এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  কূটকচালি

  • পোনু-মনুসংহিতা

    প্রণব কুমার দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    কূটকচালি | ২৮ মে ২০১২ | ২০০৭ বার পঠিত
  • [ বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যাযের [ব-ভ-ম] এক মানসপুত্র ছিল, তার নাম পোনু। সে তার সুখদুঃখের খবর যুক্তাক্ষরবর্জিত ভাষায় ভগবানকে জানিয়ে প্রাণঘাতী সব চিঠি লিখতো। বহুদিন পর আর এক পোনুর দেখা পাওয়া গেল, লেখক হবার সাধ আছে বোধহয়, তাই লেখকদের ভগবান, অর্থাৎ সম্পাদককে তেমনি প্রাণঘাতী চিঠি লেখে। যদি সেই পোনুই হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে যে যুক্তাক্ষরটা সে মোটামুটি আয়ত্ত করেছে, যদিও মনের বয়স সময়ের সঙ্গে তাল রেখে বাড়াতে পেরেছে বলে মনে হয় না। কে জানে আবার সেই পোনু নাও হতে পারে। ]

    এই যে অবসরপ্রাপ্ত স্যারঃ

    অনেকদিন খবর না পেয়ে ভেবেছেন হাড়ে বাতাস লাগলো, ছোকরা হয় জেলে গেছে নয় পাওনাদার এড়াতে নিরুদ্দেশ। স্যার অতো চট করে আমাদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না। কোথায় ছিলাম, কী করছিলাম পরে বলছি, আগে আপনার খবর বলুন। চুটিয়ে মহাভারত থেকে চটি গল্প ছাপছেন জ্ঞানালোক বিতরণের ভান করে, ওসব কী স্যার আজকাল কেউ পড়ে, না পড়বে। এখন হোলো তাৎক্ষণিক তৃপ্তির কাল, ইন্‌স্‌ট্যাণ্ট গ্র্যাটিফিকেশন, এখন চতুর্দশ পুরুষ আগে দেবতা থেকে ঋষি, ঋষি থেকে মানুষ পর্যন্ত কী কী বাঁদরামো করেছিল, তা জানার সময় আছে কার? তাছাড়া এই যে সব লিখছেন, একবার নিজে পড়ে দেখেছেন, ওভি বিদ্যেসাগরী বাংলা আজ কজন বুঝবে মশায়, পার্টিকুলারলি বাংলা সেন্‌টেন্সে ইংলিশ ওয়ার্ড ইউজ করে করেই আমরা যারা ব্রট আপ, য়্যাঁ? কেবল ভস্‌সে ঘি ঢেলে যাচ্ছেন।

