ঘুরতে ঘুরতে এক মেডিটেরিনিয়ান রেষ্টুরান্টে ঢুকে পড়লাম হল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের মাঝের এক জায়গায়। বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছিল যেমন আমার পায় আর কি কাছেপিঠে ভালো রেষ্টুরান্ট দেখলেই। এই রেষ্টুরান্টের রেটিং আবার ৪.৭ পাঁচের মধ্যে, মানে যা তা ব্যাপার নয় আর কি! খেতে গিয়ে মেনু দেখেই বুঝলুম যা তা ব্যাপার কেন নয়! বিশাল বড় কিছু মেনু নয় তেমন – মাত্র চার পাতার! কিন্তু সেই মেনু পড়ে বোঝে কার কি সাধ্য কি খাবার অর্ডার দেওয়া হচ্ছে! এদিকে ডাচ, ওদিকে ফ্রেঞ্চ এবং মাঝে মাঝে ইংরাজী – একেবারে ডেডলি সব কম্বিনেশন! ... ...
শীত মানেই খাওয়া দাওয়ার মরসুম। এ মরসুমে শীতের খাবারের কথা না বললে চলে! ... ...
প্লেটের দিকে তাকিয়ে সেদিন সর্বপ্রথম যার মুখটা ভেসে উঠল তিনি আর কেউ নন আমাদের ক্লাশ ইলেভেনের বায়োলজি স্যারের। স্যারের বয়স হচ্ছিল, শরীর তেমন সাথ দিচ্ছিল না – তবুও তিনি আমাদের ফিল্ড ট্রিপে নিয়ে গিয়ে গাছ-পালা চেনাবার চেষ্টা করতেন। আমরা কিছুই শিখি নি – সেটা অন্য ব্যাপার, তাতে স্যারের দিক থেকে খামতি কিছু ছিল না। তো সেদিন প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছি, আর মনে মনে ভাবছি এই প্লেট স্যার সামনে পেলে আর আমাদের কষ্ট করে বর্ধমানে রমনার পার্কে নিয়ে গিয়ে গাছপালা চেনাতে হত না! ক্লাসে বসেই যত অচেনা আর অখাদ্য শাক পাতার বিবরণ সহ পরিচিতি হয়ে যেত! ... ...
সবাই নিজের নিজের মতো হালীম বানান তবে একটা ব্যাপারে সবাই একমত — হালীম অতি সামাজিক খাদ্য। এত পরিশ্রমলব্ধ প্রাপ্তি চট করে ফুরিয়ে যেতে দিতে ইচ্ছে হয় না। তাই এ রান্না ঠিক কম করে বানিয়ে শান্তি হয় না। উপকরণের অনুপাত বলতে ওই শস্য ও মাংস সমান সমান রাখা। বাকি সব স্বাদবোধ অনুযায়ী। তাই সবকিছু মেশানর শর্তসাপেক্ষেও প্রতিটি হালীম রান্না নিজস্ব স্বাদ গন্ধে আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। ... ...
এখনও আমি জানি না, দুপুরে খিচুড়ি হবে না ফিনাইল। কিচ্ছু ভাল্লাগছে না। ... ...
সেদিন আমেরিকান রেষ্টুরান্টে এই প্লেটের কোণে ঝিনুকের মাংস আর ভাত দেখে মনটা খুশী হয়ে গেল। দেশের কেটারিং রীতি ভুলে গেলেও এরা মনে রেখেছে! ভাবছি পুরো প্লেটটাই খালি, এবার এখানে আসল খাবার আসবে। ভাতের আকার দেখে আমি ধ্বন্দে পড়ে গেলাম - এ কি চাল? রত্না বা বাঁশকাঠিও তো এমন হয় না! তাহলে কি এগুলো ছোট কাঁকুড়ের বীচি? যে কাঁকুড় বড় হতে পারে না, তাদের বীজ এমনই হয়। টেনশন দূর করতে দাঁতে কেটে দেখলাম সেই চাল - আরে বীজ নয় তো! এ চালই বটে, কিন্তু অর্ধসিদ্ধ প্লেট নিয়ে বসে আছি, তখনো সন্দেহ হয় নি। খেয়াল হল প্লেটের বাকি খালি জায়গায় আঁকাবুকি কাটা কেন?? ... ...
যেমন তেমন শেফ হলে আমি জিজ্ঞেস করতাম – “এই জিনিস-কে কি ভাবে খাবার নামে ডাকা যায়?” এই শেফ-কে সেই প্রশ্ন করলাম না, কারণ তার উত্তর আমার জানা। বহুদিন আগে, ১৯১৭ সাল নাগাদ মার্সেল দ্যুসোঁ নামক এই বিখ্যাত ফরাসী চিত্রকর এবং ভাষ্কর, নিউ ইয়র্কের এক মর্ডান আর্ট চিত্র প্রদর্শনী-তে পোর্সেলিনের একখানি সাদা ইউরিন্যাল লাগিয়ে দিলেন দেওয়ালের গায়ে। ঠিক যেমন সাদা ইউরিন্যাল আমরা শপিং মল বা রেল স্টেশনে ব্যবহার করি। চারিদিকে হই হই পরে গেল। বোদ্ধারা ছেঁকে ধরলেন মার্সেল-কে, তাঁদের প্রশ্ন এই, “এই জিনিস কি করে আর্ট হয়”? মার্সেল দ্যুসোঁ নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি বলছি তাই এটা আর্ট”। আমি শিওর ছিলাম সেদিন শেফ-কে জিজ্ঞেস করলে ঠিক উত্তর-টাই আমি পেতাম! ... ...
আমাকে এই বিখ্যাত সী-ফুড রেষ্টু্রান্টে এনে মেনু কার্ড দিয়ে বলা হল কি খাবে? ইংরাজীতে লেখা থাকলেও একটা খাবারের নাম বুঝতে পারলাম না! কিন্তু চাষার ছেলে হলেও বুদ্ধি খাটিতে চাল দিলাম ভাঙলেও মচকাবো না এই টাইপের। বললাম, "তোমরা যা রেকমেন্ড করবে তাই খাবো" বিশাল ভুল করলাম! এটা শুধু ঐতিহাসিক নয়, একেবারে প্রাগঐতিহাসিক ভুল যাকে বলে প্রায় কাঁচা চাল। দাঁতে কেটেই পাশের জনকে - চাল তো সেদ্ধ হয় নি! - মানে? আবার আমার অ্যান্টেনা সংকেত পেল। কিছু না বলে সেই প্রায় কাঁচা চাল খেলাম, মাঝে মাঝে চিঙড়ি, শামুক এই সব মুখে এল রিসোত্তো না কি যেন একটা নাম বলল! বিখ্যাত ইতালিয়ান ডিস নাকি এটা! ইতালিতে কি আগুনের অভাব নাকি যে ব্যাটারা চাল সিদ্ধ করে না! ... ...
খাবার আসতে দেরী আছে বলে উইলিয়ামকে গণার চপের গল্প শোনানো গেল। মেমারী স্টেশন বাজারে পুরানো দিনে নীরেন ময়রার দোকানের পাশে বিকেলে গণা এক ট্রে ভেজিটেবল চপ বিক্রী করত। সেই ট্রে খালি হতে আধ ঘন্টা আর প্রচুর খদ্দের ফিরেও যেত। কিন্তু গণা কোনদিন এক ট্রের বেশী চপ বানালো না! যত সহজে লিখলাম উইলিয়ামকে ভেজিটেবল চপ বোঝানো তত সহজ ছিল না। চপের ইংরাজি কি?? সে বোঝাতে গিয়ে যা সময় লাগল তাতে ধাড়ি ছাগলের মাংস কড়াইয়ে সিদ্ধ হয়ে যাবে! এবং সেই ততক্ষণ বাদেই সেই মেয়ে এই কারী এনে দিল! এক চামচ খেয়ে উইলিয়ামকে বললাম, নারকেলের দুধ আর কাজু মেশালেই কি আর থাই রান্না হয়! এর থেকে নিমোর তাপস, লাল্টু বা মুকুল অনেক ভালো রান্না করে! উইলিয়াম জানতে চাইল মুকুল কি কোন বড় শেফ? তাকে জানালাম মুকুলের গল্প করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে, এখন খিদের মুখে সেসব হবে না। তবে এটা জেনে যাও মদের চাট বানাতে মুকুলের ধারেপাশে কেউ আসবে নে! ... ...
সেদিন খাওয়া দাওয়া সেরে ফেরার সময় শেফ-কে বিদায় জানাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – এই রেষ্টুরান্টের তেমন বিজ্ঞাপন দেখি না কেন! আবারো সেই টিপিক্যাল উত্তর পেলাম – “দরকার পড়ে না”! রোজই সব টেবিল বুক থাকে, বেশীর ভাগ কাষ্টমারই রিপিট কাষ্টমার। টুরিষ্ট তেমন কেউ আসেই না এখানে – প্রায় চোখের আড়ালে তাদের। টেবিল রিজার্ভ না করে গেলে চান্স কম। তবুও কোন কোন টুরিষ্ট ঘুরতে ঘুরতে এখানে খেতে ঢুকে পরে এবং টেবিল খালি থাকলে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ধরে নিতে হবে। রিজার্ভ করলে পুরো সন্ধ্যেটাই সেই টেবিলে অতিথি কাটাবে ধরে নেওয়া হয় – ফলে টেবিল টার্ন-রাউন্ড এর কোন কনসেপ্ট নেই এদের। ধীরে ধীরে খাওয়া এবং পান চলতেই থাকে। এত বেশী সময় নিয়ে চলতে থাকে খাওয়া দাওয়া যে এর ফাঁকে একটা পলাশীর যুদ্ধ টাইপের ছোটখাট ইভেন্ট কিছু ঢুকে যেতেই পারে! ... ...
- কোনো ক্রাইসিস পিরিয়ডে ঘুম থেকে উঠে, আগে ভাত আর ডাল বসিয়ে দিতে হয় জানোনা। তুমি তো অনেকক্ষণ উঠেছো। ডালটা সিটি দেওয়া থাকলে, তাতে ডুবিয়েও তো সবাই পাঁউরুটি খেতে পারতো। তিনটে অসুস্থ, দুটো সুস্থ মানুষ খাবে কী এখন। ঘড়িতে সকাল দশটা বাজতে যায়? কর্তা দেখলাম জুৎসই উত্তর হাতড়াচ্ছেন। এমন সময় রান্নার মেয়েটি ঘর থেকে বেরোলো, আর বাংলার পাঁচ, ছয়, সাত সবরকম মুখ করে চাল ধুতে শুরু করলো। সহোদরাও বেরিয়ে পড়লো। আমাদের ঘরে তো আর অ্যাটাচড বাথ নেই। আর পতিদেব সুযোগ বুঝে - 'ওরে বাবা, চারদিকে করোনা বেরিয়ে পড়েছে, মাস্ক আমার মা - স্ক' - এই বলে এক লাফে বেডরুমে ঢুকে পড়লেন। আমি দাঁত কিড়মিড় করে ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, কর্তা একেবারে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়েছে আর দুটো চোখ বার করে দেখছে, আমি তাকে দেখছি কিনা। যেই আমি তাকিয়েছি, দেখি মুখে একটা অসহায় হাসি, এদিকে কম্বল থেকে একটা পা বার করে নাচাচ্ছে - পা দেখিয়ে আমায় রাগাচ্ছে। কী আর করি। পাত্তা দিলাম না। কিন্তু বুঝলাম মাটন স্টুটা আমাকেই রাঁধতে হবে। একমনে মহা করোনাঞ্জয় মন্ত্র আওড়ালাম - "মাটোন আমার কাঁটোন সই উনুনের ঝিক। রাম করোনা বুকে আছে পারবো আমি ঠিক।" ... ...
-দ্যাখো, বীনস, অ্যাসপারাগস, স্পিনাচ, ব্রকোলি এই সব তো দিন রাত খাইয়ে খাইয়ে আমাকে প্রায় শুঁয়োপোকা করে ফেললে -মানে কি বলতে চাইছো -তেমন কিছুই বলতে চাইছি না, শুধু তোমার নোটিশে আনতে চাইছি যে ঘাস পাতা খেয়ে খেয়ে আমার অবস্থা নিমো স্টেশনের ধারে সজনে গাছে থাকা শুঁয়োপোকা গুলোর মত হয়ে গেছে! দ্যাখোনি তুমি স্টেশনে শুঁয়োপোকা? -দেখেছি, কিন্তু তার সাথে তোমার কি সম্পর্ক ... ...
খাবারের বাছবিচারে প্রতাপ রায় সাবেক কলকাত্তাইয়া। রয়ালের চাঁপ, সাবিরের রেজালা, নিজামের রোল, চাচার ফাউল কাটলেটে এমনই আস্থা যে সে জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে পারেন না। তবে আশাভঙ্গও হয়। যেমন চাচার ফাউল কাটলেট। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যে আশাভঙ্গ প্রতাপ রায়ের হয়েছিল, আমার হল বছর তিন-চার আগে। চাচা তো ফুটপাত বদল করে উল্টোফুটে চলে এসেছে। সেজে উঠেছে নবসাজে। সে রূপ অবশ্য পাড়ার নতুন কাফে ডি তেলেভাজার থেকে থেকে কিছু ভিন্ন নয়। তবু এখনও ফাউল কাটলেটটি করে। কিন্তু সে শুষ্কং-কাষ্ঠং কাটলেট খেলে চাচার দোকানের ওপর শ্রদ্ধার থেকে অন্য কিছুর উদয় হয় মনে। শিককাবাব আর করে না। ... ...