সেই ছেলেটা ভেলভেলেটা – ঝর্না বিশ্বাস
১
একটা ছেলে বাসা খুঁজতে গিয়ে অন্য বাসায় ঢুকল
বাড়িওয়ালা বলল,
- দেখ বাছা, ঘর আছে তবে দরজা নাই,
তার ওপর ওপরেতে ছাদ, জলও পড়তে পারে টুপটাপ্
বাকি ভাড়া বলতে অ্যাডভান্স –
ঝক্কি তো নেওয়া যায়না, কে কখন ফুরুত হয়ে যায়...
ছেলেটা বেশি কথা বলল না,
শুধু একটু অনুনয় বিনয় করল,
- একবার ঘর দেখতে চাই...
লোকটা অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে তাকে ওপরে নিয়ে এলো...
আর সেখানে জানালাটা অল্প খুলতেই হল
ঝুরমুর মত শব্দ...
ছেলেটা দেখল, ওটুকু দিয়েই
ওর সামনের জানালার আরেকজন
আকাশ দেখে যাচ্ছে...
তাই সে রাজি হয়েই হাত বাড়াল শুন্যতায় ...
২
ছেলেটা অষ্টমীর ফুল ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল,
এখানে নতুন বুঝি...
মেয়েটা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল
উম্হু - অনেকদিন...
এরপর আবার যখন তাদের দেখা হল তখন
অঞ্জলীতে দেওয়া ফুল ও বেলপাতাগুলো সরানো হচ্ছে...
ছেলেটা বলল,
যা হোক পূজো কেমন কাটল আপনার...?
মেয়েটা মোবাইলে আসা এত্তগুলো শুভেচ্ছাপত্র ওল্টাতে ওল্টাতে বলল,
দিব্যি!
তাহলে বিজয়া সম্মিলনীতে হয়তো আবারও দেখা হবে...
ছেলেটা তাই জিজ্ঞেস করে বসল,
আচ্ছা ওইদিন আসছেন তো...
মেয়েটাও হড়বড়িয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই –
এবারে আমি ও আমার স্বামী দুজনেই একই কবিতায়...
তাই না থেকে তো আর উপায় নেই,
তবে আপনি এলে জানাবেন কিন্তু আবৃত্তি কেমন হলো,
অপেক্ষায় থাকব...
৩
জানেনতো “যেমন খুশি সাজো” তে আপনার মত হওয়া সবচেয়ে কঠিন
ফটোতেই আস্ত মানুষটা আপনি যেভাবে তাকিয়ে থাকেন
যে কোন মেয়েরই হার্টফেল হতে পারে...
তাই অনুরোধ এ পাড়ায় ফটো তুললে কোণাকুনি তাকাবেন
ব্যাপারটা সোজা এসে আর আমাতে লাগবেনা...
৪
সেদিন দেখা হতেই ছেলেটি বলল,
- দেখ, এরপর আর কিচ্ছুটি লিখব না...
মেয়েটা হাসল...খুব হাসল...
মনে হলো গুড়ো গুড়ো মশকরা কিছু মিশিয়ে নিল তাতে...
[ কত বারই তো এমন হলো,
কি করে বিশ্বাস করি আজ... ]
কথাগুলো হাওয়ায় মেলাতে গিয়েও বাঁধা পড়ল...
মেয়েটা তখনই দেখল আর্ন্তজাল কবিতার এক নীল মলাট থেকে
ছেলেটা ওর নাম মিটিয়ে দিচ্ছে...
তাই ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল,
আর যেতে যেতে বলল -
পৃথক হওয়াটা এত সহজ হতে পারে জানলে
আমিও এমনটাই করতাম...
৫
টাইটানিক টু হবার প্রত্যাশা নিয়ে মেয়েটি দু হাত ছুঁড়ল
ছেলেটি জানত ডুবসাঁতারে এ মেয়ে পাকা
তাই বাঁচানোর চেষ্টা করা বৃথা...
যদিও কিছুদিন পর মেয়েটিকে আবার ফিরে পাওয়া গেল...
সে জানাল...জলে ভেসে থাকার দারুন মজা
তার ওপর একেবারে ডুবে গেলে
কে কতটা মনে রাখে জানা যেত না...
উত্তরে ছেলেটি আর কিছুই বলল না,
বরং পুর্নজন্মের একটি সিক্যুয়াল হবে ভেবে
কলম তুলে নিল...
৬
আজ কথাদের শুরুতেই মেয়েটি বলল,
আমার ভেতরের চড়াইগুলো সেই কবে উড়ে গেছে...
ছেলেটি তখন জল দেখছিল, জলের উপর ছায়া
দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর...
একটু পরেই ছলছলাৎ শব্দ - জলটাও ঘোলা হয়ে এলো...
