- মা কী বলবে বলেছিলে মনে আছে? - কী রে? - দাদুরা আড়বালিয়ার বাড়ি ছেড়ে শহরে কেন গিয়েছিল? - ইচ্ছে হয়েছিল তাই গিয়েছিল। - না, বল ঠিক করে, বলতেই হবে। তোমার মামার বাড়ির কথা তো অনেক শুনলাম। আমার মামার বাড়ির কথা জানবোনা বুঝি? আড়বালিয়ার অমন প্রাচীন ইতিহাস নেই? - সে তো নিশ্চয়ই আছে, তবে কিনা রাজা মহারাজাদের সাত পুরুষ, দশ পুরুষ সব নাম নথি পাওয়া যায়, সাধারণ মানুষের সেসব লেখা থাকেনা, তাই হারিয়ে যায়। আমাকে নিয়ে কেবল চার পুরুষের কথাই জানি। - সেটাই বল, আমাকে তো জানতে হবে। - জানতে হবে? সংক্ষেপে জানবি নাকি বিশদে? - ওসব জানিনা, তুমি যা জানো আমাকে বলতে হবে। - তাহলে তোকে কিন্তু ধৈর্য ধরে অন্তত সোয়াশো বছর আগের আড়বালিয়ায় যেতে হবে। পারবি? - তাই নাকি! চল, চল, শিগগির। ... ...
আমাদের ইস্কুলের একশ পঁচিশ বছর এসে পড়েছে। বিভিন্ন প্রাক্তনী ব্যাচের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আমরা সাতাশির ব্যাচ ঠিক করলাম, কলকাতায় প্লেগ মহামারী আর বর্তমান করোনা মহামারীর তুলনা করে একটা আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার করব। ১৮৯৮ সালে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার সময়ে প্লেগের থাবায় আহত হয়েছিল শহরটা, তাই এই আলোচনার উদ্যোগ। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা মিলে সময় বের করে আমরা কাজ শুরু করলাম। মাতাজীরা বললেন, নিবেদিতার ডাকে সেযুগের যুবকেরা, মহিলারা প্লেগ নিবারণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই করোনা মহামারীতে নবীন প্রজন্ম কীভাবে অংশ নিয়েছে, সেটা তাঁরা শুনতে চান। ... ...
ছোট বেলায় দেখতাম, মায়ের তেমন কোন ভাল শাড়ি ছিলনা। কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে মা কোন বন্ধুর থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে পরত। সেকালে এমন চল ছিল অবশ্য। ইমিটেশন গয়না পরত। একজোড়া কানের রিং ছাড়া মায়ের আর কোন সোনার গয়না ছিলনা। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগত। একটু বড় হতে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম - ‘এত বড়ো বংশের মেয়ে লাবণ্য। বড় ঘরের বৌ! গয়না ছিলনা মা? বন্ধুরা সব গল্প করে, ঠাকুমার বালা, দিদার বিছে হার। তোমার তো কিছু নেই। তোমাকে দেয়নি? - সব গেছে, দেবে কী করে? - গেছে মানে, কীকরে গেল সব? প্রথমে বললে হারমোনিয়াম গেছে, তারপর বললে, দিদার হাতের কাজগুলো গেছে। এখন বলছ গয়না গাঁটি গেছে। গেল কীভাবে, সেটা তো বলো। মা বলল, - আজ কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল মা, আবার একদিন হবে। মেলা কাজ পড়ে আছে।’ - যাঃ জানা হলনা তবে? ... ...
