বুল ডগ
মলয় রায়চৌধুরী
কর্কস্ক্রু লেজ নিয়ে কষ্টে ভুগতো, তবু পড়শিরা বেশ ভয় পেতো ওকে
ছুঁচালো পাকানো লেজ শৈশবেই ডকিঙের নাইলন সুতো বেঁধে
ছেঁটে ফ্যালবার পর যখন সে যুবক তখন দেখবার মতো ওর হুংকার
চেনে বাঁধা থাকলেও
ঘঙ ঘঙ ঘঙ ঘঙ ঘঙ ঘঙ
আসলে লেজও তো শিরদাঁড়ার ডারউইনি প্রসার বই নয়
যতই কচিকাঁচা হোক
লেজকাটা গেলে পরে মেরুদণ্ডটির ক্ষতি হয় না কি
কেন লেজ কেটে নেয়া হয় তার যুক্তি দিতে ওস্তাদ যারা কেটে নেয়
অথচ লেজ তো নাড়াবার জন্য
আহ্লাদে আটখানা ভঙ্গী প্রকাশের জন্য
যদি শৈশবে লেজটিকে ছেঁটে ফেলা অবহেলা করো
তাহলে মালিক ছাড়াও অনেক সময়ে
মালিকের মোসাহেবদের আর পড়শিদের দেখে
লেজ নাড়াবার আনন্দ হিল্লোল থেকে মুক্তি পাবে না বুল ডগ
মাঝে-মাঝে চেনে বেঁধে রাখে বটে মালিক কিংবা তার শাকরেদ-দল
তবুও কি অভ্যাস যায় ?
শান্তি নষ্ট করা ওর কাজ
দিন নেই রাত নেই গেরস্তের শান্তি ভঙ্গ করে
ঘঙ ঘঙ ঘঙ ঘঙ ঘঙ ঘঙ
ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ
লেলিয়ে দিলেই টুঁটি ছিড়ে
আগন্তুকের কিংবা বেছে নেয়া শত্রুদের
মাংস হাড় চামড়া রক্ত সব একাকার
মালিক-মালকিনি বলবেন ওনাদের কোনো দায় নেই
ওনাদের কাজ শুধু লেজ কেটে নেয়া যা ওনারা করেছেন অতিসুষ্ঠুভাবে
|
|
|
অবিশ্বাস বেড়ালের নূপুর
কচি রেজা
সাপের কিবা দোষ, দেবতাদের বিবাদ নিয়েও দুঃশ্চিন্তা করি না। আমার ঘর সর্বনাশে কেটেছে। পালিয়ে গেছে জল ছেঁকে আনা রঙিন মাছ। আসলে রঙ তো কপালে থাকেনা, রঙ থাকে প্রতিবিম্বের সিঁথিতে। বেহুলার চোখের ঘুমকেই দায়ী করেছ তোমরা? তাইতো কালরাত্রে কেরোসিনের প্রদীপগুলো জ্বলে থাকে, আমিও জেগে থাকি অবিশ্বাসের ভয়ে। সাপ অদূরদর্শী সবাই জানে, আমরা জানিনা বলে সর্বনাশ কিন্তু আটকায়না। আমাদের সব অপরাধ দেবতাদের চোখে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ, সাপের কী দোষ!
সিঁদুরের জন্য এবার কৃষ্ণচূড়া লাগাব। এবার আর ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেবনা কেরোসিনের বাতি। বহুদূর থেকে কত গাঙুড় পেরিয়ে এসেছি নতুন চরে, কপালে কালশিটে দাগ, নগ্ন পায়ে অশ্রু ও রক্তের নূপুর। আমি এবার হাসনের গানের উপর, সুরের উপর, শূন্যের উপর ঘর বানাব।
|
সন্ন্যাস
রোশনারা মিশ্র
কিছু নেই, কিছুই ছিল না
তবু মাঝে ছিল কেউ - মাছিদের ভূত!
দিনমান ভনভন, প্রব্রজ্যা বোঝে না
তাড়িয়ে বেড়ালে তাকে হবে না সে জুত
না থাকারও থাকে অনুসায়া -
(অবসেসন, অভিমান, মায়া)
হৃদয় উদাস হয় মাছিদের ভূতে
রাইফেলের মত এক দীর্ঘ নিকায়
মাজেলেও মাছি পাক খায়
মজ্ঝিম নিকায় এসে বোধি বলে তার সঙ্গে শুতে
|
|
|
পাপাচার
সরদার ফারুক
‘পাপাচার ভুলে গেলে বৃদ্ধ হয়ে যাবে’ – আমাকে বলেছে এক
জটাধারী সাধু
মাঠের একলা চাঁদ পথ দেখিয়েছে, হাজামজা দিঘি
সেখানে পদ্মের ভিড়ে সাপের উচ্ছ্বাস
‘জিতে নাও, পড়ে আছে সব
ধ্বস্ত হবে জেনে’ –
কানে কানে এই কথা বলে
হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো প্রাণের ঠাকুর
|
চিরায়ত
শাকিলা তুবা
১
জোছনা চুরির গল্প অনেক শুনেছি
পলিগামী পুরুষের রসায়ন
ভাবতে ভাবতে
নিঃশ্ছিদ্র মশারীর আকার-প্রকার
নির্ধারন করে ফেলি
চাঁদও কি জোছনাভূক প্রানী নাকি
চাঁদেও ফোটে নানাবিধ ফুল!
আমাদের এখানে বৃষ্টি হত
মনে রাখবার মত রাত্রিও নামত
ঋতুবতী গুহানারী একবার চাঁদে ফেলে
এসেছিল লাল রঙটার অর্থ
অন্ধকার আর নীরবতা
যোগ হয়েছিল আলোর সমগোত্রে
যার কারনে গল্পগুলো খরস্রোতা হয়ে গিয়েছিল।
সেই থেকে ওরা গল্প করত সারারাত
যদিও নারীটি বাঁধা থাকত লালঝুঁটি
মোরগের কাহিনীতে যেখানে একটি মেয়ে
জুতার ফিতায় নানারঙ যোগ করে
খলখল হেসে উঠত
পুরুষটা আবার হাসি-কান্না সব থেকেই
আমিষ খুঁটে খেতে শিখেছিল প্রবল।
আদি থেকে এভাবেই চুরি হয়ে যাচ্ছিল
সমস্ত কুলীন নিঃশ্বাস
যা আটকে থাকে প্রতিটি জোছনার রঙে;
রঙভ্রান্তির বিকারে।
২
তুরাগের জলে ডুবন্ত এক মানুষ দেখেছিলাম
যে বাঁচতে চায়নি মোটেও
তার উর্ধ্বমুখি হাত ছিল না সাধারণ
অথচ আমরা তাকে বাঁচিয়েছিলাম আর সে
ক্ষেপে উঠেছিল লজ্জাহীনের মত।
তাকে বাঁচাবার লজ্জায় আমাদের ঘুম নষ্ট হয়
এখনো, আমরা প্রতি রাতে পালা করে
লোকটাকে পাহারা দেই
এরপরে শিলা, এরপরে লিনা
এরপরে একসময় হয়তো আমরা কেউ থাকব না।
লোকটা তখন অনায়াসে ডুবে যেতে পারবে
তখন তার কান্না শুনবে তুরাগ, শুধুই এক নদ।
৩
বিড়ালকে জিজ্ঞেস করা হল, তোমার মুকুটে
কি লাগানো আছে মেয়ে?
বিড়াল তার থাবা মেলে ধরে বলল, মুকুট নেই
শুধু নখে মেখে রেখেছি কাঁটা-কাঁটির সোহাগ!
|
|
|
দাদরি
আষিক
সরু রাস্তার মধ্যে দিয়ে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসছে মেয়েটি
ভেজ? নন-ভেজ? চিকেন? বিফ?
মাংসের শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে
রাস্তা কতটা সরু হলে সেইখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে
পারবে না আখলাক?
***
মাংসের গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছে ওরা
ওদেরকে তুমি বোঝাচ্ছ
তুমিও রাক্ষস, মানুষ নও
হ্যাঁ এবং না-এর তলানিতে ঠেকা
এইসব তর্কের শেষ থাকে না, রফা থাকে
এখন তোমাকে প্রমাণ করতে হবে তুমিও রাক্ষস
***
একজন মাস্টার, একজন স্লেভ
তিন চরিত্রের এই খেলার নাম মাস্টার ঠিক করেছেন
বি ডি এস এম
তৃতীয় চরিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করছে একটি চাবুক
প্রত্যেকটি আঘাতের পর তুমি বলছ আর হবে না
অথচ তুমি জানোই না কী আর না হলে চাবুকের বাড়ি বন্ধ হতে পারে
তাই চাবুকের পর আরও চাবুক নেমে আসতে থাকে
মাস্টার অভয় দেন – “আরও হবে”
|
নিজস্ব অভিধান
সুমন মান্না
দেখেছি বেশ কিছু নাম মুখের সঙ্গে মিশ খায় না বলে হোঁচট খেয়েছি কতবার
সিদ্ধার্থ কে রাজীব ভাবি আর অনিরুদ্ধকে তো হিমাংশু মনে হয় সব দিক থেকে
ঘুমের মধ্যিখানে একদিন সরোবর জুড়ে সারি বেঁধে ইস্কুল হোমটাস্ক ঘর বাড়ি
যাকে দেখলেই মনে হল আধো জ্যোৎস্নার ভিতরে সাইকেলে জয়ন্ত এসেছে
ব্যাগ ভর্তি কাঁইবিচি দিয়ে লুকিয়েছে বাসের টিকিট যা তাকে রাখতে বলেছিলাম
কিন্তু সে আসলে জয়ন্ত নয় কিছুতেই। মুখের দিকে তাকালেই সব পরিস্কার হয়।
বাসের টিকিট আসলে ঘরভর্তি লোকের সামনে অনর্থক কথা বলে হাস্যস্পদ হওয়া।
ওই সরোবর বলে যাকে দেখলাম সে তো বহুদিন মরে যাওয়া দাদুর হাতের পাতা
এই যাকে খাতা বললাম – যাতে কিছু লেখা হচ্ছিল তাকে আমি অফিস থেকে ফিরে
জামা খুলে ধুম হয়ে বসে বসে ক্ষয়ে যাওয়া মনে হচ্ছে। যে সব আমি কখনো বলিনা
সেই সব অবান্তর কথারা দেওয়ালী পোকার মতো সারাবছর সুপ্ত গুপ্ত থেকে বছরের
একটা দিনে অন্ততঃ তোমার আলোর সামনে ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে মরে যাবে বলে
হ্যাঁ, তোমাকে আলো মনে হয়, বলাই কে বাহুল্য, জানলাকে কবিতার বই, পেন টাকে ছাতা
অনন্ত বারান্দা বা জাহাজের ডেকে নিজস্ব অভিধান ফুলে ওঠে, টুপটাপ খসে পড়ে পাতা।
|
|
|
বয়স
শৌভ চট্টোপাধ্যায়
জীবন আমাকে রোজ যতটুকু যাপন করেছে শুধু ততটুকু জানা হল আজ। পিরিচে, কাপের নিচে পড়ে রইল বিষাদের গুঁড়ো। চলে যাওয়ার আগে, তুমি জানালে না, কীভাবে কাচের গায়ে পারদ মাখান হয়। কীভাবে শব্দ না-করেও খেয়ে ফেলা যায় গোটা একটা বিস্কুট।
প্রতিদিন, রাত্রি তার অন্ত্র খুলে বলত, ‘প্রবেশ করো’, আর আমি খালিপায়ে ঢুকে যেতাম অন্ধকারে, পাক খেয়ে। এখন আবার সেই মনখারাপ-করা স্বপ্নের ভেতর একপাক ঘুরে এসে দেখলুম, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আর জানলা বেয়ে নেমে আসা জ্যোৎস্নায় শাদা হয়ে আছে আমার চুল।
|
এখন দূরের কাছে
সোনালি সেনগুপ্ত
এখন দূরের কাছে ফিরে আসা বার বার
হাঁটুর ভিতরে দেহ গুঁজে
ভয়ের নাড়ির শব্দ শোনা যায়। কতদিন আর?
বেমক্কা হাওয়ায় যদি উড়ে আসে শিথিল বয়েস
তবে আর প্রহরায় কে থাকে দরোজা জুড়ে? অনেক
অনেক দিন হলো
তোর হাত ধরে আমি হাঁটিনি শৈশবময় ভোরে
অনেক অনেক দিন হলো
উজ্জ্বল কাগজ হাতে কড়া নেড়ে ঘরে ঢুকে আসিসনি তুই
এলে পরে
আমিও কুঁকড়ে গেছি ভয়ে, বিতৃষ্ণায়, অভিমানাহত
চাহনির অন্তরালে নিচু হয়ে
কুড়িয়ে নিয়েছি চশমা। পারিসনি তুই
আমিও পারি না আর। হাঁটুর ভিতরে মাথা গুঁজে
শেষের অপেক্ষা নিয়ে বসে আছি দিনরাত
হাসপাতালের নিচে
শাঁখ বাজে অবিরাম। ধুকধুকে, সদ্য নাড়ি কাটা
একা শাঁখ, চলচ্ছক্তিহীন
|
|
|
পুজোর সনেট
সোমনাথ রায়
এসো স্মৃতি এসো সংকেত ভেদ করে এই পথমাঝে
রূপের গভীর থেকে মূর্তির মত যা যা পাই, ঘ্রাণে
আরতির ধোঁয়া এসে স্বয়ং উদিত হও ঘটের বিরাজে
যেরকম কুয়াশার থেকে মিশে যাও আশ্বিনের ধানে
এসো পথ এসো স্তবের বিচার থেকে স্মৃতির সকালে
রৌদ্র মেঘের ফাঁকে রেখে যাক পখি ওড়ানোর গান
বন্যা থামাতে তুমি ঢাল তুলে দিতে সেই নদীর কপালে
শিউলির হাসি দিয়ে সেজে চনমনে বিষাদবাগান
এসো রৌদ্র এসো বর্ষা এসো কুয়াশায় এসো ভুলপথ
মাঠের নবীন বাহু তালগাছ দুটি এসে সিগন্যালে স্থিত
ভোরের রসের মত ঘুমের পর্দা তুলে যেন নহবত
মাইকের বাঁকে বাঁকে ডুবে আছে সানাইয়ে চিরপরিচিত
শঙ্খের ধ্বনি, পান-সুপুরির ঘটে জলে আমপাতা
পূর্বাশ্রমে তুমি কৃষকঘরণী ছিলে; আজ কলকাতা।
|
এই গ্রাম পাহাড় দিয়ে ঘেরা
সায়ন্তন গোস্বামী
এই গ্রাম পাহাড় দিয়ে ঘেরা, এখানে আকাশের ছাদ নীচু
ট্যুরিস্টরা এসে পাখিদের ছবি তোলে, শাটারে কিছুকিছু
রৌদ্রছায়াতে মেঘ আলতো করে কামড়ে ধরে ঠোঁট, হাওয়ায়
এই গ্রামে এসো একবার, শান্তিতে ভালোবাসা যায়।
এখানে দুঃখের নীল জল ফোঁটা-ফোঁটা লেগে থাকে পাতায়
বৃষ্টিতে ভিজে দুইজনে, এই গ্রামে ফুলেদের ছাতায়
পেয়ে যাব সুবাসিত স্ট্যাম্প পোস্টকার্ড, ভ্রমণবিলাসী
এই গ্রামে রাখঢাক না করে অক্লেশে বলো ‘ভালোবাসি।’
|
|
|
যদি জেগে ওঠে
সায়ন করভৌমিক
শেষরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলি যদি
যদি বলি স্মৃতিবিষে ম্লান ছিল
পথঘাট, জাহাজের খোঁজ
দিই যদি ছোটমুখে বলি যদি এলোমেলো হাত
কি লিখিতে কি লিখেছে
জানি না খবর
যদি বলি বালিকার মনে ছিল
ভোরের আমেজ
যদি বলি ঘাস ছিল জলে ভেজা
শরতের মত
যদি বলি চাই কিছু লেখার কাগজ কালি
সাবেকি টেবিল
যদি বলি দূরদেশে হলুদ আলোয়
যেন ঝাউপাতা স্থির
যদি বলি এসবই সত্যি, আর এসবই নদীর তীরে ভ্রম
যদি বলি এমনই পদ্য হয়, এরকমই বেভুল বালিকা
জেগে ওঠে একাকী বালিকা, যদি, অচেনা শরীরে
|
ভৈরবী
হিন্দোল ভট্টাচার্য
যেন কোনও অন্ধকার পড়েছিল বেওয়ারিশ ভাবে
তোমার মুখের দিকে আজ সব পর্দা সরে গেছে
চাপা চাপা দুঃখগুলো যেরকম ঘর-বারান্দায়
ভিজে জামাকাপড়ের মতো উদাসীন হয়ে থাকে,
তেমনই তোমার চোখে আমি শুনি বহুদিন আগে
শোনা কোনও বাঁশি, যার সুরে বাজে করুণরাগিনী!
একা একটা সাঁকো থাকে, ঘরোয়া আলাপ থাকে ভালো,
পয়সাকড়ি কিছু নেই, তবু সরু রাস্তার ভিতর
কারা হাতছানি দেয়, কারা বলে- এসো, চলে এসো!
সেইসব অন্ধকার তোমার চোখের নীচে গাঢ়
যেন বা বিষাদ, তাকে, মনখারাপ বলে ডেকে ফেলি।
পাশাপাশি হেঁটে যাই, কাছাকাছি, দূরত্বই থাকে।
ঘনঘন লরি যায় রাজপথের লাশের ওপর
সকলেই ঘরে ফেরে সকলের স্টেশন ছাড়িয়ে।
কিছু কিছু অন্ধকার পড়ে থাকে কলকাতা শহরে...
সেখানে উৎসব হয়, নীলাম, বাজার, হাট, দর...
তোমাকেও দেখি আমি, সেইসব অন্ধকারে ভোর!
|
|
|
অতীত
মিঠুন ভৌমিক
বেলা পড়ে এলে শেখ হবিবুর রহমান লেনে-
ফেরিওলা হেঁকে যায়, থমকায় শখের বেড়াল
পাঁজিতে অম্লরস ছায়াগাছে বাসা বেঁধে আছে
দাঁতভাঙা বিষন্ন বাড়ি এক, পাখীর আবাদ।
এ বাড়ি শ্মশ্মানঘাট, ধুলো জমে অবাধ পাথর
আমপাতা নিরন্ন, কোণ ঘেঁষে মরিচার দাগ
নিজল পেতলঘট তোবড়ানো মুখের আদল
ছাদের আলসে থেকে ঘুঘুডাক, কৈশোরঘ্রাণ
এই ঘরে শাঁখডাক, ঐ ঘরে আজানের সুর
ভেসে আসে তালপাতা, রূপকথা মায়ার কাজল
বাগানে ফোয়ারা নেই, কেরোসিন তেলের দোকান।
এরপর সাঁঝ নামে, ভাঙাচোরা কালির আঁচড়ে
সাদাটে চুনের দাগ, খোলসের সশব্দ বাস-
নীলচে শাড়ীর পাড় আহ্নিকে ভিজে কর্পূর
বাতাসে বালির রাশ হাওয়া দেয় দখিনের ঘরে
এসবই নদীর হাওয়া, তার চরে পীরের কবর
সুদূর ঢাকের স্বর, সেই যবে সান্নিপাতিকে –
এসবই গল্পকথা, এসবই স্বপ্ন আহরণ
শৈশব মধুময়, সেই রাতে জোনাকির আলো
শামিয়ানা রোশনাই বিফলে মূল্য কিছু কম
গঞ্জ মফস্বল, মঞ্চে তামাম সাধারণ
ফুরোলেই রাত নামে, পরীদল জীবন্ত হয়
কুর্ণিশ করে সরে, আলগোছে তারার প্রাসাদে
ফটফটে জোছ্নায় নিরালম্ব সূক্ষ্ম শরীরে
সমাধিক্ষেত্রে। শেখ হবিবুর ফিরে দেখলেন
নিরাকার চালচিত্র একা জেগে আঁধার আকাশে।
|
স্বর্ণমুকুরে রাখা গাথা
কৌশিক বাজারি
এ হল এক রূপশালী কন্যা আর তার স্বর্ণমুকুরে রাখা গাথা। আয়না খুললেই ঝলমল করে উঠত তার সোনার বরণ। রূপশীর খিলখিল হাসিতে ঝরে পড়ত মুক্তোর পাতা আর মানিকের ফুল। এদিকে আয়নারও ছিল এক নিজস্ব আনত মুখ আর অন্যদিকে উদাসীন হাসি। তার একমুখে রূপসীর প্রশংসা আর অন্য মুখ গম্ভীর, ক্রুর। একদিন সূর্য ডুবু ডুবু, সন্ধ্যার আকাশে দুটি তারা সবে মাত্র ফুটেছে ঈশানে, রূপসীর হাত গেল কেঁপে, রূপটান বেঁকে গেল, হায়, সে তার মূর্খতা ছুড়ে মারল লোহার দেয়ালে আর স্বর্ণমুকুর গেল ভেঙে – ঝনঝন অট্টহাস্যে সে তার মৃত্যুর আগে বলে গেল; শোনো হে সুন্দরী, আজীবন যাকিছু বলেছি তার সব কথা সত্য নয় জেনো... তবু, বলি শোনো , যাকিছু বলেছি তা মিথ্যেও নয় । শুধু রূপের কথা, পটের কথা, আমার বৃত্তাকার আয়তনে যেটুকু রেখেছো তুমি, আমিও বলেছি সেইটুকু। যেটুকু আড়াল করেছো সাবধানে, রেখেছো আঁধারে, সেও জানি, জানি সে কাচের নিচে সাবধানী পারা’র প্রলেপ , যা তুমি ভুলেছো সযতনে । সচেতনে তবু সে তোমায় ভোলেনি কোনোদিন। এই কথা বলে যাই আজ : জরা নয়, মৃত্যু নয়, আমায় হত্যার দণ্ড ভোগ কর আজীবন আয়নার অন্তরালে থেকে...
|
|
|
সুখ
শিবাংশু দে
পীরিত যাহারই হোক
স্বপ্নে থাকা ভালো
অভাবের রান্না ঘরে
বঁধুয়ার প্রেম শেখে
কথার আড়াল
যতোটা কাব্যে লেখে
যেভাবে জড়ালো
আকুল শরীর আর
এলোমেলো আশ্লেষ
মাঝরাতে
সেখানেও তেপান্তর
বেসুর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
বিষাদসঙ্গীতই শেষে
হৃদয় ভরালো ..
|
শব্দসন্ধান
অনিকেত পথিক
যে সব শব্দরা আমার জীবনে এল না
আমি তাদের ছবি সঙ্গে নিয়ে ঘুরি
রাস্তাঘাটে দেখা হয়ে যায়
হয়তো অন্য কারুর জীবনে
তখন ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখব বলে
আমি সেই জীবনে কড়া নেড়ে ঢুকে পড়ি
সেও অবশ্য আপত্তি করে না
যত্ন করে আলাপ করিয়ে দেয় ‘এই হল আমার---’
সবসময় ছবির সঙ্গে ঠিকঠাক মেলে না
কেননা শব্দেরও তো বয়স হয় চেহারা বদলায়
তখন আবার ছবিতে এটা ওটা যোগ করা
তবে এইসব করতে গিয়ে আমি খুঁজে পেয়ে যাই
সেই সব শব্দদের যারা শুধু আমার জীবনেই এসেছে
তাদেরও সাবধানে তুলে রাখি
যেমন করে লোকে ছবি রাখে অ্যালবামে ।।
|
|
|
তারিখ
সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
ব্যথা ছিল আঁচিলের মত
সয়ে যাওয়া, আলঙ্কারিক;
সেই আভরণ তুমি কেন
ছুঁয়ে যাও, মেঘ-নাগরিক?
ঝনঝন ঝেঁপে ওঠে বুক,
ত্সুনামীয়, ভয়ঙ্কারিক!
ঋজুরেখ মাস্তুল এ যেন
ভরাডুব মাঝ-সাগরিক....
ব্যথার কেন্দ্রে নতজানু,
আর কত হবো নাস্তিক?
ব্যথায় গুটিয়ে থাকা প্রাণ
রয়ে যাবে মেরুপ্রান্তিক?
গোনা হলো প্রহরান্ত দিন,
কোলাহল সপ্তাহান্তিক।
কাল গেছে যেমনটা যায়,
আজও ছিল তোমার তারিখ!
|