সাহিত্যসৃষ্টি পঠিত হয় বারংবার। সময়ের ব্যবধানে। কখনো বা একই পাঠক তাঁর প্রিয় বইটিতে ফিরে ফিরে যান, জীবনের নানা মুহূর্তে। প্রায়শই একই লেখা পাঠ থেকে পাঠান্তরে আনে ভিন্ন অনুভব, ভিন্ন অর্থ। এ কথা মাথায় রেখেই নির্মিত হয়েছে এই বিশেষ সংখ্যা। শঙ্খ ঘোষের যে কোনও একটি বই ফিরে পড়ুন, লিখুন এ মুহূর্তের ভাবনা— এই ছিল এই সংখ্যার লেখকদের কাছে অনুরোধ। কোন বই নিয়ে কে লিখবেন, ছিল না তার কোনো নির্দেশ। ফলত, একই বইয়ের পৃথক পাঠপ্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে একাধিক লেখকের কলমে, ঘটেছে এমনটাও। সংখ্যাটিকে তা আরও সমৃদ্ধ, কৌতূহলোদ্দীপক করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। ... ...
১৯৬৯। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘শঙ্খ স্যার’-কে প্রথম দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখা। পরবর্তী বহু দশকে নানা উপলক্ষে চেনা-জানার সুযোগ। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনকালে বেশ কাছের মানুষ হয়ে ওঠা। তবু থেকে গিয়েছে কিছু খটকাও। স্মৃতিচারণে মীরাতুন নাহার ... ...
নিজের সঙ্গে কথা বলেন কবিরা অনেকসময়ই। ম্যানিফেস্টো লেখেন। কবিরা যে ম্যানিফেস্টো লিখে নিয়ে তারপর কবিতা লিখতে বসেন তা আদৌ নয়, কবিতা লিখতে লিখতে হয়তো কোনো ম্যানিফেস্টোর প্রয়োজন বোধ করেন। এমন মুহূর্ত আসে যখন নিজের সঙ্গে একটা কড়ার করে নিতে হয়। তার আগে পরে যা আছে তা যে সাধনধন নয়, তা নয়। তবু নিজের সঙ্গে নিজের সাধনা নিয়ে কথা বলতে হতে পারে। আপন মনে কথা, সত্তো ভোচে। কবি শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণদিনে তাঁর তেমনই একটি কবিতা স্মরণে অমিয় দেব ... ...
‘আমার সমসময়ই মনে হত, আমাদের তাৎক্ষণিক চাহিদায় বা নিতান্তই সঙ্গসুখলোভে আমরা ওঁর যে সময়টা গ্রাস করে নিই, সেই নষ্ট সময়েই তো তৈরি হতে পারত অনন্ত সম্পদ—কিছু লেখায় রূপ নিত, কিছু ওঁর অপারসক্রিয় ভাবনায় মথিত হত— যা থেকে যেত কত কালের আস্বাদনের জন্য। তাঁর বাড়ির সপ্তাহান্তিক বিখ্যাত আড্ডায় আমি কখনও যাইনি, ওই ভাবনা থেকেই।’ শরণাপন্ন হয়েছেন অবশ্য সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনে। তেমনই দুই অভিজ্ঞতার কথা লিখলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ... ...
মন দিয়ে শুনছেন যে শ্রোতা তিনি হয়তো এই কবিতায় দুটি বিসংবাদী সুর শুনে চমকে উঠছেন! আজ্ঞার সুর যে এখানে বড়ো বেশি প্রকট এবং সুতীব্র, আবার কাতর কণ্ঠের কোমল সুরও। পরস্পরবিরোধী সুর সব, কবি শঙ্খ ঘোষের এমনই কাব্যরীতি যে এই দুই অতি ভিন্ন সুরের মেলবন্ধনেই তিনি রচনা করে চলেছেন এক অনবদ্য রাগিণী— যেন পাঠকের কাছে পেশ করছেন কোনো সিম্ফনি। ... ...
কবি সেই ভারতের দিকে আমাদের দৃষ্টি টানেন যা ‘মানচিত্রে ভেসে উঠে পেয়ে গেছে তবু কিছু মান’, আর সেই দেশেই যদি এখনও মানুষ ‘গাঁয়ে বসে খুঁটে খায় খুদকুঁড়ো’ তার কারণ হতেই হবে ‘রক্তে তো ইংরেজি নেই’! এই স্যাটায়ারের স্বর মৃদু, কিন্তু যথেষ্ট ধারালো— উঠে আসে কীভাবে আমাদের ভোগ করা যাবতীয় সুযোগসুবিধার মূলে রয়েছে কোনো ঔপনিবেশিক মনোভাব। ... ...
শঙ্খ ঘোষ বিশ্বসাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক। তাঁর একটা কাজ, সৃষ্টিশীল কাজ, শিশুদের জন্য লেখালিখিও। ১৯৯৪ সালে বাংলার বিশিষ্ট ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকা তাঁর উপর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। তাতে ছিল তাঁর লেখালিখি নিয়ে বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের লেখা। অনুষ্টুপের এই সংখ্যায় ওঁর নিকটতম বন্ধু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেছিলেন শঙ্খবাবুর নানা গুণের কথা। তার মধ্যে একটা ছিল কর্তব্যবোধ। ... ...
আশ্চর্য এক বিদেশি পথে আগন্তুক, কিন্তু পথ হারানোর কোনো ভয় নেই, আমি এই কবিতাগুলিকে ছুটতে দিই আমার আগে আগে এবং একটি মাত্রার জন্যও তাদের অনুসরণ করা ছাড়ি না, চলি যেখানে তারা আমাকে নিয়ে যায়। একটি ধীর পদক্ষেপের পর আর-একটি ধীর পদক্ষেপে ‘পার্কস্ট্রিট থেকে গড়িয়ায় / আর তার মুক্তদেশে সোনালি সপ্তর্ষিরেখা রেখে’! চলে যাই গ্রামে গ্রামান্তরে, শহরে শহরে, ময়দানে, সেইসব জায়গায় যেখানে কোনোদিনই যাইনি। গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে সওয়ার হয়ে আমি চলি, তিলমাত্র ভয় নেই যে পৌঁছাব না হয়তো। ... ...
দুটো ছবি আমার মনের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় কেবলই: সারা দুনিয়া থেকে আসা পিকচার পোস্টকার্ড খচিত দেয়াল থেকে দেয়ালে ঠাসা বইয়ের আলমারি ঘেরা তাঁর ‘বই’ঠকখানায়(!) কথপোকথন চলছে রবীন্দ্রসংগীত ঘিরে, শুনছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো, দেখছি তাঁর অনুপম শরীরী ভাষার নানা ভঙ্গিমা—এই এক ছবি; আর-এক ছবি—স্থিতি, গতি, লয়—এই তিনের ধারণার রকমফেরে কবি ও সুপণ্ডিত শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রনাথ পাঠের যে পথরেখা তৈরি করেছেন, তা থেকে উৎসারিত কাব্যরস নিয়ে নাগাড়ে বলে চলেছেন প্রবাল দাশগুপ্ত। ... ...
বাস্তবের অন্তরালবর্তী হাজার অনুভূতির আবিষ্কার-পুনরাবিষ্কার কিংবা পরীক্ষণ-পুনর্নিরীক্ষণই হয়তো শঙ্খ ঘোষের কবিতার সহজ সংজ্ঞা। তাঁর নীচু গলার প্রায় প্রতিটি উৎসারণে যেন ধ্বনিত হয়েছে পাস্কেল-কথিত সেই অন্তহীন মহাশূন্যের আবহমান নীরবতা। তাঁর কবিতাময় উচ্চমানের গাম্ভীর্য, সন্দেহ নেই: কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়া-র অনায়াস ও স্বচ্ছন্দ প্রয়োগের দৃষ্টান্তগুলি এইরকমের— অনুভূতির সঙ্গে অনুভূতির খেলা, শব্দের সঙ্গে শব্দের এবং অনুপ্রাস আর অন্ত্যমিলের নিরবচ্ছিন্ন অন্বেষণের অভেদ তুলে আনে এক অনন্য সৃষ্টিশীলতা ... ...
‘খবর’ শীর্ষক কবিতায় যে দৃশ্যপট চোখে পড়ে, তা এমন— সব জায়গায় কাঁপিয়ে ঢোকে খবর। আধা খোলা দরজা ঠেলে ভেতরে কে ঢোকে? না, খবর। জানালার ধার ধরে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে কে? না, খবর। এদিক-ওদিক, যে দিকে হেলান দিলে চেপে ধরে কে? না, খবর। ঘরে বাইরে সর্বত্র খবরের রাজ। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে স্তূপের মতো উপরে চেপে বসে খবর। রুদ্ধ হয়ে যায় নিশ্বাস। মৃত শরীরের উপর খবর নাচে আহ্লাদে, নেচে চলে। গভীর শ্লেষ থেকে নিমেষেই পরিহাস তুলে আনেন শঙ্খদা অনায়াসে, যেমন ‘কোমা’ থেকে চেতনায় ফিরে আসে চেতনাহত। ... ...
শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়া এক গভীর কৌতূহলোদ্দীপক, আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আমি মূলের ভাষা বা তার নান্দনিকতা নিয়ে কিছু বলতে তো পারি না, শুধু এটুকু বলতে পারি, তরজমায় যে কবিকে পাই তিনি গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সূক্ষ্ম সংবেদনশীল, গভীর আবেগময়, নির্ভুল পর্যবেক্ষণকারী এবং পরিশীলিত ভাবনার মানুষ। তিনি কবিতা-শিল্পটিকে করায়ত্ত করেছেন ন্যূনতম শব্দ খরচ করে সর্বাধিক সম্ভব ভাবপ্রকাশের পারদর্শিতায়। তাঁর কবিতার কথোপকথনের ভঙ্গিমা এবং বিবিধ উত্তর তুলে ধরা আমাকে প্লেটো-র ‘রিপাবলিক’, এবং পারসিক কাব্যের ‘কথোপকথন’ (ডায়ালগ) গোত্রের কবিতার কথা মনে করায়। আমার কাছে তিনি বিপুল পড়াশোনা করা একজন কবি, যাঁর এক চক্ষু নিবদ্ধ বিশ্বসাহিত্যের উপর। ... ...
শঙ্খ ঘোষ একজন সংবেদনশীল কবি, যাঁর আঙুলে সমাজের নাড়িস্পন্দন নির্ভুল ভাবে অনুভূত হয়। তাঁর দৃষ্টি সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি এবং ট্র্যাজেডির ওপর কেন্দ্রীভূত। এবং তিনি তাদের ওপর শব্দের পোশাক সযত্নে পরিয়ে দেন। ... ...