- ওহ, রুশ ভাষায় মাকে বুঝি নেনকো বলে? আর কী কী শিখেছিলে? - বাড়িতে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে অনেক গুলো ডিকশনারি ছিল। সেখান থেকে এ টি দেবের ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারির শেষে দেখলাম গ্রিক আর রুশ বর্ণমালা রয়েছে। ব্যাস আর আমায় পায় কে? দিনরাত নতুন বর্ণমালা মকশো চলল রাফ খাতায়। প্রগতি প্রকাশনের রুশ গল্পের বাংলা অনুবাদ যত আছে, সব নিয়ে খাটে ছড়িয়ে বসলাম। মলাটের পরের পাতায় বাংলার নিচে ছোট ছোট করে রুশ ভাষাতেও লেখা থাকত। উভচর মানুষ বইটার লেখক আলেকজান্ডার বেলায়েভ। রুশ বর্ণমালা মিলিয়ে দেখলাম, লেখা আছে, এ বেলায়েভ। বাংলায় মস্কোর নিচে যা লেখা আছে, তা বাংলা মতে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায় মস্কভা - মানে মস্কো। হায় কপাল! ইস্কুলের ভূগোল বইতে লেখা আছে, মস্কো শহর মস্কোভা নদীর ধারে। ভুল, এ যা দেখছি, তাতে মস্কো শহর মস্কো নদীর ধারে। দৌড়লাম, মাকে এই নতুন আবিষ্কার জানানোর জন্য। মা শুনে বেশ অবাক হল, বলল - - ‘বাবা! পড়ে ফেললি তুই। তুই যেমন রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস, আমার মাও এভাবে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করত।’ ... ...
- তোমার ছোটবেলার সিনেমার গল্প বল। - আরে তখন যুগটাই ছিল, যে কোনো উপলক্ষে আত্মীয় স্বজন- বন্ধু বান্ধব মিলে সিনেমা দেখতে যাবার যুগ। জ্ঞান হওয়ার আগে থেকে অসিত বরণ, উত্তম কুমারের সিনেমা দিয়ে হাতেখড়ি। মামার বিয়ে হল - নতুন বৌকে নিয়ে মায়ার সংসার। রবিবার এলো তো বাবা মার হাত ধরে সব্যসাচী। মাসিমণির বিয়ের কথা চলছে, নতুন পাত্রকে নিয়ে চিরন্তন। কালে কালে বাবার হাত ধরে টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী, এন্টার দ্য ড্রাগন, গ্রেট এসকেপ, গানস অফ নাভারোন। অবশ্য হিন্দি সিনেমায় বাধানিষেধ ছিল। স্কুল পাশ করে কলেজ পর্যন্ত শুধু সফেদ হাতি আর পার। কলেজে উঠে ও ব্যথাও মিটে গেল। নুন শোয়ে ফুল অর কাঁটে, প্রতিবন্ধ, লমহে - আহা কীসব দিন। - দাঁড়াও, কলেজে উঠি, তারপর আমিও যাব। - যাবি। - সিনেমা দেখে দেখে সিনেমা প্রীতি? - না না তা কেন? আসল হল, চরিত্র চিত্রণ, কোন সিন কীভাবে তোলা হচ্ছে, এসবের চুলচেরা আলোচনা। - কীরকম? ... ...
- "মা, তুমি গান জানো, আমাকে তো কোনদিন বলোনি। - গান জানিনা তো। - তাহলে বাজাচ্ছো কি করে? - আমার মায়ের কাছে শিখেছি। শুরু করেছিলাম। তারপর আর হলনা। - হলনা কেন? - হারমোনিয়ামটা হারিয়ে গেল। - কীকরে? - সে অনেক কথা, পরে বলব।" ছোটো করে একটা ধাক্কা লাগল মনে। লাবণ্যর হারমোনিয়াম হারিয়ে গিয়েছিল? কি এমন কথা আছে, মা বুকে চেপে আছে? ... ...
- মা, শ্বেত পাথরের টেবিলের গল্পটা বলবে বলেছিলে! - টেবিলের গল্প? টেবিলের তো আর আলাদা কোন গল্প হয়না রে বাবু, এ হল টেবিলের চারপাশের মানুষের গল্প। - সেটাই বল শুনি। - শোন তবে। আমাদের ছোটবেলায় খুব রেডিওতে নাটক শোনার চল ছিল। যেদিন যেদিন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের শ্বেত পাথরের টেবিল নাটকটা হত, সেদিন মা, মামা, মাসিরা সব কাজ ফেলে রেডিও ঘিরে বসত আর নানান মন্তব্য করত। নাটকটা শেষ হয়ে যাবার পরেও অনেকক্ষণ সেই আড্ডা চলতেই থাকত। আলোচনার মূল কথা হল, এ তো আমাদের বাড়ির গল্প, সঞ্জীব বাবু কীভাবে জানলেন? ইত্যাদি। সেই সব গল্প থেকেই প্রথম জানতে পারি যে, আমার মামার বাড়িতে এককালে বিশাল এক নকশাকাটা শ্বেত পাথরের টেবিল ছিল। - নাটক থুড়ি গল্পটার সঙ্গে মিলটা কী? - গল্পটা তোকে পড়তে হবে, তবে তো? মোবাইলে খোল, গুগলে আছে। - আচ্ছা, ওয়েট, দেখি, ... ...
- ও মা! আমি টেবিলের ওপরে আলু কাটছি। - চপিং বোর্ড নিয়ে নে। নইলে ছুরির দাগ পড়ে যাবে। - কিন্তু হোটেলে যে টেবিলের ওপরে কাটে দেখেছি। - সে টেবিলের ওপরে পাতলা মার্বেল লাগানো থাকে, তাই। - আমরা মার্বেল লাগাইনি কেন? আচ্ছা মা, তোমাদের কলেজের সেই গোল শ্বেত পাথরের টেবিলটা এখনও আছে? ... ...
এই যে আপনারা, মানে যারা জুনিয়র বা সাব জুনিয়ার সিটিজেন, তাদের যে জিনিস দেখে আমি মুগ্ধ হই তা হচ্ছে আপনাদের গভীর আত্মবিশ্বাস আর দুঃসাহস। আমরা সিনিয়র সিটিজেনরা, কীরম একটা ন্যাকাটে ও ক্যাবলা কার্তিক ছিলাম। এখনো। তো, সেই সময়টাই সেরকম ছিল। মা বাবা গুছিয়ে ক্যালাতো, অংকের মাস্টারের তো কথাই নেই। এমন কি ভূগোলের মাস্টার মশাইও সাতটা রাজধানীর নাম না বলতে পারলে উত্তাল পেটাতেন। "শালা" বলেছি, শুনতে পেয়ে পাড়াতুতো এক কাকা উদ্যোগ নিয়ে কান মলে দিতেন। সে এক মুক্তাঞ্চল। ... ...
আমাদের ধারণা ছিল কলেজের ছেলেমেয়েরা তো বড় হয়েছে, এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে ওদের সচেতনতার শিক্ষা খুব বেশি প্রয়োজন নেই, কারণ টেলিভিশন বা সমাজ মাধ্যমের কারণে এরা সব কিছুই দেখেছে, শুনেছে, জেনেছে। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম একেবারেই ভুল ভেবেছি। যেহেতু প্রথম ঢেউয়ে গ্রাম তেমনভাবে আক্রান্ত হয়নি, তাই এই ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই অসুখটার ণত্ব ষত্ব কিছু জানেনা। টেলিমেডিসিন কি, অসুখের প্রোটোকল কি? কতদিনের মধ্যে কী ধরণের পরীক্ষা করাতে হবে, পরীক্ষা কোথায় হয়? অক্সিজেন কেন, কখন লাগতে পারে এগুলো তারা বিশেষ কিছুই জানেনা। তাছাড়া বেশিরভাগের বাড়িতে অক্সিমিটার তো দূর থার্মোমিটার পর্যন্ত নেই। ... ...
আমরা মনখারাপের সঙ্গে লড়াই করার জন্য কলেজে মাঝেমাঝেই মনোবিজ্ঞানীদের নিয়ে ওয়েবিনার করছিলাম, যাতে তাঁরা আমাদের বাঁচার কোন পথ বাতলে দিতে পারেন। তাঁরা বলেছিলেন বই পড়তে, বিশেষ করে জীবনীমূলক বই। পরীক্ষা শেষ হবার পর, আমি পূর্ব দিনের মহামারীগুলি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম স্বামী বিবেকানন্দের লেখা প্লেগ ম্যানিফেস্টোর প্রথম কয়েক লাইন বাদ দিলে প্রায় পুরোটাই যেন করোনার সাবধানতার সঙ্গে মিলে যায়। সেই একই পরিচ্ছন্নতার বার্তা, টাটকা আর পুষ্টিকর খাবারের পরামর্শ। ডাক্তার আর জি করের প্লেগের ওপরে লেখা একটি বই হাতে এলো। নতুন করে ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় কুমুদিনীর বাবা কৃষ্ণকুমার মিত্রের আত্মচরিত পড়লাম। হজরত মহম্মদের ওপরে লেখা তাঁর বইটি আন্তর্জালে খুঁজে পেলাম। অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে জগৎ ভুলে পাগলের মত কেবল পড়েই যেতে লাগলাম। বই থেকে মুখ তুললে যত রাজ্যের আতঙ্ক এসে ধরে, তাই কেবল বইয়ের আড়ালে আড়ালে আমার দিন কাটতে লাগল। ... ...
লকডাউনের দ্বিতীয় ঢেউয়ের অতি নিদারুণ এই দিনগুলি কোনমতে কাটছিল। খেয়াল করলাম, আমাদের অনার্সের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে গ্রুপ চ্যাটে অনেকদিন কোন কথা বলছেনা। ফোন করলেও ফোন ধরছেনা। কী করে যোগাযোগ করি ভেবে পাইনা। শেষে তাদের বন্ধুদের কাজে লাগিয়ে জানলাম, প্রত্যেকের বাড়িতেই একাধিক নিকটাত্মীয় মারা গেছেন। এদিকে অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতি তলানির দিকে, যারা আসে, তারাও ঠিকমত সাড়া দেয়না। বুঝি মনটা ওদের ভালো নেই। এর মধ্যে অনেক গুলিই ঘটনা ঘটল - তার মধ্যে দুটো বলছি। পিজি ক্লাসের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হঠাৎ করে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গেল, সব যোগাযোগ বন্ধ। অনেকবার ধরে ফোন করতে করতে জানতে পারলাম, ছেলেটার কারণ কী। ... ...
আমি একটা ফেসবুকের পাতা বানিয়েছিলাম, সেখানে নানা ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা লেখা, আঁকা, মোবাইলে তোলা ফটো, নিজের করা হাতের কাজ, রান্নার ছবি, গান, নাচ বা আবৃত্তির ভিডিও - লকডাউনে যে যা পাঠাত, সেগুলো আপলোড করতাম। এছাড়া ওদের মন ভাল করার অন্য কীই বা উপায় ছিল! বেশিরভাগ তো সব দূরদূরান্তে অজ পাড়াগাঁয়ে বাড়ি, কলেজের কাছে মেস করে থাকে। নিজেরা হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়। একবার একটা পিজি ব্যাচ পাশ করে মেস ছাড়ার আগে আমাদের নেমন্তন্ন করে মাংস ভাত খাইয়েছিল। যা হোক, আলটপকা দু সপ্তাহের লকডাউন হতে দু তিনটে জামাকাপড় নিয়ে সব বাড়ি চলে গিয়েছিল। বই খাতা মেসে পড়েছিল, আর যে ওগুলো নিতে ফিরতে পারবেনা, তা তো স্বপ্নেও ভাবেনি। বাড়িতে বসে লেখা পড়া যে করবে, উপকরণ ছিলনা। আমি যখন বলতাম এই তো রবীন্দ্র জয়ন্তী এসে গেল, কিছু লিখে পাঠাও। অনেকে বলেছিল, ঘরে কাগজ নেই ম্যাডাম। তখন আমি বললাম, যে ওমা! লিখতে বুঝি সব সময়ে কাগজ লাগে? আমি তো মোবাইলে লিখি। তখন আর্জি এলো কোন, জয়ন্তী নয়, শুধু আমাদের জন্য মোবাইলে লিখুন ম্যাডাম। ... ...
তো, নস্টালজিয়ার একটা সেট প্যাটার্ন আছে। প্রথমটায় ঠাট্টা, ফাজলামি প্রচুর করুন। এমন কি বুঝিনা বুঝিনা করে একটু অসভ্য টাইপের জোকও করতে পারেন - কিন্তু সেটা ইশারাতেই। তারপরে একেবারে শেষটায় একটা হুল্লাট ইমোশনাল মোচড় - একটা দগদগে চোখ ছলছলে ভাব - বুক চাপা একটা কান্না গোছের। তাইলে জমবে। আমি প্রথমেই জানিয়ে দি'- আমার এই নস্টালজিক খানা পিনার ব্যাখ্যান একেবারে পুরো ফ্যামিলি নিয়েই পড়তে পারবেন। রেটিং একেবারে ইউনিভার্সাল। আর শেষটাতেও কোনো হায় হায় রে ক্লাইম্যাক্স নেই। খুবই সহজপাচ্য। আসলে এই আমাকে দেখুন। জন্ম ৫৩ সালে (AD), সেই কলেজ বেলার থেকে কতো যে নতুন নতুন খাবার খেয়ে অবাক হলাম। এবং এখনো সেই অবাক হওয়া শেষ হয় নি। ... ...
জীবনের এক অধ্যায়কে পিছনে ফেলে গাড়ি এসে দাঁড়ায় কাজের পরিসরে। দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ভিতরে। শালিক পাখির গল্প লেখার জন্য আমার নামে পুরষ্কার উঠেছে। আজই অনুষ্ঠান। হাসিমুখে দাঁড়াই মঞ্চে, মাইক ধরে দু চার কথা বলি নিপুণ পেশাদারিত্বে। আজ এই দৃশ্য দেখে যারা সবচেয়ে খুশি হত, তারাই আজ নেই। এ যে কী শূন্যতা বলে বোঝানো যায় না। আত্মীয় স্বজনের গুঞ্জন কানে ভাসে, 'তোমার খুব মনের জোর।' 'তুমি তো একটা ছেলের কাজ করছ'। এদের কাছে অন্তর ঢেকে রাখি সঙ্গোপনে। অসুস্থ বোনটা বাবা মায়ের কাছেই থাকত। এখন তাকে নিয়ে এসেছি সব পাট চুকিয়ে। আর আমার দুটো মেয়ে নয়, তিনটে। মনে ভাবি সামলাতে পারব তো সব দায়িত্ব! ... ...
আমি চমকে প্রথমবারের মত তার দিকে ভালো করে তাকাই। তার ছাপা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা তোলা, ঘোমটায় কপাল ঢাকা আর দুই কানের পাশে আটকানো। ওর সঙ্গে আগে মুখোমুখি হইনি। টিয়াকে দেখে আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি ওরা মুসলমান। না এতে আমার আপত্তি কিছু নেই। আসলে এটা নতুন দেখলাম। আতি চাচা এত তো আমাদের বাড়িতে আসত। দাওয়ায় বসত, কিন্তু ঘরে বসতে দেখিনি। রান্নাঘরেও কোনদিন মুসলমান মেয়ে বৌকে কাজ করতে দেখিনি। আমি সহজ ভাবে টিয়ার মায়ের সঙ্গে আলাপ জমাই। ... ...
