসীমা বা discernibility-র স্তরে তুলে আনার প্রচেষ্টা কি আমরা চালাবো? এরকম আরও অনেক রোগের কথা বলা যায়। প্রসঙ্গত, আমেরিকায় অ্যাসেবেস্টোসিস রোগে (সিলিকোসিস ধরনের একটি রোগ) বছরে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ মারা যায়। এ নিয়ে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল (NEJM) পত্রিকায় ১৫ আগস্ট, ২০১৯, সংখ্যায় বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হল “A Most Reckless Proposal – A Plan to Continue Asbestos Use in the United States”। আমরা কবে পারবো এরকম এক পদক্ষেপ নিতে? আমেরিকায় ৪০,০০০ মানুষের জন্য মান্য মেডিক্যাল জার্নালে খবর হয়। আমাদের এখানে করোনার মতো অতিমারিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে অগণন মৃত্যুর মতো ঘটনা ছাড়া এসব “ফালতু” ও “অবান্তর” মৃত্যুগুলো আমাদের গোচরেই আসেনা। কোন পদক্ষেপ তো অনেক কষ্ট-কল্পিত ব্যাপার।


    (৩) প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কোন বিকল্প কোনভাবেই অধুনা ভারত সরকার প্রস্তাবিত Health and Wellness Centre (HWC) হতে পারেনা। ঐতিহাসিকভাবে জনস্বাস্থ্যের আতুর ঘর হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অন্তত ২০০ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনে ও ধাপে এটা প্রমাণিত। এখানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয়, চিকিৎসা হয় মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগীর এবং আরও অনেক অবহেলিত রোগের, যাদেরকে অবহেলাভরে দেওয়া হয়েছে “neglected tropical diseases” বা “গরম দেশের অবহেলিত রোগসমষ্টি”। Do We Care গ্রন্থের সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ লেখিকা সুজাতা রাও বলেন – “একটি হার্ট সার্জারি, কানের একেবারে অন্তর্ভাগে “ইমপ্ল্যান্ট” বসানো কিংবা সিজারিয়ান সেকশনের জন্য অর্থ পাওয়া সহজলভ্য, কিন্তু সহজলভ্য নয় প্রয়োজনীয় এবং একেবারে প্রাথমিক ডায়াগ্নোসিসের জন্য, কিভাবে রোগ প্রতিরোধ করা যায় এ শিক্ষার জন্য, রোগ থেকে সেরে ওঠার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য, বৃদ্ধদের দেখাশোনা এবং যত্নের জন্য, স্কুলে স্বাস্থ্যরক্ষা এবং বয়ঃসন্ধির যত্নের জন্য, অথবা communicable (যেমন ডায়ারিয়া, টিবি, শ্বাসকষ্টের রোগ) কিংবা non-communicable (যেমন ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক) রোগগুলোর যে সরাসরি কারণ (যেমন দূষিত পানীয় জল, দূষিত পরিবেশ বা বায়ু) সেগুলোকে আয়ত্তে আনার জন্য, কিংবা অর্থের জোগান নেই অ্যাক্সিডেন্টের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সামান্য জ্বরের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সাপে কাটা রোগীর জন্য – যে বিষয়গুলো দরিদ্র মানুষের জন্য নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ”। (পৃঃ ২৪-২৫) HWC এখানে নিরুত্তর। আমরা HWC চাইনা, চাই উপযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যা ১৯৪৮-এ “ভোর কমিটি”-র রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক কালে শ্রীনাথ রেড্ডির সুপারিশে যা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। 


    (৪) ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (UHC) এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্য - এই দুটি ধারণার মাঝে ফারাক আছে। UHC-তে ধরে নেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো যে পরিষেবা দেবে মানুষকে তার জন্য মানুষ স্বাস্থ্যের জন্য ইন্সিউরেন্স থেকে টাকা পাবে। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভিত্তিই ছিলো “equitable access to basic health services” অর্থাৎ, স্বাস্থ্যের বুনিয়াদি সুযোগের জন্য সবার সমান প্রবেশাধিকার থাকবে। এবং এর জন্য ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র, রোগীকে কোন ব্যয় বহন করতে হবেনা। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য কি সরকারি বা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের আওতায় আসবে? হাঙ্গরের মতো হাঁ করে রয়েছে বহুজাতিক ইন্সিউরেন্স কোম্পানিগুলো। একবার যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষার রাষ্ট্রীয় কবচ সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে সরকারের তরফে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি ইন্সিউরেন্সের কথা বলা হলেও শেষ অব্দি তা বেসরকারি ইন্সিউরেন্সের হাতেই চলে যাবে। 


