এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  পর্যালোচনা (রিভিউ)  বই

  • গোরা নকশাল-এক উড়ে চলা ফিনিক্স পাখির গল্প  

    Sumona Choudhury লেখকের গ্রাহক হোন
    পর্যালোচনা (রিভিউ) | বই | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২১৩০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • "সেইসব গোরাদের, যারা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদের ফিরে আসার কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারিনি।" 
    -- ৬৪ পাতার এক বইয়ের উৎসর্গপত্রের কয়েকটা লাইন। যা আমার বইটি পড়ার সময় ত্বরান্বিত করেছিল। মাথায় ভীড় করে আসছিলো ড্রেনের ধারে, ময়দানে পড়ে থাকা, নদীতে ভাসা কিছু লাশেদের কথা। পুলিশ লকআপে হাঁটু থেতলানো, চোখ উপড়ানো কিছু মানুষের কথা। এক যন্ত্রণাবিদ্ধ অস্থির সময়---যা পড়েছিলাম। জেনেছিলাম। যে জানার শুরুটা হয়েছিল সাহিত্যের হাত ধরেই। জানার শেষের গন্তব্যটা এখনও জানা নেই। কিছু মানুষ বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। যারা একদিন দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে গৃহের নিরাপত্তা, সুখী সামাজিক জীবনের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে অনিশ্চিত এক পথে হাঁটা দিয়েছিলেন। পুলিশ লকআপে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেও যারা জেলের দেওয়াল জুড়ে সাদা-কালো হরফে বলে যেতে পেরেছিলেন---
    "ভাঙছি বলেই সাহস রাখি গড়ার
    ভাঙছি বলেই সাজিয়ে নিতে পারি
    স্বপ্নের পর স্বপ্ন সাজিয়ে তাই
    আমরা এখন স্বপ্নের কারবারি।"

    ---আমরা তাদের ফেরার নিরাপত্তা দিতে পারিনি। এই 'আমরা' শব্দটি কোনো এক জায়গায় পাঠক হিসাবে আমাকেও দগ্ধ করে দিয়ে যায়। তাই বইটির ভূমিকা অথবা ব্যাক কাভারে লেখা প্রকাশকের তরফে সতর্কবাণীর মর্মবস্তুটি উপলব্ধি করতে বিলম্ব হয় না। 'এক রম্য দুপুরের রোদে পিঠ ঠেকিয়ে এক নিঃশ্বাসে এই ছোট উপন্যাসটি পড়ে ফেলা সম্ভব নয়।' কোনোমতেই নয়। এ বই পাঠককে ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করে যায়। প্রশ্নের সামনে ঘুরপাক খাওয়ায় কেন 'তাদের ফেরার নিশ্চয়তাটুকু' দেওয়া গেল না? 

    নব্বই দশকের প্রারম্ভে আমার জন্ম। নকশাল আন্দোলন, নকশাল রাজনীতি সম্পর্কে জানার শুরু আরোও বহু পরে। দুহাজার পাঁচ-ছয়ের দিকে। ষাট-সত্তর দশকের সমাজ-রাজনীতি-সময়ের টালমাটাল অবস্থা চোখে দেখিনি। তবু যখন পড়ি --
    “আমরা সাহায্য চাইনি
    কারণ আমরা বদল চেয়েছি।
    চেয়েছি ক্ষিদের মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে
    একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।
    …কোনদিনই আমরা কমিউনিস্ট হতে চাইনি।
    এখন সময়
    মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।
    আমরা চাইনি ইজ্জত খুইয়ে ঘাড় হেঁট করে পেট ভরাতে।
    আমরা বদল চেয়েছি
    চেয়েছি ক্ষিদের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে
    একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।” 

    ---আমাকে ভাবায়। অনিমেষ, ব্রতী, দ্রৌপদী গায়েন হয়ে গোরা নকশাল, প্রিয়াংশু, সুশান্ত আমাকে ভাবিয়ে যায়। ছোটো টুকনুর 'যে উড়তে পারে সে-ই নকশাল' ভাষ্য আমাকে ভাবিয়ে যায়। নকশাল আন্দোলন কি আদতে এক নৈরাজ্যবাদী সংগ্রাম ছিল? কিছু দামাল মানুষের হঠকারিতা? নাকি অহিংসা আর শান্তির পথে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার তত্ত্ব-ই আসলে গণমানুষের মুক্তির উপায়? প্রশ্নের চক্রব্যুহে ভাসতে ভাসতে আমি শুধু ভেবে যাই। আবার, ক্ষুধার যন্ত্রণায়, নিজের অধিকার নিয়ে মানুষের মতো বাঁচতে চাওয়ার দাবী জানালে কেন গোরাদের পঙ্গু হয়ে ফিরতে হয়? সুশান্তদের নদীতে লাশ হয়ে ভাসতে হয়? ময়দানে ভোরে খুন হয়ে পড়ে থাকা কবির খুনের কোনও সাক্ষী থাকে না? ভাবনার দ্বন্দ্ব তৈরী হয় আমার মাঝে…। দ্বিধাজড়িত হয়ে মিহির সেনগুপ্ত পড়ি। 'টাঁড় পাহাড়ের পদাবলি' বইয়ের প্রথম পর্বে মিহির সেই সময়টার কথা-ই খানিকটা বলেছেন এইভাবে----

    'আমরা, যুবজনেরা দেখলাম, আমাদের ঘরে স্থান নেই, বাইরে স্থান নেই, সামনে এক ধূসর প্রান্তর। সেই প্রান্তরে একমুঠো মাইলোর জন্যেও মাইল-মাইল পথ জুড়ে মানুষের বুভুক্ষার মিছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়কালে যেসব প্রতিজ্ঞা অঙ্গীকারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তার কিছুই বাস্তবে রূপায়িত হচ্ছে না। ফলত, যুববিদ্রোহ। বাবা, জ্যেঠা, কাকারা তখন পুরোপুরি নিহিতস্বার্থ। নিহিতস্বার্থ বিদ্রোহ-বিপ্লব পছন্দ করে না। তাই সেই বিদ্রোহ দমনের জন্য এমন এক দমননীতির আশ্রয় গৃহীত হয়, যা স্বৈরাচারী লাতিন আমেরিকার জঙ্গি রাষ্ট্রপ্রধানদের পর্যন্ত লজ্জা দেয়। তাদের বোধকরি আহ্লাদও হয়েছিল এই ভেবে যে, এই তো দ্যাখ, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবস্থা। তা আমরা আর এমন কী বাড়াবাড়িটা করেছি!....... সেই ঘৃণ্য সময়ে যারা বিদ্রোহী হয়ে বাবা, কাকা, জ্যেঠাদের মূল্যবোধকে টুকরো টুকরো করে ভাঙছিল তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের সমস্যাগুলি বোঝার কোনো চেষ্ঠা করা হচ্ছিল না।.." 
    ---বুঝা-নাবুঝার দ্বন্দ্বের ঘূর্ণিপাক আবারও চলতে থাকে মাথার ভেতর। 

    বিশ্বের যে কোনো রাজনৈতিক গণআন্দোলনের সাথেই সাহিত্য-শিল্পের সম্পর্ক বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। সামাজিক সত্তা দ্বারা-ই যেহেতু মানুষের চেতনা নিয়ন্ত্রিত হয়, সামাজিক আন্দোলন, লড়াইয়ের প্রভাব মানুষের চেতনা ও বোধ থেকে উৎপন্ন কাজে প্রভাব ফেলবে--এ অতি স্বাভাবিক বিষয়। বাংলা সাহিত্য-গান-থিয়েটার-সিনেমার  ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা এই একই রূপ দেখতে পাবো। তেভাগা আন্দোলন থেকে নীল বিদ্রোহ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশভাগ, নকশাল আন্দোলন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের খাদ্য আন্দোলন থেকে শ্রমিক আন্দোলন---সবই বাংলা সাহিত্য-শিল্পের জগতকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে গেছে। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস-গল্প-কবিতা-সিনেমা তৈরী হয়েছে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে। কালবেলা, মহাকালের রথের ঘোড়া, হাজার চুরাশির মা, শ্রেণীশত্রু, শ্যাওলা পেরিয়ে দ্রৌপদী গায়েন সহ আরো সব অনন্য সৃষ্টি। একটা সময়কে তার যাবতীয় ব্যর্থতা-সফলতা-স্বপ্ন-নিরাশা-আশা দিয়ে এঁকে রাখার চেষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও গিয়ে কল্লোল লাহিড়ীর 'গোরা নকশাল' এই সমস্ত কিছু থেকে খানিকটা হলেও আলাদা হয়ে ওঠে। একদিন কিছু মানুষের দেখা স্বপ্ন আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে গড়ে তোলা আন্দোলন ও তার পরের স্বপ্নভঙ্গের সময়আখ্যান শুধু এ বইটি নয়। তারচেয়ে বেশী কিছু। যা ছাই থেকে আবার জন্ম নেওয়া ফিনিক্সপাখির মতো  নতুন জীবনের আকাঙ্ক্ষা, দিনবদলের স্বপ্ন দেখার প্রতিস্পর্ধার বীজ পুঁতে দিয়ে যায় আগামীর টুকনুদের মাঝে। বলে যায়- "টুকনু ভুলে যেও না একদিন কারা যেন সুশান্তকে খুন করেছিল। কারা যেন খুন করেছিল গণতন্ত্রকে..অধিকারকে..বেঁচে থাকার মূল মন্ত্রকে।..….ওরা আমাদের শুধূ জেলের মধ্যেই মারেনি ওরা আমাদের জ্যান্ত লাশ করে দিয়েছে।"   টুকনুরা ভুলে না। ফিনিক্স পাখির মতোই বহু বছর পরে এসে তা হয়তোবা আবারও একাত্ম হয়ে যায় জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশের লাঠি চার্জের সামনে সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে। 'আসমান পে ইনকেলাব লিখহা যায়েগা' উচ্চারণ করা ছেলেটার ঋজু স্বরের কাছে। বিভিন্ন জেলে বন্দী ছাত্র-যুবদের মাথা নত না করার জেদের সাথে। দেশের যে কোনও প্রান্তে যে কোনো সময়ে যে কোনও মানুষের মার খাওয়ার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাথে।  

    গোটা বই জুড়ে দেখানো হয়েছে ভিন্ন দুটি সময়ের সমান্তরাল ভ্রমণ। একদিকে দেশভাগের ক্ষত বয়ে বেড়ানো এক উদ্বাস্তু পরিবার। আরেকদিকে সত্তর দশকের এক অস্থির সময় ও তার পরবর্তী সমাজ-রাজনৈতিক ঘাত-অন্তর্ঘাত-দ্বন্দ্বের জীবন্ত রূপ। কি আশ্চর্য এক লেখক কল্লোল! দুটো ভিন্ন সময় একই সাথে নদীর  মতো বয়ে গিয়ে তার পরের সময়কেও হালকা ছুঁয়ে যাচ্ছে অথচ কোথাও পাঠককে হোচট খেতে হচ্ছে না। বহমান প্রবাহিকার মতো পাঠকও বয়ে চলে যাচ্ছেন  টুকনুর মণি, ঠাম্মা, বড়মার কাঁটাতার পেরিয়ে একা একা ইছামতি পার করার আঁধারে, ঠাম্মার লক্ষীর ঝাঁপিতে করে বয়ে নিয়ে আসা দেশের মাটিকে যত্ন করে পুজোর মূহূর্তে, সকালের রোদ ঢুকতে না পারা বালীর বাসায় সারা ঘর ছেয়ে থাকা উনুনের ধোঁয়ায়,  আবার কখনো জেল ফেরত এক পঙ্গু লোকের অমলিন হাসিতে ভরিয়ে দেওয়া টুকনুর সকালের কাছে, বন্ধ জুটমিলের শ্রমিকদের রক্তাক্ত আন্দোলনের কাছে, প্রিয়াংশুর খুলি ছিটকে পড়ার ভোরে, ১৩৮ নং বেডের লাল কম্বল গায়ে জড়ানো পেশেন্টের গায়ে এসে পড়া সকালের নরম রোদের কাছে। প্রতিটা বাঁকের দৃশ্যআখ্যানের কাছে। 

    বাংলা সাহিত্যে নকশাল আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময়ের পটভূমিতে রচিত অসাধারণ সব গল্প-উপন্যাস তো কম নেই, কিন্তু সে প্রেক্ষাপটে সেইসময়ে বা তার পরবর্তীতে কিছু মানুষের বোধ-চিন্তা-যাপনে যে দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল তার বীভৎসতা গোরা নকশাল স্পষ্ট করে  দেখিয়ে দিয়ে যায়। ঘুমন্ত টুকনুর কপালের চুল সরাতে সরাতে বিড়বিড় করা গোরা নকশালের বয়ান পাঠককের বুকেও তাই রক্তক্ষরণ ঘটায়--
    "প্রিয়াংশু অমিয়াকে নিয়ে ঘর করতে চেয়েছিলো। প্রিয়াংশু দেখতে চেয়েছিল আনন্দীর মুখ। প্রিয়াংশু দেখতে চেয়েছিল সবাই দুবেলা পাবে দুমুঠো ভাত। সবাই পাবে পরার কাপড়। মাথা গোঁজার ঠাঁই। শিক্ষার প্রাথমিক অধিকারটুকু। প্রিয়াংশু দেখে যেতে পারে নি। প্রিয়াংশুকে আমরা উপহার দিয়েছি এক খুলি বুলেট।….."
    ---পড়তে পড়তে মনে আসে পার্থ বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার কটা লাইন-- 
    'অন্ধকারের মাঠের দিকে যার গুলি খাওয়া শরীর
    দুদিন দুরাত্রি খোলা আকাশের নিচে পচেছে
    সেই ছেলেটা গান গাইতো – মুক্তির গান।' 

    ইতিহাসের দুই অদ্ভুত আর নৃশংস সময়কে এক মোহময় ঘোর নিয়ে পাঠকের কাছে বয়ান করে গেছেন কল্লোল। তাঁর ভাষার টানে, নির্ভার গদ্যে, লেখার ধরণের যাদুময়তায়। নিখুঁতভাবে আঁকা  প্রতিটা চরিত্রের মাধ্যমে। এক ছোটো ছেলের চোখে দেখিয়ে গেছেন ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস  দুই সময় ও তারপরবর্তী সময়কে। ঠিক যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরী War Horse সিনেমায় স্টিভেন স্পিলবার্গ এক কিশোর ও তার ঘোড়ার চোখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অমানবিকতা, নৃশংসতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কারখানা বন্ধের ফলে শুরু শ্রমিক আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে গোরা নকশাল, সুশান্ত, ঠুলি, মণি, ঠাম্মা, দিদা আর একটি পায়রাকে  নিয়ে টুকনুর গল্প বলা বয়ে চলে। নানান ঘাত-অন্তর্ঘাতের মধ্য দিয়ে।  

    গোটা বইটির প্রতিটি পর্বে সুত্রধরের কাজ করে গেছে অসামান্য কিছু কবিতা। কল্লোল লাহিড়ীর লেখার অসামান্য দিকটা হল, যেটা তাঁর ইন্দুবালা ভাতের হোটেলেও দেখা যায়, তাঁর ভাষা এবং গল্প বলার ধরণ। কোথায় কি বলতে হবে এবং যা  পাঠকের মস্তিষ্কের সাথে সাথে হৃদয়েও তীক্ষ্ণ খোঁচা দিয়ে যাবে, তিনি জানেন। তাই যখন তিনি গোরা নকশালের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করান 'গাছেরা ঘুমোলে কি ফুলেরাও ঘুমিয়ে পড়ে?, সে প্রশ্নের উত্তর সময়-প্রজন্মভেদে পাঠকেরও প্রশ্ন হয়ে ওঠে। গোটা বইটিতে যেন স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েও আরেক নতুন স্বপ্ন নির্মাণের গল্প বলে গেছেন কল্লোল। গঙ্গার ঘাটে সুশান্তের লাশের পাশে কোল থেকে টুকনুকে নামিয়ে যখন গোরা নকশাল বলে-- "বাড়ি চলে যাও টুকনু। আর ভুলে যেও না তুমি সুশান্তকে দেখেছিলে। কোনোদিন ভুলে যেও না তোমার সুশান্তকে কারা যেন মেরেছিলো।"  অথবা এই পর্বেরই শেষে যখন টুকনু সুশান্তের লাশ নিয়ে মিছিলের একেবারে সামনের সারিতে ঠুলিকে দেখে একটা বড় লাল পতাকা হাতে, আর ভাবে--"ঠুলির চোখে কি জল? না ঠুলির চোখে জল নয়। ঠুলির চোখে তখন সুশান্তের স্বপ্ন। এক খুন হয়ে যাওয়া মৃত কমরেডের কাছ থেকে এটাই তার একমাত্র উত্তরাধিকার।"-----দিনবদলের স্বপ্নের বীজমন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে উত্তরোত্তর প্রজন্মের মাঝে। 

    বইটির একদম শেষে ফুটনোট হিসেবে কল্লোল বলেছেন--'গোরা নকশাল সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এই আখ্যানে বর্ণিত কোন মানুষ, মানুষের জীবন, জীবনের ওঠা পড়া দুঃখ দুর্দশার সাথে জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তির সাদৃশ্য থাকলে তা নেহাতই কাকতালীয়।'  বই শেষের এই অংশটুকু পড়তে পড়তে কবি কৃষ্ণ ধরে'র 'একদিন সত্তর দশকে' কবিতাটা মনে আসে----
    “শিকারকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে
    অন্ধকারে মিলিয়ে যায় জল্লাদের গাড়ি
    শহরের দেয়ালে দেয়ালে পরদিন দেখা যায় তারই কথা
    সে নিদারুণ তৃষ্ণায় একবার জল চেয়েছিল
    যে যন্ত্রণায় নীল হয়ে একবার ডেকেছিল মাকে
    তবু স্বপ্নকে অক্ষত রেখেই সে
    বধ্যভূমিতে গিয়েছিল
    একদিন সত্তর দশকে।”

    গোরা নকশাল কোনো একক ব্যক্তির জীবনালেখ্য নয়। এ এক সময়ের, সম্মিলিত কিছু  মানুষের-- যারা কখনো দিনবদলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঘর ছেড়েছিল, যারা ফিরতে চেয়েছিলো আবার একটি সমতার যৌথ যাপনের সমাজব্যবস্থায়, কিন্তু রাষ্ট্র তাদের ফিরে আসার কোনও ব্যবস্থা করেনি, তাদেরকে বুঝতে চায়নি, নৃশংসভাবে খুন করেছে, পঙ্গু করে দিয়ে একটা ব্যর্থ অসমতার সমাজ-দেশ ছুঁড়ে দিয়েছে মুখের উপর---সেইসব সম্মিলিত মানুষের জীবনালেখ্য। পিঠে কাঁটাতারের দাগ নিয়ে সারাজীবন বুকের ভেতর হাহাকার নিয়ে যারা বেঁচেছে, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নিশ্চিন্ততার বিপরীতে যাদের উদ্বাস্তু তকমায় হাতে খালি থালা ধরিয়ে বুভুক্ষু লাইনে দাঁড় করিয়েছিল রাষ্ট্র--সেইসব সম্মিলিত মানুষের জীবনালেখ্য। তাই এই বইয়ের কোনো সাদৃশ্য-ই কাকতালীয় হতে পারে না। বরং বহু মানুষ সম্মিলিত এক রূঢ় সময়ের আলেখ্য হয়ে ওঠে। 

    কল্লোল লাহিড়ির সাথে পরিচয় ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের মাধ্যমে। কিন্তু তাঁকে আমি মনে রাখবো গোরা নকশালের মতো এক অসামান্য আখ্যানের জন্যেও। ইন্দুবালা, মণিরুল, মৈত্রী এক্সপ্রেস, স্বাধীন বাংলা রেডিও স্টেশনের বাঁশির সুরের সাথে টুকনু, গোরা নকশাল, প্রিয়াংশু, সুশান্ত, ঠুলিও  মাথা-মন জুড়ে চিরকাল থেকে যাবে। বারে বারে মনে করিয়ে দিয়ে যাবে--"কারা যেন খুন করেছিল গণতন্ত্রকে..অধিকারকে..বেঁচে থাকার মূল মন্ত্রকে।…." 
     
     
    বই: গোরা নকশাল
    লেখক: কল্লোল লাহিড়ী
    প্রকাশক: গুরুচন্ডা৯
    দাম: ৬০ টাকা
     
     
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • পর্যালোচনা (রিভিউ) | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ২১৩০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন