ছুটতে ছুটতেই দারিয়ানাসু লুকোনো দরজার দূরত্ব মনে মনে মেপে নেয়, মনে মনেই একবার হাসে। নিশ্চিন্ত হবার হাসি, পেছনে ছোটা ঘোড়সওয়ারদের বোকা বানানোর হাসি। আরও পিছনে হৈ-হৈ করতে থাকা লোকগুলোকে এখন দেখা যাচ্ছে না, টিলার আড়ালে হারিয়ে গেছে। ঘোড়সওয়ারদেরও দারিয়ানাসু আগেই বোকা বানিয়ে দিতে পারত, হরিণের মতো ছুটতে পারে সে, কিন্তু পিঠের দামি বোঝাটা ফেলে দিতে চায়নি। অবশ্য তাতে কিছু ক্ষতি হয় নি তার, আর দশবার শ্বাস নিতে-না-নিতেই সে পৌঁছে যাবে লুকোনো গোল দরজার পাশে। ব্যাস, তারপর একটা ছোট্ট লাফ, তারপর দু’পলকে দরজার ফাঁকটুকু বুজে যাবে। হাঃ হাঃ হাঃ, ঘোড়সওয়ারগুলো বুঝতেই পারবে না কোথায় ভ্যানিস হল তাদের শিকার। ছাউনিতে গিয়ে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবে অন্যদের কাছে, বলবে ভুতুড়ে মানুষের কথা, যাদের দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না।
হঠাতই পরিচিত ঘড়ঘড় শব্দ কানে আসে দারিয়ানাসু-র। ঠিক যেন পাথরের একটা চাকাকে কেউ গড়িয়ে দিচ্ছে পাথরের ওপর দিয়ে। আতঙ্কে আর অবিশ্বাসে তার দুচোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়, ফুসফুসের শেষ দমটুকু দিয়ে সে চিৎকার করে—দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি এসে গেছি। একটুখানি মাত্র।
ঘড়ঘড় শব্দের আরও কাছে সে। আর একটুখানি, হে আকাশের অধীশ্বর অশ্বারোহী সাবাজিওস, আর একটুখানি, হে পাহাড়ের শস্যদায়ী মা কুবেলিয়া, আর একটু... দাঁ-ড়া-ও-ও-ও-ও-ও-ও! ওহ!!
ঘড়ঘড়ঘড়...
১
সন্ধ্যের পরে খোলা মাঠের ওপর বিরাট তাঁবুতে ঢুকে পড়ে সবাই। দিনের ক্ষমাহীন সূর্যদেবতা সল আকাশ থেকে বিদায় নেন। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধদেবতা মার্স-এর কাজকর্মে ভাঁটা পড়ে, পাহাড় আর লাল কাঁকরের ধূ-ধূ প্রান্তরের ভুতুড়ে অন্ধকারে তাঁবুর আলো মিটমিট করে জ্বলে। মাঝেমধ্যে মাটি ফুঁড়ে উঠে ঘুরে বেড়ায় অপদেবতার দল—যেদিন পুরো চাঁদ আকাশে থাকে সেই রাতগুলোতে দিব্যি দেখা যায় তাদের, পাহাড়ের গায়ে ইঁদুরের মতো নড়েচড়ে। রোমান সৈন্যরা শিউরে উঠে জুপিটার আর সমস্ত দেবদেবীদের ডাকে।
সেই কবে মার্স-এর নামাঙ্কিত মাসে যুদ্ধে বেরিয়েছিল তারা। পার্থিয়ান-দের সঙ্গে শেষ যুদ্ধ হবে। রোম আর তার মহান সম্রাট যুদ্ধে জিতে দু’শ বছরের শত্রুর নিপাত করবেন। সম্রাট ট্রাজান—মহান ইম্পারেটর সিজার নার্ভা ট্রাইয়ানাস ডিভি নার্ভি ফিলিয়াস অগাস্টাস—বলেছেন আর্মেনিয়াতে রাজার পদে বসানো ঐ লোকটা বড্ড বেশি পার্থিয়ান-ঘেঁষা। মহান ট্রাজান বহু শত্রু নিপাত করে রোমান সাম্রাজ্যকে বিশ্বজোড়া করেছেন, কিন্তু ঐ পার্থিয়ানদের জন্য শান্তি পাচ্ছেন না। পাবার কথাও নয়, মহান জুলিয়াস সিজারের বন্ধু ক্রাসাস-কে হত্যা করে ওরা, তার প্রতিশোধ দেড়’শ বছরেও ঠিক করে নেওয়া যায় নি। অতএব সেনা অভিযান। জয় রোমের জয়। জয় সম্রাট ট্রাজানের জয়। বাকি পৃথিবীটুকু জয় করবে রোম।
এক তুড়িতেই জয় হয়ে গেছে আর্মেনিয়া, বন্দী হয়েছে তার বেয়াদব রাজা। ওর ব্যবস্থা পরে হবে, এখন আর্মেনিয়া থেকে দক্ষিণ দিকে পার্থিয়ানদের আক্রমণ করবে মহান রোমের অজেয় সেনাবাহিনী।
স্থলপথে রোম থেকে আর্মেনিয়ার পথে পড়েছে আনাতোলিয়া। উত্তরে কৃষ্ণসাগর, দক্ষিণে আর পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর, উত্তর-পশ্চিম কোণে মর্মর সাগর আর তারই প্রণালী দিয়ে গ্রিস আর থ্রেসিয়া থেকে আলাদা হয়ে থাকা আনাতোলিয়া উপদ্বীপ। কিছু সমভূমি, বাকিটা পাহাড়ী ঊষর এলাকা। পুরোটা জুড়ে রোমের চারটে প্রদেশ। অনেকদিন রোমান সেনাবাহিনীর দেখা না-পেয়ে আনাতোলিয়ার নানা অঞ্চল কিঞ্চিৎ বেয়াড়া হয়েছিল, সেনা আসার সঙ্গে সঙ্গে দশদিক উজাড় করে সমস্ত খাদ্য আর পানীয় এনে দেয়নি। গ্রামের বালবাচ্চা আর জোয়ান ছেলেদের যে সম্রাটের বাহিনীতে খিদমত খাটার কাছে পাঠাতে হয়, এ কথাটাও বোকাদের দল যেন ভুলেই গেছিল। সেনাপতি কোমলমনা, তিনি মাত্র কয়েকটি গাঁ জ্ব্বালিয়ে দিয়েছেন, তাতেই অবশ্য কাজ হয়েছে। সেনাবাহিনীতে এখন খিদমত খাটার লোকের অভাব নেই। সত্যি কথা বলতে কি, খিদমতগাররা সেনাবাহিনীর সেবায় এতই প্রাণ ঢেলে দিয়েছে যে তাদের অনেকে খাবার সময়ও পায় নি, খাটতে খাটতে মরে গেছে। মহান রোমান সম্রাটের সেবায় মরেছে, জুপিটার তুষ্ট হয়ে পরের জন্মে হয়তো খোদ রোমের নাগরিক করেই পাঠাবেন তাদের—সৌভাগ্য বটে!