    ল্যান্সেট-এ ২৪ আগস্ট, ২০১৯-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ জানাচ্ছে – ২০১৮-তে সবচেয়ে বেশি রেভেন্যু দেয় এরকম ১০০টি সংস্থার মধ্যে ৬৯টি হল কর্পোরেট সংস্থা, ৩১টি সরকারি সংস্থা। (“From primary health care to universal health coverage – one step forward and two steps back”, Lancet, August 24, 2019, pp. 619-621) পূর্বোক্ত প্রবন্ধে দুটি মনোযোগ দেবার মতো পর্যবেক্ষণ আছে – “UHC, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিপরীতে, রোগের ক্ষেত্রে যেগুলো সামাজিকভাবে নির্ধারণ করে সেই “social determinants of health” এবং কমিউনিটি অংশগ্রহণের ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে থাকে”। এবং ”কেয়ার” বা যত্নের পরিবর্তে “কভারেজ” (coverage) এই শব্দটি স্বাস্থ্যের সীমায়িত পরিসর বোঝায়, এবং বোঝায় যে একটি ইন্সিরেন্স স্কিমে কতগুলো নাম (সবার নাম নয়) তালিকাভুক্ত হবে। আরও বিপজ্জনক হল UHC-র ইন্সিউরেন্স-নির্ভর মডেলকে প্রোমোট করা হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য কম অর্থ বরাদ্দ এবং অন্যান্য জনস্বাস্থ্যের প্রোগ্রামকে আর্থিকভাবে বঞ্চিত করে”। প্রসঙ্গত মনে রাখবো ভারতের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় এত ঢক্কানিনাদের পরেও জিডিপি-র ১-১.৫%-এর মধ্যে। ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটির বেশি। এবার মাথাপিছু গড় ব্যয় কতো হিসেব করুন। শুধুমাত্র চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে প্রতি বছর গড়ে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায় – এ সংখ্যা ইংল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার প্রায় কাছাকাছি। (National Health Policy 2017, 2015)


    (৫) বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (WHO) এবং ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে ১৯৭৮-এর আলমা-আটার ঘোষণাপত্রে হু-র তরফে হ্যাফডান ম্যালারের অধিনায়কত্বে স্পষ্টত “New International Economic Order (NIEO)”-এর ধারণা উচ্চারিত হয়েছিলো। দেশের সম্পদ বিতরণের ব্যাপারেও সেখানে আলোচনা হয়েছিলো। পৃথিবীর ১৩০টির বেশি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেসব দেশে, অর্থাৎ পৃথিবীর এক বড়ো সংখ্যক দেশে, এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে মেডিক্যাল সিলেবাসও তৈরি হচ্ছিলো। সহজেই বোঝা যায়, দৃষ্টিকোণ এবং পরিস্থিতি বদলের সাথে সাথে মেডিক্যাল সিলেবাস এবং শিক্ষার ধরণও বদলে যাবে। আলমা-আটার ঘোষণাপত্রকে কোন কোন গবেষক স্বাস্থ্যের জগতে Magna Carta-র সাথে তুলনা করেছেন (Magna Carta for health)। ১৯৮০-র দশক থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মন্দা এবং নিওলিবারাল অর্থনীতির উত্থানের ফলে হু কোণঠাসা অবস্থানে চলে যেতে লাগলো। ইংল্যান্ডের থ্যাচার এবং আমেরিকার রেগান হু-কে হুমকি পর্যন্ত দিতে শুরু করে। হু-কে দেওয়া এদের অনুদান প্রায় বন্ধ করে দেয়। হু-র অপরাধ হল ১৯৭৭-এ “এসেনশিয়াল মেডিসিনস প্রোগ্রাম” নেয় যেখানে জেনেরিক ড্রাগস (দামী ব্র্যান্ডের পরিবর্তে) ব্যবহার করার বিধান দেওয়া হয়। প্রত্যাশিতভাবেই দানবীয় বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো এর প্রবল বিরোধিতা করে। ১৯৮১ সালে আবার এক বিপত্তি ঘটালো হু – International Code for Marketing Breast Milk Substitutes-এর নীতি নিল! মায়ের বুকের দুধের বদলে বেবি ফুডের প্রচারক ও উৎপাদক নেসলের মতো কোম্পানির (যে একটি মাঝারি সাইজের মধ্যবিত্ত দেশ কিনে রাখার ক্ষমতা রাখে) রোষানলে পড়লো, এদের সঙ্গী হিসেবে রইলো এদের দ্বারা প্রভাবিত আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো।  একটি গবেষণাপত্র (“(Re-)Making a People’s WHO”,  প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ পত্রিকায় জুলাই ১৬, ২০২০, সংখ্যায়) অনুযায়ী যেসব দেশ হু-র পরামর্শ শুনেছে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে জোর দিয়েছে তারা তুলনায় কোভিড-১৯ আক্রমণে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – যেমন, জার্মানি, ভিয়েতনাম, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ফিনল্যান্ড। আর এ দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ড তো এখন কোভিড মুক্ত।