আর গাছের ছবিটা অল্প হাল্কা হতেই, একটানা কতগুলো পাখি আবারও বলে উঠল -
থ্যাংকিউ – থ্যাংকিউ...এই দ্যাখো বাসা ফিরে পেয়েছি।
৭
ছেলেটা ও মেয়েটার এখন প্রায়ই দেখা হয়
ওরা কোন কবিতায় একসাথে ওদের ভালোলাগা জানায়
সাথে এও জানিয়ে দেয় একে অপরকে মিস করছে কতটা...
ছেলেটা যদিও এসবকে আজগুবি ভাবে...
ভাবে মিনিটের টাইমপাস...সে বয়স আর নেই ...
যে হাত বাড়ালেই বন্ধু হওয়া যায়...
৮
একটা উড়োজাহাজকে সেদিন ছাদের খুব কাছ ঘেঁষে উড়তে দেখা গেল
মেয়েটি আন্দাজ করল ওর জানালার ঠিক পাশে বসে
কেউ এক জন অন্য কথা ভাবছে...
তাই ও নিজেও জানালায় এসে বসল,
এবারে আর আকাশ নয়, মাটিতে নামতে হবে...
ছেলেটির সেদিন আসার কথা ছিল – এলো না।
মেয়েটি ভাবল ব্যস্ত কোথাও, হতেই পারে...
তাই ও গাছের ওপরে খুঁটখুঁট করা কতকগুলো কাঠবেড়ালিকে টা টা করে
চলে গেল...
এমন ঘটনা আবারও ঘটল তবে চরিত্রের বদল হলো শুধু...
মেয়েটি সেদিন এলো না, তাই ছেলেটি
বেলুনওয়ালার সাথে হাঁটতে হাঁটতে আরেকটু এগোতেই দেখল
অন্য একটি মেয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে...
তাই তাকে সঙ্গ দিতে মাস গেল ও বছর ।
১০
মেয়েটা শুরুতেই আপনি আপনি
ছেলেটা সহজেই তুমিতে নেমে এলো
তারপর প্রথম আলাপেতে যা যা হয় –
প্রিয় ফুল, প্রিয় কবিতা থেকে শুরু করে - বাড়িতে কয় জন...
মেয়েটা ততক্ষণে ভেতরের চেকলিস্টটা মেলাতে গিয়ে দেখল
এই মানুষটা সবেতেই ঠিক ঠাক-
তাই যাবার আগে মনে মনে বলে গেল...
আপনি ও আমি একই পাড়ার হলে
নির্ঘাত অন্য কিছু ঘটত।
১১
ওয়ান্স আপন আ টাইম দিয়ে যখন গল্প শুরু হয়
তখন প্রতিটা রাজকুমারীর একটি রাজপুত্র থাকে -
কিন্তু এখানে তেমন কোন রাজপ্রাসাদ নেই
শুধুই চ্যাটরুম আর দু - দুটো ফেক নাম...
মেয়েটা সেখানে তরতরিয়ে লিখে যায়
ও আবহাওয়া পূর্বাভাসের মতন জানান দেয়, সবেতেই সম্ভাবনা
ছেলেটিও তাই চলে যাবার আগে মিথ্যে মিথ্যে বলে
- কোথাও আজ ভীষণ ব্যস্ত, কথা দিয়ে এসেছি।
১২
“দারুন” বলার পর মেয়েটি আকাশেতে হাত বাড়ায় ও দেখে
ওরই মতন কতকগুলো দলছাড়া তারা
অনেকটা কোণ ঘেঁষে একা একা জ্বলছে...
ছেলেটা সেখানে নিজেকে মধ্যমণি ভাবে -
ভাবে, চাঁদ সেজে বেঁচে থাকতে হলে
আগেপিছে বহু কিছুকে তুচ্ছ করতে হয়
১৩
একবার মেয়েটার একটা গল্প হারিয়ে গেল
মেয়েটা অলিতে গলিতে কোত্থাও না পেয়ে যখন ফিরছে
তখন জগজিৎ জি হঠাৎই গেয়ে উঠলেন,
- ওহ্ খত কে পুর্জে উড়া রহা থা / হাওয়াও কা রুখ দিখা রহা থা...
কিছুটা বিশ্বাস হল - আবার হলও না
কারণ গল্পটা কাগজে হলেও মানুষটা ছিল সত্যি!
১৪
মেয়েটা আজ ফোন তুলেই অদ্ভুত প্রশ্ন করল,
-আচ্ছা দেখা হলেই সবাই “হ্যালো” বলে কেন?
ছেলেটা তখন ব্যাগবাক্স গুছোচ্ছিল,
বলল, আমি ঠিক জানিনা তবে যাবার আগে “বাই” বলে না “আসি”
যা হোক কিছু একটা ভেবে নিও
এই আমি চললাম।
১৫
মেয়েটা গম্ভীর হয়ে বলল,
- দেখুন আমাদের মাঝে কেমন সেতু তৈরী হয়ে গেল...!
ছেলেটা এপাশ ওপাশ ঘুরল কিছুক্ষণ
তারপর কিছুই না পেয়ে বলল...
