ইংরেজিতে একটা শব্দবন্ধ রয়েছে -a gift that keeps on giving. একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের শাসকরা এরকম একটা উপহার আবিষ্কার করেছে - low scale conflict বা ক্ষুদ্র আকারের সংঘাত।এ যেন সোনার ডিম দেওয়া হাঁস, হাঁসটাকে যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়,ততদিন সোনার ডিম দেবে।ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন, রাশিয়ার চেচনিয়া,আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য,ভারতের কাশ্মীর,এই সংঘাতগুলো দীর্ঘকালীন সময় ধরে চলছে,তার প্রধান কারণ এটাই যে এই সংঘাতগুলো মিটিয়ে ফেলায় মুনাফা নেই।
মুনাফা।একশো বছরেরও বেশি সময় আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে রাশিয়ার লেনিন নামে একজন লোক একটা তিন প্যারাগ্রাফের নোট লিখেছিলেন।নাম ছিলো ‘কার লাভ’ (who stands to gain)?নোটে বলা ছিলো যে,যে কোন ঘটনাকে বিশ্লেষণ করতে গেলে সেই ঘটনার সরাসরি অংশগ্রহণকারী কারা,কারা তার স্বপক্ষে বা বিপক্ষে গলা ফাটাচ্ছে,কারা প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব এনে জনমানসকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করছে, এই বিষয়গুলোর থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে মুনাফা কার? তাই কাশ্মীরের সংঘাতের পেছনে কারণ খুঁজতে একশোটা বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে, হাজারটা তর্কে অংশগ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু এর সমাধান খুঁজতে গেলে অন্যতম যে প্রশ্নটাকে এড়ানো চলবে না, তা হলো - মুনাফা কার? ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীর মাথাদের, যারা এই কাশ্মীরের মতন উপদ্রুত অঞ্চলের বাসিন্দাদের ক্ষোভকে মূলধন করে তাদের মধ্যে থেকে নিজেদের সংগঠনের সদস্যদের সাপ্লাই লাইনের যোগানের ব্যবস্থা করে?পাকিস্তান এবং ভারতের শাসকগোষ্ঠীর,যারা নিজেদের দেশের যে কোন সমস্যার থেকে নাগরিকদের নজর ফেরাতে কাশ্মীর এবং বর্ডারের সংঘাতকে ব্যবহার করে? আমাদের দেশের হিন্দু মৌলবাদীদের, যারা কাশ্মীর (মুসলমান সন্ত্রাসবাদী) এবং পাকিস্তান (মুসলমানদের দেশ) এর ইস্যুকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনীতির দিকে ঝোল টানতে? চীন, যার কাশ্মীর এবং বর্ডার অঞ্চলে বিশাল বিনিনিয়োগ রয়েছে পরিকাঠামোর স্তরে, ব্যবসা এবং সামরিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করতে?
না। প্রধান মুনাফা এদের না।এরা তো স্রেফ একটি সংঘাতের আনুষাঙ্গিক সুবিধে উপভোগ করে।আসল মুনাফা তাদেরই, যাদের নিয়ে সেই ১৯১৩তেও লেনিন তাঁর প্রবন্ধ লিখেছিলেন।অস্ত্র ব্যবসায়ীদের।বিশ্বে এই মুহুর্তে সামরিক খাতে খরচা হলো ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার।সর্ববৃহৎ অস্ত্র রপ্তানি করা দেশ কে? আমেরিকা।
আর সর্ববৃহৎ অস্ত্র আমদানি করা দেশ? ভারত।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের মধ্যে ‘মোস্ট হেভিলি মিলিটারাইজড জোন’ কাশ্মীরের সংঘাত যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন মুনাফা করবে এই ব্যবসায়ীরা।মুনাফা করবে রাফায়েল বিমান বেচে, বোফর্স বেচে। দুদিকের লোককেই অস্ত্র বেচবে তারা। ডিজিটাল যুগে অস্ত্র মানে শুধু গোলা বারুদ বন্দুক না, সাইবারসিকিউরিটি এই সামরিক শিল্পের এখন এক অন্যতম অংশ।তাহলে শান্তিচুক্তি করে,গোল টেবিল বৈঠক করে, বা উলটো দিকে নির্ণায়ক যুদ্ধ করে এই সমস্যা মিটিয়ে ফেলা তো ব্যবসায়ীদের পক্ষে ক্ষতিকর।ওষুধ কোম্পানিগুলোর মতনই, অস্ত্র কোম্পানিরাও জানে, সুস্থ বা মৃত মানুষে মুনাফা নেই। মুনাফা আছে খালি অসুস্থ মানুষে।
তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায়, যে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের বা পাকিস্তানের আসলে যে বিদেশনীতি, বা সামরিক নীতি, তা আদতে ভারত বা পাকিস্তান নামক জাতিরাষ্ট্রের নীতিই না।তা হলো ব্যবসায়ীদের কর্পোরেট নীতি, সেই নীতি নির্ধারকদের মধ্যে আমেরিকা আছে, চীন আছে, ইজরায়েল আছে, বা বলা ভালো এই দেশগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে। স্বাধীন বিদেশনীতি আসলে সোনার হরিণ, ওটা নাগরিকদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে, জাতিরাষ্ট্রের নীতি আসলে কর্পোরেটদের মুনাফার নীতি। প্রায় দশ বছর আগে ইংরেজি সংবাদপত্র গার্জেনে একটি লেখা বেরিয়েছিলো, যে নেশন স্টেটের এক্সপেরিমেন্ট শেষের পথে, নেশন স্টেটের শবদেহের ওপর কর্পোরেট স্টেটের নির্মাণ চলছে। যদিও শবদেহটাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়নি বা কবর দেওয়া হয়নি, নাগরিকদের বোকা বানাতে ওইটূকু রাখতেই হবে।
আমরা যারা নিজেদের যুক্তিবাদী, প্রগতিবাদী এবং গণতান্ত্রিক স্রোতের অংশ মনে করি, তাদেরকেও এই ভারত, পাকিস্তান, চীন, আজাদ কাশ্মীরের গোলকধাঁধার মধ্যে থেকে নিজেদের আখ্যানকে বার করে আনতে হবে, তৈরি করতে হবে সঠিক আখ্যান, বারবার বলতে হবে মুনাফাবাজদের কথা, যেই মুনাফাবাজদের ব্যালেন্স সীট মেলাতে পুলওয়ামাতে মরতে হয় ৪৪ জন দরিদ্র পরিবারের জওয়ানকে, বা গত ২০ বছর ধরে শয়ে শয়ে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের, গুলি খেতে হয় কাশ্মীরের বাসিন্দাদের, বারবার চিহ্ণিত করতে হবে সেই গোষ্ঠীকে যাদের মুনাফা বাড়াতে অস্ত্র কেনা হয় আমাদের পয়সা দিয়ে। মোদী, যুবরাজ সালমান, দোভাল, ইমরান খান, এরা আদতে গ্লোরিফায়েড ব্রোকার।এদের মালিক আম্বানি, লকহিড মার্টিন, বোয়েইং, আমেরিকা, ইজরায়েল, ফ্রান্স - সেই চক্রটা যাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স বলেছিলো। এই চক্রকে চিহ্নিত করা প্রথম কাজ - নাহলে এদের মুনাফার স্বার্থে এরকম আরও অনেক পুলওয়ামা হবে, আর আমরাও মেকি জাত্যাভিমান আর দেশপ্রেমের আখ্যানে ভেসে গিয়ে ধ্বংস হবো।