    নিওলিবারাল অর্থনীতি, অতিবৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা, নিওলিবারাল অর্থনীতির বাহক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এবং পৃথিবীর বড়ো রাষ্ট্রগুলোর চাপে হু নিজের অবস্থান বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। “সকলের জন্য স্বাস্থ্য”, “স্বাস্থ্য আমার অধিকার” এবং “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা”-র ধারণা ১৯৭৮ থেকেই নিঃসাড়ে বদলাতে শুরু করে। প্রথমে আসে “সিলেক্টিভ প্রাইমারি হেলথ কেয়ার (বেছে নেওয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা)”, তারপরে এলো GOBI (growth monitoring, promotion of oral rehydration, promotion of breast feeding, immunization) এবং পরবর্তীতে খুব খোলাখুলি ভার্টিকাল বা রোগ-কেন্দ্রিক প্রোগ্রাম। কমিউনিটির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি জীবন্ত ও সক্রিয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রোগ্রাম পরিত্যক্ত হল। এর বিষময় ফল আমরা এই অতিমারির সময়ে প্রত্যক্ষ করছি। ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (এপ্রিল ৭, ২০১৮) “WHOse health agenda? 70 years of struggle over WHO’s mandate”-এ বলা হল – “The 1990s heralded a defanging (বিষ দাঁত ভেঙ্গে দেওয়া) of WHO. The international health field was transmogrified into global health, whose “shared” agenda opened the floodgates to business.” আজকের ২০০-র বেশি দেশ আক্রান্ত হবার পরেও জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে – “opened floodgates to business” (ব্যবসার বাঁধ খুলে দেওয়া)-এর ফলে কে বেশি লাভ করবে। 


    আমরা বিলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি করোনা বা কোভিড-১৯ কেবলমাত্র একটি রোগ না থেকে এর নিজস্ব বায়োলজিকে অতিক্রম করে পৌঁছে গিয়েছে নিওলিবারাল অর্থনীতির ভূমিতে, রাজনৈতিক রেষারেষিতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে “অপর” নির্মাণে, মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল-স্টেট-পলিটিক্স কমপ্লেক্সের নতুন ব্যঞ্জনায়। এসবকিছুর ভরকেন্দ্রে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণ।


    এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে প্রসঙ্গে প্রবেশ করা যাক। ২১ নভেম্বর, ২০১৮-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে-এ প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের শিরোনাম – “Disease and Famine as Weapons of War in Yemen”। প্রবন্ধটি শুরু হচ্ছে এভাবে – How can the medical community take stock of the humanitarian disaster in Yemen? কিভাবে পৃথিবীর মেডিক্যাল সমাজ ইয়েমেনে যে মানবিক বিপর্যয় চলছে তার বিবেচনা করবে? 


    NEJM-এর লেখাটিতে ফিরে আসি। লেখার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমরা জানছি ২০১৮-র অগাস্ট মাসে একটি স্কুল বাসের ওপরে সামরিক বিমান হানায় ৫০ জনেরও বেশি খুদে স্কুল ছাত্র মারা গিয়েছে। কিন্তু “woefully underreported relative to the magnitude of the ongoing crisis” – বর্তমানে যে পরিমাপের সংকট চলছে তার তুলনায় করুণভাবে এ নিয়ে প্রায় কোন রিপোর্ট নেই। এরপরে প্রবন্ধে একটি অমোঘ মন্তব্য রয়েছে – “এরকম অবহেলা আমাদের সামগ্রিক সংবেদনশীলতা যে বিবশ হয়ে পড়েছে (numbing of our collective sensitivity) তা বড়ো দগদগে করে দেখায়।” কোথায় রাখবো আমরা মানবাত্মার এবং আমাদের মরমী অস্তিত্ব ভুলুন্ঠিত হবার অপমান? একই ঘটনা কয়েক বছরের মধ্যে আমরা ইরাকে দেখেছি, দেখেছি সিরিয়াতে, দেখেছি আফগানিস্তানে। আমাদের যাপনে আর চৈতন্যে এভাবে হয়তো কষাঘাত করেনি – পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন!


