জলে বাড়ি,জলবাগান,জলের গান
ডাল,কাশ্মীরের প্রাণ। চুপচাপ বসে আছি লেকের বাঁধানো পাড়ে। সারা ভারতের মধ্যে কেরালার ব্যাকওয়াটারের হাউস-বোট কেট্টুভালাম ছাড়া কাশ্মীরে কি করে এল জলবাড়ি সেও এক গল্প। ডোগরা রাজবংশের আমলে ফতোয়া জারি হল ব্রিটিশরা কেউ এখানে জমি কিনে বাড়ি বানাতে পারবেনা।তাতে কুছ পরোয়া নেই।বেনিয়াবুদ্ধি।চোখ চলে গেল জলে।জলেই থাকব বাড়ি বানিয়ে।১০ থেকে ২০ ফুট চওড়া আর আশি থেকে একশোপঁচিশ ফুট লম্বা সিডার কাঠে তৈরি হল আখরোট বা ওয়ালনাটের কারুকার্য হল তাতে।মাটিতে দেওয়ালে সর্বত্র কাশ্মীরি গালচের আস্তরণে রাজকীয় হয়ে উঠল নৌকা।ড্র্যিং, ডাইনিং, ড্রেসিং,বেডরুম সব রইল তাতে।বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে ছাদ।ছাদে ফুলের বাগান।আর কি চাই!।কেনেথ সাহেবের নৌকো হয়ে গেল হাউসবোট।দশ থেকে কুড়ি ফুট চওড়া, আর আশি থেকে একশো পঁচিশ ফুট লম্বা সডার কাঠে তৈরি হল নৌক। মাটি তে দেওয়ালে কাশ্মীরী গালচের আস্তরনে রাজকীয় হয়ে উঠল।ড্রয়িং, ডাইনিং, ড্রেসিং, বেডরুম,বারান্দা,সিঁড়ি বেয়ে ছাদ, ছাদে ফুলের বাগান।আর কি চাই।আর চমৎকার সব নামের বাহার। শবনম,রোজমেরি,সোওয়ান,বালমোরাল ক্যাসেল,বাকিংহাম প্যালেস।নাগিন লেকের হাউসবোটের কৌলিন্য বেশি।ঝিলমের হাউসবোট তুলনায় সস্তা।
আমার হাউসবোটের ভারি কারুকাজ করা পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, ভোর হওয়ার ও আগে।চারপাশের আবছা হয়ে আসা অন্ধকার ভেঙে গমগম করে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে আজানের সুর।অদ্ভুত সেই মায়াময় আবহ বাঙালীর কাছে যেমন মহিষাসুরমর্দিনী র গান শোনা ভোর।হাউসবোটে না থাকলে এমন ভোর হওয়া কোনোদিন ই জানতে পারতাম না।
কিন্তু সময় নেই হাতে।তখুনি বেরিয়ে পড়তে হবে অন্য ডাল এর সন্ধানে।নাজিম ভাইয়ের শিকারা অপেক্ষা করছে। শীতেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ঘুম ঘুম চোখে শিকারায় চড়ে বসতেই নাজির ভাই যত্ন করে পায়ের ওপর রজাই টেনে দিয়ে বলে আয়েশ করে বসুন।তারপর সেই আবছা অন্ধকারে লগি ঠেলে চলি জলবাজারের দিকে।আকাশে তখনো চাঁদ।সামনে শঙ্করাচার্য মন্দিরের চুড়ো র আলো যেন প্রদীপ।
অলিগলি পেরিয়ে চলতে চলতে আলো ফুটতে লাগলো।দূর থেকে দেখি আবছা আলোয় কত শত নৌকার ভীড়।কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষন। এ বাজার সূর্য উঠলেই ভেঙে যায়।ডালের ভাসমান সবজি ক্ষেত এর সবজি নিয়ে আসেন কৃষকরা।সেই সবজি চলে যায় শ্রীনগরের বাজারে বাজারে হাত ফেরতা হয়ে।কোনো দরাদরি র হাঁকডাক নেই।হাল্কা ভোরের হাওয়ার বেচাকেনা, আগুপিছু নৌকার ভাসাভাসি,পোষালে এর বোঝা খালি,ওর খালি বোট ভরে যায়।
বিট,শালগম, ওলকপি,লাউ,পেঁয়াজ,টমাটো,পদ্মের নাল,কুমড়ো,আলু,রাঙালু,কত রকমের শাক।বিক্রি হচ্ছে গাছের চারাও।আমরা ছাড়া আর দু একজন বিদেশি ট্যুরিস্ট ক্যামেরা চোখে।জলবাজারে চলতি ট্যুরিস্টের ভীড় নেই। পাশ দিয়ে বেয়ে আসে টিনের তোরঙ্গ ভরা কুকিসের বোট।ওপরে লেখা " ডিলিইশাস"।আমন্ড, নারকেল,আখরোট এর পুর ভরা কুকি।ছিপছিপে এক নৌকো এগিয়ে আসে জাফরান বেচতে।না বললে দূরে সরে যায়।
রোদ ওঠে।বাজার ভাঙতে থাকে।ফিরি আমরাও।এদিকওদিক জলদোকান খুলে গেছে ততক্ষণে,নাস্তা র রুটি দুধ বিস্কিট আরো কতকিছু নিয়ে।ছপছপ করে দাঁড় বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এক কাশ্মীরী মহিলা।হাত বাড়িয়ে খান পাঁচ ছয় কাশ্মীরী রুটি কিনে নিয়ে রাখেন শিকারার পাটাতনে।না কোনো প্যাকেট,বা থলি,বা কিছু।আবার দাঁড় বেয়ে ঘরের দিকে।
নাজিম আমাদের চারচিনার দেখাবে কথা হয়।কিন্তু তার আগে একবার ঘর থেজে সেল ফোন টা মিয়ে আসতে চায়।আমাদের ও নাস্তা চায়ে খাওয়ার নেমন্তন্ন করে।
ভাগ্যিস, রাজি হই। নাহলে ডালের অন্যদিকে এক অদ্ভুত সবুজ ডাল-এর হদিশ না জানাই থেকে যেত।এখানে অল্প-দূরে জলবাগান, চাষের ক্ষেত আর অন্যদিকে গেরোস্থালির পাড়ায় যাওয়ার কাঠের সাঁকো।উইলোর ডালগুলো ঝুঁকে ঝুঁকে জলে নেমে এসে যেন এক পান্নাসবুজ সরণী বানিয়েছে।তার মাঝ বরাবর জল কেটে এগোচ্ছে নাজিম ভাইয়ের শিকারা।কি শান্ত চারদিক।এদিক ওদিক কাঠের বাড়ি শুরু হল একটু পর ই।বুঝলাম এসে গেছি জল-পাড়ায়। অজস্র গোলাপ ফুটে আছে সব বাড়ির সাম্নেই।ছবি তুলছি দেখে হাসে আর মুঠি মুঠি ছিঁড়ে তুলে দেয় হাতে,জানলা থেকে দিদার ইশারায় তাঁর ছোট্ট নাতনি।আপত্তি শোনে না।আরো এক অতি বৃদ্ধার হাতে কিছু কুটিরশিল্প, জানলায় নির্লিপ্ত মুখ,তাকিয়ে কাজে মন দেন।।
নাজিম ভায়ের বাড়ি দুতলা।ইচ্ছে ওপরটা হোমস্টে করার।শিকারা পৌঁছে দেয় প্রায় দোরগোড়ায়।একতলার কার্পেট মোড়া রান্নাঘরে বসে সুন্দরী অষ্টাদশী আফরোজ।গ্র্যাজুয়েশান করছে সঙ্গে ট্যুরিজম এর কাজ।বড় ভাই স্টোনের ব্যবসা,ছোট স্কুলে পড়ে।আমরা পা মুড়িয়ে কার্পেটে বসি।আফরোজের সামনে বিরাট ডেকচি তে " নমকিন চায়ে"।নাস্তা য় এই চা আর রুটি।অবশ্য অতিথি র জন্যে লিপটন চা ও আছে।আমরা বারণ করি। আমাদের সামনে মিস্টি হেসে এগিয়ে দেয় চায়ের কাপ আর রুটি। রুটি সবাই কার্পেটে রেখে খায়। না কোন থালা বাসন। মাজা বাসন উপুড় করে রাখা অন্যদিকে। সবাই মিলে খাওয়া আর গল্প। ভেতর থেকে বাড়ির আর সকলে এসে যোগ দেন। ছবি দেখায় শীতের বরফ জমা ডাল এর। বাড়ির পিছনে বাগান। আপেল গাছে ফল ধরেছে। দেখান। মহারাজি আর দিলচস, দু'রকম আপেল হয় এখানে। মহারাজি খাট্টা,কিন্তু উপকারি। ওরা রাতের খাওয়ার পর একখানা করে খায়। খানা হজম,ঘুম ভাল হয়।
সুন্দর এক সকাল কেটে যায় গল্পে কথায়। ফেরার পথে বাগানের একগুচ্ছ গোলাপ হাতে ধরিয়ে দেন নাজিম ভাই।