দশম পর্ব: "কই....হাতটা দাও দেখি মা?", মায়ের বিগ্রহের চরণের পুষ্প তুলে আচার্য্য রূপাকে তার হাত বাড়িয়ে দিতে বললেন। রূপা কেমন যেন আনমনে বিশুর দিকে তাকাল। বিশু সম্মতি দিলে রূপা ধীরে ধীরে ওর ডান হাত বাড়িয়ে দিল প্রজ্ঞানন্দ আচার্য্যর বাড়ানো হাতের দিকে। আচার্য্য গলা থেকে নিজের পৈতে টা ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ওপর জড়িয়ে মায়ের চরণের পুষ্প সমেত নিজের হাত রাখলেন রূপার হাতের ওপরে। এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। বিশু আর গণশা একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখের ঈশারায় কথা বলতে লাগল। কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিলেন প্রজ্ঞানন্দ আচার্য্য! চোখ খুলেই কিছুটা স্ফীত চোখে তাকিয়ে ... ...
ছোটবেলায় কী প্রাণোচ্ছল ছেলে ছিল সৌরভ! ওর সাথে দৌড়ে কেও পারত না। স্কুলে স্পোর্টসে প্রতিবছর তিনটে প্রাইজ ওর বাঁধা থাকত! হান্ড্রেড মিটার রেস, লং জাম্প আর হাই জাম্প। এরপর অবশ্য অন্য কোন ইভেন্টে নাম দিলে সেই প্রাইজটাও ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় এমন সাধ্য আর কারোর ছিলনা। টিচাররা বলতেন,"সৌরভ তুই এই তিনটের বেশি ইভেন্টে নাম দিলে সব প্রাইজগুলো তো তুইই নিয়ে যাবি! বাকিরা কেও কিচ্ছু পাবে না!" পড়াশোনায় যে সৌরভ খুব খারাপ ছিল, তেমনটা নয়। এক থেকে পাঁচের মধ্যে থাকতই সে। একটু চঞ্চল হয়ত ছিল, তবে একেবারেই যে খারাপ তা বলা যাবেনা! তাছাড়া খেলাধুলোয় বরাবরই স্কুলের নাম উজ্জ্বল করায় পড়াশোনা নিয়ে ... ...
নবম পর্ব: কালীমন্দিরের সামনে আসতেই "দাদু?" বলে হাঁক দিল গণশা। কিছুক্ষণ পরে মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে এলেন বছর ষাটের এক প্রৌঢ়। গায়ে গেরুয়া বসন, চুল দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোক বেশ লম্বা, গায়ের রং উজ্জ্বল। বিরূপাক্ষ তান্ত্রিকের মতোই দাড়ি আর চুল লম্বায় বেড়ে গিয়ে মিলেমিশে একাকার, তবে বিরূপাক্ষ তান্ত্রিকের সাথে বাহ্যিক রূপার তফাৎ অনেকটাই। ওনাকে দেখে একটা অদ্ভুত রকমের ভক্তি আসে মনে, যা বিরূপাক্ষ বাবা কে দেখে মোটেই আসে নি। হাতে, গলায় বেশ কয়েকটা করে হরীতকীর মালা ঝুলছে ইয়া লম্বা লম্বা। কপালে লাল তিলক যেন নীচ থেকে ওপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে গেছে। এই ঘন জনমানবহীন জঙ্গলে সূর্য ডোবার ... ...
অষ্টম পর্ব: রেল গেট পেরিয়ে মাইল খানেক গেলেই জঙ্গলের মাঝে এক বহু পুরোনো গ্রাম বল্লভপুর। প্রাচীনকালে রাজা মহেন্দ্রবর্মন নাকি গ্রামটি যজ্ঞ, আহুতি এসবের জন্যই আলাদা করে আড়াল করে রেখেছিলেন। তাই গ্রামটি জঙ্গলঘেরা- একান্তে, একদিকে, অন্য সব পাশের গ্রামগুলো অবশ্য বেশ দূরে। সে আমলে পুজো হত এই প্রজ্ঞানন্দ আচার্য্য - এর কালীমন্দিরেই। ইনারই পূর্বপুরুষ সেসময় এই কালীমন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। বংশপরম্পরায় এই পৌরহিত্য চলতে থাকায় বর্তমান সময়ে এই পুজোর গুরুভার এখন প্রজ্ঞানন্দ আচার্য্য এঁর কাঁধে। কালিমন্দিরটি বর্তমানে গণশার পিসেমশাই দুর্গামোহন বাবু দেখাশোনা করেন। পিসি মারা গেছেন অনেক বছর আগেই। সব মিলিয়ে বলতে গেলে এই বল্লভপুর গ্রামের আনাচে কানাচে ইতিহাসের রহস্য লুকিয়ে আছে! "আর কত ... ...
সপ্তম পর্ব: বিশুর কাছে এরকম অলৌকিক কান্ড শুনে গণশা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল! সচরাচর গর্ভধারণের ক্ষেত্রে এরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া অসম্ভব! এ তো সাধারণ তুকতাক হওয়ার কথা! কিন্তু রূপার এইরকম আশ্চর্যজনক পরিবর্তন দেখে গনশা বিশুকে এক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিল,"শোন বিশু, রূপাকে দেখে আমার ভাল কিছু মনে হচ্ছে না। আমার মনে হয়......!" গণশার কথা শেষ না হতেই বিশু বেশ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,"কী মনে হয়? "মনে হয় এ সাধারণ কিছু নয়! কোন অশরীরী আত্মা ভর করেছে রূপার ওপর!" বিশু শুনেই প্রচণ্ড রেগে গিয়ে গণশাকে সপাটে এক চড় মারল! গনশার জামার কলার ধরে চিৎকার করতে করতে বলল,"তোর কি মনে হয় আমার বউকে ভূতে ধরেছে? আমি জানি তোরা ... ...
ষষ্ঠ পর্ব: বেশ কয়েকমাস ধরেই গভীর রাতে রূপার এই আচরণ অক্ষুণ্ন রইল। যেদিন থেকে সে তান্ত্রিকের দেওয়া মালা ধারণ করেছে, তান্ত্রিক বাবার দেওয়া বোতলের বিশেষ জল সেবন শুরু করেছে, সেদিন থেকেই রূপার গভীর রাতে উঠে দরজার কাছে গিয়ে আপন মনে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে দরজায় মাথা ঠোঁকা যেন অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। রোজই ঘুমের ঘোরে সে দরজায় গিয়ে নিথর হয়ে মাথা ঠুঁকে ঠক ঠক শব্দ করে আর বিশুর সেই শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বিশু তখন রূপাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। প্রত্যেকদিনের আঘাতে কপালের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষত। তবে রূপার এই আচরণগত পরিবর্তন শুধুমাত্র রাতটুকুই থাকে। সারাদিন অবশ্য তার ব্যবহারে কোনরকম অস্বাভাবিকতা চোখে ... ...
পঞ্চম পর্ব: পরের দিন বিশু কাজে বেরিয়ে গেলে রূপা স্নান করে পুজো সেরে তান্ত্রিক বাবার দেওয়া মালাটা তুলসী মঞ্চে একবার ছুঁইয়ে প্রণাম করে পরে ফেলল। বেশ অদ্ভুত দেখতে মালাটা! একটা বড় লকেট ঝুলছে নিচের দিকে। লকেটটা বেশ ভারী, একটা বড় মত চকচকে পাথর দিয়ে তৈরি। পাথরের ওপর কীসব জ্যামিতিক ছবি আঁকা রয়েছে, লেখা রয়েছে মন্ত্র। মালাটা পরতেই হঠাৎ একটা ঝটকা পেয়ে দু'পা পিছিয়ে গেল রূপা। কানের পাশে ফিসফিস করে কেও যেন অদ্ভুত একটা চেনা গলায় কী একটা বলে গেল! ঠিক গতকাল ঝড়ের সময় যে কর্কশ, অদ্ভুতুড়ে গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল, অনেকটা ওরকম! একটু হলেও ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে একবার চারিদিক তাকিয়ে ভিতরে ... ...
চতুর্থ পর্ব: বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর বাবা চোখ খুললেন। সে চোখ বিকেলের অস্তমিত সূর্যের মত রক্তিম! চোখের মণি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম! যেন কিছু বলতে চাইছে! ও চোখের দিকে তাকালেই যেন সব রোগ সেরে যায়! সব বাধা কেটে যায়! ভয়ানক হলেও সে চোখের দিকে তাকালে অদ্ভুত এক নিশ্চুপ শ্রদ্ধার জন্ম নেয় ভিতরে! "এত দেরি করলি যে মা? তোর গর্ভে সন্তান না আসার যন্ত্রণার চিকিৎসা ওসব ডাক্তার বদ্যি কিস্যু করতে পারবে না! ওখানে যাওয়া বৃথা।......... পাপ! পাপ! সব পাপের ফল!", মোটা কর্কশ গলায় রূপার দিকে তাকিয়ে বিরূপাক্ষ তান্ত্রিক বললেন। সে গলার আওয়াজ ধীর হলেও মুমূর্ষ! শান্ত হলেও গভীর! যেন বাবা আগে থেকেই ... ...
তৃতীয় পর্ব : প্রকৃতির সেই অলৌকিক ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে ওরা যখন বাবার আখড়ার সামনে এল তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে আরও। কালবৈশাখীর তেজ যেন আছড়ে পড়ছে হেতমপুর শ্মশানের মাঠে! ভক্তের দল আশ্রয় নিয়েছে তাঁবুর তলায়! বেশ বড় এলাকা ছড়িয়ে বসেছেন এই বিরূপাক্ষ বাবা। অসংখ্য ছোট ছোট তাঁবু রয়েছে এখানে ওখানে, অনেকটা মেলার মত। সামনে একটা গেট, সেই গেট দিয়ে ঢুকে প্রথমটায় কুপন কাটতে হচ্ছে। পরেরটায় প্রসাদ বিলি আর তারও পরেরটায় প্রসাদ কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। বিশু অবশ্য বাবার সাথে দেখা করার কুপন গতকাল গণশার সাথে এসেই কেটে নিয়ে গিয়েছিল। তাই লম্বা লাইনে অপেক্ষা করার ব্যাপার হয়ত থাকবেনা। বৃষ্টিতে বেশ ভিজে গেছে ... ...
দ্বিতীয় পর্ব: রবিবার বিশুদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মত। সকালেই ওরা স্নান সেরে নতুন জামা কাপড় পরে তৈরি। শুধু মিতন আর কনকচাঁপার টোটো নিয়ে আসার অপেক্ষা। রূপার আর তর সয়না, বলে,"একবার গিয়ে দেখো না গো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো?" বিশু উত্তর দেয়,"দেরি কেন হবে? মিতন ঠিক সময়ে এসে হাজির হবে দেখো, ওর সময়জ্ঞান আছে। দেখলে না? সেবার বাস ধরতে গেলুম, কেমন ঠিক সময়ে পৌছে দিল?" ঠিক এমন সময় টোটোর হর্ন শুনে বিশু বেরিয়ে দেখে মিতন হাজির, সঙ্গে ওর স্ত্রী কনকচাঁপা। দুজনে এক্কেবারে পরিপাটি হয়ে এসেছে। এসব ব্যাপারে কনকচাঁপার আবার একটু বেশিই আগ্রহ। তুকতাকে সে খুব বিশ্বাসী। জ্যোতিষ, তন্ত্র, শাস্ত্র সে খুব মেনে চলে। বাড়িতে ঠাকুর প্রণাম ... ...