- মানে?
- মানে এই যে আপনি ও আমি কোথায় দুজন
আবার কখনও দেখা নাও হতে পারে...
- তা ঠিক, তবে তোমার দিক থেকে এই সেতু চলাচল
বন্ধ রেখ,
নইলে তোমার উত্তরসূরী জানতে চাইবে – কে সেই মানুষ, কি তাঁর নাম
বলতে পারবেনা...
১৬
দরজা জানালার হিসেব করলে আমার এ ঘরটা কিন্তু
তোমার থেকে পিছিয়ে –
ছাদে তখনই তারা গোণা শেষ
তাই মেয়েটা উম্হু করে নীচে নেমে এলো...
হিসেবে যে একখানি ঘর সেদিন বাদ পড়েছিল
তার জানালাটা বাইরে থেকে দেখা যায়না
তবুও মেয়েটি জানে ছেলেটির ঐ বন্ধ ঘর একদিন
তাঁর হাতেই খুলবে...
১৭
ছেলেটা এক জায়গায় আঁকিবুকি কাটছিল
মেয়েটা তা দেখে বলল,
- আহা, মানচিত্র!
এ কথায় আরো কটা মেঘ জুড়ে গেল পৃষ্ঠায়
সাথে তাথৈ তাথৈ করে কিছু খাপছাড়া নদীও
মেয়েটা চিৎকার করে উঠল,
- এত জলের ভার সহ্য হয়না আর
তুমি বরং সব মুছে দিয়ে নতুন কিছু কর .....
ছেলেটা তাই কবিতা লিখতে বসল,
আর মেয়েটা "আজ উঠি" বলে সেই যে গেল
এতদিনে ফেরেনি।
১৮
ছেলেটার সাথে মেয়েটার এখন চিরকালের আড়ি
বহুদিন ওরা কথা বলেনা...এমনকি গল্পকথায় একে অন্যের নাম এলেও
এড়িয়ে চলে যায় –
তবু দুজনেই জানে কথাদের শুরুতেই একে অপরের কাছে সেই একই প্রশ্ন
উত্তরের ঝাঁপিতেও তাদের শব্দসংখ্যা এক -
শুধু ভাবভাব আর হবেনা...কোনদিনও না...
১৯
মেয়েটির দেওয়া গাল হোক বা গল্প
ছেলেটির বড় প্রিয় ছিল -
যদিও উপহারে দেওয়া সেই পেন না পেইন
একদিন সে বোঝা মত করে বলল,
- এইটা আপনার, নিজের করে রাখুন...
ছেলেটা সেই কথামত সঙ্গী করেছে দুটিকেই
পেন আঙুলে ব্যথা বাড়ালেও পেইন তেমন নয়
তাই এত বড় বড় কবিতাতেও দিব্যি লুকোনো যায় খারাপলাগাটা -
আর আবহাওয়া ভালো হলে অনেকেই বলে যান,
দারুন দারুন...এমন আরেকটা লিখুন না প্লিজ...
২০
শর্ত ছিল কথা হবে না আর
বছর এক দুই এবং আরো যা একসাথে অতিক্রম করবে
পর হয়েই থাকব – যদিও একটি ছেলেকে ধন্যবাদ না দিলে হয়না
ভাগ্যিস সে মুখবই বানিয়েছিল – আর তাতে তোমার বত্রিশটা বন্ধু, পঞ্চান্নটা লাইক
এটুকুতেই ভালো আছ জানা যায়, বাকি লাগেনা...
২১
আজ আবার একটা বারান্দা বিষয়ক গল্পে আপনি উনি উঠে এলেন
তাই এ পাঁচকাহন...নইলে হ্যাপিশ্যাপি ট্যাগখানা আমাতেও লাগানো
বোধহয় খেয়াল করেন নি।
এরপর যা দুছত্র লেখা হলো তা এই...
“মঞ্চের ঘোরানো সিঁড়ি ও পাশে বারান্দা...আজ ওখানে কেউ নেই”।
এবং পাদটীকায় – এ লেখা পড়ে ডিপ্রেশন ভাবা ভুল।
শেষ।।
এখন আমাদের মধ্যে গাছের সংখ্যারা বাড়ছে
বাড়ছে একটু একটু করে আকাশের বয়সও
তাও যত পরিযায়ী আমার এপাশ ওপাশে ছড়ালে
একবার করে উড়তে ইচ্ছে হয়
ইচ্ছে হয়, সময়ের ঘাড় ধরে বলি,
তুমি আর একা নও
আমিও তো কেমন তরতরিয়ে এগোচ্ছি।
পড়লাম জীবনের গল্প।
খুব ভালোলাগছে আপনাদের মতামত জেনে। অসংখ্য ধন্যবাদ। এমনিতেই চারপাশটা কেমন মনখারাপ আজ...
সবাই ভালো থাকবেন...
:)