এই বহুচর্চিত সিনেমাটি শুরু হল কিভাবে? লিখছেন শুরুর কুশীলবদের একজন।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে কৌশিকের ফ্ল্যাটে আমি আর কৌশিক মুখোমুখি বসে, ওর সামনে রাখা ছোটো কালো নরম গোলাকার একটি পিণ্ড, আমার সামনে রাখা একটি গ্লাসে চায়ের লিকারের রঙের তরল, বাইরে বিকেল চলে গেছে, সন্ধ্যা তখনও আসেনি, ঘরের আলো জ্বালা হয়নি, ফলত ঘর থেকে বাইরে তাকালে যে আলো, কেউ ভাবলে ভাবতে পারে যে ভোর হচ্ছে, এখুনি সূর্য উঠবে, আসলে এইমাত্র সে ডুবলো। সূর্যের এই ডুবে যাওয়াকে আমি অনেকবার সূর্যোদয় বলে ভুল করেছি। এবারো করলাম আর তখন আমাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হয় তা এই –
১
কৌশিকঃ আমরা ফিল্ম নিয়ে কী করতে চাইছি সেটা এই কলকাতায় কেউ বুঝতে পারছে না।
সুরজিৎঃ কেন? আমাদের ভাষা বুঝতে পারছে না? নাকি স্টাইল বুঝতে পারছে না?
কৌশিকঃ কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। এতদিন কলকাতায় কাজ করছি, ‘লাভ ইন ইন্ডিয়া’র মতো ডকুমেন্টারি ফিল্ম, যা ইউরোপের সব কটা মেজর টিভি চ্যানেল দেখিয়েছে, এরকম একটা ছবি করার পরও আমরা কোনও প্রোডিউসার পাচ্ছি না।
সুরজিৎঃ বুঝতে পারছে না কেন ?
কৌশিকঃ আমরা গান্ডু বলে। ওদের বোঝাতে পারছি না
সুরজিৎঃ নাকি ওরা গান্ডু বলে, বুঝতে পারছে না?
কৌশিকঃ আমাদের সবার মধ্যে একটা গান্ডু লুকিয়ে আছে।
সুরজিৎঃ তবে কি ওদের ভেতরের গান্ডুকে আমরা চিনতে পারছি না? তাই আমরা ওদের বোঝাতে পারছি না?
কৌশিকঃ অথবা ওরা আমাদের ভেতরের গান্ডু কে চিনতে পারছে না, তাই বুঝতে পারছে না।
সুরজিৎঃ তাহলে আমাদের আর ওদের গান্ডুর মধ্যে একদিন পরিচয় করিয়ে দিলেই হয়।
কৌশিকঃ তার আগে আমাদের গান্ডুর ব্যাপারটা লিখতে হবে।
সুরজিৎঃ বেশ। আমরা যেভাবে গান্ডুকে চিনি, সেটা লিখে ফেলা যাক।
কৌশিকঃ গান্ডুর নাম জানি না, ওকে সবাই গান্ডু বলে ডাকে।
সুরজিৎঃ ও তো নিজের আসল নাম বলে না, বলে আমি গান্ডু।
এই ভাবে শুরু হল গান্ডুর গল্প লেখা।
২
অভ্র বসু তাঁর ‘বাংলা স্ল্যাং – সমীক্ষা ও অভিধান’ গ্রন্থে লিখেছেন গান্ডু একটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ – ১. বালিশ। ২. যৌনইঙ্গিতবাহী গালাগালি। ৩. বোকা। ৪। বদমায়েশ।
সত্রাজিৎ গোস্বামী তাঁর ‘বাংলা অকথ্য ভাষা ও শব্দকোষ’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন গান্ডু র অর্থ ১. বালিশ ২.অনুভূতিহীন নির্বোধ ব্যাক্তি।
‘বালিশ’ ব্যাপারটা আমার বেশ লেগেছে। বালিশ নিজে একটি জড় পদার্থ, তার কোনও অনুভুতি নেই। কিন্তু আমাদের জীবনে ‘বালিশ’ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। তাই আমাদের সমাজে গান্ডুও একটি প্রয়োজনীয় চরিত্র, গান্ডুকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না।
তো এই গান্ডু সকালে পাড়ার চায়ের দোকানে চা খেতে গেছে। সেখানে পাড়ার দুটো ছেলে লালু আর তোপসে বসে চা খাচ্ছে। তাদের মধ্যে এরকম কথাবার্তা হয়।
লালুঃ ওই দ্যাখ গান্ডু এসেছে।
তোপসেঃ আচ্ছা, এ মালটাকে দাসবাবুর নতুন ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে দেখেছি।
লালুঃ আরে দাসবাবু তো ওর মায়ের টেকার। লাস্ট চার বছর ধরে রেগুলার নিচ্ছে।
তোপসেঃ ওই জন্যে শালা মা আর তার গান্ডু ছেলেকে নিজের একটা ফ্ল্যাটে রেখেছে। উফ, মা টা যা সেক্সি না ফাটিয়ে...
লালুঃ ওখানে লাগাতে যেও না, দাসবাবু কেটে হাতে ধরিয়ে দেবে।
এই সব শুনে গান্ডু এক চুমুকে চা টা মেরে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়। কোথায় যাবে সে? ওর কোনও বন্ধু নেই। পাড়ার সাইবার কাফে ‘দাসনেট’, সেখানে যায়। ঘন্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে পর্ন সাইট সার্ফ করে। ওর কোনও পয়সা লাগে না, কারণ মালিক দাসবাবু। দুপুরে বাড়ি আসে। মা খেতে দেয়, গান্ডু খায়। এরপর দাসবাবু আসে হুইস্কির পাঁইট নিয়ে। মা আর দাসবাবু ঘরে ঢুকে যায়। মুশকিল হল নতুন ফ্ল্যাট। ঘরে দরজার বদলে নীল প্লাস্টিকের পর্দা ঝোলানো। তাই ঘরের ভেতরের সব আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যায়। গান্ডু খেতে খেতে দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের শীৎকার শোনে। এক সময় অসহ্য হলে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। ছোটো ফ্ল্যাট সেখানেও পর্দা পেরিয়ে শীৎকারের শব্দ এসে পৌঁছয়। গান্ডু কী করবে ভেবে পায় না, প্রচণ্ড রাগে জলের কুঁজো লাথি মেরে ভেঙে ফেলে। সারা ঘর জলে ভরে যায়। তার মধ্যে উলঙ্গ গান্ডু শুয়ে থাকে।
৩
নেট সার্ফ করতে করতে একদিন গান্ডু আমেরিকান র্যাপ মিউজিক শুনে ফেলে। ব্যাপারটা ওর খুব ভাল লাগে। নেটে র্যাপ শুনে শুনে ও নিজের মোবাইল ফোনে কিছু গান ডাউনলোড করে আর সর্বক্ষণ কানে হেডফোন গুঁজে ওই গান শোনে। একদিন হেডফোন কানে গুঁজে রাস্তায় একটু হিপ হপ স্টাইলে বডি নাচাচ্ছে এমন সময় একটা রিক্সা ওকে ধাক্কা মারে। গান্ডু ছিটকে পড়ে। ঝটতি উঠে বলেঃ
গান্ডুঃ কী রে কানাচোদা দেখে চালাতে পারিস না? হর্ন নেই?
রিক্সাওয়ালা গান্ডুকে এক চড় মেরে বলেঃ
রিক্সাঃ কালাচোদা কানে প্লাগ লাগিয়ে রাখলে আর শুনবি কী করে?
একটু হাতাহাতি হয়। রিক্সাওয়ালা কুং ফু স্টাইলে মারে। যদিও সে মার্শাল আর্ট জানে না, কিন্তু ওরকম হাত পা চালায়। গান্ডুই মার খায়। শেষে যে যার পথ ধরে।
কিন্তু এরপর থেকে গান্ডু আর রিক্সাওয়ালার রাস্তায় দেখা হলে ওরা একে অপরকে দেখে মুচকি হাসে। একদিন দেখা গেল গান্ডু রিক্সায় বসে আর রিক্সাওয়ালা হাসি মুখে ওকে নিয়ে চলেছে। রিক্সা গিয়ে থামে রেললাইনের ধারে। রিক্সাওয়ালা রিক্সাটাকে একটা ভাঙ্গা টিউবওয়েলের সঙ্গে চেন দিয়ে বেঁধে তালা দিয়ে চাবিটা পকেটে রেললাইনে ওঠে। দাঁড়িয়ে থাকা একটা মালগাড়ির পাশ দিয়ে খানিকটা হেঁটে দরজা খোলা একটা খালি মালগাড়ির খোলে ওরা উঠে পড়ে। সেখানে রিক্সা (রিক্সাওয়ালাকে গান্ডু ‘রিক্সা’ বলে ) গান্ডুকে প্রথম পাতা খাওয়ায়। পাতা খেয়ে ওরা দুজন মালগাড়ির দরজায় মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। বাইরে থেকে দেখা যায় দুটো মুন্ডু ঝুলে আছে।
গান্ডুঃ কী খাওয়ালি গুরু? এতো ফুল্টুস মস্তি।
রিক্সাঃ একি বাঁ...... তোর কানে প্লাগ গুঁজে গান শোনা নাকি? এ হল সারা বডিতে প্লাগ গুঁজে দেওয়া।
গান্ডুঃ কাল আবার আসবি তো?
রিক্সাঃ আমি তো রোজ আসি।
গান্ডুঃ এই ট্রেনটা চলছে নাকি?
রিক্সাঃ না, শান্টিং হচ্ছে।
ওদের দুজনের মাথা দুলতে থাকে।
গান্ডুঃ কী হবে তাহলে?
রিক্সাঃ কিছু হবে না।
গান্ডুঃ আমরা নামবো কী করে?
রিক্সাঃ ট্রেন থামলে।
গান্ডুঃ ততক্ষণ এখানে.......
রিক্সাঃ দোল খেয়ে যা।
গান্ডুঃ বাড়ি যাব না?
রিক্সাঃ বাড়িতেই তো আছিস।
গান্ডুঃ ওঃ, আই লাভ ইট।
রিক্সাঃ এবার বুঝেছিস তো মস্তি কাকে বলে? এ বাঁ..... তোমার দশ টাকার চোলাই প্যাকেট নয়।
গান্ডুঃ এ একেবারে সুপার ধুনকি।
রিক্সাঃ আর র্যাপ মারিও না কাল থেকে.......
গান্ডু; তুই বাঁ... র্যাপের কী বুঝিস? যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না। রিক্সাঃ তুই বোঝ তোর ওই ঝাঁটের র্যাপ...... এই ভাবেই গান্ডুর গল্প শুরু হয় আর চলতে থাকে।