এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • যে যায় লংকায়

    Samran Huda লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৬ মার্চ ২০১৫ | ২২২৩ বার পঠিত | রেটিং ১ (১ জন)
  • চিকন গোয়ালিনী কয় “শুন কথার নাল”।
    মরিচ যতই পাকে তত হয় ঝাল।।
    সময়ে বয়স যায় নাহি যায় রস।
    মুখের কথায় মোর ত্রিজগত বশ।।
    ফান্দ পাতিয়া চানধরি জমীনে থাকিয়া।
    আমার গুণের কথা জানে যত ভুঞা।।
    — কমলা/ দ্বিজ ঈশান/ পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

    আমাদের বাড়ি থেকে মেজফুফুর বাড়ি― পূবহাটি যেতে যে কবরস্থান পড়ে, তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু এক খাল। তিতাসের খাল। এঁকে-বেঁকে নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে মাঝেরহাটির জলেখা বিবির বাড়ির পিছন দিয়ে বয়ে সে গিয়ে মিশেছে পূবহাটির খালে। খালের দক্ষিণ ধারে যে জমি-পুকুর-বাড়িটি দেখা যায়, সেটি জলেখা বিবির। খালপাড়ের কাঁচা সড়ক ধরে মিনিট পাঁচ হেঁটে গেলে যে তেমাথা, তার ডানদিকে দখিণগাঁওয়ের শুরু। মাঝেরহাটির জলেখা বিবির বাগ এই দখিণগাঁওয়ের শুরুতে। কয়েক একর জায়গা জুড়ে এক ফলের বাগান। জলেখা বিবির পৈত্রিক সম্পত্তি। অত বড় বাগান শাহবাজপুর কেন আশে-পাশের গোটা এলাকা জুড়ে কারও নেই। তাই জলেখা বিবি আর তার ছেলে-মেয়েদের বড় গর্বের জায়গা এই বাগ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ইতি-উতি দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন কিছু গাছ। কাছে গেলে দেখা যায়, ঠিক তা নয়। সারি দিয়েও নয় কিন্তু এই গাছ সেই গাছ এলোমেলো ভাবেও লাগানো নয়। যেদিকে আমগাছ, সেখানটায় শুধু আমেরই গাছ। তারপরেই আবার লিচুবাগান। কয়েক বিঘা জুড়ে পরপর পর শুধু লিচুরই গাছ। কোথাও আবার সারসার শুধু সুপুরি গাছের সারি। রয়েছে বাঁশঝাড়ও। এ যেন ছোট্ট ছোট্ট অনেকগুলো বাগান জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে গোটা একটা বাগ, জলেখা বিবির বাগ। গাছগুলো ঘন বা একটার গায়ে আর একটা নয়, বেশ দূরে দূরে অনেকটা জায়গা ছেড়ে ছেড়ে লাগানো। ফলে অত গাছ আর মাঝে মধ্যেই ঝোঁপ-ঝাঁড় থাকলেও জায়গাটাকে জঙ্গল মনে হয় না কখনই। এই বাগানের গাছ-গাছালি জুড়ে অসংখ্য পাখ-পাখালির বাস। সন্ধেবেলায় দেখা যায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে বসছে গাছের ডালে ডালে। এইখানেই তাদের বাসা।

    গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়েরা প্রায় সারাদিনই বাগে থাকে, খেলা-ধুলা করার জন্যে। গ্রামের লোক তো বটেই আশে-পাশের গ্রাম থেকেও মানুষ আসে জলেখা বিবির বাগে, বনভোজন করবে বলে। সে অবশ্য বিশেষ বিশেষ মরশুমে। এমনিতে বিকেল-সন্ধ্যেয় ছেলের দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকে বাগে। দিনবান্ধা মুনিষেরা দিনের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে দু’দণ্ড জিরোয় বাগে বসে। তামাক-টামাক খায়। পাতা কুড়ানি মেয়েরা বড় বেতের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে পাতা কুড়োতে ঢোকে দুপুরবেলা। ঘন্টাখানেক পাতা কুড়োলেই তাদের ঝাঁকা ভরে যায়। তারপর দল বেঁধে বসে গল্প করে, একে অন্যের মাথার উকুন বেছে দেয়, পিঠের ঘামাচি মেরে দেয় ততক্ষণ, যতক্ষণ না গ্রামের ছেলেরা এসে বাগে ঢুকছে দল বেঁধে। এরকম সময়ে মাঝে-মধ্যেই তার স্বামীর লাঠিটি হাতে নিয়ে বাগে এসে ঢোকেন জলেখা বিবি। লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে দেখেন কোনও গাছে পোকা ধরল কিনা, কোনও গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল কিনা, কেউ ডালপালা কেটে নিয়ে যাচ্ছে না তো? কোথায় মউল এল, কোথায় পাক ধরল। এ তার দৈনন্দিনের কাজ।

    বিকেল হলেই বাগে গিয়ে ঢোকে জলেখা বিবির মেয়ে রাহিমা ফুফু। সঙ্গে থাকে তার গ্রামের বন্ধুরা, যারা তার সঙ্গে কলেজে পড়ে। হাতে করে নিয়ে যায় মাদুর আর রেডিওখানি। তাদের আড্ডা লিচুবাগানে। জোর আওয়াজে রেডিও চলে, ততোধিক জোরে তাদের কথা-বার্তা, হাসি-মস্করা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেয়েদের কলেজে পড়ে সে। বাসে করে রোজ শহরে যায়, বন্ধুদের নিয়ে দল বেঁধে ফিরে আসে বিকেলে। এমনিতে মাঠে-ময়দানে তখনও মেয়েরা গিয়ে বসত না। গ্রামে তো নয়ই। এ সেই সময়, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সদ্য। দেশে শেখ মুজিবের শাসন। মাঠ-ময়দানে দল বেঁধে বা একলা গিয়ে বসে থাকার একচেটিয়া অধিকার যেন ছিল শুধু ছেলেদেরই। মেয়েরা থাকবে ভিতরবাড়িতে, বড়জোর বাংলা উঠোন অবধি যাবে, তাও যখন কিনা বাইরের কোনও পুরুষমানুষ নেই। এইসব নিয়ম-কানুনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মাঝে-মধ্যেই তিতাসের ব্রিজে গিয়ে দাঁড়ায় কলেজফেরত রাহিমাফুফু ও তার বন্ধুরা। কখনও বা ব্রিজ থেকে নেমে গিয়ে তিতাসের চরে গিয়ে ওঠে। রাহিমাফুফু মুখে মুখে ছড়া বানাতে পারত। অন্ত মিলিয়ে দুটো লাইন বলে একজনকে বলে, পরের লাইনটা বল। কখনই অন্যের বলা পরের লাইনটা তার পছন্দ হয় না, নিজেই আর একটা লাইন বলে আর নিজের কৃতিত্বে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায়।

    শীতকালে জলেখা বিবির বাগে মেলা বসে। এই মেলা বাবদ মোটা টাকা পান জলেখা বিবি। বাচ্চাদের জন্যে নাগরদোলা আসে, চরকি ঘোড়া আসে। নানান রকম পসরা নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে দোকানিরা আসে। মাটির হাড়ি-কলসি, বাসনপত্র আর নানা রকম পুতুল নিয়ে আসে কুমোরের দল। ছোলা-মটর ভাজা, বাদামভাজা, চানাচুর আর জিলিপি-নিমকির ছড়াছড়ি মেলা জুড়ে। আসে নানান রকম জুয়ো। যাত্রা আসে, ঘাটুগানের দল আসে, যাতে ছেলেরা মেয়ে সেজে নাচ-গান করে। আসে বাউল ফকিরেরাও। এক মাস ধরে মেলা চলে জলেখা বিবির বাগ জুড়ে। দুপুর থেকে মেলা শুরু হয়, চলে সেই গভীর রাত পর্যন্ত। নিঃস্তব্ধ গ্রাম জুড়ে গভীর রাত অব্দি মাইকে ভেসে আসে নানান রকম গান-বাজনার শব্দ। সুনসান গ্রামের নৈঃশব্দ তচনচ করে দিয়ে গ্রামের সকল ছেলে-বুড়ো মজে থাকে মেলায়। গ্রামের মূল সড়কটি জলেখাবিবির বাড়ির সামনের পুকুরের পাশ দিয়ে গেছে। উত্তরগাঁওয়ের একমাত্র সমিতি ঘরটিও এই সড়কের ধারে— সেও জলেখা বিবির বাড়ির সামনে। দুই কামরার পাকা বাড়ির সমবায় সমিতির সামনে একখানি টিপকল। যদিও বারো মাসই সমিতির ঘর দু’খানি বন্ধ থাকে, কোনও রকমের কোনও কাজকর্ম এখন আর হয় না বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী, আয়ূব খানের জমানার অনুশাসনে। তবে এই সমিতি ঘরে কিন্তু লোকের আনাগোনার অভাব কখনই হয় না বা সমিতির সামনে। বিকেল-সন্ধ্যেয় কাজ-কর্ম সেরে পাড়ার পুরুষেরা সমিতির সামনেই বসে গল্প-গুজব করে যা কিনা চলে সেই এশার নামাজের আগে পর্যন্ত।

    কখনও বা তারও পরে রাত গভীর হয়ে সব সুনসান হয়ে গেলে এ’পাড়া ও’পাড়ার সব অল্পবয়েসি ছেলের দল সিগারেট-গাঁজার ছিলিম নিয়ে এসে বসে সমিতির সামনে। শুধু গল্প-গুজব করে সময় কাটানো নয়, মাঝে-মধ্যেই তারা রাত দুপুরে বনভোজন করে এখানে। বিলের মধ্যে পথ হারানো একলা হাঁস বা চুপি চুপি কারও খোয়াড় খুলে তুলে নিয়ে আসা মুরগিটির মুখ চেপে বন্ধ করে রেখেই জবাই করে ফেলা হয় কলতলায় দাঁড়িয়ে। কেউ যোগাড় করে মাটির হাড়ি তো কেউ বটি। কেটে-কুটে সাফ করা মাংসে মশলা বলতে পড়ে কারও একটা খেত থেকে তুলে আনা কাঁচা-পাকা মুঠি মুঠি লংকা। যার কোনওটা পেকে টুকটুকে লাল তো কোনওটা লালে-সবুজে মেশানো। ডাঁটি ছাড়িয়ে কলে ধুয়ে আধখানা করে ভেঙ্গে মাংসে দিয়ে দাও বিশ-বাইশটা সেই তাজা লংকা। কাঁচা মাংসেই ঝাল ঝাল সুবাস ছড়ায় লংকার। বনভোজনের ব্যবস্থা জলেখাবিবির জমিতে হলেও লংকা তার খেত থকে তোলা হয় না। জলেখাবিবির বিশাল বিশাল লংকার খেত একেবারেই উলটোদিকে সেই খালপারের লাগোয়া জমিতে। জমির পর জমি জুড়ে তাদের লংকার চাষ। সেইখান থেকে ওই সামান্য পরিমাণ লংকা নেওয়াটাও বুঝি বেশ লজ্জাকর। তাই রাস্তা টপকে অন্যের খেত থেকে আসে দুই-তিন মুঠি লংকা। এবার সামান্য তেল দরকার। আর নুন। কেউ একজন নিজের বাড়ি থেকে একপাক ঘুরে আসে, পকেটে করে নিয়ে আসে ছোট্ট শিশিতে খানিকটা সরষের তেল, কাগজে মোড়ানো এক খাবলা লবন। কুড়িয়ে আনা ইট দাঁড় করিয়ে বানানো উনুন। আবার বুজিয়েও দেয় রান্না হয়ে গেলে। হাড়ি থেকেই সেদ্ধ বা আধসেদ্ধ ঝাল ঝাল মাংস খাওয়া হয় নাকের জল-চোখের জল এক করে। আহা-উহু শব্দে স্বাদ আর তৃপ্তির ব্যঞ্জনা তুলে তারা বাড়ির পথ ধরে। যাওয়ার আগে হাড়ি ভেঙ্গে উনুনের উপর ফেলে রেখে দিয়ে যায়। সকাল হলে দেখা যায় বাগের অনেক অংশেই পড়ে আছে পোড়া কাঠ আর ভাঙ্গা হাড়ি।

    -দুই-
    তোতা লইল ময়না লইল আরো লইল টিয়া।
    সোণামুখী দইয়ল লইল পিঞ্জিরায় ভরিয়া।।
    ঘোড়া লইল গাধা লইল কত কইব আর।
    সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হাড়।।
    - মহুয়া/ দ্বিজ কানাই/ পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

    পানির দেশে বর্ষায় প্রায় সবারই ঘর-বাড়ির আনাচে-কানাচে পানি থাকে। বর্ষার পানি সরে গেলে পলি পড়া মাটিতে মাঠে চাষ হয় ধান। বাড়ির লাগোয়া জমিগুলোতে বেগুন, টমেটো, পেঁয়াজ-রশুন, ধনে ছাড়া আর যা হয় তা লংকা। প্রতি বছরই খেত থেকে লংকা তোলার পর গাছসুদ্ধু কিছু পাকা লংকা শুকিয়ে রেখে দেওয়া হয়। অনেক খেতেই গাছ থেকে লংকা ছাড়ানো হয় না হাত লেগে বীজ নষ্ট হয়ে যাবে বলে। গাছসুদ্ধু শুকনো খড়খড়ে লংকা গোছায় গোছায় আঁটি বেঁধে উঠে যায় ঘরের মাচায় বা গোলাঘরে। মাঝে-মধ্যেই তাদেরকে নামিয়ে রোদে দেওয়া হয়, যাতে নেতিয়ে গিয়ে নষ্ট না হয়। পানি সরে গিয়ে মাটি জেগে উঠলে মাচা থেকে নেমে আসে শুকনো খটখটে লংকার গাছ। আবার তারা রোদে পড়ে থাকে কয়েকদিন। নাকে-মুখে কাপড় বেঁধে গাছ থেকে লংকা ভেঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাড়ির নামায় ‘জালা খেতে’। জালা খেত– যেখানে বীজ থেকে চারা তৈরি হয়। সদ্য পানি সরে যাওয়া ভিজে মাটিতে খুব তাড়াতাড়িই বীজ ফেটে চারা বেরিয়ে আসে খেতময়। কোথাও গাছ হয় ঘন কোথাও হালকা। বিঘতখানেক বড় হলেই তাদের তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয় কুপিয়ে তৈরি করা মাটিতে। এক বিঘত ফাঁকে দুটো-তিনটে চারা একসঙ্গে পোঁতা হয়, কোনও গাছ যদি না বাঁচে- মরে যায় তাহলেও যেন সেই জায়গাটা শূন্য না থাকে। এই চাষের লংকার গাছ বেশি বড় হয় না, মাটি থেকে এক-দেড় হাত উঁচু অব্দি তাদের উচ্চতা। খুব তাড়াতাড়িই গাছে ফুল আসতে শুরু করে। যেদিকে চোখ যায়, বাড়ির নামায়, পুকুরপারের ঢালে, দুটো বাড়ির মাঝখানের চিলতে জমিতে, খালপাড়ের সরু সরু আল বান্ধা জমিগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট সার সার লংকা গাছ, তাতে সাদা ফুল। যেন বিশাল বড় এক পট জুড়ে কোথাও সরু চিলতে, কোথাও চৌকো তো কোথাও বিস্তৃত সবুজ মাঠ যাতে ফুটে রয়েছে ছোট্ট সাদা ফুল। ফাঁকে ফাঁকে শূন্যস্থান পূরণ করার মতো করে রয়েছে ঘর-বাড়ি, খাল-নদী-পুকুর আর মানুষ!

    লংকা পুরুষ্টু হয়ে পেকে আসার সময় এলেই কৃষকের চিন্তা শুরু হয়। খেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশের খুঁটিতে মেটে হাড়িতে কালি দিয়ে এঁকে দেওয়া কাকতাড়ুয়ার উপর আর ভরসা রাখা যায় না কারণ টিয়েপাখি এবার এলো বলে... গাছপাকা টুকটুকে লাল লংকার উপর সবচেয়ে বেশি লোভ টিয়েদের। একটা-দুটো তো নয়, ওরা যে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে! কোথা থেকে যে আসে আর খেত সাফ করে দিয়ে কোথায়ই বা চলে যায় খোদা মালুম কিন্তু যখন আসে তখন ওই একলা কাকতাড়ুয়াকে তারা পাত্তাই দেয় না। ঢিল ছুঁড়ে, লাঠি নিয়ে তাড়া করে ক’টা টিয়েই বা তাড়ানো যায়! একদিকে থেকে তাড়ালে অন্য দিকে গিয়ে বসে যদি না দল বেঁধে কয়েকজন মিলে তাড়া করা যায়। কিন্তু কে আসবে অন্যের খেত বাঁচাতে? সবারই যে খেতে লংকা! সবুজ গাছেদের গা ভর্তি পেকে আসা কালচে লাল, হালকা লাল, ফিকে লাল, গাঢ় লাল লংকার উপর টুকটুকে লাল বাঁকানো ঠোঁটের টিয়ের দল। একলা কৃষক তাদের তাড়াতে গেলে উলটে তারা দল বেঁধে এমন তাড়া করে যেন লংকার বদলে এবার লাল রক্ত’র স্বাদ নিয়ে দেখবে। সঙ্গে তারস্বরে সমবেত ডাক, সে ডাক মোটেই মিষ্টি থাকে না আর শুনতে।
    সৈজিরিনা পিতুইল্যা গাও।।
    গাছের উপর বসিয়া পাহানা হবীরে
    ঠোকাইয়া খাইব আমাগারে এইনা
    টিয়া পক্কির ছাও
    — মেয়েলী গীত/ সিরাজগঞ্জ
    লংকা পোক্ত হওয়ার আগেই কৃষক তাই জাল বোনে। কেউ বানায় ফাঁদ। ফিকে সবুজ রঙের সরু সুতোর জাল বিছিয়ে দেয় লংকার খেতের উপর। তারপর অপেক্ষা টিয়ের দলের। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই টিয়ের দল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতে। বাঁকানো নখ আটকে যায় জালে, তারস্বরে চীৎকার জুড়ে দেয় টিয়ের দল। কিছু টিয়ে উড়ে যেতে পারে পা ছাড়িয়ে তো কিছু ঠিক আটকে যায় জালে। লাঠি হাতে কৃষক এসে জাল তুলে নেয় লংকার খেতের উপর থেকে, জালে ছটফট করতে থাকা টিয়ে সহ।

    উঠোনভর্তি ছোট ছোট খাঁচায় তিনটে-চারটে করে টিয়ে। অপেক্ষা– পাখির ব্যাপারির। ব্যাপারি এসে খাঁচাসুদ্ধু টিয়ে কিনে নিয়ে যায়, বাঁশের ভারায় ঝোলে খাঁচায় বন্দী টিয়ে।
    কুন্ দ্যাশেতে যামু—লো বুইন্
    কুন দ্যাশোত্ বান্ পামু
    য়্যাতো খাওয়ার পষ লিয়া কার কাছে
    কহানে যায়া খাড়ামু
    ওনালো
    কুন্ দ্যাশেতে যামু—লো বুইন্।।
    কুন্ দ্যাশেতে যামু—লো বুইন্
    কুন্ শহোরত্ বান পামু
    য়্যাতো ডইনা
    না—বুঝ পোষ লিয়া
    কার কানচিত কহানে যায়া খাড়ামু
    ওনালো
    কুন্ দ্যাশেতে যামু—লো বুইন্।।
    — মেয়েলী গীত
    প্রথমে টিয়ে নৌকা চেপে যায় কাছের ছোট শহরে, সেখানে বড় ব্যাপারির দোকান, তারপর ট্রেনে, বাসের ছাদে চেপে টিয়ের খাঁচা চলে যায় রাজধানী ঢাকা শহরে। কাঁটাবনে পাখির বড় বাজার। হাতির পুলেও সার বাঁধা সব পাখির দোকান। শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাখির দোকান থাকলেও সবচেয়ে বড় বাজার এই কাঁটাবনে। রাস্তার দু’পাশে সারসার সব দোকান তাতে ছোট-বড় নানা রকমের খাঁচায় রকমারি সব পাখি। মোবাইল ফোনে খবর চলে যায় সৌখিন লোকেদের কাছে– টিয়ে এসে গেছে, চলে আসুন। উঁচু উঁচু সব বিল্ডিংএর চিলতে সব বারান্দায় দেখা যায় ঝুলন্ত সব খাঁচা, খাঁচায় বন্দী টিয়ে। শহরে তার মেলা আদর। ডাক শোনার জন্য অনেক সাধ্য-সাধনা। গর্বিত টিয়ে মালিক বাজারে গিয়ে লংকার ঝাঁকা থেকে বেছে বেছে বার করেন পাকা লাল লংকা। এক দোকানি না দিতে পারলে ঘুরে ঘুরে কিনতে হয় নানা দোকানির কাছ থেকে। পাকা লংকা সাধারনত তোলা থাকে শুকিয়ে বেচার জন্য কাঁচা বাজারে তা এসে পৌঁছায় না। ফলে ঝিনুক থেকে মুক্তো বের করার মত লংকা খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসতে হয় বারান্দায় ঝুলন্ত খাঁচায় বন্দী টিয়ের মান ভাঙ্গানোর জন্যে।

    -তিন-
    নতুন কাচা কাইটাছি
    গুয়া নারকেল লাগাইছি
    আমও তো বোলাইছে
    গুয়াও তো চুমরাইছে
    কাঁঠালে ফেলিয়া গেল
    মোচা লো বিবি।
    ঐ না কাঁঠাল কাটিতে
    ঐ না পাশা খেলিতে
    লাইগ্যা গেল ঠাণ্ডা পানির
    প্যায়স লো বিবি।
    লাইগ্যা গেল শীতল পানির
    প্যায়স লো বিবি।
    ঐ খানে না দাঁড়াইয়া
    শোন দুলাল আমার মাদনের
    কথারে দুলাল।
    তোমার মাদনের কথা
    যেমন বাউল মরিচের
    ঝাল ও বিবি।
    — মেয়েলী গীত/ ফরিদপুর

    টুকটুকে ফর্সা, মোটা-সোটা, নাদুস-নুদুস দেখতে জলেখা বিবির বছরভর উদোম গা। সায়ার উপরে আটপৌরে করে পরা শাড়ির আঁচল আলগোছা হয়ে পড়ে থাকে ঘামজড়ানো ফর্সা পিঠের উপর। নাকে নোলক, বেশ বড় পানপাতা নাকছাবি, কানে পাশা, গলায় মোটা চেন, হাতে বালা। কখনও ছড়ি তো কখনও কাস্তে নিয়ে জলেখা বিবি দিনমান ঘুরে বেড়ান বাড়ির আনাচে-কানাচে লাগিয়ে রাখা নানান রকম গাছ-গাছালি, তরি-তরকারির খেতে। কোনও গাছের ডাল ছাঁটা তো কোথাও মাটি নিড়িয়ে দেওয়া। কোথাও আবার হেলে যাওয়া বাঁশের বেড়াটাকে তুলে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া। বিকেলবেলাটা তাঁর কাটে বাড়ির সামনের পুকুরপারের বাঁধানো বেদিতে বসে। বিশাল বড় এক উঠোনের চার ভিটেয় চারখানি বড় বড় আটচালা টিনের ঘর, সবচেয়ে বড় ঘরখানি জলেখা বিবির। সবক’টা ঘরেরই সামনে মাটির বারান্দা, সেই বারান্দার চাল খড়ে ছাওয়া। ঘরের চালে লাউ-কুমড়োর মাচা, বাড়ির পিছনে ফলের বাগান। পিছনের বাগানে বিছিয়ে থাকে সব ঝরা পাতা। প্রতিদিন সকালে উঠে মুখ ধোয়ার আগেই উঠোন ঝাঁট দেওয়াটা রেওয়াজ হলেও পেছনের বাগানে রোজ ঝাঁড়ু পড়ে না। শুকনো পাতার গালিচার উপর পাকা ফল পড়ে টুপটাপ টুপটাপ। কামরাঙ্গা, আম, জাম আর জামরুল। বাড়িটা দু’ভাগে ভাগ করা। উঠোনের পশ্চিমদিকের বড় সবচেয়ে উঁচু ঘরটা বাংলাঘর— বৈঠকখানা।যেখানে মুনি-মানুষেরা বসে হুঁকো-তামাক খায়, বাইরের লোক-কুটুম্ব এলে পুরুষেরা বসে গল্প করে, সেই ঘরের সামনের দিকে আর এক উঠোন। লম্বাটে এক চওড়া উঠোনের শেষমাথায় একটাই বাড়ি, এক ইটের দালান। সেই দালান বারোমাস বন্ধ থাকে। গ্রিলের বারান্দায় সব সময়েই ঝোলে এক বড় লোহার তালা। স্কুল বাড়ির মতো সেই দালানে সারি সারি ঘর। সব ক’টা দরজা বন্ধ, সব ক’টা দরজায় ঝোলে ইয়ব্বড় বড় লোহার তালা। জলেখা বিবি বলেন— দালানে বড় গরম হয়। তখনও বিজলিবাতি না পৌঁছুনো শাহবাজপুরের মানুষের হাতে হাতে তালপাতার পাখা।

    প্রত্যেকটা ঘরেরই কোমরসমান উঁচু ভিটে। ফি বছর বর্ষার জল পুকুর আঙ্গিনা ডুবিয়ে উঠোন অবধি চলে আসে বলে জলের দেশে প্রায় সবারই ঘরের ভিটে উঁচু হয়। জলেখাবিবির ঘরের পাশটিতে তেমনি উঁচু ভিটের উপর বিশাল বড় এক রান্নাঘর, যার মাথায় খড়ের চাল। সব ক’টা বারান্দা আর রান্নাঘরের চালের উপর বিছিয়ে থাকা চালকুমড়ো, মিষ্টিকুমড়োর গাছে ফলে থাকা পাকা পাকা সব কুমড়ো। তাই লতা-পাতা এড়িয়ে চালের খড় আর দেখা যায় না। মনে হয় যেন এইসব বারান্দা, রান্নাঘরের চাল যেন কুমড়ো গাছ দিয়ে ছাওয়া। ছবির মত শান্ত। হৈচৈ ভেসে আসে দূর থেকে। ভোররাত্তির থেকে টিপকলে জল তোলে নেতুলহাটি, মোড়াহাটি, দিঘীর পারের মেয়ে-বউরা। গোটা দুপুর টিপকলটা থাকে আশে-পাশের ছোট ছোট ন্যাংটো ছেলে-মেয়েদের দখলে। একজন কল টেপে, পালা করে অন্যেরা বদনা ভরে ভরে জল নেয় এক এক করে কিন্তু বদনা ভর্তি জল একযোগে সবাই নিজের নিজের মাথায় ঢালে। আবার চলে কল টেপা, বদনা ভরা। এভাবে চলতেই থাকে যতক্ষণ না কেউ এসে ওদেরকে ধমকে তাড়িয়ে কলের দখল না নিচ্ছে। খালপাড়ে উত্তরদিকে বেশ কিছু নামা জমি পড়ে রয়েছে, কোনও আল বাঁধানো নেই বলে মনে হয় যেন বিশাল বড় এক মাঠ। কবরস্থানের গায়ে বলেই হয়ত কেউ তাতে চাষবাস করে না। শুকনো মরশুমে ঘন ঘাস-আগাছার জঙ্গল, বর্ষায় খাল ওপচানো জলের তলায় থাকে ওই জমি সহ আশে-পাশের সমস্ত নিচু জমি। প্রায় বছরেই জলের তলায় চলে যায় জলেখা বিবির বাড়ির নামার সবটুকু জমি এমনকি নিচু পাড় বাঁধানো ওই পুকুরও।

    গ্রাম সম্পর্কে জলেখা বিবি আমার দাদি আর রফু মিঞা দাদা। লতায়-পাতায় সম্পর্ক। চাচাতো ভাই-বোনে বিয়ের ফলে নিজের বাড়ির পাশের বাড়িটিই জলেখা বিবির শ্বশুরবাড়ি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান জলেখা বিবি, ওদিকে রফু দাদাও তাই। ফলে কয়েক একরের পুকুর-বাড়ি-বাগানের একচ্ছত্র মালিক জলেখা বিবি আর রফু দাদা। খেতের ফসল ঝাঁড়াই-বাছাই, শুকানো উঠোনেই হয় বলে সেখানে কোনও গাছ নেই। লেপা-পোঁছা ঝকঝকে উঠোন। বড় বড় সব ফলের গাছ সারি দিয়ে ঘরের পিছন দিকে লাগানো, ফলে ঘরের ভিতরটা সব সময়েই ঠাণ্ডা। বাড়ির লাগোয়া নিচু জমিতে মরশুমি আনাজের চাষ-এবং তার দেখাশোনা জলেখা বিবি নিজেই করেন। মুনিষ সামলানো, অত বড় বাড়ির সার্বক্ষণিক দেখভাল, সে’সবও জলেখা বিবির দায়িত্ব। বাড়ির জন খাটতে আসা মুনিষদের একথালা মোটা চালের ভাত সঙ্গে এক চিমটি শুটকি-লংকাবাটা দিয়ে জলেখাবিবি বলতেন ‘বুঁই দিয়া বুঁই দিয়া খাইয়া ফ্যালাও’। পাতে থাকত এক খাবলা নুন। যে বস্তুটির ‘বুঁই’― গন্ধ দিয়ে ভাতটা খেতে বলা হচ্ছে সেটি আর কিছুই নয়, শুকনো লংকা বাটা। লংকার সঙ্গে একটা বা দুটো সিদল দেওয়া হয়েছে গন্ধের জন্যে। টকটকে লাল লংকাবাটায় একটা সবুজ সবুজ ছিট দেখা যায় যা এসেছে শিলে দিয়ে বাটার আগে লাউ বা কুমড়ো পাতা দিয়ে মুড়িয়ে সিদলকে সেঁকা হয়েছে বলে। মুনিষেরা খেতে বসে গজগজ করত, নামমাত্র শুটকি দেওয়া কেবল লংকাবাটা দিয়ে ভাত খাওয়া যায় না বলে। অভিযোগ করত। তাতে জলেখাবিবি অ্যালুমিনিয়ামের বাটি নিয়ে এগিয়ে এসে আঙ্গুলে করে আরও এক চিমটি লংকাবাটা দিয়ে যেতেন।

    -চার-
    আঁহা জ্বলে
    লাইত্ দিন
    হে য়্যাতো কিসের লান্দা-বাড়ি
    ওনালো
    মোনে কয় ছাইড়া যাইগা বাড়ি।।
    আঁহা জ্বলে
    হগোল সুম
    হে য়্যাতো কিসের কাটা-কুটা
    ওনালো
    মোনে কয় ছাইড়া যাইগা বাড়ি।।
    আঁহা জ্বলে
    লাইত্ দিন
    হে য়্যাতো কিসের ধুমধাম
    ওনালো
    মোনে কয় ছাইড়া যাইগা বাড়ি।।
    — মেয়েলী গীত

    রান্নাঘরে বিশাল বড় এক দু’মুখো চুলোয় কাঠের জ্বালে সারাদিন রান্না করে হেনাফুফু। অত কী রান্না করে, কেন করে জানি না কিন্তু যখনই ওদের বাড়ি গেছি তখনই দেখেছি হেনাফুফু রান্না করছে। আর সবসময়ই টকটকে লাল কিছু একটা ঝোল টগবগ করে ফুটছে হাড়িতে। সারাবছরই হেনাফুফুর ঘাম বইছে জলের মতো, তার টুকটুকে ফর্সা মুখ গরমে রাঙা। ঝোল ফোটার টগবগ শব্দ আর শিল-পাটার ঘটরঘটর বুঝি এই বাড়িতে হৃদস্পন্দনের মত কখনই থামে না। ঘরের এক ধারে বিশাল বড় এক শিল পাতা, তাতে যখনই গেছি তখনই দেখেছি কিছু একটা মশলা বাটছে হেনাফুফুদের কাজের বুবু। সিংহভাগ সময়েই সেই মশলাটা হয় লংকা। টকটকে লাল লংকা। হয় টাটকা, নয়ত শুকনো লংকা পানিতে ভিজিয়ে। পাশেই রাখা মেটে সানকিতে জল, লংকার ঝাল হাতে যেন না লাগে তাই বারে বারে ওই জলে হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা। হেনাফুফু ফোঁস ফোঁস করে সর্বক্ষণ যদিও তা জলেখা বিবির কান পর্যন্ত পৌঁছায় না— সারা বাড়ি ভর্তি মরিচগাছ, যত ইচ্ছা পাড়ো আর বাটো, তরকারিতে দ্যাও, না করব কেডা! জলেখা বিবির হুকুম মতো সবেতেই যথেচ্ছ ঝাল দিতে হতো বলে মাঝে-মধ্যেই নিজের মনে গজগজ করত হেনাফুফু।
    মরিচ বাঁটি বাত্ রান্দি
    হারাদিন এই সংসারে
    হইর্যা মারি কাম।
    কেব্ব্যা হইরা রাইত পোয়ায়
    কত দুক্কু মনে রয়
    হগনা আপনে জানেন না।
    আমার হাতে হুদাই আপনে
    অ্যাত বেশি ইয়ারকি হইবেন না।
    — মেয়েলী গীত/ সিরাজগঞ্জ

    জলেখা বিবির বড় ছেলে গফর চাচার বউ হেনাফুফু। দাদির কীরকম যেন ভাইঝি। ওদের বাড়ি ঢুকে আমি আগে হেনাফুফুর কাছেই যেতাম, রান্নাঘরে। কারণ ঝাঁকড়া কামরাঙ্গা গাছটি হেনাফুফুর ঘরেরই পিছনে। আরও একটা কারণ ছিল। হেনাফুফুর হাত ধরে থাকলে রফুদাদা বিয়ে করবে বলে ভয় দেখাতে পারত না। রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেই একগাল হেসে হেনাফুফু হাত ধরে বসিয়ে দিত কাঠের জলচৌকিতে। চুলোর জ্বাল সামলে উঠোন পেরিয়ে নিজের ঘরের পাশ দিয়ে চলে যেত পিছনে, কামরাঙ্গা গাছের তলায়। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যায় মেঝেয় পাতা মাদুরের উপর আধশোয়া গফর চাচা একা একাই তাস খেলছে, পাশেই মাটির মেঝেতে খড়ি দিয়ে অ, আ, ক, খ লিখছে হেনাফুফুর ছেলে। উঠোনের সব কটা ঘরের পিছনেই বেশ অনেকটা করে জমি আর তাতে নানান রকমের ফলের গাছ। আম-জাম-কাঁঠাল-জামরুল-কামরাঙ্গা-বরই-আতা-শরীফা ছাড়াও ছিল নানান রকম লেবু আর লংকার গাছ। মরশুমে খেতে যে লংকার চাষ হয় এ সেই লংকা নয়। নানান রকম সৌখিন সুগন্ধী লংকা। লেবু গাছের ফাঁকে ফাঁকে সেই সব বাহারি ও বিরল লংকার গাছ, কাঁটাওয়ালা লেবুগাছগুলি যেন লংকাপুরীর সার সার রক্ষী। নানান জায়গা থেকে যোগাড় করা অতি দুর্মূল্য লংকা গাছ সব। বুক সমান উঁচু কোনও কোনও গাছে আকাশের দিকে ল্যাজা করে সূর্যমুখী ফুলের মতো থোকায় থোকায় ধরে আছে ছোট্ট দেখতে অসম্ভব ঝাল ধানী লংকা। কোনও গাছ আবার ছোট্ট কিন্তু সরু সরু লম্বাটে থোকা থোকা কাঁচা-পাকা লংকার ভারে নুয়ে পড়া ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির বিভিন্ন কোণায় কোণায়।

    জলেখা বিবির ছোটছেলে মীজান চাচা পূবহাটির প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বিয়ে করেছে সেই স্কুলেরই এক শিক্ষিকাকে যে কিনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেয়ে। রোজ সকালে বাসে চেপে স্কুলে আসত, বিকেলে ছুটির পরে আবার ফিরে যেত দশ মাইল দূরের শহরে। জলেখা বিবি তাকে বলতেন ‘আমার মাস্টর বৌ’। বেটে-খাটো দেখতে সেই মাস্টর বৌ ভীষণ রোগা। জলেখা বিবির আক্ষেপ, ‘মীজানে জানি কী দেইখ্যা বিয়া করল, ‘শ্রী’ তো বৌয়ের ধারে-কাছ দিয়াও যায় নাই।’ সেই ‘শ্রী’হীন বৌ সকালে উঠেই উঠোন-বাড়ি ঝাঁট দিয়ে জামা-কাপড় নিয়ে সোজা চলে যেত পুকুরঘাটে। মীজানচাচা তখন বাংলাঘরের মেঝেয় পাতা সতরঞ্চির উপর একদল ছেলে-মেয়েকে পড়াতে বসেছে। নাসরীন চাচি— মীজান চাচার বউ স্নান সেরে কাচা কাপড় উঠোনে মেলে রান্নাঘরে গিয়ে বসত হেনাফুফুর সঙ্গে। হাতে হাতে আনাজ-তরকারি কুটে দেওয়া বা উনুনে বসানো ভাতের হাড়ি নামিয়ে মাড় গেলে থালায় থালায় সেই ভাত বেড়ে পাশেই পেতে রাখা তক্তপোশের উপর রেখে দিত নিজের আর স্বামীর জন্য। শিলে তখন বাটা হচ্ছে পাতায় মোড়ানো সেঁকা গুটিকয় সিদল, দুই কোয়া রশুন, একটা পেঁয়াজ আর এক ঝুড়ি লংকা। এক শিল।
    ছোটো বোউলো
    মোরিজ বাঁট
    আইজ্কা না-সে খাসের আট
    বাড়ির মানুষ কইয়া গ্যাছে
    আনবো রুই মাছ
    ওনালো
    ছোটো বোউ-লো তুই পাটায়
    মোরিজ বাঁট।।
    — মেয়েলী গীত
    নাকে-মুখে চাট্টি ভাত-তরকারি দেওয়ার সময় থাকত হাতে। কখনও তরকারি তৈরি না হওয়ায় সাদা ভাতে শিল থেকেই তুলে নিত খানিকটা শুটকিবাটা। তারপর দুইজনে দৌড়াত স্কুলের দিকে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে একজন বাংলাঘরে আবার বসত ছাত্রের দল নিয়ে তো অন্যজন নিজের ঘরের মাটির দাওয়ায় মাদুর পেতে পড়াতে বসত পাড়া-ঘর থেকে পড়তে আসা একটু বড় মেয়েদের নিয়ে, যারা কিনা পড়ে হাইস্কুলে।

    সকাল থেকে বাড়ির পিছনদিকের পুকুরপারে চেয়ার নিয়ে বসে থাকে জলেখাবিবির স্বামী রফুদাদা যা কিনা উত্তরগাঁওয়ের কবরস্থানের মুখোমুখি। পাড়ার ছোট ছোট মেয়েরা, যাদের সঙ্গে নাতনির সম্পর্ক, সকলকেই তিনি বিয়ে করতে চান। কবরস্থানের ডানে-বাঁয়ের পাড়া থেকে ছোট ছেলে-মেয়েরা, যারা এই আগাছা ভর্তি মাঠে খেলতে আসে, তাদের সকলেই রফুদাদাকে ভয় পায়। বাজখাই গলায় কখন যে কাকে হাঁক দিয়ে বলবে, ‘অই মাইয়া ইদিক আয়, তরে আমি বিয়া করুম’― সে কেউ জানে না। ওই রাস্তায় মেজফুফুর বাড়ি যাওয়ার সময় রফুদাদার ভয়ে কতবার যে চোখ বন্ধ করে দৌড়ে ওই মাঠ পেরিয়ে ফরিদ মাস্টারের উঠোনে গিয়ে উঠেছি তার কোনও লেখা-জোখা নেই। আর কতবার যে চুপি চুপি আদাড়-বাদাড় ভেঙ্গে ওদের বাড়ি গিয়ে জলেখা বিবিকে নালিশ জানিয়েছি রফুদাদার নামে তারও কোনও হিসেব নেই। এমনও হয়েছে যে ইতি উতি দেখে নিয়ে এগিয়েছি। রফুদাদাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে নিশ্চিন্ত মনে ওদের বাড়ি ঢুকেছি কামরাঙ্গা খাব বলে, অমনি যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো রফুদাদা― ‘এইত্তো সামাবিবি! বিয়া তো তরে করুমই করুম!’ রফুদাদার আওয়াজ পেয়ে জলেখা বিবিও উদয় হতেন তখুনি, বলতেন― ‘হ! সামাবিবির আর কাম নাই যে তুমার লগে বিয়া বইব!’
    ষোল নাসি তুল গো সুন্দন নাসি লিলা
    লিলা তোমার গায়ে গো
    রদাত্র গো লাগে
    তোমার গায়ে গো ছিদ্রি লাগে।
    কেমুন শালায় করছে বিয়া তরে লিলা
    হুকুম যদি দিতা গো লিলা
    নাকখান বইয়্যাতাম আমি
    আমার সাদু গেছেরে কুমার
    সেই লংকার ব্যাপারি
    সেই লংকার বাণিজ্যে।
    সেইখান থাইক্যা আন কুমার
    পেটনা ভরে বেমর
    সেইন্যা বেমর পিদারে কুমার
    ঘুরিয়া তামাশা চাইবাম আমি
    কুমার ঐ রে বসিয়া তামাশা
    চাইবাম আমি।
    — মেয়েলী গীত/ ঢাকা

    -পাঁচ-
    মরিচ সের পাঁচ টেয়া ভাই
    এক ছটাক লই কিনি
    মরিচ পুড়ি পানি ভাত খাইতাম
    তওফিকে কুলায় নি
    — চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান/ কবিয়াল রমেশ শীল

    উঠোনটুকু পেরোলেই হেনাফুফুর হাত ছেড়ে দিয়ে কামরাঙ্গা গাছের দিকে দৌড়াই। বিশাল বড় এক গাছ। কামরাঙ্গা গাছ যে অত বড় হয় সে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। পিছনের এই বাগান সব সময়েই ছায়া ছায়া অন্ধকার। সূর্যের আলো শুধু গাছ আর পাতাদের ছুঁয়ে থাকে এখানে, মাটি অব্দি নেমে আসে না। কাঁচা-পাকা কিছু কামরাঙ্গা সব সময়েই পড়ে থাকে গাছতলায়। ব্যস্ত হয়ে আগে সেগুলো কুড়োতে গেলে হেনাফুফু বলে, ‘শুকনা কামরাঙ্গা খাইবায়? গাছ থেইক্যা পাইড়া খাও।’ আমার ততক্ষণে কোচড়ভর্তি কুড়িয়ে নেওয়া কামরাঙ্গায়। গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার হাতের মুঠিতে ধরবে না এত বড় সব কামরাঙ্গা পেকে হলুদ হয়ে আছে পাতার ফাঁকে ফাঁকে। রোদ পড়ে চিকচিক করে ফিকে হলদে রঙের সব কামরাঙ্গা। কোচড়ের দিকে তাকাই, পড়ে থাকা কামরাঙ্গাগুলিও ছোট নয় মোটেই কিন্তু গাছের গুলোর মতো নয়! হেনাফুফু নিচু একটা ডাল ধরে ঝাঁকিয়ে দিতেই ঝুপ ঝুপ করে পাকা-রসালো কামরাঙ্গা ঝরে পড়ে শুকনো পাতা বিছিয়ে থাকে মাটিতে। একটা কামরাঙ্গা হাতে নিয়েই একটা বড়সড় কামড় বসাই, আহ্... কী মিষ্টি কী মিষ্টি...বাসি কামরাঙ্গাগুলো কোচড় থেকে ফেলে দিয়ে আবার কামরাঙ্গা কুড়োই। এত কামরাঙ্গা হাতে-কোচড়ে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাই হেনাফুফু বাড়ির দিকে যায় ঝাঁকা আনবে বলে।

    কামরাঙ্গা নিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় সূর্যমুখী ফুলের মতো ফুটে থাকা ফিকে সবুজ কতগুলো ধানিলংকা তুলে নেয় হেনাফুফু। বুঝে যাই যে কামরাঙ্গার ভর্তা হবে। উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সময় জলেখা বিবির সঙ্গে দেখা। কামরাঙ্গা দেখে বলেন, ‘পুরা মরিচ দিয়া ভর্তা বানাও বৌ’। ‘জী আম্মা’ বলে হেনাফুফু রান্নঘরে গিয়ে বড় টিনের কৌটো খুলে একমুঠো শুকনো লংকা তুলে নিয়ে উনুনের সমুখে মাটিতে রাখে। শুকনো লংকার লাল রঙ দেখেই ভর্তা খাওয়ার সাধ বেড়ে যায় বহু গুণ! উনুন থেকে ছাই তোলার বড় লম্বা ডাঁটির লোহার হাতা দিয়ে এক হাতা জ্বলন্ত কয়লা তুলে মাটিতে রাখা লংকার উপর ছড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চিড়চিড়ে আওয়াজ আসে লংকা থেকে, তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ছাড়ে লংকা। নাকে-মুখে আঁচল চেপে ধরে বাঁশের কাঠি দিয়ে আগুনটাকে নেড়ে-চেড়ে দেয় হেনাফুফু, ততক্ষণে বাদবাকি সকলেরই হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো শুরু হয়ে যায়। নাকের ভিতরে, গলায় সুড়সুড়, দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও নিস্তার নেই, গোটা বাড়িময় পোড়া লংকার ঝাঁঝ। টকটকে লাল লংকা পুড়ে কালো হয়ে গেলে কাঠিতে করে লংকাগুলো টেনে টেনে সরিয়ে দেয়। হাতায় করে তুলে একটা থালায় ছড়িয়ে দেয় ঠাণ্ডা হয়ে মুচমুচে হওয়ার জন্যে।

    কাঁচালংকার গন্ধ-ঝাঁঝ-ঝাল সবই ভীষণ লোভনীয় বটে কিন্তু পোড়া লংকা দিয়ে ভর্তা! অহো... ভাবতেই জিভে জল! ভীষণ পাতলা করে কামরাঙ্গা কাটে হেনাফুফু। বটিতে হাত চলে যেন মেশিনের মতো! কিছু বুঝে ওঠার আগেই বটির সামনে রাখা অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ভরে যায় অসম্ভব পাতলা কামরাঙ্গার চাকায়। একটু ঠাণ্ডা হলে মুচমুচে সেই পোড়া লংকা হাতে করে গুড়ো গুড়ো করে ছড়িয়ে দেয় কেটে রাখা কামরাঙ্গার উপর। নুন দিয়ে ভালো করে মেশায় পোড়া লংকার গুড়োকে কামরাঙ্গার সঙ্গে। ফিকে হলুদ রসালো কামরাঙ্গায় নুন পড়ে গামলায় রস ছাড়তে শুরু করেছে সঙ্গে সঙ্গে। মুড়ি খাওয়ার ছোট ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে এক বাটি করে ভর্তা সবার জন্যে বের করে হেনাফুফু, নিজেরটুকু তার গামলাতেই থাকে। কোমরে গোঁজা আঁচল খুলে নিয়ে মুখ-গলার ঘাম মোছে হেনাফুফু। বাটি বাটি ভর্তা সে এ’ঘরে ও’ঘরে পোঁছে দিয়ে আসে। আমার তর সয় না, রান্নাঘরে বসেই এক খাবলা ভর্তা মুখে পুরি, সঙ্গে সঙ্গে নাকে-চোখে জল চলে আসে পোড়া লংকার ঝালে। তাই বলে ভর্তা খাওয়ায় ছেদ পড়ে না।

    ছেদ পড়ে। দেশ ছেড়ে এলে। চল্লিশ বছর হয়ে গেল বাংলাদেশ স্বাধীন। দীর্ঘদিন আমি দেশের বাইরে। এবার বাড়ি গিয়ে দেখলাম বারান্দার ওপাশে, পশ্চিমদিকে একটা নতুন বরই গাছ হয়েছে আর তাতে বরইও এসেছে ঝেঁপে। বেশ বড় বড় ফিকে সবুজ রঙের বরই, অনেকটাই ঢাকাই মিষ্টি বরইয়ের মত দেখতে। সকাল থেকে নিয়ে সন্ধে অব্দি দোতলার বারান্দায় গ্রিলের ধারে পেতে রাখা লম্বা কাঠের বেঞ্চে বসে বরইগাছ পাহারা দেয় আব্বা! বলে, পোলাপাইনে ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে সব কমপোক্ত বরই নষ্ট করে, যা কিনা কেউই খেতে পারে না, আদ্ধেক তার আবার গিয়ে পড়ে পুকুরে। বেলা সাড়ে দশটা-এগারোটা হলেই বাড়ির মুনিষ আওয়াল এসে জিজ্ঞেস করে, সাব, ‘সাব, বরইভর্তা খাইবেন নি?’ আব্বা বরাবরই ভর্তা খেতে ভালবাসে তা সে আম-জলপাই-কামরাঙ্গা বা বরই যারই হোক না কেন। লম্বা বাঁশের খুঁটি নিয়ে খোঁচা দিয়ে দিয়ে হলদে হয়ে আসা পোক্ত বরই পাড়ে আওয়াল। এক ঝুড়ি বরই নিয়ে রান্নাঘর থেকে চাল কোটার গাইল বার করে। পশ্চিমপাড়ের নামার লংকার খেত থেকে তুলে আনে টাটকা কাঁচা লংকা, আমগাছের নিচে গিয়ে খুঁচিয়ে পাড়ে সদ্য আসা আমের মুকুল। পাশের খেত থেকে আনে ধনে পাতার গোছা। ঝুড়িতে করে সব নিয়ে গিয়ে ধুয়ে আনে পুকুর থেকে। বরইয়ের সঙ্গে কাঁচা লংকা, আমের মুকুল, ধনেপাতা আর এক খাবলা লবন দিয়ে গাইলে পাড় দেয় সিয়া দিয়ে। আলতো পাড়ে বরইয়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশতে থাকে সুবাস ছড়ানো আমের মুকুল, ধনেপাতা আর কাঁচা লংকা। উঠোনে ততক্ষণে জড় হয়েছে সেই সব ছেলে-পুলেরা, যারা সারাক্ষণই তক্কে তক্কে থাকে আব্বা কোথায় আছে, বরই গাছে ঢিল দিয়ে বরই চুরি করবে বলে। তার বদলে চুরি করে বরইয়ের টক-মিষ্টি গন্ধ, টাটকা ধনেপাতা আর লংকার ঝাঁঝালো সুবাস। সব মিলিয়ে চুড়ান্ত লোভনীয় এক ভর্তা তৈরি হয় গাইলে। ছোট-বড় সব বাটি নিয়ে হাজির আওয়ালের বউ সায়রা। বড় হাতায় করে বাটি ভর্তি ভর্তি ভর্তা সবাইকে দেয় আওয়ালের বউ। এক চামচ মুখে দিতেই ঝালে কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে আমার কিন্তু সেই ভর্তার এমনই গন্ধ আর স্বাদ যে ঝাল যতই লাগুক নাকের জল- চোখের জল এক করে ভর্তা না খেয়ে উপায় নেই। দেশান্তরী হওয়ার দুঃখ গায়েব আপাতত।
    কি ভর্তা বানালি বউ
    ইছা হুনির কল্লা দি
    কেঁচা মরিচ বেশি হইয়ে
    ঝাল ক্যা দিয়স এনগরি
    ভর্তা খাইতাম কইলাম বউ
    কত হউস গরি।
    — চট্টগ্রাম/ মোহনলাল দাস

    -ছয়-
    দুয়ারে আগত গাড়িলেন গুয়ার গাছ।
    ছাড়িয়া যাবেন মাহুত রে, কে করিবে আও।।
    আম গাড়িলেন, জাম গাড়িলেন, আরো নারিকোল;
    বার মাসের ফল যেমন ফুটিয়াছে গাছে।
    তুমি ফান্দী চলি যাবেন শিকার করিতে।
    আম মউলায়, জাম মউলায়, কাঁঠালে ছাড়ে মুচি;
    মুই নারী আছোঁ ঘরে, মনত নাই মোর খুশি।।
    — বিরুয়া গান

    আরফানের সঙ্গে বইয়ের বাজার নীলক্ষেতে বই খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ল ঝাঁকায় একজন কয়েকটা কামরাঙ্গা মরিচ নিয়ে বসে রয়েছেন।ঘিঞ্জি বইবাজার,ঘু্পচি ঘুপচি সব বইয়ের দোকান, সরু সরু গলি এবং তস্য গলি।নতুন বই- পুরানো বই।কলকাতায় যে বই দুষ্প্রাপ্য তাও জেরক্স করে বাঁধানো পাওয়া যায় এই নীলক্ষেতে। শসা-আমড়া বিক্রেতারা এই ভীড়েও জায়গা বের করে ঠিক বসে পড়েছেন তাদের পসরা নিয়ে। এরই মধ্যে এক কোণায়, ঝাঁকায় কিছু কামরাঙ্গা মরিচ নিয়ে বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধ।খুব একটা বড় বা দেখতে সুন্দর নয় ঝাঁকার এই লংকাগুলো বরং কেমন যেন একটু শুটকো শুটকো মতন কিন্তু চোখে পড়তেই আমি যেন দেখতে পেলাম আব্বা একটা কাগজের ঠোঙ্গা এনে রাখছে টেবিলে, যাতে রয়েছে কামরাঙ্গা মরিচ। আম্মা ছুরি দিয়ে আলগোছে কাটছে সেই লংকা। আরও মনে পড়ল, প্রথমবার আব্বা যখন আমাকে দেখতে কলকাতায় এসেছিল, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল বরিশালের আমড়া, বাতাবি লেবুর সাইজের গন্ধরাজ লেবু– যা কিনা সিলেট থেকে আনানো হয়েছিল কাউকে দিয়ে, আর গোটা কতক কামরাঙ্গা মরিচ। আমি যদিও জীবনে কোনওদিন সেই লংকা চেখে দেখার সাহস করে উঠতে পারিনি শুধু সেই একবার ছাড়া কিন্তু ঢাকায়, ব্যস্ত এই নীলখেতে এক বৃদ্ধের ঝাঁকায় কামরাঙ্গা মরিচ দেখেই আমার খাওয়ার সাধ জাগে। লংকার ঝাঁকার সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেই আরফান প্রায় চেঁচিয়েই ওঠে– ‘বোম্বাইয়া মরিচ!’ দাম জিজ্ঞেস করতে শুনলাম জোড়া পনেরো টাকা। আরফান আবার চেঁচিয়ে ওঠে– ‘কন কী মামু, দুইডা মরিচ পনরো ট্যাহা! রসগোল্লা নিহি!’ তো বারো টাকায় জোড়া রফা হলে আমি দু’জোড়া নিলাম আর আরফান নিল দশ জোড়া। বললো, ‘বুইনডায় বোম্বাইয়া মরিচের আচার বড় ভালা বানায় গো বুবু।’

    না। কামরাঙ্গা মরিচের আচার বানাতে বাড়িতে কাউকে দেখিনি বটে তবে লংকার আচার তো হরবখতই হয়। আচার বিনে দাদির ভাত খাওয়া হতো না। খানিকটা আচার আম্মারও লাগে ভাতের পাতে। বছরভর আম্মা আচার দেয়। বৈয়াম সব আলাদা করে রাখা থাকে মিটসেফে, কোনওটা কলকাতা আসবে, কোনওটা যাবে ঢাকায় আর কোনটা চাঁটগায়, আমাদের ভাই-বোনেদের কাছে। খেতে যখন অঢেল লংকা তখন শুধুমাত্র রান্না বা ভর্তা বানানোয় নয়, আচারও হয় তার। ভারতে যেমন বিশাল আকারের কাশ্মিরী লংকার ভেতরে মশলা ঢুকিয়ে আচার বানানো হয় ঠিক তেমনটা নয়। বড়, পুরুষ্টু দেখে গামলা ভর্তি লংকা ধুয়ে-জল ঝরিয়ে নিয়ে নুন-হলুদ মাখিয়ে চড়া রোদে একদিন শুকিয়ে নিতে হয়। সঙ্গতে থাকে রসুন। লংকার চারভাগের এক ভাগ পরিমাণ রসুন খোসা ছাড়িয়ে গোটা গোটা কোয়া ছড়িয়ে দিতে হয় লংকায়। এবার মশলা তৈরির পালা। তেল-সিরকায় পড়লে লংকার ঝাল উবে যায় বলে ঝালের জন্যে এই লংকাতেই আবার পড়ে বেশ অনেকটা পরিমাণে শুকনো লংকা গুড়ো। খোলায় আলাদা আলাদা করে সেঁকা হয় খোসা ছাড়ানো ধনে, মৌরী, মেথি, জোয়ান আর লংকা। সেঁকা মশলা গুড়ো হয় বড় লোহার হামানদিস্তায়। গুড়ো হয় সর্ষে। অ্যালুমিনিয়ামের গামলায় সমস্ত গুড়ো একসঙ্গে নিয়ে সর্ষের তেল অল্প অল্প করে ঢেলে মেশানো হয় মশলা। আচারের মশলা, সে তো শুধু মশলা নয়, ওতে সঙ্গে থাকে স্মৃতি, মা-কাকিদের থেকে শোনা গল্প, অভিজ্ঞতা— যা কিনা বংশ পরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মকে তাঁরা দিয়ে যাচ্ছেন। কে জানে কত প্রজন্ম ধরে। শেষ যেমন জানা নেই, শুরুও না।
    দৈবের নির্বন্ধ কথা শুন মন দিয়া।
    পূবাল্যা ব্যাপারী যায় সাত ডিঙ্গা বায়্যা।।
    এক ডিঙ্গায় ধান চাউল আর ডিঙ্গায় দর।
    মরিচ লবন আদা লইয়াছে বিস্তর।।
    — মইষাল বন্ধু/ পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

    ভুরভুর করে গন্ধ বেরোয় আচারের মশলা থেকে। চড়া রোদে থাকার ফলে খানিকটা শুকিয়ে আসা লংকা হারায় তার গাঢ় কালচে সবুজ রঙ। ফিকে দেখায় তাকে। কাঁচা সর্ষের তেল মাখানো মশলায় আলতো হাতে মেশানো হয় লংকা। তেল-মশলা পেয়ে খোলতাই হয় লংকার ফিকে হয়ে আসা রঙ, চকচক করে সবুজ সব লংকা। একদিন গামলায় করে আবার রোদ খায় মশলা মেশানো লংকা। ওদিকে ধুয়ে-মুছে রোদে রাখা আছে চীনেমাটির বিশাল বড় এক বৈয়াম, আচার রাখা হবে বলে। বিকেলে, রোদ পড়ে এলে বড় হাতায় করে চীনেমাটির সেই বৈয়ামে ঢালা হয় মশলা মাখানো লংকা আর রসুন। আস্তে আস্তে ঢালা হয় ঘানি থেকে ভাঙিয়ে আনা ঝাঁঝালো সর্ষের তেল সঙ্গে দেওয়া হয় আধ বোতল সিরকা। তখনও কৃত্রিম ভিনিগারে বাজার ছেয়ে যায়নি, সব বাড়িতেই থাকত ফলের রস থেকে বানানো সিরকা। লংকা, রসুনে যেহেতু একেবারেই কোনও টকভাব নেই, তাই সিরকা দেওয়া হয় যাতে খানিকটা টকভাব আসে। অনেকেই লংকার আচারে খানিকটা টক পাওয়ার জন্যে লংকা শুকানোর সময় গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে দেন কিছু লেবইর। অসম্ভব টক হয় এই ছোট্ট, আমলকির মত দেখতে ফিকে হলদে রঙের লেবইর। যে কোনও মাছের টক, ডালে চার-পাঁচটা লেবইর দিয়ে দিলে কাঁচা লংকা সহযোগে সেই ডাল বা মাছের টক দিয়েই খেয়ে উঠে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলে সবাই। দেশ-গাঁয়ে প্রায় সবার রান্নাঘরের পাশেই একটা-দুটো করে লেবইরের গাছ থাকে। তো লংকার আচারে কেউ কেউ দেন কয়েকটা লেবইরও। আঁট করে বৈয়ামে ঢাকনা এঁটে দিয়ে পরিস্কার ছেঁড়া কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে দেওয়া হয় আচারের। মোটা চিনেমাটির বৈয়ামে রোদে পড়ে থেকে থেকে আচার সেদ্ধ হয়, গলে মাখনের মত নরম হয় মশলার রঙ লেগে ফিকে হলদে হয়ে যায় রসুনের কোয়া, লংকা। ঢাকনা খোলা মাত্রই ভুরভুর করে জিভে জল আসা গন্ধ বেরোয়, গোটা বাড়িময় আচার আচার গন্ধ। ভুনা খিচুড়ি, সঙ্গে মাছের বিরান আর লংকার আচার বা পোলাওএর পাতে মাংসের রেজালা আর লংকার আচার। আমরা আবার উত্তর ভারতীয়দের মত শুধু আচার আর পরোটা দিয়ে আহার সারতে পারি না। যস্মিন দেশে যদাচার সত্ত্বেও।

    বছরভর রাখার জন্যে সকলেই আচার দিতেন বড় বড় সব চিনেমাটির বৈয়ামে। সেই বৈয়ম চিন থেকে আসত কি না তা হলফ করে বলতে পারি না। প্রত্যেক বাড়িতেই তা ছিল আর অনেকগুলি করেই। সেই বৈয়াম রোদেই রাখা থাকে বর্ষা আসার আগে ইস্তক। পাকা বাড়িতে রাখা হয় ছাদে নয়তো উঠানে। খড়ের চালেও দেওয়া হত কখনও সখনও। কেউ কেউ আচার রোদে দে বৈয়ামের মুখ খুলে, যে অঞ্চলে পাখির বেশি উৎপাত সেখানে বৈয়ামের মুখ বাঁধা থাকে কাপড়ে। বর্ষা এসে গেলে আচারের বৈয়াম ঘরে ওঠে, খাওয়ার ঘরে সার দিয়ে রাখা সব জলচৌকি, তাতে সব চিনেমাটির বৈয়াম, অন্য আচারের বৈয়ামের সঙ্গে লংকার আচারও জায়গা করে নেয় নিজের। আপাতঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বড় সেই বৈয়াম থেকে হাতায় করে ছোট কাঁচের বৈয়ামে রোজকার খাওয়ার আচার বের করে নেওয়া হয়, সেই বৈয়াম থাকে খাবার টেবিলে। বাড়ির কত্রীর হুকুম থাকত ঋতুমতী মহিলা-মেয়েরা যেন আচারের বানানোর প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করেন, বৈয়াম খুলে আচার না বার করেন। তাতে নাকি আচারে ছুৎ হয়, আচার নষ্ট হয়ে যায়। হ্যাঁ। আমাদের বাড়িতেও একই হুকুম জারী ছিল সকল বয়েসী মহিলাদের উপর।

    সময়ের সঙ্গে মানুষের ব্যস্ততা বাড়ে, আচারের সার সার বৈয়াম অন্তর্হিত হয় খড়ের চাল থেকে। জলেখাবিবির বাড়ির অহরাত্র শিলের পাটার আওয়াজ ক্রমশ থেমে আসে। সাধের লংকা বাগান শুকিয়ে যায়। রফুদাদা মারা যায় হঠাৎ করে। জলেখা বিবি অসুস্থ, সারাদিন শুয়ে থাকেন বিছানায়। হেনাফুফু বাড়ি সামলায়, গফরচাচা সারাদিন একা একা তাস খেলে কাটিয়ে বিকেল থেকে সমিতির সামনে গিয়ে বসে। একে একে এসে জড়ো হয় তার ইয়ার-দোস্তোরা। তাসের আড্ডা চলে মাঝরাতেরও পর অবধি। রাহিমাফুফু থাকে চাঁটগায়ে। হেনাফুফুর বড়ভাই মিসির চাচার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার। মীজানচাচা আর তার বউ নাসরীন চাচি সারাদিন ব্যস্ত। জলেখা বিবির বাগ দেখা-শোনা করার কেউ নেই। বাগে সব সমাজবিরোধীদের আখড়া হয়েছে, সারাদিন সেখানে জুয়ো খেলে গ্রামের যত বেকার ছেলে-পুলের দল। বহুকাল সেখানে আর মেলা হয় না। জুয়া-হাউজির আখড়া বসে বলে মীজানচাচাই মেলা বন্ধ করিয়েছিল। সেই মেলা এখন বসে দখিণগাঁওয়ের মাঠে। মাঝে বেশ কয়েক বছর এমন হয়েছে যে বাড়ি গিয়েছি অল্প দিনের জন্যে, কোথাও বেড়াতে যাওয়া বা কারও সঙ্গে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। এই বার বাড়ি গিয়ে দেখলাম, আশে-পাশের বাড়ি-ঘরের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সব নীল-সাদা ইউনিফর্ম পরে সক্কাল সক্কাল স্কুল যাচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলের তো এরকম ড্রেস নেই! শুনলাম জলেখা বিবির বাগে নতুন স্কুল হয়েছে। মীজান মাস্টার আর নাসরীন মাস্টারনির স্কুল। আম্মা বলল, বাগের একটা অংশ মীজান বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকায় পাকা বাড়ি বানিয়ে সেখানে স্কুল খুলেছে, ইংরেজি স্কুল। নার্সারি থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত। শুধু শাহবাজপুর নয়, আশে-পাশের দেউরা, দিৎপুরা, রাজা পাড়িয়া হাট, কুসনি, বুড্ডা, মলাইশ থেকেও ছেলে-মেয়েরা আসছে মীজান মাস্টার-নাসরীন মাস্টারনির স্কুলে।

    -সাত-
    আপনার মত পাই তবে গ্রাসে কত খাই
    পোড়া মাছে জমিরের রস।।
    নিধানী করিয়া খইতথি মহিষের দই
    কুল করঞ্জা প্রাণসম বাসি।।
    যদি পাই মিঠা ঘোলপাকা চালিতার ঝোল
    প্রাণ পাই পাইলে আমসী।।
    কিছু ভাই রাই-খাড়াচিঙ্গুড়ির তোল বড়া
    সজারু করহ শিকপোড়া।।
    পোড়া মৎসে লেম্বুরস কই মৎসে রান্ধ ঝশ
    দিবে তথি মরিচের ঝাল।
    — চণ্ডীমঙ্গল/ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী

    প্রতি শহরেরই নিজস্ব স্বাদ-গন্ধ থাকে। যারা সারাক্ষণ সেই শহরের নাগপাশে থাকে তারা বুঝি আলাদা করে সেগুলো পায় না। আমি তো পাই। যতবার ঢাকা যাই সেই অনন্য স্বাদের গন্ধ এসে জানিয়ে দেয় কোথায় আছি আমি। টক আর ঝাল মেশানো এক বিচিত্র স্বাদের শহর ঢাকা। ভীড়ের রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে, যে কোনও বাজার বা শপিং মলের সামনে, সিনেমাহল বা বাসস্ট্যান্ডে, সদরঘাটের লঞ্চঘাটে, মেঘনার বা পদ্মার ফেরীঘাটে একটা লাইন কানে আসে– ‘ছিল্যা-কাইট্যা লবন-মরিচ মাখাইয়া দিমু’। এই ছি্লে-কেটে নুন-মরিচ মাখিয়ে যে বস্তুটি বিক্রেতা দিতে চাইছেন, তা শুনলে মনে হবে শশা বা ক্ষীরার কথা। তা কিন্তু মোটেও নয়। সেটি বরিশালের মিষ্টি আমড়া।কোথাও কোথাও যাকে বলা হয় বিলিতি আমড়া। বরিশালের বিলিতি আমড়া। খোসা ছাড়িয়ে এমন এক কায়দায় ছুরি দিয়ে আমড়া কাটা হয়, দেখে মনে হয় যেন ঝাঁকাভর্তি শুয়ে আছে ফুটন্ত কোনও ফুল। ছোট্ট কাঠি গোঁজ়া আছে সব কটি আমড়াতেই, কেউ কিনলে তাতে শুধু মুখ ফুটো করা ছিপিওয়ালা শিশি থেকে লবন আর মরিচবাটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। দেদার বিক্রি হয় নুন-মরিচ ছড়ানো মিষ্টি আমড়া।
    চারি হাড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ।
    ছয় হান্ডি মুসুরী-মিশ্যা তথি লাউ।।
    ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া।
    কচুর সহিত খায় করঞ্জা আমড়া।।
    — চণ্ডীমঙ্গল/ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
    সিনেমার গানের লাইনও বিক্রেতাদের মুখে মুখে ফেরে– ‘অ ভাই, খাইয়া যান, লইয়া যান, ঘরের লাইগ্যা লইয়া যান না’। এই মরিচ শুকনো মরিচের গুড়ো নয়। শিলে বাটা সবুজ মরিচ, যা হয়ত জন্মেছে কাঁচা খাওয়ার জন্যই। শুকনো মরিচ দেওয়া হয় বাদামের সঙ্গে বেচা ঝাল-নুনে। তাও সেই জলেখাবিবির ‘পুরা মরিচ’ অর্থাৎ তরিবত করে পোড়ানো শুকনো মরিচ। স্বাদের সঙ্গে আপোস নেই কোথাও।

    আজিজ মার্কেট, চারুকলার সামনের ফুটপাথে দেখা যায় ছোট্ট তোলা উনুন নিয়ে বসে রয়েছেন মহিলারা।উনুন জ্বলছে, মেটে খোলা বসানো। একের পর এক পাতলা পাতলা চিতই নামছে, পাশেই রাখা বড় বাটি থেকে এক চিমটি করে ফিকে লাল রঙের শুটকির ভর্তা তুলে চিতইয়ের গায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সহকারি। ছোট স্টিলের প্লেটে করে বাড়িয়ে দিচ্ছে অপেক্ষারত খদ্দেরের দিকে।শুটকির ভর্তা দিয়ে কখনই কোথাও চিতই খাওয়া হয় না।আমি দেখি নি অন্যত্র। মেঘনার পারে ফেরিতে ওঠার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে বসে প্রথমবার এই পিঠা আর ভর্তা বিক্রি হতে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। আব্বা সঙ্গে ছিল, খেতে চাইলে বলেছিল, নদীর পারের সব ধুলো ওই পিঠা আর ভর্তায়, খেয়ে পেট ব্যথা করবে। কিন্তু খানিক পরে নিজে থেকেই গিয়ে সেই ভর্তা মাখানো পিঠা কিনে নিয়ে আসে এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও দিব্যি হাপুস হুপুস করে খায় মেঘনার পারের ধুলোমাখা চিতই আর ভর্তা। নামেই সে শুটকির ভর্তা আসলে গন্ধের জন্যে নামমাত্র শুটকি দিয়ে তাতে নুন দেওয়া ঝাল ঝাল এক লংকাবাটা। পেঁয়াজ-রসুনের চিহ্নও তাতে থাকে না। অসম্ভব ঝাল সেই ভর্তা নামমাত্র খেলেও ঝালে ব্রহ্মতালু অব্দি জ্বলে যায়। অথচ বিকেল থেকে শুরু করে এই শুটকিবাটা সহকারে পিঠা বিক্রি চলে সেই রাত ন’টা-দশটা অব্দি। বাংলাদেশের মানুষ তা আয়েস করেই খায়। সত্যি, সেলুকাস বৈচিত্র খুব বেশি কিছু বুঝতেন না।

    তবে আমাদের বাড়িতে সকালবেলায় চটা পিঠার সঙ্গে সিদলের ভর্তা খাওয়া হতো। আহা। একটু মোটা করে সেদ্ধচাল বেটে শুধু লবন দিয়ে মাখিয়ে লোহার চাটু বা মাটির খোলায় হাতে করে যতটা সম্ভব পাতলা করে ছড়িয়ে দিতে হয় গোল রুটির মতো করে। মাটির ঢাকনা চাপা দিয়ে মিনিট কতক রেখে দিলেই এক পিঠ মুচমুচে হয়ে গিয়ে খোলার গা ছেড়ে দেয় চটা।সোঁদা সোঁদা পোড়া একটা গন্ধ ওঠে চটা থেকে। ওদিকে চলছে শুটকি বাটার তোড়জোড়। পুঁটি মাছের সিদল বা কাঁইক্যা শুটকির ভর্তা।কাঁইক্যা সরু সরু ঠোঁটওয়ালা অদ্ভূত এক মাছ। প্রচুর পাওয়া যেত আমাদের নদীতে। সিদলকে ধুয়ে নিয়ে লাউ-কুমড়ো বা কচুপাতায় মুড়িয়ে নিয়ে খোলায় সেঁকে নিতে হয়। দু’পিঠ মুচমুচে হয়ে ঝিম ধরানো গন্ধ যখন ছাড়তে শুরু করে তখন থেঁতো করে নিতে হয় খোসা ছাড়ানো পেঁয়াজ, কয়েক কোয়া রসুন। একটু মোটা করে বাটতে হয় শুকনো লংকা, ঝাল কে কত খায় তার উপর নির্ভর করে লংকার পরিমান। লংকা বাটা হয়ে গেলে আলগোছে বেটে নিতে হয় পাতায় মোড়ানো সেঁকে রাখা শুটকি। লবন দিয়ে শিলের উপরেই পেঁয়াজ, লংকাবাটার সঙ্গে মেখে নেয় অভিজ্ঞ হাত। কাঁইক্যার ভর্তা বানানোর প্রক্রিয়া আবার অন্য। টুকরো টুকরো করে কাটা কাঁইক্যা না ধুয়েই মুচমুচে করে সেঁকা হয় খোলায়। সেঁকা শুটকি ধুয়ে নিয়ে শিলে দিয়ে থেঁতো করে তাতে থেঁতো করা পেঁয়াজ, ইচ্ছেমতন কাঁচালংকা বাটা আর এক গোছা ধনেপাতা থেঁতো করে মিশিয়ে নিতে হয় নুন দিয়ে। সে এক স্বর্গীয় জিনিস! যাঁরা খাননি তাঁদের আমি কী করে বোঝাই? পিতলের জামবাটিতে করে খাবার টেবিলে পৌঁছে যায় ভর্তা। ততক্ষণে বাড়ি ছাড়িয়ে গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে শুটকির গন্ধ।একে একে খোলা থেকে নামছে চটা আর গরম গরম পৌঁছে যাচ্ছে পাতে। সঙ্গী ঝাল-ঝাল সিদল বা কাঁইক্যা শুটকির ভর্তা।
    সুন্দইরা মাঝির নাও ওজান চলে ধাইয়া।
    আগায় পাছায় গলুই দুইখান, কাইক্কা মাছের ঠুইট্টা।
    আহা বেশ বেশ বেশ।।
    লহর ভাইঙ্গা পবন বেগে ছুটছে কলকলাইয়া রে।
    — সারি গান/ কুমিল্লা

    -আট-
    দরিয়ার পানিতে যত আছে হীরা মণি।
    জালেতে ঠেকাইয়া রাখে না বাছি না গুণি।।
    আমনে বদল করে সোণা মণ মণ।
    শুড়ি মাছ বদলে দেয় কাঠা মাপ্যা ধন।
    কাটুয়া কাছিম পাইলে তারা অতিশয় সুখী।
    আর যদি পায় মেষ ছাগল খাসী।
    — মইষাল বন্ধু/ পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

    চই ঝাল দিয়ে মাংসের কথা অনেকেই শুনেছেন। আমিও শুনেছি। আমাদের অঞ্চলে এর প্রচলন ছিল না। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাদের আত্মীয়-কুটুম ছিল তাদের বাড়ি থেকে সাধারণত চারা এনে আমাদের প্রতিবেশীরা লাগাত। পুরানো আম বা কাঁঠালগাছে ছড়িয়ে পড়ত লতানে চই এর গাছ। পান-পাতার মত পাতা গাঢ় সবুজ রঙের। বছরের পর বছর থেকে পুরু হতো সেই গাছের গোড়া আর ডালপালা। এই গাছের ডাল থেকে কলম করেও নতুন চারা বানানো হতো। তবে মানুষের নজর তো নতুনের দিকে ছিল না। ছিল পুরানোর দিকে। এমনিতে এই গাছের পাতা খায় না খায় কান্ড। পুরানো হলে তার কদর বাড়ে। রান্না হাঁড়িতে চাপিয়ে একখণ্ড ডাল গাছ থেকে ছিঁড়ে এনে পাতা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে পেঁয়াজ রসুনের কুচির সঙ্গে হাঁড়িতে ফেলে দেওয়া। তা সে কবুতরের মাংসই হোক বা রাজহাঁস। যে মাংস সেদ্ধ হতে যত সময় লাগে, চই ঝালের টুকরো তাতে তত মোটা পড়ে। তার বটের ঝুরির মত মোটা টুকরোর ভেতরের শাঁস জ্বাল খেতে খেতে হয়ে পড়ে কচি তালশাঁসের মত নরম। গনগনে আগুনে ঝাল, স্বাদ আর গন্ধে মাংস এমনিতেই পাকস্থলির অনেক কাছাকাছি পৌঁছে যায়।

    আগেই বলেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে এর চল থাকার কথা নয়, নেহাত সাতক্ষীরা-খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলে আত্মীয়-কুটুম না থাকলে। তবে আমাদের পাড়ার নাগেদের বাড়ি সম্ভবত সেই গাছ ছিল। তিতাস থেকে যে সব কচ্ছপ পাড়া বেড়াতে আসত খাল ধরে তাদের অবশ্য গন্তব্য ছিল নাগেদের বাড়ি। ধর্মীয় কারণে বেশির ভাগ মানুষই তা খেত না। মুসলমান ছাড়াও হিন্দুদের মধ্যে কাছিমকে অনেকেই বিষ্ণুর অবতার বলে মান্য করত। অবস্থাটা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের— যশোর, খুলনা, বরিশালের মত ছিল না। হয়ত চই ঝালের লভ্যতার কারণেই! আর লোকশ্রুতি এটাই কাছিম, কাঠা বা দুড়োর মাংসের সঙ্গেই চই ঝালের অধিক পীরিত। সিলেট অঞ্চলে চই এর প্রচলন ছিল সম্ভবত আদিবাসীদের মধ্যে। চা- বাগানগুলিতে ধরা পড়া কাঁটাওয়ালা সজারুর ছাল ছাড়িয়ে নুনের সঙ্গে জ্বাল পড়ত চই ঝালের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। লংকার ঝালের সঙ্গে চই এর প্রধান তফাত রেওয়াজের, যেমন ক্লাসিকাল গানের সঙ্গে লোকসংগীতের। চইঝাল খুবই উচ্চাঙ্গের ব্যাপার। বুঝতে হলে সঙ্গে থাকতে হবে সুগন্ধি সরু চালের ভাত, কাটারিভোগ গোত্রের। ঝোল হবে কিঞ্চিত পাতলা। ভাতের স্বাদ গন্ধ তাতে হারিয়ে না যায়। এই ভাতের টানেই চই গিয়ে পৌঁছেছিল দিনাজপুর, রংপুর, নীলফামারির উত্তরবঙ্গে। শুধু রেলওয়ে কলোনী নয় তার বাইরেও এমন চই গাছের সন্ধান পাওয়া যাবে যাঁদের কাছে দেশভাগের স্মৃতি এখনও টাটকা, এঁদের সন্তান নাতিপুতিরা এখন এইপারের শিলিগুড়ি, ময়নাগুড়ি, বালুরঘাটে সখ্যতা যুগিয়ে চলেছে তুলাইপাঞ্জি আর কাটারিভোগের সঙ্গে।

    দেশ-গাঁয়ে তখনও পাঁউরুটি আর আন্ডা পোচের চল হয়নি, তাই গোলমরিচের কথা সেইভাবে স্মৃতিতে নেই। বাড়িতে আসত নিশ্চিত কিন্তু সে কোথা থেকে আর কীভাবেই বা খাওয়া হত তার কিছুই মনে নেই। আমাদের কাছে তা ছিল বেশ ব্রাত্য। গোলমরিচ হয় দক্ষিণভারতে। বাংলাদেশের কোনও আঞ্চলের সঙ্গেই মাটি আবহাওয়া তার মেলে না। তাই বুঝি সেইভাবে চল হনি আমাদের দেশে। কেউ কেউ সখ করে লাগিয়ে থাকলেও দেওয়া-থোয়ার যায়গায় কোনওদিনও আসেনি। এর গাছও লতানে। পাতা সেই পানপাতার মতো। গাছে পুঁই এর মত মেচুড়ি হত গাঢ় লাল রঙের। যা শুকিয়ে কালো হলে গোলমরিচ বলে চেনা যায়। চই ঝালের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় ছিল কম। তা বলে ঝাল নিয়ে আদিখ্যেতা আমাদের কিচ্ছুটি কম ছিল না। প্রতিবাড়িতেই লংকা গাছ থাকত আর তা নানা রকম। তারপরেও কেউ অন্যত্র কাজে বা বেড়াতে গেলে যেমন নিয়ে আসত সেইখানকার নাম করা মিষ্টান্ন তেমনই অন্যান্য জরুরি জিনিসের সঙ্গে সখের লংকা। এমন কি আত্মীয় বাড়ি থেকেও আসত বিশেষ প্রজাতির কাঁচা বা শুকনা মরিচ! কখনও তো চারাও নিয়ে আসা হতো। লাগানো হতো যত্ন করে। অধিকাংশ সময়ে তাতে ঠিক যেমন স্বাদ আর গন্ধওয়ালা লংকা হতো না। আশাহত গৃহকর্তা তার চেষ্টা পুনরায় চালিয়ে যেতেন। এবং বারংবার। আসলে এই ঝাল ব্যপারটা ছিল মানুষের শখের জিনিস। ফলে খোঁজ খবর করে ঠিক ঠিক জিনিসটা তারা ঠিক বের করে ফেলত। অফিসফেরত আব্বা প্রায়ই ফল-মিষ্টির সঙ্গে আর অতি অবশ্য একটা জিনিস নিয়ে আসত।কামরাঙ্গা মরিচ।

    ছোট্ট একটা ঠোঙ্গায় করে চারটে বা ছ’টা লংকা আনত আব্বা। না, রান্নার জন্যে এই লংকা নয়। লংকাপ্রেমীরা ভাতের পাতে একফালি গন্ধরাজ লেবুর সঙ্গে নেন এক কুচি কামরাঙ্গা মরিচ। সেই লংকা ভাতে মেখে খেলে বারবার করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়েও নিস্তার নেই, হাতের জ্বলুনি থেকে যায় সারাদিন। ওই জন্যে কামরাঙ্গা মরিচ কেউ ভাতে মাখে না, ভাত মেখে নিয়ে নখের ডগায় একটুখানি ছিঁড়ে নিয়ে আলতো করে মুখে ছেড়ে দিতে হয়। ব্যস! ব্রহ্মতালু অব্দি জ্বালিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট কামরাঙ্গা মরিচের ওই একটি কণা। তীব্র সুগন্ধী আর ভয়ঙ্কর ঝাল এই লংকার কুচি ভাত খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও থালায় পড়ে থাকে। এমনই ঝাল যে এক কুচি লংকাও খেয়েও শেষ করা যায় না। এক কুচি কামরাঙ্গা মরিচ পালটে দিতে পারে পুরো খাবারের স্বাদ ও গন্ধ। ইঞ্চি দেড়েক লম্বা, বেড়ে আধ ইঞ্চি মতো, দেখতে ঠিক কামরাঙ্গার মত বলে সবাই বলে কামরাঙ্গা মরিচ। সিলেটে এই লংকাকে ‘নাগা মরিচ’ বলে, ঢাকায় বলে ‘বোম্বাইয়া মরিচ’। এর আসল নাম যে কী এবং কোথা থেকে এসেছে আমি সেটা জানি না। দেখতে নীরিহ এই কামরাঙ্গা মরিচে সবাই এমনকি হাত দিতেও ভয় পায়। আম্মাকে দেখেছি লংকার ডাঁটিতে ধরে ছুরি দিয়ে দু’কুচি কেটে নিত, একটা আব্বার জন্যে আর একটা নিজের জন্যে। বাকি লংকাটা একটা ছোট তশতরিতে করে খাওয়ার টেবিলেই রেখে দিত, যাতে করে টেবিলের সব খাবারেই লংকার গন্ধ পাওয়া যায়! নিজের পাতের লংকাকুচিটুকু আম্মা কখনই খেয়ে শেষ করতে পারত না, একবার মুখে দিয়ে হুহ্ –হাহ্ করতে করতে বাকি ভাতটুকু খেত। ওদিকে আব্বা নিজের ভাগের লংকা খেয়ে আম্মার টুকুও চেয়ে নিত। আহাঃ আহাঃ করতে করতে বলত, ‘ঝাল বিনা কোনও স্বাদ নাই’!

    একবার সেই কামরাঙ্গা মরিচের গাছ নিয়ে এলো আব্বা। টবসুদ্ধু লংকার চারা, তাতে ফলে আছে ছোট-বড় বেশ কিছু লংকা। বললো, খাবার ঘরের জানলায় বসিয়ে দাও, বাসী মরিচ খেতে হবে না, খেতে বসার সময় গাছ থেকে লংকা পেড়ে নিয়ে খাওয়া যাবে আর ঘরেও ‘বেশ মরিচ মরিচ’ একটা গন্ধ থাকবে! তা বেশ। একটা লংকাতেই দু-তিনদিনের খাওয়া হয়ে যায় যখন গাছে যা লংকা আছে তাতে বেশ কিছুদিন চলে যাবে তারপর তো নতুন লংকা হবেই আবার! বেশ উৎসাহভরে আব্বা খেতে বসার আগে লংকা পাড়ে, সেই লংকা দিয়ে ভাত খায় আর অপেক্ষা করে, কবে আবার লংকা দিতে শুরু করবে গাছ। মজাটা হলো নতুন লংকা আর আসে না। ফুল দেখা যায় দু-একটা কিন্তু নতুন লংকা আর হয় না। আম্মা বলে, ওতে আর লংকা হবে না। ঘরের মধ্যে, ছায়ায় রেখে দিলে গাছ কখনও ফল দেয়! ফুল ফললেও তাতে ঝাল হত না, নিশ্চিত। আব্বা বলে, বেশ, পরেরবার অনেকগুলো গাছ এনে বাগানে বসিয়ে দেব! যে লংকা পাতে লাগেই এক সামান্য কুচি! আর অন্য সমস্ত স্বাদ ঢাকা পড়ে থাকে যে ঝালের তলায় তার নাকি গোটা একটা বাগান!

    ‘কোন সহরে বাড়ী তোমাররে সাধু কোন সহরে ঘর।
    কি নাম তোমার মাতাপিতার হারে কি নামডী তোমার।।’
    “বাড়ী আমার মরিচপুরে বাপ গদাধর।
    মায়ের নামডী কোলারে সতী যেমন মোর নামডী সুন্দর।।”
    — নীলা/ পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা

    -শেষ-

    -বলে দেওয়া কর্তব্য যে লেখাটি পূর্বে প্রকাশিত, গুরুবান্ধবদের জন্যে ব্লগে দেওয়া।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৬ মার্চ ২০১৫ | ২২২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kiki | ***:*** | ১৬ মার্চ ২০১৫ ০২:৪৯68241
  • আহা!!
  • Swati | ***:*** | ১৬ মার্চ ২০১৫ ০৬:১২68242
  • খুব ভাল খেলাম গো.......
  • Ishani | ***:*** | ১৬ মার্চ ২০১৫ ১২:৪৬68240
  • সামরান ! পাতা খুলেই চমক | আর মন ভালো , মন ভালো ! :))))
  • Biplob Rahman | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৫ ০২:৩০68250
  • জলেখা বিবির বাগ পর্বের ধানী লংকার সঙ্গে দেশান্তরী পর্বের ঝাল শুটকির ভর্তা কি আশ্চর্য লোভাতুর স্বাদ তৈরি করে। শ্যাজা দি'র সেই জাদুকরি লেখনি!
  • Nina | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৯68243
  • এই হল সামরুর কলম--ল্ঙ্কার কথাও হয়েওঠে কি মিঠে

    মুখের কথায় তোর ত্রিজগৎ বশ !!

    অনেক অনেক লেখ --মনমাতানো তোর এক একটি লেখা --আহা !!!!!
  • b | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:৫২68244
  • অনেকদিন পরে আপনার লেখা দেখলাম। ভালো লাগলো।
  • ranjan roy | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৫ ০৬:০৭68245
  • কী ঝাল! কী ঝাল!
  • de | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৫ ০৯:০০68246
  • সামরান কত্তো দিন পর লিখলো -- আহা! রূপকথার গপ্পো যেন!
  • hu | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৫ ০৯:৪০68247
  • অতি উপাদেয়। হাপুস হুপুস পড়ে ফেললাম।
  • Tim | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৫ ০৯:৫২68248
  • সামরানদির লেখা বড়ো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়, আর... "ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়"
  • de | ***:*** | ১৭ মার্চ ২০১৫ ১০:২৩68249
  • এই কামরাঙা মরিচই কি ভোট জলোকিয়া?
  • S | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৫ ০১:০১68252
  • দারুণ লেখা। এই কামরাঙা মরিচ কি হ্যাবেনারো? হ্যাবেনারোর অরিজিন কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকা কিন্তু এখন আমেরিকান সুপার মার্কেটে পাওয়া যায়।
    http://en.wikipedia.org/wiki/Habanero
  • oishik | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৫:৪৫68254
  • onek din পরে samrandir লেখা পড়লাম
  • | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৫:৪৮68255
  • s,
    হ্যাবেনারো। তবে আমরা সবুজটা পাই।

    আর হ্যাঁ, থ্যাঙ্কু :-)
  • | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৫:৫৩68256
  • এবং হ্যাঁ, ছবি দেখে নিশ্চিত হলাম এই ভোট জালোকিয়া বা নাগা মরিচ ই আমাদের কামরাঙা মরিচ। সিলেটে একে সবাই নাগা মরিচই বলে।
    সকলেরে থ্যাঙ্কু :-)
  • hu | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৫:৫৮68257
  • হ্যাবানেরো ভীষন ঝাল। প্রথমবার না বুঝে একটা গোটা হ্যাবানেরো দিয়ে মাছ রান্না করে ফেলেছিলাম। খুবই কষ্ট করে খেতে হয়েছিল।

    তবে হ্যাবনেরোতে একটা স্মোকি ফ্লেভার থাকে যেটা কোনো দেশি লঙ্কায় পাইনি। কামরাঙা মরিচেও কি এই স্মোকি ফ্লেভার থাকে?
  • a x | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৬:০৫68258
  • স্কচ বনেটও বোধহয় এই ফ্যামিলির। জামাইকান রান্নায় ব্যবহার হয়।
  • | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৬:২২68259
  • কামরাঙা মরিচে খুব ঝাঁঝালো গন্ধ, মানে কাটা অবস্থায় গোটা ঘরে গন্ধ ছড়ায়, স্মোকি বোধয় নয় hu।

    অক্ষ, ছবি দেখে তো একই জাতি বলে মনে হচ্ছে। মানে পাকা কামরাঙা মরিচ বলে মনে হচ্ছে। তবে আকৃতি একটু অন্যরকম।
  • | ***:*** | ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৮:৪৩68251
  • দে,
    এই কামরাঙ্গা মরিচই ভোট জালোকিয়া কিনা আমি জানি না, তবে হতেও পারে।
  • Paramita | ***:*** | ১৯ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৯68260
  • সব স্বাদের মধ্যে ঝালস্বাদকে বরণ করেছি সবচেয়ে বেশী করে। কিন্তু আহারে, কত বর্ণ গন্ধ স্বাদের মরিচ এখনো খাইবাম পারলাম না। আমার ঐ সবখানে থাকবার কথা ছিল। সান্ত্বনা একটাই, সামরানের লেখা পঠনেন অর্ধভোজনম।
  • kamre.. | ***:*** | ২০ মার্চ ২০১৫ ১০:১৯68261
  • লেখা কোথায়? এতো হাতে আঁকা কিছু টুকরো ছবির কোলাজ।। রং তার সেপিয়া।। বহু যত্নে সাজিয়ে রেখে ভুলে যাওয়া, তারপর হটাত ই একদিন খুঁজে পেয়ে যাওয়া কিছু এলোমেলো ছবির অ্যালবাম.......
    বড় ভালো লিখেছিস রে।..............
    বি দ্র: তোর হাতের রান্না খাওয়া টা বেশ ঝুঁকির কাজ হয়ে যাবে দেখছি।। :) :)
  • Nina | ***:*** | ২১ মার্চ ২০১৫ ০১:৫৮68262
  • এই হ্যাভানেরো দিয়ে একটা দারুণ স্যালাড বানাই বারবিকিউ চিকেন ল্যাম্ব ইত্যদি র সাথে
    আনারস টুকড়ো করে কেটে সরু লম্বা করে লাল পেয়াজ কেটে হ্যাভানেরো সরু করে কেটে একসঙ্গে মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে পরেন দিন খাওয়া
  • | ***:*** | ২৩ মার্চ ২০১৫ ০৪:১৫68264
  • মোহর :)
  • মোহর | ***:*** | ২৩ মার্চ ২০১৫ ১২:৩৫68263
  • সামুদিদিইইইইইইইইই :)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন