অষ্টমশ্রেণীতে সবচেয়ে বড় সমস্যা শুরু হল অঙ্ক নিয়ে। সপ্তম পর্যন্ত পাটীগণিত নিজে নিজেই পারতাম। পঞ্চম আর ষষ্ঠশ্রেণীতে দাদু যা শিখিয়েছিল তাতেই হয়ে যেত। খুব সামান্য কিছু কখনও হয়ত দাদুকে জিগ্যেস করতাম, সেও নিজে তো জানিই একবার দাদুকে বলে নেওয়া। বীজগণিত শুরু হয়েছিল সপ্তম শ্রেণীতে, সে শুরুর দিকে অসুবিধে হলেও মোটামুটি পেরে গেছি। দাদু বীজগণিত দেখাতে চাইত না, আর হাফ ইয়ার্লির আগেই ছোটমামার বিয়ের দিনে দাদু সেই যে পড়ে গেল, আর তো কোন অঙ্কই দেখাতে পারল না। কিন্তু এখন তো বীজগণিত বেশ কঠিন লাগে, এমনকি পাটীগণিতেও মাঝে মাঝেই আটকে যাই। অঞ্জলীদি কতগুলো বাড়ীর কাজ দিয়ে রাখেন, না করে নিয়ে গেলে খুব বকেন তো বটেই, মা'কে বলেও দেন। মা ভাবে আমি মন দিয়ে করার চেষ্টা করি না, কখনও ঠাঁই ঠাঁই করে দুটো থাপ্পড় দেয়, কখনও আমার দ্বারা যে কিস্যু হবে না সেটুকু বলে নিজের কপালের দোষ দেয়। একদিন ভয়ে ভয়ে বড়মামার কাছে নিয়ে গেলাম অঙ্কের বই আর খাতা। বড়মামা খানিকক্ষণ দেখে করেও দিল অঙ্কটা, খানিকটা বুঝিয়েও দিল। তাতে বাকী অধ্যায়টা নিজে নিজেই করে ফেলতে পারলাম। সেই থেকে মাঝে মাঝেই অঙ্ক নিয়ে যেতে লাগলাম বড়মামার কাছে। বড়মামাকে এমনিতে আমার একটু ভয় ভয় লাগে, খুব একটা বেশী কথা বলে না। কোনোকারণে বড়মামার ভুরুদুটো প্রায় সবসময়ই অল্প কুঁচকে থাকে। বড়্মামা ওঠে খুব ভোরে, প্রায় দিদার সঙ্গে সঙ্গেই। সাড়ে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যায়, হেঁটে হেঁটে আটটার আগেই পৌঁছে যায় রিষড়ার অ্যালকালি। অ্যালকালির ভোঁ আমাদের বাড়ী থেকে শোনা যায় না, বেশ অনেকটা দূর। বেলা দশটা নাগাদ টিফিনওলা, একটা রোগা ছেলে সাইকেলের দুইদিকে অনেকগুলো টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলিয়ে এসে দাঁড়ায়। বড়মাইমা কিম্বা দিদা গিয়ে একটা ভাত, ডাল, মাছের ঝোল ভরা হিন্ডালিয়ামের তিনথাক টিফিন ক্যারিয়ার দেয় তাকে, সে শোঁও করে সাইকেল বেঁকিয়ে চলে যায়। একটা দেড়টা নাগাদ এসে খালি টিফিনকারিটা ফেরত দিয়ে যায়। কোনও একটা বাড়ীর টিফিনকারি থাকে ওর কাছে, যার মাঝখানের আর ওপরের বাটিদুটো টোল খাওয়া, ওপরের বাটিটার টোলের পাশে কালো কালো দানা দানা মত, দেখে কেমন বিশ্রী লাগে। আরেকটা টিফিনকারি আছে তামার তৈরী বোধহয়, টাট, কোশাকুশির মত ঝলমল করে। বাটিগুলো একটু ছোট, ফলে পুরো টিফিনকারিটাই অন্যগুলোর থেকে কম লম্বা। আমার খুব পছন্দ ওটা, যতক্ষণ টিফিনওলা অপেক্ষা করে, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। ... ...
আবার সেই গাদাগাদা অচেনা লোক, সেই একগাদা হাবিজাবি মন্ত্র আর বারবার করে 'প্রেত প্রেত' করতে লাগল ঠাকুরমশাই। আবার আমার ইচ্ছে করে এই ঠাকুরমশাই নামের লোকটাকে ধাঁইধাঁই করে মারতে। মীনামার মত ভালমানুষ যে কাউকে কোনোদিন একটু জোরে বকে নি, সবসময় হাসিহাসি মুখে থাকত, তাকেই এই পাজী লোকটা 'প্রেত প্রেত' বলছে! আমাকে যারা যারা ভালবাসত তাদেরকে এই ঠাকুরমশাইরা 'প্রেত' বলে ডাকে আর তারপর একগাদা কাপড়চোপড়, বাসনপত্র, খাবারদাবার এমনকি বিছানা বালিশ, ছাতা পর্যন্ত পোঁটলা বেঁধে নিয়ে চলে যায়!! এই নামাবলি জড়ানো একটু কুঁজোমত লোকগুলোর প্রতি এক তীব্র বিতৃষ্ণা, প্রায় বিদ্বেষ জন্ম নিতে থাকে আমার মনে। ... ...
বীরেন শা'য়ের বাড়ীর দুইঘর ভাড়াটে নাকি গিয়ে সাতুদের দোতলায় উঠেছে। এদিকে দাদুদের গোয়ালঘরেও ভালই জল উঠেছে, প্রথমদিন তো লালি আর আকাইম্যা সারাদিনরাত দাঁড়িয়ে রইল। পরেরদিন ভোররাতে লালি কেমন অদ্ভুত আওয়াজ করে ডাকতে লাগল। তখন দাদু গিয়ে ওদের দড়ি ধরে এনে দাদুদের দিকের ভেতরের বারান্দায় তুলল। সে বেচারাদের কি ভয় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে, অর্ধেক সিঁড়ি তো জলে ডোবা, তড়বড় করে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আকাইম্যা একেবারে দাঁড়িয়ে গেল শক্ত হয়ে, কিছুতেই নড়েচড়ে না। দাদু শেষে ওকে পাঁজাকোলা করে বারান্দায় তুলে দিল। লালি বেচারীর শিগগিরই বাছুর হবে, পেটটা ফুলে একেবারে ঝুলে গেছে, প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই। খুব কষ্ট করে বারান্দায় উঠল। বারান্দার কোণায় ছোট গামলা করে ওদের জাবনা দেবার ব্যবস্থা হল। লালি উঠেই সেই যে বসে পড়ল, সারাদিনে আর উঠে দাঁড়াল না। শেষে দাদু আর দিদা সন্ধ্যের আগে অনেকক্ষণ ধরে ছোবড়ার আগুন জ্বালিয়ে লালিকে সেঁক দেওয়ার পরে বেচারী একটু ধাতস্থ হয়ে জাবনায় মুখ দেয়। পরেরদিনটাও লালিরা বারান্দায়ই রইল, তার পরের দিন জল অনেক নেমে গেল; উঠোনে আধহাঁটু, গোয়ালে গোড়ালি ভেজে কি ভেজে না। লালি আর আকাইম্যা আবার গোয়ালে ফেরত গেল। বারান্দায় দুই বোতল ফিনাইল ঢেলে ধোয়া শুরু করল বড়মামীমা। লালির জন্য গোয়ালে একটা ভাঙা দরজা পেতে দেওয়া হল, যাতে শুকনো জায়গায় বসতে পারে। পাড়া থেকে কারা যেন জিটিরোডে গিয়ে ইলেকট্রিক অফিসে খবর দিয়ে এল। এই সময় শুরু হল উঠোনে মাছের আনাগোণা। এদিকে শ্রীপল্লীর মাঠের পেছনের অংশের পুকুরটা ভেসেছে, ওদিকে শ্রীদুর্গা মিলের পুকুর। এই শিউলি গাছের গোড়া বাটামাছের ঝাঁক তো নারকেল গাছের গোড়ায় কইমাছ কানে হাঁটছে। বাবু, সুবীর, রতন, বুম্বারা ছেঁড়া মশারি, গামছা আর মাটির হাঁড়ি নিয়ে হইহই করে সারাপাড়া জুড়ে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। বুড়ীর মা মাসি আজ কাজে এসেছে, পেয়ারাগাছের সামনে থেকে খপ করে একটা মাঝারি সাইজের শোলমাছ ধরে ফেলল। বড়মামীমা মাছ কাটতে কাটতে মা'কে বলে 'কালিয়া করব, ওদের জন্য দেব, আগেভাগেই ওদের ভাত খাইয়ে দিস না দিদি।' ভাই শুনতে পেয়ে মুখ বেজার করে, ও মাছ খেতে একদম ভালবাসে না। ছবিমাসি দিদাকে বলে ‘মাসিমা আফনে রান্ধেন, আফনের রান্ধা কালিয়ার সোয়াদ মুহঅ লাইগ্যা থাহে।' দিদা হাসিহাসিমুখে বলে ‘হ বৌমা তুমি অন্যটি দ্যাহ, মাছটা আমি দেখ্তাসি।' ... ...
হাইস্কুলের মণীষাদি খুবই মারকুটে ছিলেন, তিনিও আর বেত মারেন না, তবে অদ্ভুত অপমানজক শাস্তি উদ্ভাবনে এঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। ক্লাসে কথা বলায় দুজনকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে একে অপরের কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ও পাশে মিনুদিকে পাহারাদার হিসাবে বসিয়ে রাখা, অঙ্ক না পারলে জুতো হাতে নিয়ে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, দুজন ছাত্রীর মধ্যে ঝগড়া ও মারামারির অভিযোগ পেয়ে নিজের নিজের জুতো দিয়ে একে অপরের গালে মারতে বাধ্য করা ইত্যাদি ছিল তাঁর উদ্ভাবন। ... ...
রেখাদি সামনে দাঁড়িয়ে ওকে বকছেন রাতের খাবার হজম না হওয়া সত্ত্বেও সকালের খাবার খাওয়ার জন্য, স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার না খেয়ে মুখরোচক খাবার খাওয়ার জন্য। উনি জানতেন না কল্পনার বেশীরভাগ দিনই রাত্রে খাওয়া হয় না, সকালেও না। ওর মা দুপুরের পর এসে রান্না করলে ওরা সবাই বিকেলের দিকে একবার খায়। কল্পনার মা যেসব বাড়ী কাজ করে তারা কেউ কোনওদিন রুটি বা মুড়ি দিলে রাত্রে ওরা একগাল খায়, নাহলে আবার সেই পরেরদিন বিকেলে। উনি জানতে চানও নি অবশ্য। মিনুদি কোত্থেকে একঠোঙা মুড়ি এনে ওর হাতে দিয়ে বলে 'তুই আস্তে আস্তে একটু করে জল দিয়ে দিয়ে খা দিকিনি'। রেখাদির দিকে তাকিয়ে বলে 'আপনি ক্লাসে যান দিদিমণি, এই মুড়িটুকু খাইয়েই আমি ওকে ক্লাসে দিয়ে আসছি'। আমরা চুপি চুপি ফিরে আসি। আমি জানি অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে পেটে খুব ব্যথা হয়, বাবা বলত রাত্রে না খেলে অনেকক্ষণ পেট্খালি থাকবে, পেটে খুব ব্যথা হবে। ... ...
তার পরেরদিন সকালে আবার মা উঠিয়ে দেয় ঘুম থেকে, তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিতে বলে, ভর্তি হতে যেতে হবে। আমি অবাক হয়ে ভাবি হিন্দু গার্লস কি এত সকালে ভর্তি নেবে? ওদের তো দুপুরে স্কুল, কিছু জিগ্যেস করার আগেই দাদু আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, সেই ভাগাড়পাড়ার স্কুলের দিকেই যাই আমরা। দাদু আমাকে নিয়ে ‘বালিকা শিক্ষা সদন জুনিয়র হাই' স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়, বিলবইতে লেখা ছিল নামটা, ইরাদিদিমণি হেডমিস্ট্রেস। কিন্তু এখানে কেন সেটা যদি কেউ একটু বুঝিয়ে দিত! জানুয়ারী মাসে তো তেমন ক্লাস হয় না, রোজই প্রায় দশটায় ছুটি। আমি বাড়ী ফিরে দেখি শুভ্রা, রিঙ্কু, শর্বরী, মিঠু, সাতুরা এ ওর বাড়ী গিয়ে ডাকাডাকি করে একজায়গায় হয়, তারপর একসাথে খুব মজা করতে করতে যায়, ইলু, শীলুও হীরালাল পালে ভর্তি হয়েছে এই বছর, ওরাও যায়। ওদের স্কুলে রোজ ড্রেস পরতে হয় না, বেশীরভাগ দিন ওরা পরিস্কার এমনি জামা পরে স্কুলে যায়, মাঝে মধ্যে সবুজ-সাদা স্কুলড্রেস পরে। আমার তো আর ওদের সাথে হইহই করে যাওয়া হয় না, আমি থেকে যাই ভাগাড়পাড়া স্কুলে ফেলের মধ্যে ফার্স্ট হয়ে। ... ...
বছরে চারদিন, যাকে ‘অম্বুবাচী' বলে, তাতে অমনি করতে হয়, রান্না করা কিচ্ছু খেতে নেই। কিন্তু একা মা’কেই কেন করতে হবে? দিদা বড়মামীমা কেউ তো এসব করছে না। আবছামত মনে হয় তাইজন্য জিজি গত শনিবারে তিনকিলো আম নিয়ে এসেছিল, আস্তে আস্তে বলছিল ‘তোর মা কিছুতেই শুনছে না, এইসব একেবারে অর্থহীন, তোর বাবা দেখে কষ্টই পাচ্ছে শুধুশুধু'| কিন্তু মা যে মাছ খেতে খুব ভালবাসত, মাংস প্রায় খেতেই চাইত না, কেন ওরা মা'কে মাছ খেতে দিচ্ছে না? আমাদের এখন খুব বুঝেশুনে খরচ করতে হয়, মা বলেছে, তাইজন্য বুঝি? কেউ যদি একটু বুঝিয়ে দিত। আমার মাথার ভেতরে আবার সাত সকালের সব ধোঁয়া ঢুকে যেতে থাকে, আমি দাদুর খাটে শুয়ে ঐ মাঝ বিকেলে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ি। মেরুদন্ড সোজা করে বসে থাকা আমার দাদু, এত গন্ডগোলেও একটা কথাও না বলা দাদু, একইভাবে বসে আস্তে করে ফ্রকটা পায়ের ওপরে টেনে দিয়ে হাতপাখা দিয়ে আমাকে হাওয়া করতে থাকে। ... ...
একদিন দুজন এসে বাবার রেকর্ড প্লেয়ার আর সমস্ত রেকর্ড নিয়ে গেল, দেড়শো টাকায় বিক্রি হয়ে গেছিল বাবার সংগ্রহের সমস্ত রেকর্ড। ১৬ আরপিএমের একবাক্স রেকর্ড ছিল মোজার্ট ও বেঠোভেনের বিভিন্ন সিম্ফনি। ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল বাবার বিশেষ পছন্দ ছিল। মা’র অল্প অপরাধবোধ ছিল এই সংগ্রহ বিক্রি করায়, বারেবারেই বলত ‘কে আর শুনবে ওসব।‘ তখনও বাবার অফিস থেকে টাকাপয়সা কিছু পাওয়া যায় নি, এমনকি সমস্ত আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি মেনে ও মিটিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতেও সাড়ে তিনমাস সময় লেগেছে। গাড়িটা বিক্রি হওয়ায় খানিক স্বস্তি মেলে। বাবার সেতারও গেল। ভাই তখনো হয় নি,বাবা সেতার বাজাচ্ছে, ইন্দ্র রায় রোডের বাড়ির পেল্লায় উঁচু উঁচু সিলিং ... বাইরের ঘরটা অন্ধকার, জানলার ফাঁক দিয়ে আকাশ থেকে উপছে পড়া জোছনা চেষ্টা করছে ঢুকে আসবার। রাগ রাগিণী কিছুই বুঝতাম না কিন্তু কিছুতেই নড়তে পারছি না সিঁড়ির কোণা থেকে ... চারিদিক থেকে ঝমঝম করে ঘিরে ধরছে সুর আর ধ্বনি, ধ্বনি আর সুর ... খুব আবছা মনে পড়ে। ... ...
মঞ্জুদিদি তারপরেও অনেকদিন, যতদিন না ওর বিয়ে ঠিক হয়, আমাদের বাড়িতেই ছিল। বেশ কিছুদিন আমার সাথে সরাসরি কথা বলত না, আমিও না। পরে আর মঞ্জুদিদির সাথে কখনো যোগাযোগ হয় নি। এখন বুঝি সেই সময় জিজির যা অবস্থা তাতে চার পাঁচশো টাকা হারানো কতটা তার জন্যও ভয়ানক ছিল। আমার অন্যায়টা- It was wrong on so many levels...। এই অন্যায়টার কথা কেউ জানে না, ভাইও না। আজ এখানে লিখে রাখলাম। শুধু মঞ্জুদিদির কাছে ক্ষমা চাইবার একটা সুযোগ যদি পেতাম। ... ...
‘চুমু চুমু আদর আদর আদর আদর চুমু চুমু সাবধানে যাবে সাবধানে আসবে।‘ বাবা অফিসের সাজপোশাক পরে তৈরী হয়ে গেলেই খাটে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার গলা জড়িয়ে দুই গালে চুমু খেয়ে দুই হাত দিয়ে গালে আলতো করে ঘষে দিয়ে এই কথাগুলো বলা ছিল আমার রোজের কাজ। কে শিখিয়েছিল কি জানি। হয়ত জিজি কিংবা মীনামা, কারণ কোনওরকম আবেগের বহিঃপ্রকাশের ব্যপারে আমার মা অতিরিক্ত সংযত আজীবন। বাবা তো ঘামত খুব, একেবারে গলগল করে জলের মত নেমে আসত ঘামের ধারা গাল কপাল বেয়ে অনর্গল। চুমু খেতে গিয়ে মুখ ভিজে যেত আমার, আদর করতে গিয়ে হাতও। ফ্রকের সামনেটা তুলে মুছে নিতাম। আগে যখন পৌণে ন’টায় ভারতী সিনেমার উল্টোদিকে বাসের জন্য গিয়ে দাঁড়াতে হত তখনও বাবা তৈরী হয় নি। হয়ত স্নান করে এসেছে নয়ত টোস্ট আর নরম তুলতুলে স্ক্র্যাম্বলড এগ দিয়ে প্রাতরাশ করছে, আমি ইস্কুল ড্রেস পরে গিয়ে দাঁড়াতাম। জুতো পরা হয়ে গেছে তাই খাটে উঠতে পারব না, বাবা দাঁড়িয়ে থাকলে কুঁজো হয়ে দাঁড়াত আর আমি বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে ডিঙি মেরে গলা জড়িয়ে ধরতাম। ... ...
চামেলিপিসিদের খাটের নীচে কী আছে সেটা দেখতে খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু জিজি মানা করেছে। অন্যদের বাড়ি গিয়ে তাদের জিনিষপত্রের দিকে তাকানো নাকি ভারী অসভ্যতা। ওদের চৌকির তলায় এত এত জিনিষ যে কখনো পাশ দিয়ে অসাবধানে যেতে গেলেও পায়ে গুঁতো লাগে শক্ত বস্তামত কীসবের সাথে। চামেলিপিসির বাড়ি থেকে ফেরার সময় প্রথমদিন অত লোককে রাস্তায় লাইন করে বসে খেতে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। অনেকেই কেমন নোংরা কালো জামা পরা, একদম সামনে যে তার শার্টের কাঁধে এত্তটা ছেঁড়া! ওদের মায়েরা বকে না জামা নোংরা করলে? জিজি তাড়াতাড়ি হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে, ওদের নাকি বলে কাঙালি। শ্রীহরি ওদের ভোজন করায়। রোজ রোজ লুচি ছোলারডাল খেতে পায় কী মজা! মা বোঝায় না মোটেই মজা নয়, সারাদিনে ওরা অনেকেই হয়ত আর কিচ্ছুই খেতে পাবে না। ওরা রাস্তায়ই থাকে, অনেকের মায়েরাও হয়ত ওই লাইনেই বসেছে। আমার খটকা যায় না, রাস্তায় থাকাটা কি খুব খারাপ ব্যপার? কেমন ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে পারে। ... ...
এর মধ্যেও দুই তিনদিন সাড়ে দশটায় বাস ধরতে হয়েছে আর দিদিটাও সমানে ব্যাটারি ব্যাটারি করে গেছে। এখন আবার ওর সঙ্গের আরো দুটো দিদিও হাসে আর চোখের সামনে কিলবিলিয়ে আঙুল নাচায়। ইচ্ছে করে ঘ্যাঁক করে কামড়ে ধরি একটা আঙুল। কিন্তু ঠিক সাহস হয় না। খালি মনে মনে ভাবি দাঁড়াও না মা বলেছে চশমা পরলে আর চোখের নড়াচড়া টের পাওয়া যাবে না, আসুক আমার চশমাটা তৈরী হয়ে। কিন্তু অনেক ছোট একটা মেয়েকে অবাধে লাঞ্ছনা করার এমন সুযোগ ওরা ছেড়ে দেবে কেন? কাজেই প্রথম যেদিন চশমা পরে বাসে উঠলাম ওরা একেবারে হইহই করে উঠল ‘আরে আরে দেখ ব্যাটারির চারচোখ’। এবারে নতুন খেলা, চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে জানলার বাইরে হাত বের করে ঝুলিয়ে রাখা ‘এই ফেলে দিলাম ফেলে দিলাম’। ভয়ে কাঠ আমি, চশমা ভেঙে গেলে বা হারিয়ে গেলে মা হয়ত মেরেই ফেলবে আমাকে, বারেবারে বলে দিয়েছে সাবধানে রাখতে। হোঁচট খাচ্ছিলাম বলে বকেছে পড়ে যেন চশমা না ভাঙে। ... ...
ইন্দ্র রায় রোড ধরে হেঁটে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোডে ওঠার মুখটায় ডানদিকের কোণায় ‘দাঁ পেপার হাউস’, রাস্তা থেকে বেশ অনেকটা উঁচু বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। দোকানের ভেতরে নতুন খাতার গন্ধ, নতুন উডপেন্সিল আর রবারের গন্ধ, হলদে গোলাপী চার্টপেপারের গন্ধ, নতুন বইখাতায় মলাট দেবার ব্রাউন পেপারের গন্ধ ম’ ম’ করে। আর আছে রং পেন্সিল, রং কলম আর রঙ বাক্স। মোম দেওয়া রঙ পেন্সিলের ছোট বাক্স ড্রয়িং ক্লাসের দিন ইস্কুলে নিয়ে যেতে হয়। আমারটা বারো রঙের ছোট্ট বাক্স, সুলগ্না খুব সুন্দর আঁকতে পারে, ওর বাক্সে আঠেরটা রঙ। ত্রিসীমার একটা ইয়াব্বড় বাক্স আছে তাতে ছত্রিশটা রঙ, একদিন ইস্কুলে দেখাতে এনেছিল। ... ...
আগে যাঁরা ভাগাড়পাড়া স্কুলের গল্প পড়েছেন তাঁদের অনেক জায়গাই রিপীটেশান মনে হবে। বস্তুত ঐটা আর এদিক ওদিক লেখা আরো কিছু কুড়িয়ে বাড়িয়েই এটা চলবে। আরেকবার ফিরেদেখা। কেউ যদি পড়ে মন্তব্য করেন সম্ভবতঃ উত্তর দেব না, কারণ এটা আমার নিজের জন্যই নিজের সাথে কথা বলা। আগাম মাপ চেয়ে রাখলাম। ... ...
আগে যাঁরা ভাগাড়পাড়া স্কুলের গল্প পড়েছেন তাঁদের অনেক জায়গাই রিপীটেশান মনে হবে। বস্তুত ঐটা আর এদিক ওদিক লেখা আরো কিছু কুড়িয়ে বাড়িয়েই এটা চলবে। আরেকবার ফিরেদেখা। কেউ যদি পড়ে মন্তব্য করেন সম্ভবতঃ উত্তর দেব না, কারণ এটা আমার নিজের জন্যই নিজের সাথে কথা বলা। আগাম মাপ চেয়ে রাখলাম। ... ...