আমার কর্তা এমন ব্যবস্থা করেছিলেন যে, যতদিন আমরা আড়বালিয়ায় থাকব, বড়জেঠু, মেজজেঠু, সেজজেঠু কারোর পরিবারে আলাদা হাঁড়ি চড়বেনা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হবে। সে বড়ঘরের ছেলে, বাড়িতে অনেক লোকজনের থাকা খাওয়ার আয়োজনের জন্য কীভাবে সুচারু বন্দোবস্ত করতে হয় - এসব বিষয়ে অল্প বয়স থেকেই বেশ পাকাপোক্ত। তাই আমাকে কিছুই মাথা ঘামাতে হয়নি। ওর এই ব্যবস্থায় আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম, কারণ কয়েকদিনের জন্য হলেও আমার ছোটবেলা যেন ফিরে এসেছিল। ... ...
একই জিরা,ধনে,লংকা,হলুদ (একটু গ্যাপ দিয়ে পড়বেন প্লীজ) ঐ সব দিয়ে একই ঘ্যাঁট রেঁধেছি আর খেয়েছি- দিনের পর দিন। তা ও ভালো ইউ টিউব আসায় গুল তাপ্পি মারা সহজ হয়েছে। কিন্তু মাসের পর মাস - কতোই বা লিখবো? সুবিধের মধ্যে এই, যে আপনেরাও বিশেষ পড়েন টড়েন না। তা ও, কথা যখন দিইছি, তখন লিখবোই। এইবারের থিম হচ্ছে "হারিয়ে যাওয়া খাবার"। জানেননি তো, যাদের আর কিছু নেই, তাদের নস্টালজিয়াই সম্বল। ... ...
এসে গেল শীতকালের দিন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভ্যাকসিন মানুষের হাতের মুঠোয় আসতে চলেছে শিগগির। আনলক চতুর্থ পর্ব চলছে। যেহেতু কলেজ এখনও খোলেনি, তাই আমার লকডাউন বহমান, থামার জো টি নেই। লকডাউনের অবসরে কর্তামশাই আমার এই একচিলতে বাসার জানলাগুলো বাগান করে ভরিয়ে দিয়েছেন। জানলা থেকে পুঁইশাক কেটে খাওয়া চলল নানারকম, কখনো শাক, কখনও শুধু ডাঁটা অথবা পুঁইমিটুলির চচ্চড়ি। বিলোনোও হল কিছু নিকট আত্মীয় আর প্রতিবেশীকে। এখন ঐ জানালার একফালি রোদে তার বীজ শুকনো হচ্ছে আবার নতুন করে বোনার জন্য। বারান্দাকে তো একটু বড়সড় জানলা হিসেবে ভাবাই যায়, সেখানে তিনি ফলিয়েছেন ছোটো ছোটো বেগুন, দুরকম - সাদা আর বেগুনি। এখন শীতকালে দক্ষিণের জানলায় রোদ আসে বেশ। ছোটোবেলার স্মৃতি আর ইউ টিউবের পড়া মিশিয়ে, রান্নার মেয়েটির সঙ্গে যুক্তি করে থালায় থালায় দিলাম বড়ি। শুকোতে দিলাম সেই জানলায়। ... ...
আমাদের কর্তা গিন্নি দু'জনের জীবনেই ঝুলন পূর্ণিমার স্মৃতি মনের ঝিলের গভীর স্তরে সাজানো আছে। আমার স্মৃতিতে ভরে আছে - কাঠকলে গিয়ে বস্তা করে কাঠের গুঁড়ো আনা, সেগুলো নানারকম রঙ করা, গ্রাম, শহর, জঙ্গল সব পাশাপাশি, একধারে পাহাড়, নদী, ঝরনা - সেই পাহাড়ের মাথায় শিব ঠাকুর। প্যাকিং বাক্স ওপরে ওপরে রেখে, কাদা জলে ছোপানো কাপড় দিয়ে ঢেকে সেই পাহাড়, কায়দা করে শিব ঠাকুর বসানো। নিচে বড় মোটর সাইকেলের পাশেই ছোট ছোট হাতির সারি। স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে করা একরত্তি পুকুরে উত্তরাধিকারে পাওয়া এক মস্ত পোর্সেলিনের হাঁস। আর ঝুলন যেদিন শেষ হয়, সেদিন হল রাখী। ... ...