জয় গোস্বামীর সম্পূর্ণ বক্তব্যটি ভিডিও আকারে রয়েছে। সেটি নিচে দেওয়া হল। প্রকাশিত লেখাটি তার একটি অংশ। অনুলিখিত, এবং সে কারণেই, যৎসামান্য হলেও, পরিবর্তিত। ভিডিওতে পূর্ণাঙ্গ মৌখিক বক্তব্যটি শুনতে পাওয়া যাবে। এবং বক্তব্যের শেষে যে প্রশ্নোত্তর পর্ব আছে, সেটিও শোনা যাবে, যা এখানে লিখিত আকারে নেই। প্রশ্নোত্তরে অংশ নিয়েছেন গুরুচণ্ডালির পক্ষে প্রতিভা সরকার এবং সহযোগিতায় সুমন চক্রবর্তী।
বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে যা ভারতবর্ষ নামটির পক্ষে অপমানজনক। ভারতবর্ষ এমন এক দেশ যেখানে সমস্ত ধর্মের মানুষ স্থান পেতে পারে। ভারতবর্ষের চরিত্রই এমন। রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতার যা উচ্চারণ, তাকেই মিথ্যে করে দিয়ে এখন এই ভারতবর্ষেই এইসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকারকে, খন্ডিত করা হচ্ছে, তাকে অপমান করা হচ্ছে, এবং সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন করে দেওয়া হচ্ছে। বিল আনা হচ্ছে, পাশ হচ্ছে, এবং তা আইনে পরিণত হচ্ছে। কেন্দ্রে যেহেতু বিজেপি সরকার আছে, তাই এই আইনের বিরুদ্ধে যদি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া হয়, তাহলে আশঙ্কা করা যায়, যে, এই আইনের বিরুদ্ধে কোনোরকম বিচার প্রার্থনাকে তারাও খারিজ করে দেবে।
দ্বিতীয়ত আমাদের একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবেনা, যে, এই ভারতবর্ষে মুসলমানদের হাত থেকে আমরা কত শিল্প পেয়েছি, তাদের সঙ্গীত আমাদের কী ভাবে সমৃদ্ধ করেছে। মুসলমান ওস্তাদদের যন্ত্রে বাজানো এবং কণ্ঠে গাওয়া গান আমাদের এই উপমহাদেশকে, এই ভারতবর্ষকে কেমনভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এখানে যেমন হিন্দু গায়করা আছেন, তেমনই মুসলমান সঙ্গীত শিল্পীরা আছেন, বড় বড় মায়েস্ত্রোরা আছেন। সেখানে হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করবার, বিদ্বেষ জাগাবার প্রবল চেষ্টা করা হচ্ছে। একদিকে বিদ্বেষ তৈরি করা হচ্ছে, অন্যদিকে মুসলমানদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন করে দেওয়া হচ্ছে।
শুধু মুসলমানদেরই নয়, এই যে, এন-আর-সি, যা করা হবে বলে জানা যাচ্ছে, তা সমস্ত নাগরিককে নিরাপত্তাহীন করে দিচ্ছে। এটা একটা বর্বর এবং অত্যন্ত অন্যায় কাজ যা আইনের মধ্যে দিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। আমার স্ত্রী ফেসবুকে আমাকে একটা পোস্ট দেখিয়েছেন, তাতে একজন তরুণ বিজেপি নেতা, যাঁর নাম আমি জানিনা, কিন্তু তিনি কী বলছেন, সেটা আমি স্বকর্ণে শুনেছি। আমার স্ত্রী আমাকে ভিডিওটা দেখিয়েছেন। সেই ভিডিওতে তিনি বলছেন, যে, 'আগর ইস তহকে সওয়াল পুছোগে', সাংবাদিকদের বলছেন, সাংবাদিকরা টেলিভিশনের বুম হাতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, এবং তিনি বলছেন, 'আগর ইস তহকে সওয়াল পুছোগে, তো গৌরী লঙ্কেশকে ভাই বনকে পড়ে রহোগে'। এটা আমি নিজের কানে শুনেছি। এখানে আমাদের মনে পড়ে যায়, যে, ২০০২ তে, যে গুজরাতে নরহত্যা এবং ধর্ষণলীলা সংঘটিত হয়েছিল, সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই মুখ্যমন্ত্রীই আজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমরা কত ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে বাস করছি তা চিন্তা করা যায়না। আমার এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সে, আমি রাস্তায় বেরিয়ে যে আন্দোলন করব, সেরকম শারীরিক সামর্থ্য আমার নেই। আমি শারীরিকভাবে অনেকখানি অসমর্থ। কিন্তু আমার মনে হয় প্রত্যেক নাগরিকের রুখে দাঁড়ানো উচিত এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা উচিত।
তৃতীয়ত, শুধু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে বিভেদ তৈরি করছে তা নয়। এই যে বলা হচ্ছে ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত যারা, তাদের প্রমাণপত্র দিতে হবে, এ প্রমাণপত্র কী করে দেব। বলা হচ্ছে, তুমি যে ওদেশ থেকে চলে এসেছ, তোমার উপরে নিপীড়ন হয়েছে, সেই নিপীড়নের প্রমাণ দেখাও। সে সেই নিপীড়নের প্রমাণ দেখাবে কি করে? আমি অন্য দেশে ছিলাম, সেখানে আমি সংখ্যালঘু ছিলাম, সেখানে আমার উপর নিপীড়ন হয়েছে, আমি চলে এসেছি এই দেশে, সেই নিপীড়নের প্রমাণ আমি দেখাব কীকরে? আবার আমি যে এই দেশে জন্মেছি, এবং এই দেশের নাগরিক, তারই বা প্রমাণ দেখাব কীকরে? আমার নিজেরই কি বার্থ সার্টিফিকেট আছে? আমি যদিও এদেশে জন্মেছি, আমারই কি বার্থ সার্টিফিকেট আছে? আমার তো বার্থ সার্টিফিকেট পাওয়া যাবেনা। আমি দেখাব কীকরে? তা এই ভাবে প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনকে যেভাবে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে, অপমানের মধ্যে, প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এবং একই সঙ্গে বিদ্বেষের বীজ বপন করা হচ্ছে, তা চিন্তা করা যায়না। জামিয়া মিলিয়ায় পুলিশ ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের উপরে লাঠিচালনা করেছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পুলিশ ঢুকে লাঠি চালাচ্ছে, এবং সেটা দিল্লিতেই ঘটছে। আসামে যে অবস্থা, সেই অবস্থার জন্যও কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারই দায়ী। এই কেন্দ্রীয় সরকার বলছে যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, অনেক বেশিরকম আসন জিতে তারা ক্ষমতায় এসেছে। সেই জন্য তারা এই রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। আমার মনে হয়, যে, সমস্ত নাগরিকের একসঙ্গে অন্তত মনে-মনে এর বিরুদ্ধে না বলা উচিত। পথে নামা দরকার। আমার মতো দু-একজন হয়তো তাদের শারীরিক অসামর্থ্যের কারণে পথে নামতে পারবেনা। আজকেও যেমন একটা মিছিল আছে, কিন্তু সেটা বেলা ১২ টা, আমি সহ্য করতে পারবনা ওই রোদ্দুর, সেই জন্য যেতে পারলাম না। কবীর সুমন একটা মিছিল ডেকেছেন, সেখানে সকলের যাওয়া উচিত। এইভাবে প্রত্যেক নাগরিকের দরকার হচ্ছে না বলা।
আমি এখানে অসহায় বোধ করি, কারণ আমি এখানে একা কী করব। এর অন্তর থেকে বিরোধিতা করতে পারি। বা লেখায় বিরোধিতা করতে পারি। কিন্তু এরা বলে, 'ইস তরাকি সওয়াল পুছোগে তো গৌরী লঙ্কেশকে ভাই বনকে পড়ে রহোগে', এই কথা পত্রকারদের বলছে, এটা আমি নিজে কানে শুনেছি। এরা এই ভাবে কথা বলতে পারে। যখন অমিত শাহ মিটিং করতে কলকাতায় এলেন, তখন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হল। আর এখন যে কাজটা হচ্ছে, তা হচ্ছে, ভারতবর্ষের যে মূর্তি, ভারতবর্ষের যে ধর্মনিরপেক্ষ মূর্তি এবং যে ভারত সকলকে স্থান দিয়েছে, তাকে ভাঙার।
অভীক মজুমদার বলে একজন কবি আছেন, তিনি একটা কবিতায় লিখেছেন, শরণার্থী না অনুপ্রবেশকারী। যারা শরণার্থী, তাদের যদি অনুপ্রবেশকারী বলা হয়, তাহলে তারা কি কোথাও স্থান পাবেনা? তারা কোথায় যাবে? মেটিয়াবুরুজের দর্জিরা আজকে বলছেন, এই দেশ ছেড়ে আমি কোথায় যাব। আজকের কাগজে খবর আছে। মেটিয়াবুরুজের যে দর্জিরা, পুরোনো দর্জিরা রয়েছেন, তাঁরা বলছেন, এই দেশ ছেড়ে আমি কোথায় যাব। এই দেশ কি তাঁদের দেশ নয়?
এই শাসকরা, বিজেপি পরিচালিত যে কেন্দ্রীয় সরকার, তা অত্যন্ত অন্যায্য কাজ করছে এবং অত্যন্ত অন্যায় আইন প্রণয়ন করছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের একটা আশা আছে, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে এন-আর-সি করতে হবে। তাঁর মতো দৃঢ়চেতা একজন নেত্রী রয়েছেন, সেটা আমাদের মনে জোর দেয়, যে, তিনি একথা বলেছেন, যে আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে এন-আর-সি করতে হবে, যদি এন-আর-সি করতে হয়। তা, এখন আমার এইটুকুই বলার, যে, তিনি যে সাহসী এবং সবল পদক্ষেপ নিচ্ছেন এর বিরুদ্ধে, এর পিছনে সকলের সমর্থন দরকার, প্রত্যেক নাগরিকের সমর্থন দরকার। আমি তো ভাবতে পারিনা পশ্চিমবঙ্গ কোনোদিন বিজেপি কবলিত হবে, আমি ভাবতে পারিনা, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অন্তত এত সচেতন যে তারা বিজেপি কবলিত হবে এমন আমি ভাবতে পারিনা। সুতরাং আমার এইটা মত, যে আমরা যেন প্রত্যেকে অন্তত মনে-মনে না বলতে পারি, এবং আমরা এই আইনের দ্বারা পর্যুদস্ত হবনা, এমন মনোভাব নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলতে পারি। এবং আমরা যেন কোনোদিন ভুলে না যাই, যে, ২০০২ তে গুজরাতে যে নরহত্যা লীলা ঘটেছিল, তার যিনি প্রধান কারিগর ছিলেন, তিনি আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। একথা যেন আমরা কোনোদিন ভুলে না যাই, তাঁর ভাষণ শুনে এবম তাঁর নানা ধরণের চাতুরি দেখে আমরা যেন এটা ভুলে না যাই।
পারমিতা চ্যাটার্জি
এ এক অতি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এরা এমন একটি দল যাদের কাছে সাহিত্য সংস্কৃতি কৃষ্টি কিছুরই দাম নেই। দেশ তো শেষ হয়ে গেলো কিন্তু বাংলাকে বাঁচানোর জন্য আমাদের একসাথে চলতেই হবে। বিজেপিকে কিছুতেই বাংলায় আসতে দেওয়া যাবেনা।
ঠিক বলেছেন। শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতবর্ষ থেকে উৎখাত করতে হবে এই বিজেপি সরকারকে।