    আমি বলি কী, যদি একান্তই এন্‌সাইক্লোপিডিয়া সাইট বানাতে হয় তবে মনুসংহিতা ছাপুন। কী বললেন, মনুসংহিতার নাম শোনেননি। খাঁটি হিন্দু বলে বড়াই করেন, সারা বছর গোরু খেয়ে একদিন উপোস করে পুজোতে গিয়ে পুরুতের ভুল উচ্চারণের ভুল সংস্কৃতে গলা মিলিয়ে অঞ্জলি দিয়ে ভাবেন অক্ষয় স্বর্গবাস হস্তামলক, আপনাদের পক্ষে সব সম্ভব। কিছু না হোক, এই যে পুরুত ঝট্‌পট্‌ বলে দিচ্ছে দশ পেগ মাল খেয়েছো, তবে প্রাচিত্তির করো পাঁচশো টাকা ফেলে, বিষ্যুৎবার বেগুন খেয়োনা, কাজের লোকের মাইনের টাকা মেরে দাও তাতে কিছু পাপ নেই, ওরা তো শুদ্দুর, ইত্যাদি, ইত্যাদি এবং এই যে সব শেয়ালের একই রা, এসব এরা কোত্থেকে পাচ্ছে মশায়। সব এই মনু থেকে, সংহিতা বলুন, শাস্তরই বলুন। ওঃ, সে কী সাঙ্ঘাতিক বই রে মশায়, 'সব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত'। সব পাপের এবং তার সাজারও লিস্টি দেওয়া আছে। আরে মশায় আমার ডুব মারার কারণ তো এই বই। কী কুক্ষণে যে হাত দিয়েছিলাম, পড়ে আমার সেই শিব্রাম্‌ চক্‌রবর্‌তীর দশা, সেই যে মশায়, মেটিরিয়া মেডিকা পড়ে ভদ্রলোক আবিষ্কার করলেন যে তিনি পৃথিবীর সমস্ত রোগের লক্ষণের ডিপো হয়ে বসে আছেন, এতৎসত্তেও কী করে বেঁচে আছেন, সেই চিন্তাতেই ভদ্রলোক মারা গেলেন। আমারো তাই দশা, ও মশাই এ বইয়ের সব পাপই যে করে বসে আছি, আমার কী হবে? প্রায়শ্চিত্তের যা বিধান আছে তাতে আমার চোদ্দো পুরুষ তিরিশ জন্ম কুক্কুরযোনি গ্রহণ করেও সেই পর্বতপ্রমাণ পাপের পাহাড়ে আঅঁচড়টিও কাটতে পারবেনা। একবছর তো ডিপ্রেশনে মরোমরো অবস্থা। এখন একটু সুস্থ হয়ে ভাবলাম শুধু আমার একারই দোষ কেন, আপনারাও এমন কিছু ধোয়া তুলসীপাতা নন, সবাইকে জানানো হোক তারপর দেখা যাবে ঘোর কলি কাকে বলে।

    মনু কে। মনু কে কী মশায়, মনু হচ্ছেন মানুষের বাবা। মানব = মনু + কিচিৎ (বা ওভিরকম কোনো অনুচ্চারণীয়) প্রত্যয়, তাও জানেননা। ইস্কুল ফাইনালে পালি নিয়েছিলেন বুঝি। বিবস্বান্‌ অর্থাৎ সূর্যের (আমাদের বিরিঞ্চি বাবার আদরের বিবু) পুত্র, অবশ্য তাঁর নাম ভাঁড়িয়ে আরও কিছু পাপী সংহিতার ব্যবসা চালিয়েছে, সেকালে পেটেণ্ট বা কপিরাইট আইনের খুব চল ছিলোনা তো। তা এই মনু একলক্ষ শ্লোক, আবার বলি, একশো হাজার, একের পিঠে পাঁচটা শূন্য, লিখে তাঁর ছেলেমেয়েদের, অর্থাৎ মানবদের জ্ঞান দিয়েছিলেন। সাধারণবুদ্ধির একটু অভাব ছিলো মনে হয়, আত্মজদের চরিত্রও তেমন বুঝতে শেখেননি। এরা তো একেই হাড় বজ্জাত, তার ওপর সাতসন্ধ্যে আহ্নিক করে আর চোদ্দো পুরুষের ঠিকুজী মুখস্থ করে তারা একলক্ষ শ্লোককে, তাও আবার দুর্বোধ্য সংস্কৃতে লেখা, কোনোরকম পাত্তা দেবে, সেটাই বা তিনি কী করে ভাবলেন! যাই হোক, ছেঁটেছুটে শেষ পর্যন্ত তা দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার শ্লোকে। তাতেও নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। অবশ্য বারোটি অধ্যায়ে ভাগ করা আছে, আপনি বলতে পারেন যেটুকু তোমার দরকার তাই পড়ো না কেন বাপু। অবশ্য কিছুই না পড়লে চলে, বামুনেরা তো রয়েইছে প্রাণ জল করে সব বলে দেবার জন্য। তবে পরের মুখে ঝাল খাওয়ার ফল সবসময় তো ভালো হয় না, বিশেষ করে যেখানে আপনার ইহলোকের ধনসম্পত্তি, পরলোকের সুখস্বাচ্ছন্দ্য আর জন্মান্তরের কর্মফল, এসব নিয়ে কারবার।

    কী লেখা আছে? ‘পূজা পার্বণ তিথির হিসাব শ্রাদ্ধবিধি লিখছে হেথা’ এবং আরো অনেক কিছু। এই যে চতুর্বর্ণ আছে, তারা কে কী খাবে, পরবে, খাবে না, পরবেনা; রাজা কীভাবে রাজ্য চালাবেন; স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক; পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক; সামাজিক অনুষ্ঠান, যথা, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে; ট্যাক্‌সো, উত্তরাধিকার আইন; পাপ, প্রায়শ্চিত্ত, পুনর্জন্ম, সৃষ্টিরহস্য; নখ খাওয়া বা বগল বাজানো বৈধ কিনা; গয়লাকে কতো মাইনে দিতে হবে; ছাগল চরানোর কী বিধান; মিথ্যে সাক্ষী দিলে (এবং ধরা পড়লে) কী বিচার। এমনিতর বেঁচে থাকতে গেলে দৈনন্দিন যতসব কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সব কিছুর সমাধান পাবেন এই বইতে। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক, পরিছেদ ও শ্লোকসংখ্যা, সায়েবরা যাকে বলে চ্যাপটার এণ্ড ভার্স, বন্ধনীর মধ্যে রইলো।

    অবসর নিয়ে মনু কী বলেছেন, তাই লিখি, পড়ে আপনার নিশ্চয় রোমাঞ্চ হবে। চুল পাকলে, নাতি-নাতনী হলে বনে যাবেন বানপ্রস্থ করতে। গিন্নিকে ছেলের ঘাড়ে চাপাবেন, নিতান্ত নাছোড়বান্দা হলে সঙ্গেও নিতে পারেন। সেখানে গাছতলায় থাকবেন, মাটিতে শোবেন, জটা রাখবেন, নোখ কাটবেন না, বুনো ফলপাকুড় খাবেন। মাটিতে গড়াগড়ি দেবেন, একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। গ্রীষ্মের দুপুরে সূর্য মাথায় নিয়ে আর চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে (গালভরা নাম হোলো পঞ্চতপা) তপস্যা করবেন, বর্ষায় ছাতাটাতা ভুলে গিয়ে বৃষ্টিতে কষে ভিজবেন, হেমন্তকালে ভিজে জামা গায়ে ঘুরে বেড়াবেন। এতে যদি রোগে ধরে তাহলে উপবাসী থেকে ঈশানমুখে সোজা হাঁটতে থাকবেন যতক্ষণ না অক্কা পান। এতসব করেও যদি টেঁসে না যান তাহলে আপনাকে সন্ন্যাসাশ্রম করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। সে পর্বের কথা নাহয় আর নাই লিখলাম, বানপ্রস্থের ঘটনা থেকেই আপনি নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন (৬, ১-৩৩)।

    কেমন বুঝছেন স্যার, চিত্ত একেবারে নির্মল হয়ে যাচ্ছে না? মনুসংহিতা থেকে আরো সামান্য কয়েকটি রত্ন উদ্ধৃত করি যাতে বুঝতে পারেন যে মনুসংহিতার প্রকাশ কী আশু প্রয়োজন। আগে বলে রাখি, আমাদের চতুর্বর্ণ প্রথাই বলুন, জাতিভেদই বলুন, মনু এতে ভয়ানক বিশ্বাসী, ব্রহ্মা স্বয়ং এই প্রথা সৃষ্টি করেছেন তো। বামুন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র, এই চারটি বর্ণ, খাদ্য শৃঙ্খল, phood chain-এর যথাক্রমে খাদক, রক্ষক, উৎপাদক আর জমাদার (১,৮৭-৯১)। নামেই পরিচয় -- যথাক্রমে শর্মা, বর্মা, ভূতি, দাস (২,৩১)। এবার শুনুন।

    ইহলোকে মানুষকে দূষিত করাই স্ত্রীলোকের স্বভাব, অতএব সাধু সাবধান (২,২১৩)। আবার যে কুলে নারীদের সম্যক সমাদর আছে, দেবতারা সেখানে প্রসন্ন আছেন (৩,৫৬)।

    বাচাল বা কটাচোখো মেয়েকে বিয়ে কোরো না (৩,৮)।

    ধরুন পাপস্খালনের জন্য ব্রাহ্মণ ডেকে পঙ্‌ক্তিভোজন করাচ্ছেন। শুনুন, যদি কাণা লোককে পঙ্‌ক্তিতে দেখতে পাওয়া যায় তাহলে ষাট, অন্ধ - নব্বই, কুষ্ঠ রোগী - একশো, পাপী - এক হাজার, এই পরিমাণ ফল নষ্ট হবে, অর্থাৎ ক্রেডিট পাবেননা (৩,১৭৫-১৭৭)। কিছুই কী মনুর নজর এড়াতো না!

    পিতৃপুরুষকে পিণ্ডদান করতে হয়। শুনুন কী ধরণের খাবারে তাঁদের কতোদিন পরিতৃপ্তি হয়। তিল, ধান, যব ইত্যাদি -- একমাস; মাটন - চারমাস, পাঁঠার মাংস -- ছমাস, মোষের বা শুওরের মাংস - দশমাস আর গণ্ডারের মাংস - অনন্তকাল। গণ্ডার কেন endangererd species সেটা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন (৩,২৬৭-২৭২)।

    চতুর্থ অধ্যায় অবশ্যপাঠ্য কেননা এই অধ্যায়ে দৈনন্দিন আচারবিধি লেখা আছে। যথা প্রাতঃকৃত্য (উইঢিপি একেবারে নৈব নৈব চ), ভার্যাগমন ইত্যাদি। আরো সূক্ষ্ম সব বিচার : কাউকে ডেকে রামধনু দেখাবে না (৪,৫৯), গাধার মতো ডাকবে না (৪,৬৮), দুহাত দিয়ে মাথা চুলকোবে না (৪,৮২), . . .।

    সেকালে তো যখনতখন বন্‌ধ্‌ ডাকার চল ছিলোনা, তবে ছাত্ররা ইস্কুলটা ফাঁকি দিতো কখন। বর্ষাকালে, ভূমিকম্প বা উল্কাপাত হলে, রাজার ছেলে হলে (তিনদিন), কুয়াশা হলে, চোঁয়া ঢেঁকুর উঠলে(৪,১০০-১১৩)। আরো আছে। বেদ পড়ার সময় যদি গুরু আর শিষ্যের মাঝখান দিয়ে গরু, কুকুর, ব্যাঙ, সাপ, বেজী বা ইঁদুর চলে যায় তাহলে পুরো একদিন ছুটি (৪,১২৬)।

    মনুর কালে টিভি, ভিডিও এমনকী খবরের কাগজও ছিল না, তাই ভোজনই (এবং প্রজাবৃদ্ধি) ছিল বিনোদনের প্রধান উপায়। মনু তাই খাওয়াদাওয়া নিয়ে প্রচুর জ্ঞানবিতরণ করেছেন। শুধু কী খাবে, কী খাবেনা তাই নয়, কে কী খাবে এবং মনুর কথা না শুনলে কে তোমাকে খাবে, এও মনু ধার্য করে দিয়েছেন। মাছমাংস, দুইঅই খাবার নির্দেশ আছে। শজারু, গোসাপ, আর গণ্ডার তো আগেই বলেছি, এসব চলতে পারে (৫,১৮) , যদিও মনু রেসিপি কিছু দেননি। আবার এদিকে বলছেন, তুমি যাকে খাবে, সেও তোমাকে খাবে, মাংস শব্দের ব্যুৎপত্তিতেই তা লেখা আছে, মাং অর্থাৎ আমাকে সঃ অর্থাৎ সে (ভোজন করিবে উহ্য)(৫,৫৫)।

    রাজাদের কথা বলা হয়েছে। মানব চরিত্র ব্যাপারে মনু একেবারে গোলা ছিলেন না, হাজার হোক একই gene তো। তা বলছেন রাজার কাজ হোলো দণ্ড দেওয়া, কেননা কেবল দণ্ডভয়েই মানুষ ন্যায়পথে থাকে, নির্দোষ মানুষ সোনার পাথরবাটি (৭,২২)। খাঁটি কথা!

    আর সেসব কী দণ্ড রে মশায়, পড়লে আপনার দাঁতকপাটি লেগে যাবে। পাপ করে ভেবেছেন মনুর পৃথিবীতে রেহাই পাবেন, সেটি হবার নয়। তা রাজাই দণ্ড দিন বা নিজে নিজেই প্রায়শ্চিত্ত করুন। একটা শুনুন। গুরুপত্নীর সঙ্গে ইয়ার্কি দিয়েছেন, এখন লোহার তৈরী জ্বলন্ত এক নারীমূর্তি আলিঙ্গন করে আগুন গরম লোহার খাটে শুয়ে থাকুন, যতক্ষণ না প্রাণবিয়োগ হচ্ছে। আগুনে এলার্জি আছে বলছেন। তাহলে জাপানী স্টাইলে হারাকিরি (ওই তার কাছাকাছি আর কি) করতে পারেন, হাঁটতে হবে কিন্তু নৈঋতদিকে (ন য়ে ঐ, ঋ তে রেফ, ত)দিকে। অবশ্য আপনি যদি কোমলমতি হন, এইসব কাটাকুটি পছন্দ না করেন তাহলে তিনমাস যাউ (রেসিপি নেই) খেয়ে চান্দ্রায়ণ ব্রতও করতে পারেন (১১, ১০৩-১০৭)।

    আর এই তো কলির সন্ধ্যে। আট রকম বিবাহের কথা বলা আছে। অবৈধ অথবা বর্ণসঙ্কর সন্তানদের কুলুজী দেওয়া আছে (৯)-- ঔরস, ক্ষেত্রজ, দত্তক, গূঢ়োৎপন্ন, অপবিদ্ধ, কানীন, সহোঢ়, পুনর্ভব, পারশব, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা কে, সম্পত্তির কত ভাগ পাবে, শ্রাদ্ধ করবে কি করবে না -- এইরকম সব জটিল সমস্যার সহজ সমাধান মনু বলে গেছেন, আপনি শুধু বামুনকে দক্ষিণা দিন আর বিধান জেনে নিন। নৌকো চড়বেন? একপণ ভাড়া দিন। সঙ্গে গিন্নি আছেন -- পাঁচসিকে। পাপ করতে চান কিন্তু জন্মান্তরে তার কী ফল হবে জানতে চান? মনুর পাতা উল্টে দেখে নিন। গুড় চুরি করেছেন? -- বাদুড়; গন্ধদ্রব্য? -- ছুঁচো; বামুন হয়ে মাল খাবার ইচ্ছে হয়েছে? -- কৃমি।

    আর তালিকা বাড়ানো উচিত হবে না, কপিরাইট আইনে পড়ে যেতে পারি। সুভাষিতও অনেক আছে, যেমন আদালতে সাক্ষীদের মূলমন্ত্র ‘ন ব্রূয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্‌’(৪,১৩৮), লম্পটদের বীজমন্ত্র ‘স্ত্রীরত্নম্‌ দুষ্কুলাদপি’ ইত্যাদি। এখন একে যদি ‘এন্‌সাইক্লোপিডিক’ না বলেন তবে কাকে বলবেন। হাজার হাজার বছর ধরে এই সংহিতা আমাদের ভারতবর্ষে হিন্দুদের ভাগ্য, সমাজব্যবস্থা ও দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে বর্ণাশ্রমধর্মী এক সমাজ অবয়বের ভিত্তিতে। এই ভিত্তিটি মেনে নিলে বাকীটা হজম করা কঠিন হয়না। দেখুন, একটা পিনাল কোড তো থাকতেই হবে, তা মনুর বিচারই হোক বা কাজীর বিচারই হোক। সায়েবরা মনু নিয়ে প্রচুর নাড়াচাড়া করেছেন -- জোন্‌স্‌, মোক্ষ মূলর, নীট্‌শে; এই তো আমার কাছেই এক পেঙ্গুইন সংস্করণ আছে। আজকাল ভারতীয় পণ্ডিতেরা বলছেন যে সায়েবরাই নাকি এই মনুসংহিতাকে আইনের বই বলে প্রচার করেছেন, আসলে এটা মুখ্যত শিক্ষা দেবার জন্য লেখা। সায়েবদের এরকম বদ্‌ প্রচারকৃতির সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি, কাজেই ভারতীয় পণ্ডিতদের কথা সত্যও হতে পারে।

    মনুসংহিতা লিখেছেন বামুন পুরুতেরা, মনুর নির্দেশ মুখ্যত বামুনদের প্রতি প্রযোজ্য এবং অবশ্যই উদ্দেশ্য বামুনদের প্রতিপত্তি বজায় রাখা, চাই কি বর্ধন করা। তা এধরণের ব্যাপার তো মশায় অন্যান্য ধর্মেও দেখা যায়, তবে আমাদের মনু কিন্তু কারুর থেকে কম যাননা।

    ভেবে দেখবেন। শনিবারে দাঁত খুঁটেছি বলে আমাকে এখন আবার যাউ খেয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নয়তো পরজন্মে দাঁতাল শুওর হয়ে জন্ম। তারপর ওভি যে কবি বলিয়াছেনঃ

    ‘সব লিখেছে, কেবল দেখো পাচ্ছিনেকো লেখা কোথায় --
    পাগ্‌লা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন করে ঠেকাবো তায়!’

    আমার বিশ্বাস একথাটা ঠিক নয়, আছে সবই, কেবল সংস্কৃতে লেখা বলে চট করে বোঝা যাচ্ছেনা। এই করে কোনোদিন একটা পি.এইচ.ডিও পেয়ে গেলে আশ্চর্য হবেন না!

    বিনীত প্রণবকুমার দাস
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • কূটকচালি | ২৮ মে ২০১২ | ২০০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • oikik | ***:*** | ২৮ মে ২০১২ ০৯:১৯89473
  • অহো! আমাদের মেস- এ, একটি ছেলে সংস্কৃত পড়ে, তার থেকে মনুসংহিতা নিয়ে (টীকা-টিপ্পনি সহ) পড়ে খিল্লি করা (আর মাঝে মাঝে ভয় পাওয়া) আমাদের একটা ফেভারিট টাইম পাস্‌... সে কি জিনিস মশয়... একবার পড়লে সাদ্দিন খাবি খেতেই হবে... এ তো তাও নিরামিষ গুলো দিয়েছেন, পরে কখনো আমিষগুলো শেয়ার করবো'খন...
  • মিলা | ***:*** | ২৯ মে ২০১২ ০৩:৩১89474
  • বেশ মজা লাগলো, কিন্তু মনু-সংহিতার কোনো লিখিত রূপ আছে কি? নাকি যে যখন পেরেছে নিজের সুবিধের জন্য বাড়িয়ে গেছে, আর দোষ হচ্ছে মনু দাদুর (নাকি প্রদাদু হবেন? সে যাকগে!)
  • ponu | ***:*** | ২৯ মে ২০১২ ১১:১৫89475
  • উত্‍‌স:
    (১)"মনুসংহিতা", পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ১৩৯৭। ওপরে বন্ধনীবদ্ধ সংখ্যাগুলি এই বইয়ের পরিচ্ছেদ ও শ্লোকের সংখ্যা, chapter and verse।
    (২)"The Laws of Manu", Wendy Doniger translator, Penguin Books, 1991
  • ranjan roy | ***:*** | ২৯ মে ২০১২ ১১:৩১89476
  • মহামহোপাধ্যায় বি ভি কাণে'র ইংরেজি তর্জমায় , যদ্দূর মনে পড়ছে, মাইশোর থেকে প্রকাশিত। বিশাল তিন ভল্যুম হবে।
  • ডিডি | ***:*** | ৩১ মে ২০১২ ০৮:৪৫89477
  • এরম আরো শাস্ত্র আছে। উনিশ জনৃষির নামে লেখা উনবিংশ সংহিতার অনুবাদ করেছিলেন ভবানী চরন বন্দোপাধ্যায়, ১৮৩৩ নাগাদ। অত্রি,অংগিরা,গৌতম, যাজ্ঞবল্ক্য,ইত্যাদি উনিশ জন ঋষির আইনী ব্যাখ্যা।
    এটা পাবেন হেথায় http://dspace.wbpublibnet.gov.in/dspace।

