১
গোড়ার কথাঃ শিজো বনাম হাইকু
শিজো। ছোট তিন লাইনের কবিতা। জাপানে যেমন হাইকু, কোরিয়াতে তেমনি শিজো। সংক্ষিপ্ত, শাণিত। সহজ, কিন্তু ভারী সুন্দর।
অনেকে বলেন, কবিতার ফর্ম হিসেবে শিজো নাকি হাইকুর চেয়েও প্রাচীন। হাইকুর মত শিজোরও আছে কিছু বজ্র-আঁটুনি নিয়মকানুন। একেকটা লাইনে থাকবে মাত্র চোদ্দ থেকে ষোলটা সিলেবল, বাংলায় যাকে বলে ‘দল’। তাই শিজোয় শব্দব্যবহার হতে হয় খুব সংযত, পরিমিত।
হাইকুর সঙ্গে তুলনা করলে অবশ্য বোঝা যায়, শিজোর এই লাইনের দৈর্ঘ্যও নেহাৎ কম নয় , কারণ হাইকুতে সাধারণতঃ প্রথম লাইনে পাঁচ, দ্বিতীয় লাইনে সাত আর শেষ লাইনে পাঁচ, এইভাবে সিলেবল-এর বিন্যাস হয়। মোট সতেরো। হাইকু তাই আরও ছোট্ট। এখানে একফাঁকে মনে করে নেওয়া যেতে পারে মাৎসুয়ো বাশোর সেই বিখ্যাত হাইকুটিকে, ইংরেজি অনুবাদে যাকে লেখা হয় : “An ancient pond/ a frog jumps in/ the splash of water”, রবীন্দ্রনাথ যার বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ‘পুরোনো পুকুর/ ব্যাঙের লাফ/ জলের শব্দ’। ভাষান্তরের সময়ে ওই মাত্রা-সিলেবল এর চুলচেরা হিসেব মানেননি তিনি। সেটা সম্ভবও নয় কারণ দুটো ভাষার গঠনরীতি পুরো আলাদা।
কোরিয়ান শিজো অমন সাতে-পাঁচের নিয়মে থাকে না, তার দৈর্ঘ্য আরেকটু লম্বা-- তিন লাইন মিলিয়ে চুয়াল্লিশ থেকে ছেচল্লিশ সিলেবল। সেই জন্য হাইকুতে যেমন একটা লাইন শুধু একটাই দৃশ্য দেখায়, শিজোর একেকটা লাইনে ধরে যায় দুটো টুকরো ছবি। লাইনের মাঝখানে ছোট্ট একটা বিরতি পড়ে, যার দুপাশে থাকে সে দুটো বাক্যাংশ।
গোলমেলে ঠেকছে কী? একটা উদাহরণ দিয়েই না হয় শুরু করা যাক তবে।
দশটা বছর ব্যয় করে এই পর্ণকুটির তৈরি করা
আধখানা তার বাতাস থাকে, আধখানা তার চাঁদের বাড়ি
কোথায় তোমায় বসতে দেব? বরং তুমি বাইরে এসো।
সং সুন নামে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের এক কোরিয়ান কবির লেখা । রাজদরবারে কাজ করতেন আগে, পরে সব ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যান, লেখালিখি নিয়েই জীবন কাটান। এই কবিতাটার পিটার লি-কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমি বাংলা করেছি। এখানে যদি একেকটা লাইনকে দেখা যায় আলাদা করে, বোঝা যাবে প্রত্যেকটায় আসলে দুটো বাক্যাংশ আছে, দুটো ছবি। প্রথম লাইনেই যেমন দুটো স্টেটমেন্ট, একটা বলছে দশ বছর পরিশ্রমের কথা, অন্যটা বলছে বাড়ির কথা। দ্বিতীয় লাইনে তো আধাআধি ভাগ হয়ে গেছে লাইনটাও, বাড়িটারই মত... যার অর্ধেকটায় থাকে বাতাস, আর বাকি অর্ধেকটায় চাঁদ। শেষ লাইনেও অমন দু ভাগ, প্রথম অংশটা বলছে বাড়িতে ঢুকতে/বসতে দেবার জায়গা নেই (যেহেতু বাতাস ও চাঁদ আগেই সবটা দখল করে রেখেছে), আর শেষ টুকরোটা জানাচ্ছে, বাড়ির বাইরেই বরং অতিথিকে গ্রহণ করা হবে।
ছোট্ট একটা ছিমছাম কবিতা। তিন লাইনের জাফরির ফাঁক দিয়ে আসা একটুকরো গল্পের আভাস। শিজো আসলে এরকমই।
২
শিজোর রেসিপি
আগেই লিখেছি, শিজোতে তিন লাইন মিলিয়ে মোট চুয়াল্লিশ থেকে ছেচল্লিশটা সিলেবল থাকে। লাইন পিছু চোদ্দ থেকে ষোলটা।
ইংরেজি অনুবাদের সময়ে সচরাচর সিলেবল-এর হিসেব একদমই মানা হয় না, এমনকি লাইনের হিসেবও নয়। বাংলায় সেটা করা বরং তুলনামূলকভাবে কিছুটা সহজ। আমি অনুবাদ করার সময়ে ষোল মাত্রার স্বরবৃত্তের ছাঁচ রাখার চেষ্টা করেছি, যাতে সিলেবল-এর হিসেবটা বজায় থাকে মোটামুটি (মানে ছেচল্লিশ সিলেবলের উর্ধ্বসীমাটা আরেকটু বাড়িয়ে আটচল্লিশ বানালাম আর কি!) আর ছন্দটাও খানিক ফিরিয়ে আনা যায়। যদিও কোরিয়ান শিজোতে সিলেবল বিন্যাসের হিসেবটা আরও জটিল, সেগুলো কয়েকটা শব্দবন্ধে ভাগ হয়ে এরকম দেখায়
১ম লাইন – ৩ -৪ -৪ – ৪ (বা ৩)
২য় লাইন - ৩ -৪ -৪ – ৪ (বা ৩)
৩য় লাইন -৩-৫-৪-৩
এ তো গেল শিজোর শুষ্ক গঠনগত দিকটা - খাঁচার গড়ন, যন্ত্রপাতি আর কলকব্জা। তার ভেতরের কবিতাটা কেমন হবে? নিয়ম আছে তারও। প্রথম লাইনে বিষয়টার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে, দ্বিতীয় লাইনে সেটাকেই দেখানো হবে সবিস্তারে। তৃতীয় লাইনে এসে কিন্তু একটু পালটে যাবে বিষয়মুখ, আসবে একটা ছোট্ট টুইস্ট (কিম্বা, ক্ষেত্রবিশেষে একখানা বড় ক্লাইম্যাক্স)... মোটমাট প্রথম দু লাইনের থেকে একটু বদলে যাবে স্বর।
যেমন আগে দেওয়া কবিতাটায় প্রথম লাইনে এসেছে বাড়িটার উল্লেখ। দ্বিতীয় লাইনে তারই বিস্তারিত বর্ণনা। শেষ লাইনে কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত নতুন সুর এসে গেছে... একজন অতিথির কথা, একজন ‘তুমি’, যাকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া যাচ্ছে না। এটাই শিজোর বৈশিষ্ট্য। একটা ছোট্ট মোচড় শেষে, একটা আলতো বিষয়ান্তর।
ব্যস, শিজো মানে এই-ই।
শেষ লাইনে টুইস্টের কথা বললাম ঠিকই, কিন্তু শিজো সেই অর্থে ওপরচালাক কবিতা নয় মোটেই। পাঠককে চমকে দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। শিজো আসলে খুব সরল, এবং গভীর। প্রাচ্যের দেশগুলোতে, তা চিন হোক জাপান হোক আর কোরিয়াই হোক, কবিতার মূলসুরটা তো খুব সহজ তারে বাঁধা থাকে। হয়তো প্রকৃতির বর্ণনা, হয়তো কবির সুখ বা দুঃখের একটুকরো ছবি, এইটুকুই। শেষ লাইনে যেটা আসে সেটা ওই একই ছবিকেই হয়তো একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে নেওয়া।
আর হ্যাঁ, শিজো কিন্তু গান হিসেবেও গাওয়া হত। সুর-টুর দিয়ে, বাঁশির সঙ্গে। অনেক সময়েই সেগুলো হত তাৎক্ষণিক, কোনও জলসায় বসে তখখুনি কথা বসিয়ে সুর দিয়ে গেয়ে ফেলা। সেকালে আমাদের দেশেও কবিয়ালরা যেমন করতেন। কাজেই কবিদের শিজো-নির্মাণের নিয়মকানুন, অক্ষর আর সিলেবল-এর বিন্যাস একদম ভালোভাবে রপ্ত থাকতে হত, যাতে যে চট করে কথা বসিয়ে ওই ফর্ম্যাটে যেকোনও বিষয়ের ওপর কবিতা কিম্বা গান বেঁধে ফেলা যায়।
৩
সবচেয়ে পুরনো শিজো
প্রথম শিজোর জনকের মর্যাদা দেওয়া হয় উ তাক নামের এক কবিকে। মোটামুটি তেরোশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি, এই তাঁর জীবনকাল। সেই আদি শিজোর চেহারা একবার দেখে নিই -
East wind that melt the mountain snow
Come and go, without words.
Blow over my head, young breeze,
Even for a moment, blow.
Would you could blow away the grey hairs
That grow so fast around my ears.
এই ইংরেজি অনুবাদটা পিটার লি-র ‘অ্যান্থলজি অফ কোরিয়ান পোয়েট্রি ফ্রম দ্য আর্লিয়েস্ট এরা টু প্রেসেন্ট’ থেকে নেওয়া। তিন লাইনের শিজো অনুবাদে হয়ে গেছে ছ লাইনের। কারণ শিজোর প্রত্যেকটা পংক্তিতে, আগেই বলেছি, দুটো বাক্যাংশ থাকে। ইংরেজি রূপান্তরের সময়ে সচরাচর সেগুলোকে আলাদা বাক্য হিসেবেই অনুবাদ করা হয়। অর্থাৎ এখানে প্রথম দু লাইন নিয়ে মূল শিজোর প্রথম পংক্তি, তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন নিয়ে মূল শিজোটির দ্বিতীয় পংক্তি, আর শেষ দুলাইন নিয়ে আসল শিজোর অন্তিম পংক্তি।
বাংলায় যদি মূল তিন লাইনের ধাঁচটা ফিরিয়ে আনতে চাই, খানিকটা এরকম দেখাবে –
পূবের হাওয়া তুষার গলায়, তার যাতায়াত শব্দবিহীন,
বও হে আমার মাথার ওপর তরুণ বাতাস, একটি নিমেষ।
কানের পাশে বাড়তে থাকা শ্বেত চুলেদের নাও উড়িয়ে।
বোঝাই যাচ্ছে, বেড়ে যাওয়া বয়েসের চিহ্ন কবি রাখতে চান না, বেশ আক্ষেপ আছে তাঁর ওই পক্ককেশ নিয়ে।
কোরিয়ান কবিতার ইতিহাস কিন্তু আরও প্রাচীন। খ্রীষ্টের জন্মের সময়ে এদেশে গোগুরেয়ো নামে এক সাম্রাজ্য ছিল, যাঁর এক রাজার নাম ছিল য়ুরি। প্রাচীনতম কোরিয়ান কবিতার যে হদিশ পাওয়া যায়, সেটা এঁর লেখা। “হলুদ পাখির গান” বলে পরিচিত সে কবিতায় রাজা বলছেন “ পাখিদম্পতি কি সুন্দর একসঙ্গে আকাশে উড়ছে/ আমি কার সঙ্গে উড়ব, কার সঙ্গে বাসায় ফিরব?”। কিংবদন্তী, রাজার দুই রানি ছিলেন, হোওয়া-হি আর চি-হি, দুজনেই চীনদেশের কন্যা। তারপর যা হয়, দুজনের বনিবনা হচ্ছিল না মোটেই। শেষকালে যখন ‘এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি যান’-এর পরিস্থিতি হলো, রাজা মনের দুঃখে এই কবিতা লিখতে বসলেন।
এই কবিতাটা শিজো নয়। কিন্তু ভাবগত দিক থেকে শিজোর খানিকটা আদিপুরুষ তো বটেই।
৪
কয়েকটি শিজো
শিজো প্রধানত লেখা হত প্রেম-বিরহ-বিষাদ কিম্বা প্রকৃতিকে নিয়েই।
যেমন পঞ্চদশ শতকের কবি সোং-সাম-মুন-এর লেখা এই কবিতাটা। ইংরেজি শিক্ষার্থী কিছু কোরিয়ান ছাত্রছাত্রী মিলে তাদের দেশের কিছু কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিল একটা প্রোজেক্টে, সেখানেই এ কবিতা প্রথম পড়ি।
বাংলা ভাষান্তরে এরকম দাঁড়াচ্ছে -
আমায় যদি প্রশ্ন করো, মরার পরে কী হতে চাই,
দীর্ঘদেহী পাইন হবো, বং-নে পাহাড়চুড়োর ওপর ।
সবাই যখন বরফঢাকা, একলা আমিই থাকব সবুজ।
আরেকটা শিজো দেখা যাক।
দীর্ঘ শীতের রাত্রি কেটে করছি দুভাগ। আধখানা তার
লুকিয়ে রাখি লেপের নিচে। প্রেমিক আমার আসবে যেদিন,
ভাঁজ খুলে সব বিছিয়ে দেব, সে রাত যাতে অনন্ত হয়।
এটা লিখেছিলেন হোয়াং চিন-ই নামে ষোড়শ শতকের এক নারী। তিনি পেশাগত ভাবে ছিলেন গিসায়েং, খানিকটা আমাদের বাইজি বা নগরনটী ধরণের। এঁরা সাহিত্য, সঙ্গীত ও অন্যান্য কলাবিদ্যায় পারঙ্গমা হতেন। সমাজে এঁদের স্থান খুব যে উঁচু ছিল সেটা নয়, কিন্তু তাঁদের শিল্পকলার প্রতি সবারই একটা সম্ভ্রম থাকতো। হোয়াং-চিন-ই ছিলেন এই গিসায়েং দের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত – তাঁর চোখধাঁধানো রূপ, ক্ষুরধার বুদ্ধির গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরত । শিজো কবি হিসেবেও তাঁর নাম ছিল, যদিও তার অল্প কয়েকটাই এখন পাওয়া যায়। ওপরের কবিতাটা তার মধ্যে একটা।
এমন আরও অজস্র শিজো ছড়িয়ে আছে প্রাচীন কোরিয়ার সাহিত্য জুড়ে। যেমন, য়ুন সন দো নামে এক কবি (১৫৮৭-১৬৭১) ‘মৎস্যজীবীর দিনলিপি’ নাম দিয়ে অনেকগুলো শিজোর একটা লম্বা সিরিজ লিখেছিলেন। চার ঋতুর দেশ কোরিয়া – গ্রীষ্ম, অটাম, শীত ও বসন্ত। তাঁর কবিতায় একেকটা ঋতুকে বর্ণনা করা হয়েছে অনেকগুলো শিজো দিয়ে। এবং এই প্রত্যেকটা শিজোই একজন জেলের চোখ দিয়ে লেখা – যে স্রেফ নৌকো ভাসাচ্ছে জলে, আর দেখে নিচ্ছে নদীর দুপারে কেমনভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতু, বদলাচ্ছে জীবন।
৫
ইতিহাসঃ কবিতার আয়নায়
কোরিয়ার ইতিহাসের খুব নামজাদা কিছু মানুষেরও শিজো-লিখিয়ে হিসেবে পরিচিতি ছিল। রাজা বা রাজ-অমাত্য কিম্বা সেনানায়ক, অনেকেই ছিলেন কবি। তাই এঁদের লেখায় ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছায়া ফেলে গেছে, যদিও খুব সরাসরি বিবরণমূলক কিছু লিখতেন না ওঁরা ।
কোরিয়ার জোসন রাজবংশ রাজত্ব করেছিল চতুর্দশ শতক থেকে উনবিংশ শতক পর্যন্ত। সুশাসক, প্রজাপালক হিসেবে সুখ্যাতি ছিল জোসন রাজাদের। কনফুসিয়ান আদর্শে বিশ্বাস করতেন বলে তাঁদের জীবনযাপনও ছিল ভারী অনাড়ম্বর। এই বংশেরই এক রাজা সেওং জোং সাহিত্য, শিল্পকলায় খুব আগ্রহী ছিলেন। তাঁর লেখা একটা কবিতা -
যাচ্ছ তুমি? যেতেই হবে? কেনই বা যাও? ক্লান্ত বলে ?
কিম্বা কোনও বিরক্তি, ক্ষোভ? কেউ কি তোমায় বললো যেতে?
যাবেই যখন, তোমার চোখে অমন কাতর দৃষ্টি কেন !
এক প্রিয় অমাত্য নাকি তাঁর রাজসভা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন রাজা এই তিন লাইন লেখেন।
কোরিয়ার জাতীয় বীর হিসেবে যাঁরা সম্মান পান, তাঁদের একজন হলেন ষোড়শ শতকের নৌ-সেনাধ্যক্ষ য়ি-সুন-শিন। ইনি ১৩ টা রণতরী নিয়ে জাপানের ১৩৩ টা রণতরী-সমৃদ্ধ বিশাল নৌবহরকে পরাস্ত করেছিলেন। রাজধানী সোলের ব্যস্ততম চত্বরে তাঁর বিশাল মূর্তি বসানো আছে, এমনকি দক্ষিণ-পূব উপকূলের জিনহে নামের এক শহরে কোরিয়ান নৌবাহিনীর অ্যাকাডেমিতে সযত্নে রাখা আছে তাঁর কচ্ছপমুখো নৌকোর রেপ্লিকা।
তাঁর লেখা একটা শিজো -
দেখছি আকাশ, ঝলমলে চাঁদ। দুর্গপ্রাচীর, একলা বসে,
হস্তে কৃপাণ। রাতপাহারায় জাগছি, বেজায় শঙ্কিত মন ।
কোথাও দূরে বাজছে বাঁশি। ভয় কি তাতেই ছিন্ন হবে?
সেনানায়কের কবিতা যেমন হওয়া উচিত আর কি!
প্রাচীন জাপানে এবং কোরিয়ায় ‘ডেথ পোয়েম’ বলে একধরণের কবিতার চল ছিল। জাপানে বীর সামুরাইরা হারাকিরি করবার আগের মুহূর্তে কবিতা লিখতে বসে যেতেন। কোরিয়াতেও মৃত্যুর আগে কবিতা লিখবার রেওয়াজ ছিল এমন। কিন্তু সে কবিতায় আসন্ন মৃত্যু ততটা গুরুত্ব পেত না, বরং বীরের আত্মত্যাগ, মৃত্যুপরবর্তী জীবন, এসবই আসত। মৃত্যুর কথা যদি বা লেখা হত, সেটাকে নানারকম রূপকের আড়ালে রাখা হত, নিভে যাওয়া বাতি, অস্ত যাওয়া সূর্য, ইত্যাদি।
১৪৫৬ সালে জোসন বংশেরই সেজো নামে এক রাজপুরুষ তাঁর ভাইপো, তদানীন্তন রাজা দানজোংকে সিংহাসন-চ্যূত করে ক্ষমতা দখল করেন। পূর্বতন রাজার মন্ত্রী সভায় ছজন খুব জ্ঞানীগুণী মন্ত্রী ছিলেন। রাজা সেজো প্রথমে তাঁদের নিজের সভাতেও সমাদরে স্থান দেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই টের পাওয়া গেল, মন্ত্রীরা গোপনে পুরনো রাজা দানজোংকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তখন রাজা সেজো তাঁদের মৃত্যুদন্ড দেন, ভাইপো দানজোংকেও বিষ খাইয়ে মারার ব্যবস্থা করেন। মন্ত্রীদের অবশ্য একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, বলা হয়েছিল, পুরনো মনিবকে ত্যাগ করে নতুন রাজার আনুগত্য প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিলে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে। ছয় মন্ত্রীর কেউই তাঁদের আদি প্রভুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাজি হননি, মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিলেন। এবং হ্যাঁ, ডেথ পোয়েমও লিখেছিলেন।
ই-গে নামে এক মন্ত্রীর লেখা সেই প্রাক-মৃত্যু শিজো দিয়েই শেষ করা যাক –
জ্বলতে থাকা মোমের আলো, কার সাথে আজ রওনা দিলে?
সাশ্রুনয়ন, ভেতর থেকে পুড়ছ। সেসব কেউ বোঝেনি।
আমরা যাব প্রভুর সাথে, তোমার মতই দগ্ধ হব।
তথ্যঋণ –
১) Anthology of Korean poetry from the earliest era to the present : Peter H Lee, The John Day Company, New York
২) Shijo: Truly Corean Poetry Cadence Rhymed, Edited by Lee-Kyung-Hoon, Musong Publishing Company, Korea
৩) The Fisherman’s Calendar, Yun Sondo, Translated by Kevin O’Rourke, Eastward Publication, Korea
৪) Shijo Rhythms, Translated by Kevin O’Rourke, Eastward Publication, Korea
৫) Wikipedia