গ্রিস আর থ্রেসিয়া হয়ে আনাতোলিয়ার বিথিনিয়া আর গ্যালেকটিয়ায় ঢুকেছে রোমান বাহিনী। এখানকার মানুষজন রোমান সাম্রাজ্যের রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, আর রোমের প্রাদেশিক শাসকবর্গও ভালই জানেন কেমন করে প্রজাপালনের মহান ধর্ম পালন করতে হয়। তাই সেনাপতিকে দু-একটা গাঁ-জ্বালানো ছাড়া তেমন কিছু করতে হয় নি, গ্রামে গ্রামে এই বার্তা রটি গেছে ক্রমে যে সম্রাটের বাহিনী আসছে, তাদের সাদর আমন্ত্রণের জন্য তৎপর সবাই। জনবসতিও খুব কম নয় এখানে, পাহাড়ের পাশে উপত্যকায় জমি কমবেশি ঊর্বর।
কিন্তু আর্মেনিয়ার প্রায় গাঁ-ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা বিদিকিচ্ছিরি জায়গা আছে, রোমানরা বলেন ক্যাপাডোকিয়া। এসিয়া, গ্যালাকটিয়া, বিথিনিয়া আর ক্যাপাডোকিয়া—আনাতোলিয়ার এই চারটে মূল অঞ্চলের মধ্যে ক্যাপাডোকিয়া একেবারে অখাদ্য। জনবিরল, পাহাড়ে ভর্তি, পাথুরে লালমাটির দেশ, অধিকাংশ জমিতে ছিটেফোঁটা ঘাসও জন্মায় না। এখানে মানুষ কেমন করে থাকে তাই বুঝে পান না রোমান সেনানায়ক ফাবিয়াস। না, তাঁর নামের সঙ্গে মিল থাকা স্বনামধন্য পূর্বসূরী ফাবিয়াস ম্যাক্সিমাস-এর মতো রোমান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নন তিনি, তিনি লেগাটাস লিজিওনিস মাত্র, হাজার পাঁচেক সৈন্য আছে তাঁর অধীনে। তাঁর ওপর ওপরওয়ালার নির্দেশ, আর্মেনিয়ায় যুদ্ধ ঢের করেছ, এখন একটু পশ্চিমে গিয়ে হতভাগা ক্যাপাডোকিয়া অঞ্চল থেকে খানিক রসদ নিয়মমতো জোগাড় করার ব্যবস্থা কর। ক্যাপাডোকিয়া-র খবর খানিক রাখতেন ফাবিয়াস, বুঝলেন যুদ্ধ জিতে নামডাক করে মার্সের কৃপায় একদিন লেগাটাস অগস্টি প্রোপারেটরি হয়ে একটা প্রদেশের সর্বময় সামরিক কর্তৃত্ব পাবার আশায় আপাতত ছাই পড়ল তাঁর। ক্যাপাডোকিয়া এক বন্ধ্যা অঞ্চল, সর্ব অর্থেই।
তবু এলাকাটাকে না জেনে যুদ্ধ করাটা কাজের কথা নয়। তাঁরই বাহিনীতে ছোট সেনাপতি লুসিয়াস, ছোকরা নাকি নানা এলাকার হরেক খবর রাখে-টাখে। লুসিয়াস আদতে গ্রিক, কিন্তু কয়েক পুরুষ ধরে রোমান নাগরিক, আর নিকোমেডিয়া-র আরিয়ান ওরফে লুসিয়াস ফ্লেভিয়াস আরিয়ানাস-এর ভাইপোও বটে সে। রোমান নয় বটে, কিন্তু একটা ব্যাপারে ছোকড়া ভারি এলেমদার। দুনিয়ার কোথায় কারা থাকে, তাদের স্বভাব কী, তাদের পূর্বপুরুষ কারা—সব গড়গড় করে বলে দেয় এক নিঃশ্বাসে। ওর খুড়োমশায়ের নাকি কীসব রোজনামচা আর বই আছে এসব নিয়েই, আর সেগুলো স্বহস্তে কপি করেছিল এই ছোকরাই। খুড়ো আরিয়ান এসব লিখে-টিখে রোমান দরবারের ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছেন, গ্রিক হলেও তিনি যে কোনোদিন নাকি সেনেটর হয়ে উঠতে পারেন। শুনে একটু গা-জ্বালাই করে খাস রোমান প্যাট্রিসিয়ান ফাবিয়াস-এর। কিন্তু গরজ বড় বালাই, ছোকরা যখন হাতের কাছেই আছে, আর ঐ পাহাড়ী রুক্ষ ক্যাপাডোকিয়াতেই তাঁকে যখন সেনাবাহিনীর রাক্ষুসে রসদ জোগাড় করতে হবে, ছোকরার কাছ থেকে ঘাঁতঘোঁত জেনে না নেওয়াটা বোকামি হবে। ফাবিয়াস এত্তেলা পাঠালেন লুসিয়াস-কে।
২
সর্দার দারিয়ানরিও-র মুখ আলোআঁধারিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তেলের পিদিমটা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। সর্দারের গলা কিন্তু শোনা যাচ্ছে সব জায়গা থেকেই। ঘর আর তার সামনে গুঁড়ি মেরে হাঁটার সুঁড়িপথ পেরিয়ে শব্দ যাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে দুটো তলার প্রায় সমস্ত লোক। অবশ্য গোটা জায়গাটাই ঢাকা, ছোট ছোট ঘরগুলো সুড়ঙ্গ দিয়ে জোড়া একে অন্যের সঙ্গে, আর কথাও বলছে না অন্য কেউ। দারিয়ানরিও সভাতে কথা বললে এখানে সবাই চুপ করে শোনে। মাটির ওপরে থাকার সময়ে সভার মধ্যেই যে যার মতো ফিসিফিস করে কথা বলত মাঝেমধ্যে, হেসে উঠত কখনওবা কোনো চ্যাংড়া ছোকরা বা মেয়ের দল। এখানে কিন্তু সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে কথা শোনে। আড়াই মাসে এই অভ্যাসটা তাদের রপ্ত হয়ে গেছে। আরও অনেক কিছুই রপ্ত হয়েছে। যেমন বেড়ালের মতো অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে চলা, ইঁদুরের মতো যে যার কুঠুরি চিনে ঢুকে পড়া, ফিসফিস করে কথা বলা। জোরে কথা বললে সুড়ঙ্গপথে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর, এমনকি ওপরতলার ছাগলছানাগুলো পর্যন্ত কান খাড়া করে শোনে তাদের খেতে দেবার মানুষের গলার স্বর, অনেকদিন শুকনো খাবার চিবিয়ে মনমরা ঘোড়াগুলো কান খাড়া করে দানাপানির আশায় চিঁ-হিঁ করে ওঠে, শব্দ শোনা যায় চার-পাঁচতলা নীচ থেকে।
দারিয়ানরিও বলে, তার গলার স্বরের তালে তালে পেছনের দেয়ালে তার ছায়াটা ভূতের মতন নাচতে থাকে, প্রদীপের আলোয় তার পেশল পাকানো শরীর আর মুখের বলিরেখা মাঝেমধ্যে দেখা যায়, আবার কখনওবা মানুষটা আবছা হয়ে যায়। কিন্তু কথাগুলো কাটা কাটা, শুনতে ভুল হবার জো নেই— “ঝরনাটা শুকিয়ে এসেছে, আমাদের গর্তে জল বড় কম। জালা করে রাতের বেলা জল আনা শক্ত হয়ে যাচ্ছে দিন-কে-দিন, ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে, দেখে ফেলবে গর্তের মুখ।”
গর্তই বটে, মনে মনে ভাবে দারিয়ানাসু। সতের বছরের জীবনে অনেক ইঁদুর আর খরগোশের গর্ত দেখেছে সে, গর্ত থেকে বের হতেই খুঁচিয়ে শিকার করেছে তাদের। কিন্তু নিজেরা গর্তে থাকার কথা ভাবেনি কখনও, ভাবেনি তাদের শিকার করার জন্য ওত পেতে থাকবে গর্তের ওপরে কিছু লোক। তার বুড়িদাদি ওকোমাহীসা, উটের লেজের ঝালরের মতো খসখসে চুলে ভর্তি মাথা তার, সেই মাথার উকুন মারতে মারতে ছোটবেলাতে দারিয়ানাসু-কে বলত অবশ্য এই গর্তের কথা। গর্তের মধ্যে আটকা পড়ে দিনরাতের হিসেব গুলিয়ে যাবার কথা। আর বাবা-কাকা-জ্যাঠারা আঙ্গুর চাষ, মদ বানানো আর শস্য তোলা-ঝাড়ার ফাঁকে ফাঁকে একসাথে যেত কোথায় যেন গর্ত পরিষ্কার রাখতে। কিন্তু দারিয়ানাসু ভাবত গর্ত বোধহয় দেব-দৈত্যদের থাকার জায়গার মতো দূরে, অন্য কোনোখানে। ছাগল চরাতে আসার পথে দেখা এই যে রুখু মাঠটাকে সে গাল পাড়ত আপন মনে একটা ঘাসও জন্মাতে দেয় না বলে, তার তলাতেই যে এই গর্ত, সেকথা বড়রা কেউ দারিয়ানাসু-কে ঘুণাক্ষরে জানতে দেয়নি।
বুড়িদাদি ওকোমাহীসা এখন বসে আছে দারিয়ানরিও-র কাছটাতে, তার খসখসে চুলভর্তি মাথাটা নড়ছে তালে তালে, যেমন সেটা নড়ে থাকে সবসময়। কথা বলতে গেলেই মাথা আরও নড়ে আর কাশি আসে, দম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দলের সর্দার দারিয়ানরিও-র পাশে সে বসে থাকবে যতদিন না সে একেবারে নিঃশ্বাস ফেলতেই ভুলে যায়, আর তাকে ধরাধরি করে শুইয়ে দেওয়া হয় মাটির তলায়। বুড়ি শুধু সর্দারের মা তাই নয়, তার মতো পুরনো দিনের কথা আর কেউ জানে না। গর্তের আট হাজার মানুষের প্রায় সকলকে সে নামে চেনে, এখনও অনেকের মুখ দেখেই গ্রাম-গোত্র-বাপ-মা সবার কথা বলতে পারে। ফোকলা দাঁতের ফাঁকে ওকোমাহীসা বলে ওঠে—“আরেকটা তলা তোরা খুঁড়ে পরিষ্কার করতে পারলি না? যত্তসব কুঁড়ের দল! এগারোতলা খুঁড়লেই আরেকটা জলের গর্ত পাবি, তার জল আসে পশ্চিমের ঐ নীচুপাহাড়ের ঝরনা থেকে। ঐ ঝরনা শুকোতে দেখিনি আমার জীবনের একাশি শীতেও, আমার দাদিমা বলত...” কী যে বলত তা জানা হয় না, কাশির দমক সামলাতে সামলাতে ওকোমাহীসা ছুটে যায় লম্বা-চিমনির দিকে, লোকে সরে সরে পথ করে দেয় তাকে, আর চিমনি দিয়ে নেমে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া খাবি খেতে-খেতে বুকে ভরে সে, ঠিক যেন ডাঙায়-তোলা মাছ।