    এইসব কবে লেখা হয়েছিলো কে জানে। ডেফিনিটলি পোস্ট মনু সংহিতার সময়। এগুলো যে কি মারাত্মক রকমের হাঁদামী তে ভরতি তা চিন্তাও করা যায় না। অবিশ্বাস্য রকমের ব্রাহ্মন্য ভাবী ও নারী বিদ্বেষী। ধর্ম টর্মের কথাই নেই। শুধু কি কি করা উচিৎ নয় তার পাতার পর পাতা লিস্টি।
  • জলধি | ***:*** | ২৬ জুন ২০১২ ১১:২৯89478
  • রসিয়ে পড়া গেল ।
  • ফুন্সুক | ***:*** | ২১ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:৪১89479
  • "বাচাল বা কটাচোখো মেয়েকে বিয়ে কোরো না" । এটা চিরকাল মনে থাকবে ।
  • Rit | ***:*** | ২১ অক্টোবর ২০১৩ ০৪:৪৯89480
  • আমি তো হেডিং দেখে ভাবলাম পলিটিক্যাল লেখা। মানে পোনু আর মনু কে নিয়ে। ঃ))
  • দেব | ***:*** | ২১ অক্টোবর ২০১৩ ০৫:২৯89481
  • অ্যাপোলজিস্টদের পজিশনটা থাকুক -

    মেয়েদের নিয়ে এটা - http://agniveer.com/manu-smriti-and-women/

    বিশেষ কিছু নেই। দু'চারটে লাইন মেয়েদের সাপোর্টে যা আছে সেটাকেই আঁকড়ে হেজিয়ে গেছে।

    বর্ণভেদ নিয়ে এটা - http://agniveer.com/manu-smriti-and-shudras/

    বর্ণভেদ জন্মগত নয়, আচার ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে স্থির হবে ইত্যাদি মিষ্টি মিষ্টি কিছু দাবী আছে। খাতায় কলমে নিয়মটা কি তাই? অনেক জায়গায় শুনেছি। কেউ জানেন?
  • π | ***:*** | ২১ অক্টোবর ২০১৩ ০৫:৩৩89482
  • মনু সংহিতা নিয়ে ধুন্ধুমার তর্ক বেঁধেছে। বিজেপি কিছু জনতা নানা লিং, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের লেখাপত্তর দিয়ে ওগুলো ডিফেন্ড করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
    https://www.facebook.com/groups/guruchandali/671574379527178/?notif_t=group_comment_reply
  • সিকি | ***:*** | ২১ অক্টোবর ২০১৩ ০৭:৩৪89483
  • কানা হলে ষাট, অন্ধ হলে নব্বই মানে?

    আবার পরের প্যারায় দেখছি মাটন চারমাস, পাঁঠার মংস ছমাস। এরই বা মানে কী?
  • π | ২৯ মে ২০২১ ০৯:৫২106552
  • এটা সুমিতদার লেখা ছিল। সুমিত রায়।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন