প্রতিশ্রুতির বন্যা বইছে। আর সেই বন্যাতেই নদী প্লাবিত হবে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে জল জমবে। সেই জল ভাগ হবে। এই প্রতিশ্রুতি যখন দেওয়া হচ্ছে তখন ভোটের মরশুম, পুরো বাংলা জুড়ে। ভোট আসা মানেই সমস্ত দলই এক গুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেবে, এটা আমরা আকছার দেখে আসছি। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতির মধ্যে যখন নদী ঢুকে পড়ছে, তখনই সহজ সরল সমীকরণগুলো একেবারে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা আর একটু ভেঙে বলা যাক।
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে জল ও নদী একটা বিবেচনার বিষয় হতে আরম্ভ করল সত্তরের দশকের সময় থেকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের ইস্তেহারে পরিবেশ একটু একটু করে জায়গা করে নিতে আরম্ভ করল বিগত পাঁচ থেকে সাত বছরে। তবে পরিবেশ রাজনীতির ময়দানে বরাবর পার্শ্ব চরিত্র হিসেবেই থেকে গেছে। এই বছরের বিধানসভা ভোটের ময়দানে দাঁড়িয়ে তিস্তা নিয়ে বিজেপি দলের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি জল রাজনীতির এক অন্যদিক উন্মোচন করল, পুরো দেশের সামনে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশের মানুষ যে আশ্বাসবাণী পেয়েছেন, তাতে জানা গেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসলে তিস্তার জলবন্টন চুক্তি সম্পন্ন হবে। যে প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, তা হলো কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের ওপর ভিত্তি করেই তিস্তার জলবন্টন সম্ভব?
উত্তর খুঁজতে গেলে তিস্তার জন্মবৃত্তান্তকে দেখতে হয়। হিমালয়ের শরীরে রয়েছে অনেক হিমবাহের আবাসস্থল। চ্যাংমেখাম্বু, জেমু, তালুং ইত্যাদি হিমবাহের জল পেয়ে তিস্তা পুষ্ট হয়। তিস্তা নদী আসলে লাচেন আর লাচুং এই দুই নদীর মিলিত ধারা। তিস্তার বয়ে চলার পথ সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ তারপর আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশ। নদীর এই যাত্রাপথেই লাচেন, লাচুং, তালুং, দিকচু, রঙ্গনী, রংপো, বড় রঙ্গিত, রেলি, লিশ, ঘিস, চেল, ন্যাওড়া, মাল আর করলা এই চোদ্দটি নদী নিজেদের পেট ভরে বয়ে আনা জল ঢালে তিস্তার বুকে।
পাহাড়ি এই নদীর বুকে জল রয়েছে। আর তার সাথে জুড়েছে ভূমির ঢাল। এই দুই কারণেই তিস্তাকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের একটা অবলম্বন হিসেবে ভাবা হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের ১৩ অক্টোবর করোনেশন সেতুর কাছে তিস্তার বুকে জল এসেছিল ১,৭৯,৭৮২ কিউসেক। ঐ একই দিনে দোমোহনীর কাছে তিস্তার বয়ে আনা জলের পরিমাণ ছিল ৩,৭৩,০০০ কিউসেক। আজকের দিন পর্যন্ত তিস্তার সর্বোচ্চ জলের পরিমাণ এই সীমা অতিক্রম করেনি। আর তিস্তার পাহাড় থেকে নেমে আসা পথে আমরা তিন রকমের ঢাল লক্ষ্য করি। চুংথাং থেকে সিংথাম পর্যন্ত তিস্তার ঢাল ৩.৫৯ থেকে ১.৬৬ শতাংশ। আর রংপো থেকে তিস্তা বাজার পর্যন্ত সেই ঢাল কমে দাঁড়ায় ০.৩৮ শতাংশে। তিস্তা নদীর অববাহিকা রয়েছে দুই দেশ জুড়ে। ভারতের মধ্যে রয়েছে ১০৬৮৬ বর্গ কিলোমিটার। আর বাংলাদেশে রয়েছে ২০০৪ বর্গ কিলোমিটার।
তিস্তার বয়ে চলা পথের ১৫৩ কিলোমিটার রয়েছে সিকিমের মধ্যে। সিকিম নদীর এই পথে প্রচুর পরিমাণে জল তুলে নিচ্ছে মূলত পানীয় ও শিল্প কারখানার জন্য। এরপর রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। তিস্তা ৫, রঙ্গিত ১ ও ২ শীর্ষক বাঁধগুলো সিকিমে হয়েছে। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের সাতাশ মাইল ও কালিঝোরায় নদীর জলের বুকে টারবাইন ঘুরিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়ে গিয়েছে। আর এই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫০ হাজার মেগাওয়াট। এছাড়াও তিস্তা ও তার উপনদীর ওপর আরও ২৭টি বাঁধ বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
আমরা যদি তিস্তার যাত্রাপথকে সম্পূর্ণ লক্ষ্য করে দেখি, তাহলে দেখব গজলডোবার অনেক আগেই তিস্তা মরে যাচ্ছে। সেচের প্রয়োজনীয় জল গজলডোবাতে আসছে না। কারণ পাহাড় আর সমতলের বন্ধু নদী তিস্তাতে সিকিম ও উত্তরবঙ্গ মিলিয়ে মোট পাঁচটা ‘তিস্তা লো ড্যাম’ প্রোজেক্ট তৈরি করা হয়েছিল।এদিকে দিকচুর কাছাকাছি রয়েছে তিস্তা স্টেজ ৫ এর বাঁধটি। আবার আমাদের মনে রাখার সময় এসেছে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিস্তার উপনদী রঙ্গিতের ওপর দিকচুর কাছে প্রস্তাবিত রয়েছে একটি বাঁধ। তিস্তার ওপর বাঁধ দেবার গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ হল না। তিস্তা লো ড্যাম ১ ও ২ বানানোর পরিকল্পনা শেষ। এই দুটি ড্যাম নির্মিত হবে যথাক্রমে সেবক সেতুর কাছে আর অন্যটি মল্লিক বাজারের কাছে, যেখানে তিস্তা আর রঙ্গিত একে অন্যের সঙ্গে মিশছে।
তিস্তা নদীর উপর নির্মিত ৫১০ মেগাওয়াটের স্টেজ ফাইভ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। সিকিম।
এতোগুলো জ্যান্ত বাঁধ আর কিছু পরিকল্পনা করা বাঁধের শৃঙ্খলকে টপকে যখন তিস্তা গজলডোবা, জলপাইগুড়ি, হলদিবাড়ি, মেখলিগঞ্জ পেরিয়ে কোচবিহারে ঢোকে তখন তিস্তার বুকে জল নেই। এমন কথা দৃঢ কন্ঠে বলছেন তিস্তাপারের মানুষেরাই। তিস্তার ওপর রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে না আনলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রুদ্র কমিশনের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই জানিয়েছিলেন দু’দেশের মধ্যে তিস্তার জল ভাগাভাগি সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল, নদী কর্মীদের একটা বড় অংশ রুদ্র কমিশনকে মানতে রাজি নয়। তাদের যুক্তি এটি ‘সিঙ্গেল ম্যান কমিশন’ ছিল। নদী কর্মীরা অনেকেই তাই এই কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
কথা প্রসঙ্গে, যদি আমরা রুদ্র কমিশনের কথাকে সঠিক হিসেবে মেনে নিই, তাহলে প্রশ্ন উঠবে কেন জল বাংলাদেশকে দেওয়া সম্ভব নয়? প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যের সেচ ও জলপথ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সুভাষ রঞ্জন মৈত্রের লেখা আমাদের সাহায্য করে (বর্তমান, ১২ জুন ২০১৫, পৃ.৪)। তিনি জানাচ্ছেন, ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল এই ১৫০ দিন বাংলাদেশের চাহিদা মোতাবেক ১০ কিউমেক করে জল দিতে হলে তিস্তাতে শুখা মরশুমে জল থাকতে হবে ১২ কোটি ১৯ লক্ষ ঘনমিটার। এই জলের শতকরা পঞ্চাশ শতাংশ নষ্ট হয় বাষ্পীভবন ও অন্তঃপ্রবাহ (যে জল মাটিতে ঢোকে) এর জন্য। তাহলে বাকি জল কতটুকু দাঁড়াল? পরিসংখ্যান বলছে ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ ৮০ হাজার ঘনমিটার।
নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বা বাস্তুতান্ত্রিক প্রবাহকে বজায় রেখে বাংলাদেশকে দেওয়ার মতো জল নদীর বুকে থাকছে না। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উপর নির্ভর করে তিস্তার জল বাংলাদেশকে দেওয়া যাবে এমন ভাবনাটির ভেতর মূলগত ত্রুটি রয়েছে। তার মূল কারণ একটা বড় পরিমাণ জলের অংশ তিস্তা থেকে তুলে নেয় সিকিম। তারপর পশ্চিমবঙ্গের জলের চাহিদা মিটিয়ে তিস্তার বন্টনযোগ্য জল তলানিতে এসে ঠেকেছে।
পশ্চিমবঙ্গের কাছ থেকে বাংলাদেশ যেমন তিস্তার জল পাওয়ার দাবী তুলেছে, তেমনি আমাদেরও একটি উল্টো দাবী জানানোর জায়গা রয়েছে বাংলাদেশের কাছে। সেটাও নদীর জল নিয়েই। যে সমস্ত নদী বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢোকে, তার মধ্যে যেমন দক্ষিণ দিনাজপুরের আত্রেয়ী, যমুনা আর উত্তর দিনাজপুরের কুলিক রয়েছে। এই নদীগুলোর ওপর ‘রাবার ড্যাম’ দিয়ে জল আটকে রেখেছে বাংলাদেশ। এটি হল জাপানি টেকনোলজি। দেখতে অনেকটা লম্বা টিউবের মত। যেখানে বাতাস ভরে ড্যামের আকৃতি তৈরি করে নদীর জলের প্রবাহ রোধ করা হয়। আর তার ফলে ভারতের দিকের নদী পাড়ের স্থানীয় এলাকার মানুষেরা জল সংকটে ভুগছে। চাষের ক্ষতি হচ্ছে।
‘রাবার ড্যাম’ টেকনোলজিতে নির্মিত বাঁধ।
এইরকম অবস্থায় দু'দেশকেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার উপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক জলবন্টন বিষয়ক "হেলসিঙ্কি নীতি"কে সঠিক প্রয়োগের জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। "হেলসিঙ্কি নীতি" কি একটু জানিয়ে রাখা ভাল। আন্তর্জাতিক স্তরে জল বন্টনের বিবাদ নিরসনের জন্য এই আইনটি রয়েছে। ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের আইন সমিতির ৫২ তম সম্মেলনে গৃহীত এই বিধি অনুসারে আন্তর্জাতিক নদীর জলে সব দেশের ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত অধিকার আছে। প্রতিটি দেশের নাগরিকদের জীবন ও জীবিকার জন্য জলের উপর তাঁদের দাবি একটি ন্যায্য অধিকার হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। এই ন্যায্য দাবী এবং যুক্তিসঙ্গত অধিকার সমস্ত ক্ষেত্রে বিবেচনা করে নির্ধারিত হবে কতটা পরিমাণ জল পাওয়া দরকার। আর এই দুই বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই হবে নদীর জলবন্টন।
"অন্যটি মল্লিক বাজারের"
তিস্তা বাজার। মল্লিকবাজার পার্ক স্ট্রীট ও সার্কুলার রোডের মিলনস্থল।
একদম ঠিক বলেছেন আপনি। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত।
১২ কোটি+ থেকে ৫০% চলে যাওয়ার পর ১৩ কোটি+ হবে কি করে? একটু দেখে সংশোধন করে দিন। যদিও একটা "পরিসংখ্যান অনুসারে" বলা আছে। মানে পরিসংখ্যানের ভুলটাই বোঝাতে চাইছেন?
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি লেখা। বর্তমানকালের নানা সমস্যার মধ্যে পরিবেশজনিত সমস্যা গুরুত্ব পায় না। আশা রাখি এই লেখাটি পথ দেখাবে।
লেখাটি পড়ে সার্বিকভাবে অবহিত হলাম,ঋদ্ধ হলাম!
দেবব্রত মজুমদার বাবু লেখাটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করে আপনার মূল্যবান মন্তব্য টি জানিয়েছেন। এর জন্য কৃতজ্ঞ।মূলত বাস্তবের সাথে পরিসংখ্যান যে কতটা ভুল থাকে, সেটা দেখানো হয়েছে। আপনার মন্তব্যটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছি। জলের পরিমাণ কতটা হওয়া উচিত ছিল, সেটা নিশ্চয় যুক্ত করে দেব।অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী বাবু আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়ে নিজের কাজের প্রতি আরো দ্বায়িত্ব বেড়ে গেল।এক নদী ধন্যবাদ রইল আপনার জন্য।
Sobuj Chatterjee বাবু, আপনার মতব্য আমায় প্রাণিত করল, আপনার জন্য রইল এক নদী ধন্যবাদ
Sobuj Chatterjee বাবু, আপনার মতব্য আমায় প্রাণিত করল, আপনার জন্য রইল এক নদী ধন্যবাদ
লেখাটা পড়ে সমৃদ্ধ হলাম, একই সঙ্গে ভয়ও পেলাম। নদীর বুকে একেরপর বাঁধ দিয়ে জল আটকাতে আটকাতে একদিন না আমরাই কোথাও আটকে যায়। মানুষের উত্তোরত্তর লোভ আগামীতে আরও ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে। এই কথা গুলিই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সুপ্রতিম কর্মকার রচিত 'তিস্তার জল কোথায় গেল ?' শীর্ষক নিবন্ধে।
অসম্ভব তথ্যপূর্ণ চমৎকার একটি লেখা। প্রত্যেকবারের মতনই সমৃদ্ধ হলাম।
আপনার সাথে দাদা ব্যক্তিগত পরিচয় আছে এটা ভেবেই খুব ভালো লাগছে।
পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম
বেশ ভালো লাগলো৷ ভারত বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার জলবন্টন নিয়ে অনেক জলঘোলা হয়েছে৷ রুদ্র কমিশনের সুপারিশ নিয়েও তথ্য রয়েছে৷ আসল কারণ প্রতিবেদনে খুব সুন্দর করে বলে দিয়েছেন তিস্তার জলের অধিকাংশই নিয়ে নেয় সিকিম৷ এরকম লেখা সংরক্ষণযোগ্য৷
তবে জল তিনভাগ হোক - সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মধ্যে। তাতে হিন্দুস্থানি নেতাদের অপুত্তি নেইতো ?
তিস্তা নদী নিয়ে এত তথ্যবহুল লেখা আমি খুব কমই পড়েছি । নদী গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষক-প্রাবন্ধিক সুপ্রতিম কর্মকারের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি । নদী ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণার বিষয়ের সঙ্গে সুন্দর মনোজ্ঞ গদ্যকে মিলিয়ে দিতে তিনি পারঙ্গম । বাংলার নদীগুলি সম্পর্কে এভাবেই আমাদের ঋদ্ধ করে যাক তাঁর নিিবন্ধ গুলি ।
স্যার পুরো বাস্তব বোলেছেন। developed sudhu korle hobe na.. Prokiti ke surokhito rekhe development kora uchit.. Govt k ai bisoi a socheton thakte hobe.