    ৭ জানুয়ারি, ২০১৭-তে ল্যান্সেটে প্রকাশিত “Malnutrition in Yemen: an invisible crisis” শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে আমরা জানছি – ১ কোটি ৪৪ লক্ষ মানুষ মারাত্মকভাবে খিদের অসুখ অপুষ্টিতে ভুগছে, ৩৭০,০০০ ইয়েমেনি শিশু ভয়ঙ্কর অপুষ্টিতে আক্রান্ত। ইউনিসেফ-এর হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি (সঠিক হিসেব ৯৯০,০০০০) শিশুর কোন না কোনরকম “nutrition assistance” প্রয়োজন। ইয়েমেন খাদ্যের মূল্য বেড়েছে ৫৫%, জিডিপি-র সংকোচন হয়েছে ৩৩%। ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭-এ ল্যান্সেটে প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধ – “Millions in need of humanitarian assistance in Yemen” – খুব স্পষ্ট করে জানালো – “The Saudi-led coalition, which has received logistical and intelligence support from the UK, the USA, and France, closed air, land, and sea access on Nov 6”। একটি ক্ষুদ্র দেশকে সমস্ত দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে কেবলমাত্র উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য। সমস্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, রোগ-মোকাবিলার প্রক্রিয়া এবং মাধ্যম, জলের ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবার ফলে প্রতি ১০ মিনিটে একজন করে শিশু মারা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ  এবং জ্বালানি সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবার আরো কিছু ধারাবাহিক ফলাফল আছে – (১) হাসপাতালে জেনেরাটর চালানো যাচ্ছেনা, (২) কোন আইসিইউ বা ইমার্জেন্সি ব্যবস্থা চালানো যাচ্ছেনা, (৩) ভ্যাক্সিন এবং ওষুধ সরবারাহের জন্য যে cold chain দরকার তা রক্ষা করা যাচ্ছেনা। এর দরুণ কোন প্রতিষেধক টীকা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখানে জোর দিয়ে উল্লেখ করতে করোনা অতিমারি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতাকে এমন নগ্নভাবে প্রকট করেছে যে রুটিন টীকা দেওয়ার যে কর্মসূচী তা স্থগিত আছে, করোনার ধাক্কায় ক্রনিক অসুখে অনান্য রোগীরা চিকিৎসার নিয়মিত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।


    এখানে আবার আমাদের সৌভাগ্যজনকভাবে মনে পড়তে পারে হ্যাফডান ম্যালারের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে আলমা-আটা-য় গ্রহণ করা “Declaration of Alma-Ata – International Conference on Primary Health Care”-এর কথা যেখানে প্রথমবারের জন্য আক্ষরিক অর্থে একটি বিশাল আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হল বিশ্ববাসীর সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা (comprehensive primary health care) সুনিশ্চিত করার কথা এবং সে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র শ্লোগান গৃহীত হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণভাবে, আলমা-আটা সনদের ১০ নম্বর ধারায় যা বলা হয়েছিল তার মূল কথা ছিল – পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের স্বাস্থ্যের সুযোগহীন মানুষটির জন্যও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুরক্ষিত করতে হবে। এবং এজন্য যুদ্ধ ও যুদ্ধাস্ত্রের পরিবর্তে স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে যার মধ্য দিয়ে একটি দেশের সুষম বিকাশের জন্য আরো বেশি মানবসম্পদ সৃষ্টি হতে পারে। 


    ১৯৫০-৭০-র দশক জুড়ে বিশ্বরাজনীতিতে দ্বিমেরু বিশ্বের জীবন্ত উপস্থিতি ছিল। প্রবল পরাক্রান্ত, আগ্রাসী ও মুক্ত পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো ভিন্ন একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব – সমাজতান্ত্রিক বলে যার উপস্থিতি ছিল জনমানসে। দ্বিমেরু বিশ্বের উপস্থিতির জন্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক একটি পরিসর তৈরি হয়েছিল যাকে বলতে পারি “তৃতীয় পরিসর”। বিশ্বের মানুষের স্বাভাবিক আশা-আকাঞ্খা এবং দাবী নিয়ে দর কষাকষির ক্ষমতা বেশি ছিল। পরবর্তীতে একমেরু বিশ্বের উদ্ভব এসবকিছুকে পরিপূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দেয় – আজকের ভারত এর একটি প্রোজ্জ্বলন্ত উদাহরণ। এ সময়েই পৃথিবী জুড়ে শ্লোগান উঠেছিল – স্বাস্থ্য আমার অধিকার।


    এরকম একটা প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে আজকের করোনা অতিমারি যে বিশ্ব পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে তা অনুধাবন করতে অসুবিধে হবেনা আশা করি।  ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (জুন ১৫, ২০২০) একটি প্রবন্ধে (“COVID-19: rethinking risk”) যা বলা হল তার মূল কথা – করোনা অতিমারিতেও সবাই একইরকমভাবে আক্রান্ত হবেনা। যাদের ক্ষেত্রে রোগের সামাজিকভাবে নির্ধারক শক্তিগুলো (social determinants) সঠিকভাবে ফলপ্রসূ হয়না – যেমন, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণী বা যারা চাকরি, বাসস্থান, খাদ্য এধরনের সামাজিক সুযোগ-সুবিধের ক্ষেত্রে বঞ্চিত – তাদের মধ্যে এ রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যাবে। পৃথিবী জুড়ে হয়েছেও তাই। আমেরিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার মতো দেশগুলোতে সর্বত্র একই চিত্র।


    করোনা অতিমারির সময়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার মানুষের দৃষ্টিপথ (visibility), শ্রুতি (discernibility) এবং ভাবনার ক্ষেত্রপথের একেবারে বাইরে চলে যাচ্ছে। অতি উচ্চ মুল্যের আইসিইউ পরিষেবা, উচ্চচাপের অক্সিজেনের ব্যবস্থা, ECMO ইত্যাদি জন মানসিকতায় ক্রমশ গ্রাহ্য হয়ে উঠছে, মান্যতা পাচ্ছে। মনে ক্ষোভ পুষে রেখেও সাধারণভাবে মানুষ চাইছে বেশি দামের রেমডেসিভিরের চিকিৎসা – নিতান্ত কমদামের এবং একমাত্র “improved survival” ঘটাতে পারে ডেক্সোমেথাসোনের চিকিৎসা নয়। চিকিৎসকেরাও এই সোশ্যাল সাইকি বা গণমানসিকতার বশে থাকছেন। বাজারের, মিডিয়ার এবং বিজ্ঞাপনের দুর্দমনীয় শক্তি উভয়কেই নিয়ন্ত্রিত এবং প্রভাবিত করছে। ফলে চিকিৎসা আরও বেশি করে হাই-টেক হয়ে উঠছে, ভার্টিকাল প্রোগ্রামের দিকে ঝুঁকছে। এবং ক্রমাগত ঝুঁকবে কেবলমাত্র রোগ-কেন্দ্রিক প্রোগ্রামের দিকে, সামাজিক স্বাস্থ্য বা পাব্লিক হেলথের দিকে নয়।


    আমাদের পরবর্তী আলোচনা জুড়ে করোনা অতিমারি-উত্তর পৃথিবীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা, রাজনৈতিক বিন্যাস, অর্থনৈতিক চিত্র এবং কর্পোরেট পুঁজির সম্ভাব্য পরিবর্তন হতে যাচ্ছে তা আমরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। বুঝতে চাইবো কিভাবে বিশ্বজোড়া মুনাফার উদগ্র বাসনা করোনা ভাইরাস বাসস্থান বদলে মানুষের তার নতুন ঠিকানা হিসেবে পেয়েছে। বুঝতে চাইবো কেন এ ভাইরাস এবং এ ধরনের ভাইরাস থেকে আমাদের মুক্তি নেই। কর্পোরেট বিশ্ব প্যান্ডোরাস বক্সের ঢাকনা খুলে দিয়েছে। 


    আমরা আবার একটু পেছন ফিরে ইতিহাসের দিকে তাকালে স্মরণ করতে পারবো গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে কর্পোরেট বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক পুঁজি পরস্পর-সংযুক্ত একটি পণ্য শৃঙ্খল (commodity chain) গড়ে তুলতে থাকে। এর শৃঙ্খলের মধ্যে উৎপাদন অঞ্চলকে (যাদের অবস্থান প্রধানত দক্ষিণ গোলার্ধে) জুড়ে ফেলা হয় যেখানে পণ্য ভোগের, লগ্নীর এবং পুঁজির সঞ্চয়ের পরিমাণ সবচেয়ে শিখরে সেই উত্তর গোলার্ধের ‘প্রভু’ দেশগুলোর সাথে। বেলামি ফস্টারের ধারণানুযায়ী (“COVID-19 and Catastrophic Capitalism” – Monthly Review, ১.০৬.২০২০), এরকম ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ শুধু “global labor arbitrage” থেকে নয়, “global land arbitrage” থেকেও হয়। এবং জমি এবং প্রকৃতিকে উন্মত্তের মতো ব্যবহার করা বিভিন্ন জুনোটিক রোগ (অর্থাৎ, প্রাণী দেহে বাস করা ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া) মানুষের বসবাসের অঞ্চলে এবং মানুষের শরীরের মধ্যে বাসা বাঁধছে – অ্যান্থ্রোপোজুনোটিক হয়ে উঠছে। 


    এর অর্থ হল – (১) যে নতুন, সর্বশক্তিমান এবং সমগ্র বিশ্বব্যাপী পণ্য শৃঙ্খল গড়ে উঠছে সেটা অতিমারির চালক হিসেবে কাজ করছে, (২) প্রাথমিকভাবে বিক্ষিপ্ত কিছু অঞ্চলে জন্ম নিলেও পণ্যের বাজারের চলনের নিয়মে (যেখানে ট্যুরিজমও একটি পণ্য) ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বজুড়ে (করোনায় এখন ২১৫টি দেশ আক্রান্ত), (৩) পুঁজির নিজস্ব গঠনেই বারেবারে অতিমারির সৃষ্টি হবে, (৪) আন্তর্জাতিক “অ্যাগ্রোবিজনেস” বা কৃষিপণ্যের ব্যবসা পৃথিবীর প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের জমি, বাস্তুতন্ত্র এবং জনজীবনকে বেঁধে ফেলেছে, ধ্বস্ত করেছে।


    আমাদেরকে শিখে নিতে হবে ভাইরাসের সাথে সহবাস করার কৃৎ-কৌশল এবং মানসিক প্রস্তুতি। সুবিখ্যাত নেচার পত্রিকায় (৬.০৮.২০২০) “The Pandemic’s Future” শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সে প্রবন্ধের শুরুতে বলা হচ্ছে – “জুন ২০২১। সমগ্র বিশ্ব দেড় বছরের বেশি সময় ধরে অতিমারি-কালের মধ্যে রয়েছে। ভাইরাসটি ধীর লয়ে ছড়াচ্ছে। মাঝেমাঝেই লকডাউনের মধ্যে থাকা মানুষের জীবনের “নতুন স্বাভাবিকতা (new normal)”। নতু্ন অনুমোদিত ভ্যাক্সিন ৬ মাস প্রতিরক্ষা দেয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তির ফলে এর সরবরাহ ধীর গতিতে হচ্ছে। ২.৫ কোটি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে এবং ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে।” 


    এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল – মুম্বাইয়ের ধারাভির মতো বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণ মানুষ রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। এরা নিজেরাই কনটেইনমেন্ট জোন তৈরি করেছে, সংক্রমিতদের আলাদা করেছে এবং তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহের ক্ষেত্রে যা করার করেছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সরকারি তরফে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় যে চিকিৎসকেরা ছিলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা ছিলেন তারা এগিয়ে এসেছেন।


    এগুলো তো প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার অঙ্গ। সেটা ভেঙ্গেচুড়ে গিয়েছে বলে মানুষ উদ্যোগ নিয়ে রোগ ঠেকাচ্ছে। এজন্য করোনা অতিমারির সময়েও মাথায় রাখতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, social determinants of health এবং Sustainable Development Goals-এর মতো অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে, সক্রিয় ও জীবন্ত রাখতে না পারলে আগামী অতিমারির সংক্রমণ কিছুতেই সফলভাবে ঠেকানো সম্ভব নয়।


    প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে জোর দিয়েই নিউজিল্যান্ড এই মুহূর্তে করোনা মুক্ত। থাইল্যান্ড বা চিন নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে সংক্রমণকে।


    এরকম সংকটের সময়ে নজরে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সাধারণ মানুষের তরফে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনেতাদের ওপরে ট্রাস্ট বা বিশ্বাস। এবং এই বিশ্বাসের ভিত্তি হয় সরকারের তরফে স্বচ্ছতাকে নিশ্চিত করা। এই মুহূর্তে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এবং ভারতবর্ষে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার একেবারে গোড়ার যে কাজগুলো সেগুলো বন্ধ হয়েছে বা থমকে আছে। এগুলোর মধ্যে পড়ে সার্বজনীন টীকাকরণ, যেগুলোকে “নেগলেকটেড ট্রপিকাল ডিজিজেজ” বা অবহেলিত গ্রীষ্মকালীন দেশের রোগ বলা হয়, যেমন ম্যালেরিয়া, টিবি বা শিশুদের ডায়ারিয়া এবং গর্ভবতী মায়েদের যত্ন নেবার জন্য যে সমস্ত প্রোগ্রাম আছে। 


    পারস্পরিক এই বিশ্বাস, স্বচ্ছতা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জীবন্ত ও বেগবান রাখার ফলে আরেকবার বলবো নিউজিল্যান্ড করোনা মুক্ত হতে পেরেছে। বর্তমান করোনা সংকটের সময়ে আমেরিকার মতো দেশে (যেখানে জিডিপি-র প্রায় ১৫% স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়, অথচ মানুষ অসুখী স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় এবং প্রাইভেট ইন্সিউরেন্সের একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য) এখন আবার প্রাথমিক স্বাস্থ্যের দিকে ফিরে তাকানোর কথা উঠে আসছে। “স্ট্রাকচারাল রেসিজম” তথা কাঠামোগত বর্ণবিদ্বেষ-এর জন্য দেখা যাচ্ছে প্রিভেন্টিভ কেয়ার এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যের নতুন উদ্বোধন ছাড়া গণ অসন্তোষকে সামাল দেওয়াও মুশকিলের কাজ। হাজার হোক ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে একটি প্রাণবন্ত নাগরিক পরিসর তথা সিভিল স্পেস রয়েছে (যা ভারতে দ্রুত অপসৃয়মান)। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর “Covid-19 and the Mandate to redefine Preventive Care” প্রতিবেদনে (অক্টোবর ১৫, ২০২০) বলা হচ্ছে – “A large-scale shift to a population-based prevention strategy is long overdue. The Covid-19 pandemic is delaying life-saving preventive screening for millions of patients, and our health system will struggle to catch up. Perhaps this crisis will be the impetus for change.”


    নেচার-এর মতো পত্রিকায় (১৩.০৮.২০২০) বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে “এইডস, ম্যালেরিয়া অ্যন্ড টিউবারকিউলোসিস আর সার্জিং”, অর্থাৎ এইডস, ম্যালেরিয়া এবং টিউবারকিউলোসিস প্রবল গতিতে বাড়ছে। এখানে এখনো অব্দি করোনা-প্রতিরোধী ভ্যাক্সিনের হিসেব দেওয়া যায়। কিন্তু শুধু ভ্যাক্সিন এর উত্তর নয়। বিপরীতে, ভ্যাক্সিন কুহকী আত্মসন্তোষের জন্ম দিতে পারে – মাস্কের ব্যবহার, ব্যক্তিগত/সামাজিক দূরত্ব বিধি, হাঁচি-কাশির ক্ষেত্রে সতর্কতা শিকেয় উঠে যেতে পারে। তখন সামাজিকভাবে আরেক দুর্দৈবের সম্মুখীন হবো আমরা। মনে রাখা দরকার, এই ভাইরাস চলে যাবার জন্য আসেনি। এর জ্ঞাতিগুষ্টিরা অপেক্ষা করে আছে মানুষের শরীরে প্রবেশের জন্য, এবং সবাই সম্ভাব্য সংক্রমণের শিকার হয়ে আছে।


    এই মুহূর্তে ভ্যাক্সিনের ধাপগুলো যে অবস্থায় আছে – Pre-clinical – 190+ vaccines are being tested in animals and lab experiments। Phase 1 – 15 vaccines are being tested in a small number of healthy, young people to assess safety and correct dose। Phase 2 – 14 vaccines are broadened to a larger group of people, including people at higher risk of illness। Phase 3 – 10 vaccines are being tested in thousands of people to check their effectiveness and safety । এবং Authorized – 1 vaccine has been determined to provide benefits that outweigh known and potential risks।


    নেচার-এর আলোচিত প্রবন্ধের পর্যবেক্ষণে – “তিন মাসের বেশি সময় ধরে লকডাউন অসংখ্য মানুষকে নন-কোভিড বা কোভিড নয় এমন রোগীরা সাধারণ চিকিৎসার কাছে পৌঁছুতে পারেনি, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একইসাথে নতুন রোগীদের উপসর্গ চিহ্নিতই হয়নি। ফলে চিকিৎসার প্রসঙ্গ আসেনা।” এদের হিসেবে চিন, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে ২০২০ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ২০০,০০০ অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটবে, সাব-সাহারা আফ্রিকায় ২০২০-তে ৭৭৯,০০০ জন মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।” ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত “Has COVID-19 subverted global health” প্রবন্ধে (৩০.০৫.২০২০) রিচার্ড হর্টন বলছেন – “দীর্ঘকালীন এবং সর্বব্যাপী লকডাউনের পলিসি এবং উচ্চ-প্রযুক্তির স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে জোর অনিচ্ছাকৃতভাবে আরও বেশি অসুস্থতা এবং মৃত্যুর জন্ম দিতে পারে, বিষমভাবে দরিদ্রদের ক্ষতিগ্রস্ত করে।” (এ প্রবন্ধটি নিয়ে পরেও আলোচনা হয়েছে)


    এই মানুষগুলোকে কে বাঁচাবে? একমাত্র সক্রিয় ও জীবন্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এদের বাঁচাতে পারে। যদি এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা না যায় তাহলে কোভিডে যত মানুষের মৃত্যু হবে তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হবে এ রোগগুলোর জন্য। নেচার-এর উল্লেখিত প্রবন্ধের শেষে মন্তব্য করা হয়েছে – “কোভিড-১৯ সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিয়েছে কয়েক বছরের জন্যতো বটেই, এমনকি কয়েক দশকও হতে পারে।” বলা হয়েছে – “একটি সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে (পড়ুন কোভিড) মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে আরেক সংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ মারা যাচ্ছে সেটা হল এমন এক শেষ হিসেব যা মানুষ কখনো চায়না।”


    কে দেবে এর উত্তর? রাষ্ট্র, রাজনৈতিক নেতারা কিংবা আক্রান্ত জনসাধারণ? সময় এবং ইতিহাস সেকথা বলবে। আসুন, আমরা প্রহর গণি এক “ফুটন্ত সকাল”-এর প্রতীক্ষায়!


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২১ ডিসেম্বর ২০২০ | ৬২০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • অরিন | 161.65.***.*** | ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:৫২101344
  • জয়ন্তদা, 


    স্বাস্থ্য আর রোগের চিকিৎসা সমার্থক নয়। স্বাস্থ্যের যেমন সামাজিক নির্ণায়ক রয়েছে, অসুখেরও তেমনি সামাজিক নির্ণায়ক রয়েছে। আমরা ডাক্তারি পড়ার সময় বা প্র্যাকটিস করার কালে রোগের নির্ণয় ও নিদানের বন্দোবস্ত করি,  মেডিকেল কলেজগুলোতে স্বাস্থ্য বা জনস্বাস্থ্য নিয়ে জোর দেওয়া হয় না। ডাকতারির জনস্বাস্থ্য প্রিভেনটিভ মেডিসিন। 


    বেশ চলছিল। সব সমস্যার সমাধান ওষুধ কাটাছেঁড়া আর টীকা দিয়ে করে ফেলা যায়, মানুষের কি কারণে সমাজ অস্বাস্থ্যের উৎপত্তি এইসব নিয়ে ভাবার কথা কেউ বিশেষ ভাবেনি (তোমার প্রবন্ধ পড়ে যাঁরা কমেন্ট করেন, তাঁদের সমবেত বিস্ময় দেখলে ও ব্যাপারটা বোঝা যায়) । মুশকিল হল, করোনাভাই এসে সব গোলমাল করে দিল।  এই নিয়ে অবিশ্যি তুমি বিস্তর লিখেছ।


    অবশ্য এই তো ভ্যাকসিন এসে গেছে, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই না?

  • সুদেব সাহা | 117.2.***.*** | ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৯101354
  • লেখাটি  আমার  ভীষণ  ভালো  লেগেছে । জটিল  বিষয়ের  সহজ - সরল উপস্থাপনা , বুঝতে কোনো  অসুবিধা  হয়নি । এই  শিকড়সন্ধানী  লেখাতে , লেখক আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে   বহু  গুরুত্বপূর্ণ  তথ্য দিয়ে সমস্যার গভীরে পৌঁছে দিয়েছেন । এ যেন একটা একটা করে যুক্তির স্তর উন্মোচন । একসময় মনে হল লেখাটা আমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল ।

  • সুচন্দ্রা অধিকারী চক্রবর্তী | 2402:3a80:1f03:d634:a14f:e6ec:d3a4:***:*** | ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৫৮101374
  • অনেক অজানা তথ‍্য জানতে,বুঝতে পারলাম।খুব ভালোলাগলো।

  • ভাস্কর ভট্টাচার্য | 117.2.***.*** | ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ১৭:২৬101389
  • আজ দ্বিতীয়বার পড়লাম, নিজের বোধগম্যতা অর্জনের জন্য। উপস্থাপনা প্রাঞ্জল,  কিন্তু বিষয়-গভীরতার জন্যই কিছুদূর এগিয়ে গিয়েও  ফিরতি   যাত্রাা করতে হয়।লেখাটা সমস্যার মূূল ধরে নাড়িয়ে দিয়েছে। 


    একটা জিজ্ঞাস্য- করোনাভাই ( শব্দটা অরিনবাবুর   সৌজন্যে প্রাপ্ত) এর   rush তো অনেক বছর  থেকেই, তাহলে গবেষণা শুরুুটাও বহুদিনের। সেক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন কি  স্বল্প  সময়ে  বেরোচ্ছে? 

  • Arin | 223.233.***.*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ১৫:৫৫101412
  • পড়লাম , ভাল্লাগলো কিন্তু আমি ভ্যাকসিনে বিশ্বাস করিনা , নিউ নরমাল নাটকও মানি না , আমার কাছে এগুলি ফালতু 

  • Dola sen | 117.203.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ১৭:১৬101433
  • তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। অত্যন্ত সরল ও স্পষ্টভাষে বলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো যারা বুঝবে তাদের অধিকাংশই (including me),  এভাবেই মরতে হবে বলে রোজকার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। 

  • আশিস সরকার | 2409:4061:2e46:d397::a78a:***:*** | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ ১০:৩৮102192
  • অসাধারণ উপস্থাপনা। এত তথ্য। লেখাটার উপযোগিতা অনস্বীকার্য। ভ্যাকসিন কি সেই বিশল্যকরনী। ভ্যাকসিনের পাশাপাশি এও প্রচার চলছে যে একই রকম সাবধানতাকে মান্যতা দিয়েই নাকি জীবন যাপন করতে হবে। তাহলে? 

  • Soumya Chakraborty | 202.142.***.*** | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৯:২২102328
  • খুব ভালো লেখা স্যার . সকল বিষয়বস্তু খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করা হয়েছে 

  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন