‘মুলক’ সিনেমাটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গল্প। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এটি একটি মুসলমান বিরোধী ছবি। এ ছবিতে তাপসি পান্নোর কোর্ট সিনের ভাষণ আমাদের অর্থাৎ ভারতবর্ষের উদারচেতা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ‘আমরা অ-সআম্প্রদায়িক’ এই অহমিকাকে বেশ তুষ্ট করে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ‘হাম’ এবং ‘ও’ অর্থাৎ আমরা ওরার বিভেদ ঘুচিয়ে একসঙ্গে পথ চলার, দেশ গড়ার ডাক দেন অভিযুক্তের উকিল তাপসি। আদালতের রায়ের দৃশ্যে জজসাহেবও তাপসির ভাষণেরই পুনরাবৃত্তি করেন, সঙ্গে উনি লোকজনকে মৃদু ভৎর্সনাও করেন। এই ভৎর্সনায় বিচারকমহাশয়, যিনি কিনা রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ আইনব্যবস্থার প্রতিনিধি, মুসলমান পরিবারের অভিভাবকদের তাদের ঘরের যুবকদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে বলেন, যাতে তারা বিপথে চলে না যায় অর্থাৎ ‘টেররিস্ট’ হয়ে না যায়!
ছবিটিতে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, মুসলমান যুবকরা যেকোন মুহূর্তে উগ্রপন্থী হয়ে যেতে পারে। শুধু ধরে নিয়েই পরিচালক ক্ষান্ত নয়, ছবিটির কাহিনী বিন্যাসও হয়েছে একটি ‘ভালো’ মুসলমান পরিবারে ‘খারাপ’ মুসলমান ছেলেকে ঘিরে। সেই ‘খারাপ’ মুসলমান যুবকটি উগ্রপন্থী হয়ে যায় এবং কিছু সাধারণ মানুষের জীবনহানি ঘটায়।প্রশ্ন হল, ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে কথা বলতে গেলে বলিউড ছবি-নির্মাতাদের কেন ছবিতে মুসলমান উগ্রপন্থী চরিত্রই আমদানি করতে হয়? কেন হিন্দু উগ্রপন্থীদের কথা, মুসলমান গো-ব্যবসায়ীদের যারা নিত্য কুপিয়ে খুন করছে, সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে ছবি বানানো হয় না সচরাচর? কেন মুসলমান যুবক মানেই সে প্রেমিক নয়, নিরীহ নয়, ইতিবাচক নয়? কেন মুসলমান যুবক চরিত্রদের দিয়ে শুধু ভাঙার কথাই বলানো হবে, গড়ার কথা নয়? নির্দিষ্টভাবে, এই সিনেমাটিতে কেন শাহিদকেই উগ্রপন্থী হিসেবে দেখানো হল? যদি সিনেমায় একটি উগ্রপন্থী চরিত্রের একান্ত প্রয়োজন হয়, তাহলে কেন মহল্লায় যে যুবকটি হিন্দু উগ্রপন্থার কথা বলছে তাকে বোমাবাজ, নিরীহ মানুষের হত্যাকারী হিসেবে দেখানো হল না? উগ্রপন্থী চরিত্র মানেই তাকে মুসলমান হতে হবে, এ হল হিন্দুত্ববাদী চিন্তার ফসল। ২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষে উগ্রপন্থী কার্যকলাপের ফলে মোট ৯৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী উগ্রপন্থীদের হামলার ফলে।
ছবিটির দ্বিতীয় সমস্যা হল, সরকারী আইনজীবীর বয়ানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচারিত মিথগুলি তুলে ধরা হল খুব জোরালোভাবে, কিন্তু অভিযুক্তের আইনজীবী অর্থাৎ তাপসি যখন সেইগুলোর বিরোধীতা করলেন তখন তিনি শুধু আবেগের কথা বললেন, কোন তথ্য দিলেন না। ‘মুসলমানদের বেশী বাচ্চা হয়’ এই প্রচারের বিরুদ্ধে তিনি একবারও বললেন না যে এটি একটি মিথ্যে প্রচার, সরকারী তথ্য বলছে, গত দুই দশক ধ’রে আমাদের দেশে মুসলমানের সংখ্যা কমছে, ২১০০ সালে এদেশে মুসলমানের সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৭ থেকে ২১ শতাংশ। ‘মুসলমানরা লেখাপড়া জানেন না’, এই অভিযোগের উত্তরে তিনি একবারও বললেন না যে, কেন মুসলমান সমাজে শিক্ষার হার কম? রাষ্ট্রের কিধরণের বঞ্চনার কারণে মুসলমান বাচ্চারা স্কুলের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারে না?কিম্বা স্কুল ভর্তি হয়েও দারিদ্রের কারণে তাদের স্কুলছুটের দলে নাম লেখাতে হয়?
ছবিটিতে দেখানো হল, যে পুলিশের গুলিতে আতঙ্কবাদী শাহি্দের মৃত্যুর পর তার পরিবার তাকে ত্যাজ্য করল, তার দেহ পর্যন্ত গ্রহণ করল না, কারণ তারা ‘ভাল মুসলমান’, তারা দেশভক্ত।কিন্তু ঐ পরিবারটি ছাড়া বাকী মুসলমান সমাজ ভারী ‘পাজী মুসলমান’, তাই তারা শাহিদকে শহীদ বানাতে চায়, শাহিদের কাজকে সমর্থন করে। এটি আরেকটি হিন্দুত্ববাদ ঘেঁষা চিন্তার প্রকাশ। যে মুসলমান নাগরিক সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য মেনে চলে, যে মুসলমান হিন্দু প্রতিবেশীকে ডেকে ডেকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়ায়, সেই মুসলমান বেশ লক্ষী ছেলে।কিন্তু যে মুসলমান নিজের ধর্মীয় অধিকারের কথা বলে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কেন গ্রেপ্তার না ক’রে উগ্রপন্থী ছেলেটিকে মেরে দিল, সেই প্রশ্ন তোলে, সে হল ভারত রাষ্ট্রে ‘পাজি মুসলমান’।
জনপ্রিয় সিনেমা আসলে সমাজের মূলধারার চিন্তার প্রতিফলন। আমাদের সমাজে বেশীরভাগ তথাকথিত উদার মানুষ, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং যারা সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন, দূর্ভাগ্যজনকভাবে তারা অনেকসময়ই নিজেদের বিশ্লেষণকে এই সিনেমাটির মত করেই সীমিত করে রাখেন। আমরা অনেক সময়ই নিজেদের সুবিধাভোগী অবস্থান থেকে, ‘উচ্চ’ অবস্থান থেকে, ভুক্তভোগীদের, এক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে মুসলমান সমাজের অবস্থা বিশ্লেষণ করতে চাই। এটি খুবই বিপজ্জনক ঝোঁক। যেমন, অনেক সভা-সমিতিতে দেখি, হিন্দু মৌলবাদের কথা বললেই, লোকজন বলেন যে, সব মৌলবাদই খারাপ। সমান গুরুত্ব দিয়েই নাকি মুসলমান মৌলবাদের কথা বলতে হবে। নিশ্চই মৌলবাদ মাত্রই খারাপ। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে হিন্দু মৌলবাদ বেশী বিপজ্জনক কারণ মুসলমানরা এদেশে সংখ্যালঘু।সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ এবং সংখ্যালঘুর মৌলবাদ কখনই এক নয়।সংখ্যার ক্ষমতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা।তাছাড়া, আজকের ভারতবর্ষে, যেখানে রোজ মুসলমানরা মার খাচ্ছে, স্বয়ং রাষ্ট্র যেখানে এদেশ মুসলমানদের দেশ নয় ব’লে মনে করে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মৌলবাদ এবং সংখ্যালঘুর মৌলবাদকে একই চোখে দেখা কিন্তু প্রকারান্তরে হিন্দুত্ববাদীদের প্রশ্রয় দেওয়া। আজকের ভারতবর্ষে মুসলমান মৌলবাদ এবং হিন্দু মৌলবাদ একইরকম ক্ষতিকারক কথাটি রাজনৈতিকভাবেও ঠিক নয় কারণ হিন্দু মৌলবাদের পেছনে এদেশের রাষ্ট্রের সক্রিয় অবদান আছে। বাংলাদেশে যা সত্য, ভারতবর্ষে তা সত্য নয়। মৌলবাদকে প্রতিটি দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা দরকার।এ বিষয়ে সাধারণ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, রাজনৈতিক ভ্রান্তির লক্ষণ।
‘মুলক’ ছবিতে এই রাজনৈতিক ভ্রান্তিই ঘটেছে।‘হাম’ এবং ‘ও’ এক হও বললেই এক হওয়া যায় না।সংখ্যাগরিষ্ঠের এবং সংখ্যালঘুর বাস্তব অবস্থানের, সুবিধা এবং সম্মান পাওয়া যতক্ষণ না এক হবে, ততক্ষণ ‘হাম’ অর ‘ও’ এক হবে না।‘হাম’-এর অবস্থান থেকে আমরা যখন ‘ও’-র দুঃখ বোঝার চেষ্টা করি, ‘ও’-কে নিয়ে সিনেমা তৈরী করি, তখন আমরা সুবিধাভোগীর চশমা পরে ভুক্তভোগীর অবস্থার বর্ণনা করি।ফলে সে বর্ণনা অনেকসময়ই হয় গতে বাঁধা (স্টিরিওটাইপ)।সে বর্ণনায় আমরা সংখ্যালঘুর পিঠ চাপড়াই, দাক্ষিণ্য দেখাই, তাদের সমান ভাবি না, যেমন এ ছবিতে মুরাদ আলি অর্থাৎ ঋষি কাপুর অভিনীত চরিত্রটিকে তার দেশভক্তির জন্য বাহবা দেওয়া হয়েছে, তাকে বেকসুর খালাস করা হয়েছে, জজসাহেবকে দিয়ে বলানো হয়েছে ভারতীয় সংবিধানে দাড়িওয়ালা মুসলমান অ্যালাউড!
সংখ্যাগুরুকে যদি সত্যিই সংখ্যালঘুর, বঞ্চিত সম্প্রদায়ের জ্বালা-যন্ত্রণা বুঝতে হয়, তাহলে সমানাভূতির চোখ দিয়ে তাদের অবস্থা এবং অবস্থানের বিশ্লেষণ করতে হবে, সহানুভূতি দিয়ে নয়।সংখ্যালঘু মানুষ আমাদের সম্মান চায়, পিঠ চাপড়ানো নয়।আমরা তাদেরই পিঠ চাপড়াই যাদের আমরা দয়া করি।অনুকম্পার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলা খুবই বিপজ্জনক কারণ অসম্মানের একপিঠ যদি দয়ামায়া হয়, অন্যপিঠের নাম তাহলে ঘৃণা।