সর্দার দারিয়ানরিও নীচু স্বরে বলে, “আরেকটা তলা খুঁড়ব। খুঁড়তেই হবে। পূর্ব দিক থেকে এবার এসেছে বটে এরা, কিন্তু এরা পশ্চিমের লোক। যুদ্ধ করছে কারও সঙ্গে। সহজে ফিরে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু তার আগেই তো জল ফুরিয়ে যাবে আমাদের...।”
কথাটা যে সত্যি সেটা জমায়েত হাজারখানেক মানুষ ভালভাবেই জানে। আগে তাদের কেউ ভাবতে পারেনি যে এই পুরনো গর্তগুলোতে এতদিন ধরে থাকতে হবে। ওকোমাহীসা-র বুড়ি দিদিমাও নাকি দুমাসের বেশি গর্তে থাকার দিনের কথা গল্প করে বলেনি কখনও, আর সেই বুড়ি মরেছে দারিয়ানাসু-র বাপ দারিয়ানওস-এর জন্মের সময়। সেই বুড়ি বলত, পশ্চিম থেকে এসেছিল ঘোড়ায়-চড়া সৈন্য, আর এইরকম বর্ম পরে তরোয়াল তীরধনুক বর্শা দিয়ে মানুষ শিকার করত তারাও। তখন এ-অঞ্চলে সর্দার ছিল আইকোমাহায়ান, সে আগেভাগেই খবর পেয়েছিল সৈন্যরা আসছে। আঙুর ক্ষেত চাষ আর ছাগল ভেড়ার পাল চড়ানো ছেড়ে পুরো দুমাস ধরে হাজার হাজার লোক সেবার পুরনো গর্তটাকে খুঁড়ে বড় করেছিল। পুরনো গর্তটা নাকি ছিল ন’তলা, আইকোমাহায়ান-এর আমলে সেটা তেরোতলা হয়। কিন্তু সে অনেক আগেকার কথা। তারপর সব শান্তিতে কাটছিল, নিজেদের মধ্যে মাঝেমধ্যে ঝগড়া-মারামারির বেশি ভয়ঙ্কর কিছু হয়নি কখনও।
সর্দার দারিয়ানরিওর গলা শোনা যায় আবার। এবার জোরদার উঁচুগলার স্বর, কোনো দ্বিধা নেই। “সমস্ত জোয়ান ছেলের দল, তোমরা যাবে ওপরে, জালা নিয়ে। জল আনবে উত্তরের ঝোরা থেকে, আর দেখে আসবে পশ্চিমের ঐ নীচুপাহাড়ের ঝরনা এখন কেমন আছে। শুনেছি পাথরের তলায় ঢুকে এখনও বইছে তার জল। যদি তাই হয়, ভাল কথা। নইলে যদি শুকিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে শুধুই উত্তরের ঝোরার জল ছাড়া আর গতি নেই। আর মাঝবয়সী সবাই! আমরা যাব নীচতলায়, খুঁড়ব আরেকটু, দেখি এগারতলায় নেমে যদি জলের গর্তটা পাই...।”
কথা শেষ হতে-না-হতেই ওকোমাহীসা বলে, “পাহাড় থেকে শেষ পাথর গড়িয়ে নেমেছিল তোর জন্মেরও আগে। মাটি কেঁপেছিল, আর পূবের পাহাড়ের ঝরনাটা গেছিল হারিয়ে। তারপর থেকে আর কোনও...” বলতে বলতে কাশির দমকে কথা বন্ধ হয়ে যায় তার, কিন্তু সমবেত কারও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে পশ্চিমের নীচুপাহাড়ের ঝরনা হারিয়ে যাবার কোনও কারণ নেই। আশায় মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, প্রদীপের আলোয় চোখগুলো চকচক করে। জল ছাড়া কী করে বাঁচবে তারা?
আরও দু-চার কথার পর দুটো হাত মাথার ওপর তুলে নাড়ে দারিয়ানরিও, জমায়েত ভাঙ্গার নির্দেশ। মানুষজন সব চলে যায়, যে যার কোটরে ফিরে শুকনো রুটি আর হয়তো একটুকরো নোনতা মাংস খেয়ে শুয়ে পড়বার আগে গলা ভিজিয়ে নেবে এক আঁজলা আঙ্গুরের মদে। আর ভাববে মদের বদলে যদি একটুখানি জল পাওয়া যেত! তবে সবাই এখনই যায় না, দশ তলার দশ গোষ্ঠীপতি থেকে যায়। শলা করে ঠিক করতে হবে কাজের ধারা।
৩
সেনাপতির তাঁবুতে নীচু হয়ে ঢোকেন লুসিয়াস। ফাবিয়াসের এত্তেলা নিয়ে লোকজন অনেক কষ্টে খুঁজে পেয়েছে তাকে। লোকদের দোষ নেই, সন্ধ্যেবেলা যখন অন্য সব সুবেদার-মনসবদার একটু গা এলিয়ে দেয়, গা-টেপায় খিদমতগার দিয়ে, চেখে দেখে স্থানীয় আঙুর-রসের মদ, সেই সময় লুসিয়াস একা একা কথা বলছিলেন হপ্তাকয়েক আগে ধরা-পড়া লোকগুলোর সঙ্গে। আজব চিড়িয়া এই লোকগুলো। কথা বলে ইহুদিদের ভাষায়। ইহুদিরা এমনিতে রোমান সাম্রাজ্যেরই প্রজা, কিন্তু তাদের রোমের অনুগত হবার নাম নেই—রোমান দেবদেবীদের বদলে আকাশে থাকা কোন এক ঈশ্বরের পুজো করে এরা, সে ঈশ্বর নাকি জুপিটারের চাইতেও ক্ষমতাধর। সদাশয় রোমের সম্রাট তাদের ধর্মাচরণে বাধা দেন নি। কিন্তু লোকগুলো যেমন বোকা তেমনই গোঁয়ার। কয়েক দশক ধরে মহান সম্রাটদের নানাভাবে চটিয়েছে ইহুদিরা, যখন তখন বিদ্রোহ করেছে, আর কচুকাটা হয়েছে দলে দলে। কচুকাটা হতে দেখলেও ইহুদিদের ঈশ্বর নড়ে বসেন না, তবু ইহুদিরা সেই ঈশ্বরকেও ছাড়বে না, নিজেদের একলষেঁড়ে স্বভাবও না।
জুডিয়া-তে তাদের নিজেদের রাজত্বই ছিল বলা যায়, তা ছাড়াও সারা রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিব্যি ছিল তারা। কিন্তু সম্রাটের সামান্য কয়েকটা হুকুমের জন্য বিদ্রোহ করে জুডিয়া খুইয়েছে, তাদের সাধের সে দেশ সিরিয়া-প্যালেস্টিনা আর অ্যালিয়া-ক্যাপিটোলিয়া হয়ে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে। কিছু ইহুদি সম্রাটের অনুগত আছে ঠিকই, আবার অনেকেই পালিয়েছে। অবশ্য বিশাল এই রোমান সাম্রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাবেই বা কোথায়। তারা সম্রাটের কাছ থেকে পালিয়ে সাম্রাজ্যেরই আনাচে-কানাচে আছে। নিজের মতো করে থাকার চেষ্টা করছে তারা, আর তাদের আজব ঈশ্বরের পুজো করছে। তেমন কিছু ইহুদি হয়তো ছিটকে এসে পড়েছে ক্যাপাডোকিয়া-তে। লুসিয়াস জানেন এখানে লাল নরম পাথরের পাহাড়ের গায়ে গুহা খোঁড়া আছে অনেকদিন ধরেই, তারই দু-একটাতে আশ্রয় নিয়েছে এই ইহুদিরা। হয়তো নরম পাথর খুঁড়ে বানিয়েছে নতুন গুহাও। কিন্তু এই ইহুদিদের গলায় ঝোলানো কাঠের টুকরোটা লুসিয়াসকে অবাক করে। দেখতে অনেকটা ক্রসের মতো। সেই কাঠের টুকরোটাকে যেন পারলে পুজোই করে এরা। বলে, এটা ঈশ্বরের পুত্র। দেয়ালেও ঝুলিয়ে রাখে পুজোর জন্য।
বয়স অল্প হলেও লুসিয়াস নিজেকে এইসব ব্যাপারে জ্ঞানী বলেই ভাবেন, আর সেটা নেহাত অকারণ নয়। সাম্রাজ্যের ভেতরে আর বাইরে শ’খানেক ধরনের মানুষের হাড়হদ্দ জানেন তিনি। কিন্তু কাঠের টুকরোকে ঈশ্বরপুত্র বলে পুজো করার মতো কোনো ইহুদি দলের কথা তাঁর জানা ছিল না। এদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে চেষ্টা করছিলেন এরা এল কোথা থেকে, আর এই ঈশ্বরপুত্র ব্যাপারটাই বা কী। খুব বেশি বুঝতে পারেন নি এখনও। এটুকু বুঝেছেন যে ইহুদিদের কোনো এক র্যাব্বিকে নাকি শ’খানেক বছর আগে ক্রুশে ঝুলিয়েছিল রোমান কোনো শাসক, আর এরা সেই ব্যাব্বিরই শিষ্য। হয়তো মহামান্য সম্রাট নিরো যাদের রাজকীয় উদ্যানে তেলে চুবিয়ে জ্যান্ত পোড়াতেন, এরা তাদের দলেরই কেউ হবে। নাঃ, এরা তাহলে বেশ বড় গোষ্ঠী হয়ে উঠছে, ভাবেন লুসিয়াস। এদের নিয়ে খুড়োমশাই কিছু লিখেছেন কিনা দেখতে হবে।
এসব গভীর চিন্তার মধ্যে হঠাত সেনাপতির তলব। লুসিয়াস মনে মনে ফাবিয়াস-কে একটি আকাট গণ্ডমূর্খ ভাবলেও জানেন যে এখনকার মতো তাঁর দণ্ডমুণ্ডের মালিক এই আকাট লোকটিই। দ্রুতপায়ে সেনাপতির তাঁবুতে আসেন তিনি, অভিবাদন করে সামনে আসেন ফাবিয়াসের। ফাবিয়াস হাত নেড়ে গা-মালিশ করা সুকুমার বালকটিকে বাইরে যেতে বলেন। ইঙ্গিতে লুসিয়াসকে নীচু আসনটি দেখিয়ে দেন। লুসিয়াস পুনরায় অভিবাদন করে আসন গ্রহণ করেন।
ফাবিয়াস বলেন– লুসিয়াস, তুমি নাকি অনেক দেশের অনেক খবর রাখ? এদেশের মানুষজন সম্পর্কে কিছু জানো-টানো? এই যে লোকগুলো আঙ্গুরক্ষেত বানিয়েছে, গ্রাম বানিয়েছে, এরা গেল কোথায়? আমার সৈন্যরা রাত্রে যে ভূত দেখে, দিনের বেলা দূর পাহাড়ের গায়ে যেসব ছাগল আর ঘোড়া চরতে দেখে, তারাই বা আসে কোত্থেকে, আর উবে যায় কেমন করে? কারা থাকে এখানে?
লুসিয়াস বলেন– মহামহিম সেনাপতি, সৈন্যরা তাদের কয়েকজনকে ধরেছে, আমি তাদের সঙ্গেই কথা বলছিলাম এখন। তার ইহুদি, তবে আজব এক নতুন র্যাব্বির উপাসক।
মহামহিম সম্বোধনে খুসি হন ফাবিয়াস। সামনের পাত্রে একটা বড় চুমুক দেন। না, রোমান মদের ধারেকাছে আসতে পারে না এখানকার আঙুর থেকে তৈরি এই পানীয়, কিন্তু এত দূরে বর্বরগুলো যে এটুকুও বানিয়েছে, এটাই জুপিটারের পরম করুণা। বলেন— দেখ লুসিয়াস, এই ইহুদিগুলো এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক। এদের খবর আমি পেয়েছি আগেই। পাহাড়ে ঐ গুহাগুলো আগে থেকেই ছিল, ওরা এসে বাসা করেছে বেশিদিন নয়। কিন্তু, আমার লোকেরা সব গুহা তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, মানুষ বলতে ঐ ক’টা ইহুদি? তারা ধরা পড়ার পরেও সৈন্যদের অপদেবতা দেখা বন্ধ হয়নি। উঁহু, এখানে আরও কিছু রহস্য আছে। কী রহস্য, সেটা ধরতে গেলে হয়তো এখানকার পুরনো দিনের কথা জানলে সুবিধা হবে। তুমি যা জান আমাকে শোনাও দেখি।
লুসিয়াস বোঝেন, সেনাপতির প্রশ্ন অনেক গভীরে। ঠিক কী জানতে চাইছেন, কী বললে খুশি হবেন তিনি, তা জিউস-ই জানেন। সতর্কভাবে শুরু করেন লুসিয়াস।
—অনেকদিন আগেকার কথা, সব কথা সত্যি কিনা, কেউ জানে না। লোকের মুখে চলে আসা কথা সব, কোন কথাটা লোকের বানানো আর কোনটা সত্যিই ঘটেছিল, সেটা জানার কোনও উপায় নেই। তবু পণ্ডিতেরা যেমন বলেন, আমি তাঁদের কথা শুনে বলছি, ভুল হলে ক্ষমা করবেম, মহামহিম।
অনেকদিন আগে এখানে রাজত্ব করত হাট্টি-র লোক। তারা কোথা থেকে এখানে এসেছিল কেউ জানে না। হাট্টি-তে প্রথম এসেছিল বলে এদের নাম হয়ে যায় হিট্টাইট, রাজধানীকে বলে হাটুসা, আর তাদের মহান এক রাজা নাকি হাটুসেলি। তাদের মধ্যে যেমন মানুষ ছিল, তেমন ছিল দৈত্যরা। দৈত্য আর মানুষ মিলেমিশে থাকত। তারা তৈরি করেছিল বিরাট সব পাথরের দুর্গ, বিশাল পাথরের চাঁই তুলে তুলে তার প্রাচীর গেঁথেছিল দৈত্যরা। এখানকার মাটি থেকে নাকি তামা আর টিন তৈরি পারত দৈত্যরা, আর তা থেকেই বানাত ব্রোঞ্জ। দৈত্যরা এখানকার মানুষদের ব্রোঞ্জ বানানো শেখায়, তারপর শেখায় লোহা বানানো। ঘোড়ায় টানা রথে চড়ে যুদ্ধ করত এরা। সেসময়ের সেরা নগর ব্যাবিলন জয় করেছিল এরা, কিন্তু সেখান থেকে আবার ফিরে আসে এখানেই। কেবল যুদ্ধ নয়, একসময় পুরনো গ্রিস, নীলনদের দেশ আর ব্যাবিলনের সঙ্গে বাণিজ্য করে বিস্তর সোনা রুপো জমিয়ে ফেলেছিল হিট্টাইটরা। সেই সময় নীলনদের ধারের মহান ফারাও তুতেনখামুন বালক অবস্থাতে মারা গেলে তাঁর বিধবা রাণী এদের রাজপুত্রকে বিয়ে করার জন্য ডেকে আনেন। রাণীকে বিয়ে করলে সেই হিট্টাইট রাজপুত্রই নীলনদের দেশের ফারাও হয়ে বসত। তাই ফারাওয়ের উজির তাকে মাঝপথে মেরে ফেলে, সিংহাসনে বসে অন্য এক ফারাও। সেই থেকে শুরু হয় হিট্টাইটদের সাথে ফারাওদের যুদ্ধ। মহান ফারাও র্যামেসিস এদের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে সন্ধি করেছিলেন।
—হিটাইট-দের কথা তেমন শুনিনি আমি, তা ঠিক। ফাবিয়াস মুখ খোলেন। “কিন্তু তুমি অনেক আগেকার কথা বলছ। হিট্টাইটরা নিঘঘাত কবেই মরে হেজে গেছে।”
—ঠিক বলেছেন মহামহিম, হিট্টাইটরা সব মরে গেছে বলেই মনে হয়। কিন্তু কী করে যে মরল তারা তা কেউ জানে না। সমুদ্র থেকে মানুষ এসে তাদের তাড়িয়েছে, এমন লিখে গেছেন এক ফারাও। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তাই কি? নাকি তারা এখনও বেঁচে আছে, হয়তো দৈত্যদের সঙ্গে থেকে থেকে অপদেবতা হয়ে আছে!
তবে হিট্টাইটরা একা এখানে এসেছিল, তা নয়। আরও কত দেশ থেকে আসে কত সৈন্য আর বণিকের দল। ট্রয়ের পতনের পড়ে সেখান থেকে আসে ট্রোজানরা। তারপর আসে হেলেন-বংশীয় প্রাচিন গ্রিকরা। দিগ্বিজয়ী আলেক্সান্দার আসার আগেই এখানকার মানুষজন হেলেনীয় সভ্যতার গৌরব কিছুটা পায়। শাহেনশাহ সাইরাস আর দারায়ুসের আমলে এখানে পারসিকদের রাজত্ব হলেও, পারসিক ধর্ম এখানে তেমন ছড়াতে পারেনি। বরং হেলেনিক ধর্ম এখানকার স্থানীয় ধর্মের সঙ্গে খানিকটা মিশে আধা-হেলেনিক সভ্যতা তৈরি করেছে। সভ্যতা বলছি বটে, কিন্তু এই ক্যাপাডোকিয়া অঞ্চলটি বড্ড পাহাড়ী আর অনুর্বর। এখানকার মানুষজন থাকে ছোট ছোট গ্রামে, আঙুর চাষ, একটু শষ্য ফলানো, আর ছাগল-ভেড়া চরানো ছাড়া তেমন কিছু জানে না। অসভ্যই বলা যায়...
সেনাপতি ফাবিয়াস অধৈর্যভাবে মাথা নাড়েন। আলেক্সান্দারার-এর কথা বলতে পারলে এই হতচ্ছাড়া গ্রিকগুলো কাজের কথা ভুলে যায়।
— আরে বাপু আলেক্সান্দার আর সাইরাসের কথা শোনার জন্য তোমাকে ডেকেছি নাকি? কাজের কথায় এস। এখানে গুহাগুলো অমন করে বানাল কারা? আর মাটির নীচে থাকা শহর, সে কি কেবল গল্পকথা? তাহলে আমাদের সৈন্যরা রাতের বেলা মানুষ দেখে কেন, যাদের দিনের আলোতে খুঁজে পাওয়া যায় না? একেবারে গোড়া থেকে বল এখানকার কথা। কে বানাল এই পাহাড় আর বিরাট এইসব খাদ, লাল পাথুরে মাটি? কে বানাল মাটির নীচে...
৪
—মাটির নীচে এই গর্তের মতো শহর বানিয়েছিল আমাদেরই কোনও পূর্বপুরুষ। তারা মানুষ ছিল নাকি দৈত্য, কেউ জানে না... দুলে দুলে বলতে থাকে ওকোমাহীসা, তার উটের লেজের মতো চুলে ভরা মাথাটা নড়তে থাকে কথার তালে তালে। কাশি সামলায়, আর কথা বলে...
—তারও আগে, অনেক কাল আগে, আমরা থাকতাম দুই পাহাড়ের মাঝখানে সবুজ এক রাজত্বে। আমাদের রাজা থাকত আমাদেরই সাথে, আমাদের মতন কুঁড়েঘরে। তারা পুজো করত সূর্য-চন্দ্র আর পাহাড়কে, পুজো করত ঝরনাকে, চাঁদের আলোর ঝরনার পাশে নাচত-গাইত, আঙুরের মদ খেয়ে হেসে উঠত আকাশ ফাটিয়ে। তারপর... তারপর একদিন ঘোড়ায় চড়ে বাইরে থেকে আসে এক দস্যুদল। আমাদের ছাগল আর ফসল লুটে নিল, আমাদের মেয়েদের জোর করে নিয়ে গেল তাদের ঘরে। সেই থেকে আমাদের আদি পুরুষরা হারিয়ে যায়, কেবল যেদিন পুরো চাঁদ ওঠে, সেদিন নীঁচুপাহাড়ের ওপার থেকে ভেসে আসে ঝরনার শব্দের মতো মিষ্টি তাদের গানের সুর। একবার সেই সুর কানে গেলে পথ হারায় জোয়ান ছেলেরা, পাহাড় পেরিয়ে চলে যায়, আর ফিরে আসে না।
নতুন-আসা মানুষগুলোর সঙ্গে ছিল যাদুকর আর দৈত্যদের দল। বড় বড় চুল্লি বানিয়ে তার মধ্যে পাথর গলিয়ে করে বের করত চকচকে বর্শা আর তিরের ফলা, কুড়ুল আর গদা। তৈরি করত চাকা আর চাকার ওপরে চলা ঘোড়ায়-টানা গাড়ি। সেই গাড়ি চড়ে যুদ্ধ করত তারা। যুদ্ধে হারলে তারা লুকিয়ে পড়ত মাটির তলার এই শহরে। অনেক অনেক লম্বা-চওড়া ছিল এইসব শহর। অনেক অনেকগুলো শহর ছিল তখন, মাটির নীচ দিয়ে তারা চলে যেত এক শহর থেকে আরেক শহরে। আবার ওপরে উঠে এসে যাদুবলে ছাগল বা কুঁজওয়ালা এক জন্তু সেজে সমস্ত ফসল তুলে আনত তারা, শত্রুর দল চিনতেই পারত না তাদের। তারপর সময় হলেই একদিন তারা উঠে আসত মাটির ওপরে, ঘুমন্ত শত্রুসৈন্যদের মেরে ফেলত।
বছরের পর বছর এইভাবে যেত। পুরনো দস্যুরা চলে যেত অন্য কোথাও, কিংবা এখানে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে ভুলে যেত যুদ্ধবিগ্রহ। ছাগল ভেড়া চরাত, আঙুর ফলাত ক্ষেতে, আর গান গাইত, নাচত, হাসত... ঠিক সেই পুরনো মানুষদের মতো। তারপর একদিন আবার আসত নতুন দস্যু। আবার তারা লুটপাট করত, আর মেয়েদের ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে যেত তাদের ঘরে, পুরুষরা মারা পড়ত কিংবা পালিয়ে যেত সেই দূরে, আকাশ যেখানে মাটিতে ঠেকে। সেখানে বানাত নতুন ঘর, হয়তো বানাত মাটির নিচের নতুন শহর।
কাশতে কাশতে বেদম হয়ে থামে ওকোমাহীসা। বুড়ি-আধবুড়ি একগাদা মেয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে তার কথা শুনছিল দারিয়ানাসু। এসব গালগল্প তার তেমন ভাল লাগেনা, কিন্তু তার ঠাকুদ্দা সর্দার দারিয়ানরিও-র হুকুম। এসব শুনলে নাকি নীচুপাহাড়ের ঝরনা খোঁজার কাজে সুবিধা হবে। উত্তরের ঝোরা থেকে জল আনার কাজটা দু’দিন করেই বড্ড একঘেয়ে লাগছিল দারিয়ানাসু-র। বিদেশি সৈন্যগুলো সংখ্যায় অনেক, আর হাতে অস্ত্রও আছে, কিন্তু মাথায় বুদ্ধি তেমন নেই। রাতের বেলা তিনজন মিলে জালা জালা জল আনল তাদের চোখে সামনে দিয়ে, তাঁবুর সামনে পাহারা দেওয়া লোকগুলোকে দিব্যি দেখতে পেল তারা, কিন্তু লোকগুলো তাদের দেখেও দেখল না যেন। অবশ্য গায়ে শুকনো গাছের ডালপালা জড়িয়ে হাঁটছিল তারা, দূর থেকে দেখে লোকে ভাববে যেন একটা শীতকালের গাছই হাঁটতে শুরু করেছে। জল আনার কাজটা ম্যাড়মেড়ে লাগছে দারিয়ানাসু-র, সে ঠাকুদ্দাকে বলে-কয়ে পশ্চিমের ঐ নীচুপাহাড়ের ঝরনা খোঁজার কাজটা নিয়েছে। কাল থেকে শুরু হবে তার নতুন কাজ। কিন্তু ঠাকুদ্দা বলে দিয়েছে, বুড়ির গালগপ্প শুনে তবে যাস ওখানে।
কাশি সামলে ওকোমাহীসা বলে চলে...
—দৈত্যদের দল নীচের এই শহরটা বানায় তাদের পাতালপুরীর মতো করে। পাথর গলিয়ে পাওয়া চকচকে অস্ত্র দিয়ে নরম পাহাড় খোঁড়ে। খুঁড়ে খুঁড়ে প্রথমে বানায় হাওয়া-চিমনি। লম্বা সোজা গর্ত, তার তলা দেখা যায় না। হাওয়া-চিমনির মাথাটা টুপির মতো ঢাকা থাকে ছোট্ট টিলার তলায়, আশেপাশে গভীর খাদ কিংবা খাড়াই পাহাড়, যেন কেউ দেখতে ্না পায় চিমনির পাশে হাওয়া ঢোকার খোলা গর্ত। তারপরে মাটির নীচে, চিমনির পাশে খোঁড়ে ঘর। খোঁড়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাবার সুড়ঙ্গ। একের পর এক ঘর আর সুড়ঙ্গ সাজিয়ে সাজিয়ে তৈরি করে শহরের এক-একটা তলা। আমাদের এই শহরে এক-একটা তলায় লোক ধরে পাঁচ-ছ’শ জন। কোন শহর নাকি আছে যেখানে এক-একটা তলায় লোক ধরে একহাজার দুহাজার। এরকম করে হাওয়া চিমনি যত নীচে যায়, তার পাশে তৈরি হয় শহরের একতলা-দোতলা-তেতলা। ওপরের তলার ঘরগুলো বড়, আর সেখানে, একতলা-দোতলাতে, পোষা জন্তুগুলো পুরে রাখার ব্যবস্থা। একটা তলা থেকে নীচের তলায় নামার ঢালু সুড়ঙ্গ। যত নীচের তলা, সুড়ঙ্গ তত সরু, ঘরগুলো ছোট ছোট। রান্না করা আর মদ বানানো, জন্তুগুলোর খাবার রাখা আর তা কেটেকুটে দেবার ব্যবস্থা করা, সবাই মিলে জমায়েত হওয়া—এসবের জন্য একতলা-দোতলা-তিনতলায় বড় ঘর আর চওড়া সুড়ঙ্গ। তার নীচে সব সরু আর ছোট।
—তা এসব শহরের খোঁজ কোনোদিন পেত না শত্রুরা? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে এক কমবয়সী মেয়ে। যদি বুড়ি ওকোমাহীসা বলে ওঠে, হ্যাঁ, শত্রুরা খোঁজ পেত, তাহলে তাদের খোঁজও তো পেয়ে যেতে পারে মাটির ওপরে থাকা সৈন্যরা, নেমে আসতে পারে সুড়ঙ্গে, গুঁড়ি মেরে বর্শা আর তলোয়ার চালিয়ে মেরে ফেলতে পারে তাদের সব্বাইকে।
—খোঁজ যে কোনোদিন পায় নি এমন নয়। আমার বুড়িদাদিমা-র বুড়িদাদিমা গল্প করে গেছে সেই সময়ের কথা। এক রাজার সৈন্যরা ওপরে বসে নজর রাখছিল, ঠিক আজকের মতো। এক রাতে এক জোয়ান ছেলে দূর পাহাড়ের পেছন থেকে লুকনো আঙুরক্ষেতের আঙুর নিয়ে আসছিল মাটির নীচের এই শহরে। চুপিচুপি তার পিছু নেয় সৈন্যরা। ওপরের দরজা খুলতেই তাকে আর ওপরের পাহারদার দুজনকে মেরে একতলার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে তারা। টের পেয়ে আমাদের সবাই একতলা ছেড়ে নিঃসাড়ে নেমে পড়ে। দোতলা আর তেতলায় বর্শা নিয়ে জমা হয় সবাই। রাজার সৈন্যরা ঢুকে পড়ে দেখে, ছাগল, ঘোড়া আর উট বাঁধা রয়েছে, কেউ কোথাও নেই। প্রথমে বুঝতেই পারেনি তাদের পায়ের নীচে আরও অতগুলো তলা আছে। জন্তুগুলো নিয়ে পালানোর সময় বোঝে তারা, আর দোতলায় নামার সুড়ঙ্গের দরজা খোলার চেষ্টা করে।
তোরা দেখেছিস তো, দরজা বন্ধ করার গোল পাথরটা কেমন? ভেতর থেকে দুজন মাত্র জোয়ান লোক দরজার পাথর গড়িয়ে দরজা খুলতে পারে, বন্ধ করতে পারে। বাইরের দিক থেকে পাথরটা ধরার কোনও উপায় নেই, খোলা খুব শক্ত। কিন্তু রাজার সৈন্যরা তা জানে না। বাইরে একগাদা সৈন্য যেই গায়ের জোরে দরজা খুলতে এগিয়ে গেছে, দরজার মাঝখানের ফুটো দিয়ে বর্শা চালিয়েছে আমাদের লোক। মারা পড়েছে সব্বাই।
তবে রাজার সৈন্য ছিল অনেক। একসময় তারা দরজা ভেঙ্গে ঢুকল একতলায়। ছোট সুড়ঙ্গপথ ছাড়া এগোনোর কোনো রাস্তা নেই। তারা যত এগোতে যায়, লম্বা বর্শা আর কুড়ুল হাতে সামনে দাঁড়ানো আমাদের এক জোয়ান তাদের মেরে ফেলে, সেই জোয়ানকে মারতে মারতে তাদের অর্ধেক সৈন্য শেষ। তারপর এগোতে-না-এগোতেই পাশ থেকে তাদের দেহে ঢোকে বর্শা আর কুড়ুল। পাশে কোথায় যে ছোট ছোট সুড়ঙ্গ আছে, আর তার কোনটাতে বর্শা হাতে আছে আমাদের জোয়ান ছেলেগুলো, সেসব বোঝার আগেই শেষ হয়ে যায় রাজার সেনা। দু-একজন পালিয়ে খবর দিয়েছিল ওদের তাঁবুতে। ওদের মরেছিল তিন-চারশো, আমাদের চারজন মাত্র। পালানো সৈন্যরা বলে সুড়ঙ্গের দানোর কথা। পরদিন সৈন্যরা তাঁবু গুটিয়ে পালিয়ে যায়। আর আসে নি।
—আমাদের গোল পাথরের গড়ানো দরজা আর সুড়ঙ্গ থাকতে কেউ কিছু করতে পারবে না... বলে ওঠে দারিয়ানাসু-র পাশে দাঁড়ানো তার সঙ্গী, অজান্তেই হাত দেয় তার পাশে দাঁড় করানো বর্শার ধারাল ফলাতে।
ওকোমাহীসা বলে—তা বলিস না। বোকা ছিল ঐ সৈন্যগুলো। যদি ওরা চুপ করে বসে থাকত মাটির ওপরে আমাদের শহরের মুখটাতে, যদি ওপরে উঠতে গেলেই মেরে ফেলত আমাদের মানুষগুলোকে? তাহলে খেতে না-পেয়েই আমাদের মরতে হত।
বুড়িকে ঘিরে গোল হয়ে বসা-দাঁড়ানো সবার সর্দার দারিয়ানরিও-র কথাগুলো মনে পড়ে। জমায়েতের সবাইকে প্রায় শাসানির গলায় বলেছিল সে, কেউ যেন মরে গেলেও মাটির নীচে ঢোকার পথ না দেখায় শত্রুদের। শত্রুদের হাতে ধরা পড়লে ওরা অত্যাচার করে মেরে ফেললেও যেন পথ না বলে। শত্রুর তাড়া খেয়ে পালানোর সময় খেয়াল রাখবে যেন সুড়ঙ্গের দরজায় ঢোকার সময় শত্রু তোমাকে দেখতে না পায়। দরজায় পালা করে পাহাড় দেবার সময় নজর রাখবে, যখন কেউ দরজা খুলে বেরচ্ছে বা ঢুকছে, তখন আশেপাশে কোনও শত্রুসৈন্য যেন দেখতে না পায়। দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে দরজার গোল পাথরের পাল্লাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেবে। বাইরে-থাকা মানুষটা শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যাবে এই ভয়ে এ-নিয়মের অন্যথা যেন কেউ না করে—করলে তারও মৃত্যুদণ্ড।
শিউড়ে ওঠে মেয়ের দল। দারিয়ানাসু মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। এইসব গালগল্পে কী লাভ তার? হঠাত কাজের কথাটা মনে পড়ে তার। গলা তুলে শুধোয় ওকোমাহীসাকে...
—বুড়িদিদা, মাটির নীচে শহরে জল আনল কেমন করে দৈত্যরা?
—দৈত্য না মানুষ জানি না বাপু। তবে এ শহর যারা তৈরি করেছিল তাদের সবাই যেমন কিছুদূর অন্তর একটা করে হাওয়া-চিমনি বানিয়েছিল যাতে দম আটকে না যায়, তেমনই তারা কয়েকটা জলের গর্ত বানিয়েছিল। ওপরের ঝরনা থেকে জল পাহাড়ের ভেতর দিয়ে নামে যেখানে, সেখান থেকে পথ কেটেছিল, যাতে ঝরনার জল পাথরের আড়াল দিয়ে সেইসব গর্তে এসে জমে। এই কাটা-পথে জল নামত মাটির নীচের শহরে, জমা পড়ত গর্তে। আর যখন মানুষ মাটির ওপরে থাকত, তখন বন্ধ করে দিত কাটা-রাস্তা, জল বইত ওপর দিয়ে। নইলে জল জমে শহরটার নীচের তলাগুলো ডুবে যেত তো।
—ঝরনাগুলোয় জল আসে কী করে? কে জল ভরে দেয় রোজদিন? শুধোয় দারিয়ানাসু। যদি জলের সেই দৈত্যটাকে বশ করা যায়! বুড়িদাদি কি তার কথা জানে?
ওকোমাহীসার কোঁচকানো মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে, কী যেন একটা ভুলে-যাওয়া কথা মনে করতে চাইছে সে। শেষে তার মনে পড়ে।
—অনেক অনেক আগেকার কথা। কোথাও কোনও মানুষ ছিল না তখন। আকাশের সূর্যদেব থাকতেন মাটিতে। একদিন আকাশ থেকে মেঘের দল তাঁর বাড়িতে ঢুকে গেল, ভিজিয়ে দিল তার শীতের কাপড়। সূর্যদেব অনেক মিনতি করলেন, এমন করলে শীতে কষ্ট হবে তাঁর। মেঘের দলের দুষ্টুমি শেষ হল না। তখন রাগে ফেটে পড়লেন সূর্যদেব। চারিদিকে মাটি থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। বড় বড় পাহাড়ের মাথায় আগুন লেগে গেল। দিনের পর দিন পাহাড়গুলোর মাথা থেকে বেরতে লাগল মাটি পোড়া ছাই, আর পাথরগলা আগুন-নদী। মেঘগুলো সেই গরমে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অবশেষে মেঘেদের মা, বৃষ্টির দেবী, গিয়ে কেঁদে পড়লেন সূর্যদেবের পায়ে। অনেক কষ্ট করে তুষ্ট করলেন তাঁকে। সূর্যদেব তার রাগ সংবরণ করলেন। পাহাড়ের মাথা থেকে আগুনে হলকা বেরনো বন্ধ হল। মেঘ জন্মাল নতুন করে। হাসতে হাসতে মেঘের কচি বাচ্চারা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল পাহাড়ের গায়ে। কিন্তু তখন পাহাড়ের গায়ে ছাইয়ের স্তুপ, ছাই ভেদ করে জল চলে গেল মাটির তলায়, বৃষ্টির দেবী আর তাদের খুঁজে পান না! দেবী তখন পাহাড়দের কাছে গিয়ে কাকুতি-মিনতি করলেন। পাহাড় তার কোল থেকে বের করে আনল ঝরনা, নাচতে নাচতে জল চলল সমুদ্রে, সমুদ্রের শেষে সে আকাশে উঠল মেঘ হয়ে...
৫
—একদিন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এলেন সূর্যদেব। চারিদিকে মাটি থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। বড় বড় পাহাড়ের মাথায় আগুন লেগে গেল। দিনের পর দিন পাহাড়গুলোর মাথা থেকে বেরতে লাগল মাটি পোড়া ছাই, আর পাথরগলা আগুন-নদী। মেঘগুলো সেই গরমে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ছাইয়ে ভরে গেল চতুর্দিক, মাটিতে ছাইয়ের মোটা আস্তরণ পড়ে গেল। তার ওপর পাথর গলা নদী ঠাণ্ডা হয়ে তৈরি করল পাথরের বর্ম। একসময় সূর্যের তেজ কমল, ঠাণ্ডা হল চারিদিক, আকাশে আবার জমল মেঘ, নামল বৃষ্টি। উঠল ঝড়। বৃষ্টির দাপটে পাথর জায়গায় জায়গায় গলে গেল, পাহাড়ের গায়ে জল পথ কেটে নামল নদী হয়ে, পাহাড়ের পাশে বইতে শুরু করল ছোট-বড় নদী, ঝরনা। জল জমে জমে হল হ্রদ, সাগর। একসময় হল মহাসমুদ্র, তার নীচে অর্ধেক পৃথিবী ডুবে গেল।
—মানুষরা তখন কোথায় গেল? তখন কি তারা মাটির মধ্যে গর্ত করে শহর বানিয়ে থাকতে শুরু করল? অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন ফাবিয়াস।
লুসিয়াস বলেন—তখন কোথাও মানুষ ছিল না। আপনি বললেন না, একেবারে গোড়া থেকে বলতে এখানকার কথা। তাই গোড়া থেকেই বলছি। এসব স্থানীয় মানুষদের মধ্যে চালু গল্পকথা, তবে পণ্ডিতেরা বলেন, কথাগুলো পুরো ফেলে দেবার মতো নয়। একটা আগ্নেয়গিরি হয়তো ...
ফাবিয়াস নড়েচড়ে বসেন। আগ্নেয়গিরির কথা তিনি জানেন না এমন ভেবেছে নাকি ছোকরা? পম্পেই-এর কথা তিনি খুব ভাল করেই জানেন।
—একটা শহর ধ্বংস হয়ে গেছিল। পম্পেই। এটা কি তত বড় আগ্নেয়গিরি ছিল?
—এই আগ্নেয়গিরি ছিল তার চেয়ে হাজার-লক্ষগুণ বড়। সূর্যদেবতা সল-এর মতো তার তেজ। আগ্নেয়গিরির ছাই ছড়িয়ে পড়ে এই দেশের সবর্ত্র। ছাইয়ের ওপর জমে আগ্নেয়গিরি থেকে আসা জ্বলন্ত লাভা। অনেক বছর পরে, বৃষ্টি নামে, আর উঁচু পাহাড়ের ওপরের জমা তুষার গলে জলে হয়ে পাহাড়ের গায়ে পথ কেটে নামতে থাকে। এইরকম করেই আস্তে আস্তে তৈরি হয় নদী, ঝরনা। নদী আর হাওয়া আস্তে আস্তে পাহাড় কেটে বের করে আনে নীচু জমি, মাটি, উপত্যকা। আজ পর্যন্ত সেই উপত্যকাতেও সমস্ত ছাই-এর স্তুপ শেষ হয় নি, তবে লাভার স্তর ক্ষয়ে এসেছে। পাহাড়ের মাথায় এখনও সেই লাভা জমে আছে কঠিন পাথর হয়ে...
—তখন কোনও মানুষ ছিল না বললে না? তাহলে এগুলো কী করে জানা গেল? তোমাদের জিউস আর পসাইডন মিলে কি এসব করেছিলেন? গ্রিক পুরাণে লেখা আছে এসব?
—আজ্ঞে না। তখন দেবতাদেরও জন্ম হয় নি। পবিত্র অলিম্পাস পর্বত নিজেই এমন এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তৈরি হয়েছিল। তার পরে দেবতারা সেখানে জন্ম নেন। কিন্তু এসব কথার প্রমাণ নেই কিছু। আপনি জানতে চাইলেন কেমন করে এই পাহাড় জন্মাল, তাই...
হতাশ ফেবিয়াস পাত্রের শেষটুকু একচুমুকে শেষ করেন। এই গ্রিকটা একটা হতচ্ছাড়া। অনেক জানে বটে, কিন্তু কাজের জিনিস কতটুকু জানে সন্দেহ। পাহাড় কেমন করে জন্মাল তা নিয়ে দিব্যি একখান গল্প ফাঁদল বটে! তাঁরই ভুল ওসব জিজ্ঞেস করা।
—ঠিক আছে, ওসব জেনে লাভ নেই। তুমি বলছ হিট্টাইটরাই এই পাতালপুরী তৈরি করেছিল? তার পর এখানে এল কারা? এখনই বা আছে কারা? সব সময়েই কি মাটির নীচে থাকে তারা?
—রাগ করবেন না মহামহিম। সমস্ত কিছু জানা নেই কারও। তবে হিট্টাইটরা এই পাতাল শহর তৈরি করলেও, তারা ছাড়াও অনেকে এসেছে এদেশে। হিট্টাইটদের আক্রমণ করেছিল পূর্বদিক থেকে আসা মিত্তানি-রা। মিত্তানিরা অদ্ভুত এক জাতি, তারা যে কোথায় হারিয়ে গেল কেউ জানে না। আর আক্রমণ করেছিল সেই তাইগ্রিস ইউগ্রেতিস নদীর ধার থেকে আসা ক্যাসাইট-রা। তাদের কেউ কেউ এখানেই থেকে যায়। শোনা যায়, হিট্টাইটরা আসার আগেও এখানে কিছু বর্বরের বাস ছিল, তারাই আঙুরের আর কিছু শষ্যের চাষ শুরু করে। এই পাহাড়ি অঞ্চলে সেইসব বর্বরেরা আস্তে আস্তে মিশে যায় হিট্টাইট, ক্যাসাইট, আর মিত্তানিদের সাথে।
—সেটা কবেকার কথা?
—সে অনেক আগেকার কথা। তখনও রোমুলাস রোম নগরীর পত্তন করেন নি, আর হেলেন তখনও তাঁর ছোট্ট দেশেই আছেন।
এটুকু বলে চমকে ওঠে লুসিয়াস। কথায় কথায় রোমুলাসকে সে হেলেনের চাইতে অর্বাচীন বলে ফেলেছে! সেনাপতির রোমান রক্তগৌরবে আঘাত লাগলে সর্বনাশ! কিন্তু না, ফাবিয়াস অতীতের গল্পে ডুবে আছেন, এতবড় আস্পর্ধা তাঁর চোখে পড়েনি মনে হয়। লুসিয়াস থামতে পানপাত্রে একটা বড় চুমুক ল্গান ফাবিয়াস। হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই কোথা থেকে ছুটে আসে সুকুমার এক বালক ভৃত্য। ফাবিয়াসের সামনে চলে আসে কানায় কানায় ভর্তি আরেকটি সুদৃশ্য পানপাত্র। লুসিয়াস আগের কথা দ্রুত বদলে নতুন করে শুরু করেন।
—হিট্টাইটদের নিয়ে অনেক গল্পকথা আছে। তারা নাকি মাটির নীচে থাকতে পারত। আবার থাকতে পারত পাহাড়ের গুহায়। ছোট্ট গুহার মধ্যে ঢোকার সময় তারা নিজেদের শরীরটাকে গুটিয়ে ছোট করে নিত, যেন ছাগলছানা। বাইরে যুদ্ধ করার সময় তারা আবার দৈত্যের রূপ ধারণ করতে জানত।
হিট্টাইটরা মাটির নীচে শহর বানাতে শুরু করে। তারপর যারা এখানে এসেছে তারাই এই শহর বড় করেছে। পুরনো গ্রিস থেকে আসা মানুষেরা মাটির নীচে শহরকে বড় করে তোলে। এমন বড় যে সেখানে নাকি রোম শহরের আধখানা ঢুকে যেতে পারে, ঢুকে যেতে পারে এথেন্সের গোটাটাই। একটা শহরের সঙ্গে দূরের শহর নাকি মাটির তলার সুড়ঙ্গ দিয়ে জোড়া। এখন যে বর্বর মানুষগুলো এখানে ছাগল চরায় আর আঙুর চাষ করে, তারাও নাকি নানাদেশের সেনাবাহিনীর আক্রমণ করলে অনেকদিন ধরে এই মাটির তলার শহরে থেকেছে, শহরকে বড় করেছে। সেই শহর চিনে, তাকে আক্রমণ করেও জিততে পারেনি বড় বড় সৈন্যবাহিনী।
—সে কী হে? মাটির নীচে থাকত এমন মানুষদের আগেও দেখেছে অন্য সৈন্যরা? মাটির নীচে থাকা যায় নাকি সত্যিই?
—পণ্ডিতরা অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারেন নি মাটির নীচে কেমন করে থাকা যায়। কেমন করে মাটির নীচে নিঃশ্বাস নেয় মানুষ। তবে এরা বেশিদিন নীচে থাকে না, সেখানে চাষ-আবাদ করা বা পশু চরানো যায় না। অনেকে বলে, এরা মানুষ নয়, কোনো একরকমের দৈত্য, অপদেবতা। কিন্তু দৈত্য আর অপদেবতা মানুষকে দেখে পালাবে কেন?
এদেশের আঙুরের মদে বেশ দ্রুত নেশা জমে উঠছে সেনাপতির। আগ্নেয়গিরি বা দৈত্য আর অপদেবতার কথা তেমন গালগল্প বলে আর মনে হচ্ছে না তাঁর। না, লুসিয়াসের কাছে আর কিছু কাজের খবর পাবার আশা কম, ব্যাটা বকবক করে বড্ড বেশি। লুসিয়াসকে বিদায় জানান তিনি। তারপর নিজের মনে তিনি আওড়াতে থাকেন...
—শুধু একজন! শুধু একজন মাটির নীচের মানুষকে হাতে পাই! পাতালপুরীর দৈত্য হবার সাধ আমি শেষ করে দেব...
৬
মাটির নীচের একজন মানুষ তখন দ্রুতবেগে হাঁটছিল মাটির ওপর দিয়ে। পশ্চিমের ঐ নীচুপাহাড়ের ঝরনা খুঁজে পেয়েছে সে। তিনদিন ধরে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে খুঁজেছে তারা। শেষমেশ আর কেউ পায়নি, দারিয়ানাসু পেয়েছে। তার পিঠে একটা শাবল আর কুঠার, তাই দিয়েই খুঁড়েছে সে পাথরে ঝরনার পায়ের ছাপ, কেটেছে কাঁটাঝোপ, ক্ষতবিক্ষত হয়ে অবশেষে সে পেয়েছে। বুড়িদাদি ওকোমাহীসা ভুল বলেনি, পাথরের আডালে লুকিয়ে পড়েছে ঝরনা, তবে গতিপথ তেমন বদলায় নি। কুঠার আর শাবল দিয়ে পাথর কেটে জলের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে দারিয়ানাসু। জল এখন তার পূর্বপুরুষদের হাতে কাটা পথ ধরে নামতে শুরু করেছে মাটির নীচের শহরের দিকে। ক্ষীণ, কিন্তু সজীব জলের ধারা। আস্তে আস্তে জল জমবে এগারো তলার গর্তে। আবার জালাগুলো ভরে উঠবে ঠাণ্ডা জলে। আঃ, শান্তি শান্তি!
কিন্তু তার কি বড় দেরী হয়ে গেল? পূর্বের আকাশ লাল হয়ে এল নাকি? সে এখন পূর্বমুখ করে হাঁটবে, যাবে গর্ত-শহরের দরজার দিকে। সৈন্যরা কি বুঝে ফেলবে নড়াচড়া করা শুকনো গাছেটা আসলে তারই শরীর? এইমাত্র পেট ভরে জল খেয়ে নিয়েছে সে, তবুও গলাটা কেমন শুকিয়ে ওঠে তার। কাল যে সৈন্যটাকে মনে হয়েছিল অকেজো পুতুল, তাকেই আজ যেন মনে হয় ভয়ঙ্কর শত্রু, নির্নিমেষ চেয়ে আছে তার জন্য।
দৌড়তে শুরু করে দারিয়ানাসু। ঐ তো, ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ওরা একসাথে দ্রুত এগিয়ে আসছে। পারবে না, দারিয়ানাসু-র সঙ্গে ওরা দৌড়ে পারবে না। কোমরে বাঁধা গাছের ডালটাকে ছুঁড়ে ফেলে সে। দৌড়োও, দারিয়ানাসু, আরও জোরে, যেমনটি তুমি ছাড়া আর কেউ পারে না! কিন্তু একি, ঘোড়ায় চড়ে দূর থেকে এগিয়ে আসছে আরেক দল! ঘোড়াগুলো ক্রমে পায়ে-চলা সৈন্যদের পেরিয়ে এগিয়ে আসে আরও কাছে। শাবল আর কুঠার কি ছুঁড়ে ফেলবে সে? না, ফেলা চলবে না, ওগুলো খুব কাজের জিনিস, আর এগারোতলাটা এখনও খোঁড়া বাকি তাদের। দৌড়োও দারিয়ানাসু, দৌড়োও, তুমি এসে গেছ। তুমি দেখতে পাচ্ছ মাটির নীচে যাবার দরজাটা। শেষ বাঁকটা নিলেই তুমি চলে যাবে ঘোড়সোয়ার দলের চোখের আড়ালে। তারা দেখতে পারবে না তুমি হঠাত কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলে। তাঁবুতে ফিরে আজগুবি দৈত্য আর অপদেবতার গল্প ফাঁদবে তারা—তুমি জিতে গেছ, দারিয়ানাসু, তুমি জিতে গেছ।
ঘড়ঘড়ঘড়...
৭
ফাবিয়াস তাঁর মাংসল কাঁধে হাত বোলান, হাত বোলান মণিবন্ধে। বড্ড হাত বোলাতে ইচ্ছে করে তাঁর নিজের পায়ের গোছে, কিন্তু আসনে বসে ওরকম করা শোভন নয় বলে সে চেষ্টা করেন না। তাঁর সামনে দাঁড়ানো রোমান সৈন্যরা উল্লাসে লাফালাফি করছে। লুসিয়াস নানা ভাষায় আর নানা অঙ্গভঙ্গি করে বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে ছেলেটিকে। এসব দৃশ্য ফাবিয়াসের কাছে হঠাৎ কেমন অবাস্তব মনে হয়। কাল রাত্রের ইচ্ছেটা এত তাড়াতাড়ি পূরণ হওয়াতে খুব খুশি হওয়া উচিৎ ছিল তাঁর, কিন্তু কেন জানি তাঁর আজ কিছু ভাল লাগছে না।
ক্রুশে বিদ্ধ ছেলেটির কাঁধ থেকে রক্ত গড়িয়ে জমাট বেঁধে আছে, মণিবন্ধ আর পায়ের গোছ থেকে রক্ত এখনও টপ টপ করে ঝরছে। তেজি ঘোড়ার মতো তার পেশিবহুল উরু দুটি। মুখ তুলে রেখেছে সে, দৃষ্টি স্বচ্ছ, যেন সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোর মতো সেও একজন দর্শকমাত্র। গজালগুলির যেন অন্য কারও দেহে। ক্রুশটি খাড়া করে দাঁড় করানো আছে। ছেলেটির চুলের ফাঁকে খেলে যাচ্ছে সকালের সূর্যের আলো। তার মুখ প্রশান্ত, মুখে সামান্য সোনালি লোমের আভাস।
লুসিয়াস জিজ্ঞেস করছেন, আহা, তোমার কষ্ট হচ্ছে বুঝি? বলছেন, তোমাকে আমরা এখনই নামিয়ে আনব। কখনও বা তিনি সৈন্য দুজনকে ছদ্ম-হুকুম দিচ্ছেন, নামিয়ে নাও। কিন্তু তারপরেই বলছেন, আরে, তুমি তো বললে না কোথায় তোমার ঘর, কেমন করে সেখানে যাব আমরা?
একই কথা নানারকম ভাষায় বলছেন লুসিয়াস, ছেলেটি নির্বিকার। না, ঠিক নির্বিকার নয়, যতবার লুসিয়াস বলছেন, কেমন করে যাব তোমার বাড়ি, তার মুখে খেলা করে যাচ্ছে এক বিচিত্র হাসি।
জিতে গেছ তুমি, দারিয়ানাসু, তুমি জিতে গেছ।
* হিটাইট ভাষার একটি শব্দের সঙ্গে ইংরাজি ভাষার একটি শব্দ হুবহু মেলে, আর সেই শব্দটি হল ওয়াটার। দুই ভাষাতেই তার মানে জল। লুপ্ত এক ভাষার সঙ্গে ইংরাজি ভাষার শব্দটা এমন এক হল কেমন করে, সে নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকরা ভাবুন। তবে হিটাইট ভাষাটি ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠির মধ্যে পড়ে। বা, পড়ত।