এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • বড় বেদনার মতো বেজেছ

    Sumana Sanyal লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ২৪৮৫ বার পঠিত
  • 'you must have received my songs. The tune of the song 'Baro bedonar mato' is perhaps not a charming one... those songs are to be sung in solitude.'

    ইংরেজি অনুবাদে ছিন্নপত্রাবলীর এই চিঠি পড়ছিলাম কিছুদিন আগে। আজ সারাদিন গান নিয়েই কাটলো। গীতবিতান পড়তে পড়তে গাইতে গাইতে আটকে গেলাম ওই 'বড়ো বেদনার মতো' তে এসে। ছিন্নপত্রাবলী নিয়ে বসলাম। কতো যে গানের উদ্ভাস চিঠিগুলোতে! কতো গানে সুর বসাবার কথাও আছে যেসব গানগুলির অধিকাংশের স্বরলিপি করেছেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই গানের বাণী আর এ গানের প্রেক্ষাপটে লেখা চিঠির মধ্যে একটা বেশ মজার বৈপরীত্য আছে। ছিন্নপত্রাবলীর ১০৬ সংখ্যক চিঠিতে এই বৈপরীত্যই আজকে সমস্ত দিন সারা সন্ধে এই গানকে জাগিয়ে রাখলো। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী কে লিখছেন 'বড়ো বেদনার মতো' গানের সুরটা ঠিক হয়তো মজলিসি বৈঠকি নয়। এসব গান যেন একটু নিরালায় গাবার মতো।'

    এ গান কালাংড়া রাগে বাঁধা। ঠাট যার ভৈরব। যেন বা গোপন কান্না জাগিয়েই যে রাগের ঋষভ আর ধৈবত কোমল। রাতের শেষ প্রহরে গাইতে হয় এই রাগ। সত্যিই তো, এ গান তো নির্জনেরই গান, দুখজাগানিয়া। কিন্তু সাজাদপুর থেকেই লেখা এ পর্বেরই অন্য একটি চিঠিতে পাই মনের আনন্দে দু'খানি গান লেখার কথা। 'হৃদয়ের এ কূল ও কূল দুকূল ভেসে যায়' আর এই 'বড়ো বেদনার মতো বেজেছ'। প্রথমটিতে চাপা আনন্দের উচ্ছ্বাস আছে একথা সত্যি। কিন্তু এই দ্বিতীয় গান কি মনের আনন্দেই লেখা? যন্ত্রণাতে আনন্দ, বিরহানন্দ। রাধা, অনিবার্য।

    সবসময় থিওরি আসেনা। ভালো লাগেনা। রবীন্দ্রনাথের গান কে আমি যাবতীয় থিওরি তত্ত্ব বাদ দিয়ে পড়বো, গাইবো। তবু ওই, স্বভাব যাবে কোথায়? মনে পড়লো লাকাঁর মনোসমীক্ষণে পাওয়া সেই অনিবার্য 'জুইসেন্স' কে। বাস্তবের প্রতিদিনের দুনিয়ায় মানুষের কল্পনা তো সহজে টিকে থাকতে পারেনা। একটা সংঘর্ষ চলে। কল্পনা তখন একটা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। লাকাঁ একে বলছেন ট্রেভার্সিং অফ ফ্যান্টাসি। কল্পনার তির্যকতা, প্রতিবাদ। কঠিন অকরুণ বাস্তবকে নিজের ওপরে বসিয়ে নেয় জুইসেন্স। জুইসেন্স একধরণের উপভোগ। এর মধ্যে সুখ আর যন্ত্রণা সমানুপাতে মিশে থাকে। "আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে"...জুইসেন্স এ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে সুখ কে উপভোগ করে বিষয়ী।

    এবার এই গানটি একবার পড়ে নেওয়া যাক...

    'বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে
    মন যে কেমন করে মনে মনে তাহা মনই জানে।।
    তোমারে হৃদয়ে ক'রে আছি নিশিদিন ধ'রে,
    চেয়ে থাকি আঁখি ভ'রে মুখের পানে।।
    বড়ো আশা বড়ো তৃষা বড়ো আকিঞ্চন তোমারি লাগি
    বড়ো সুখে, বড়ো দুখে, বড়ো অনুরাগে রয়েছি জাগি
    এ জন্মের মতো আর হয়ে গেছে যা হবার
    ভেসে গেছে মন প্রাণ মরণ টানে।।'

    এই গান লেখা হয়েছে ১৮৯৩ এর জুলাই মাসের ১০ তারিখে। ঠিক তার পাঁচদিন আগে 'সাধনা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত একটি বেশ স্বল্পপঠিত, স্বল্পালোকিত গল্প 'অসম্ভব কথা।' এ গল্প কে বাদ দিয়ে এই গানের আলোচনা চলেনা। এ গল্পের গোড়ার দিকেই তিনি লিখেছেন 'মানুষ ঠকিতেই চায়, ঠকিতেই ভালোবাসে, অথচ পাছে কেহ নির্বোধ মনে করে এ ভয়টুকুও ষোলো আনা আছে। এইজন্য প্রাণপণে সেয়ানা হইবার চেষ্টা করে। তাহার ফল হয় এই যে, সেই শেষকালটা ঠকে, কিন্তু বিস্তর আড়ম্বর করিয়া ঠকে।'

    মনের আনন্দে 'বড় বেদনার মতো বেজেছ' লেখার কথা পড়ে এই আড়ম্বর করিয়া ঠকার কথাই মনে আসে।

    'অসম্ভব কথা' একটা গল্পের মধ্যে গল্প। ফিল্ম উইদিন ফিল্মের মতো। নাতিকে রূপকথা শোনাচ্ছেন দিদিমা। বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়। রাজা তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখার জন্যে সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম দেখা এক সাত আট বছরের কাঠকুড়ানিয়া ছেলের সঙ্গে বারো বছর বয়সী রাজকন্যার অসমবয়সী অসম্ভব বিবাহ দিলেন এবং অনতিবিলম্বে রাজকন্যা বহুদূরে তাঁর বয়সে ছোটো স্বামীটিকে নিয়ে চলে গিয়ে এক সাতমহলা অট্টালিকা বানিয়ে সেখানেই তাঁর স্বামীটিকে মানুষ করতে লাগলেন এবং 'ছেলেটি পুঁথি হাতে প্রতিদিন পাঠশালে যায়'। (এখন ছিদ্রান্বেষী পাঠক যদি এই পাঠশালে ওরিয়েন্টাল ইশকুলের ছবি খোঁজে, তখন তাকে গালমন্দ করাও তো বিপদ, বিশেষত লেখক স্বয়ং যেখানে লিখছেন 'নিজেকে সেই সাত আট বৎসরের সৌভাগ্যবান কাঠকুড়ানে ব্রাহ্মণের ছেলের স্থলাভিষিক্ত করিতে কি একটুখানি ইচ্ছা যায় নাই')

    এদিকে আর এক জ্বালা। ছেলেটির সাথীরা তাকে রোজ শুধোয় হ্যাঁ গো, ওই সাতমহলা বাড়ির মেয়েটি তোমার কে হয়? ছেলেটি জানেনা মেয়েটি তার কে হয়। ঘরে ফিরে রোজ সেও প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেয় রাজকন্যাকে। 'তুমি আমার কে হও'। রাজকন্যা আজ নয় কাল বলবো বলে কাটিয়ে দেয়। (ছেলেটি কি সত্যিই জানতো না? নাকি মেয়েটির মুখ থেকে প্রার্থিত উত্তর শোনার বাসনায় রোজ এই প্রশ্ন করতো? ঘাটের কথা গল্পে যেমন সন্ন্যাসী সব জেনেও কুসুমের মুখে নিজের নাম শুনতে চাইতেন) অবশেষে রাজকন্যা যেদিন এই উত্তর দেবার জন্যে নীল শাড়ি পরে প্রদীপ জ্বেলে ঘরে গেলেন, তখন ফুলের মধ্যে থাকা সাপের কামড়ে ছেলেটি মারা গেছে। দিদিমা গল্প শেষ করেন। কিন্তু নাতি প্রশ্ন করেই চলে, "দিদিমা, তার পর?" মৃত্যুর পরেও একটা 'তারপর' আছে শিশুর কাছে। অন্তহীন রূপকথা। কিন্তু প্রাজ্ঞ মানুষ তো রূপকথা ধরে রাখতে পারেনা। কতো মৃদু অথচ তীব্র অভিঘাতে এ গল্প শেষ হয়..." কিন্তু যাহার বিশ্বাস নাই, যে ভীরু এ সৌন্দর্যরসাস্বাদনের জন্যও এক ইঞ্চি পরিমাণ অসম্ভবকে লঙ্ঘন করিতে পরাঙ্মুখ হয়, তাহার কাছে কোনো কিছুর আর 'তার পরে' নাই, সমস্তই হঠাৎ অসময়ে এক অসমাপ্তিতে সমাপ্ত হইয়া গেছে।'

    ১৮৮৪ সালের নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাসে যেভাবে তাঁর নিজের জীবনেও একটা রূপকথা অসমাপ্তিতে শেষ হয়ে গিয়েছিলো এবং সমস্ত জীবন ধরে, আমৃত্যু যে বেদনা তাঁকে জাগিয়ে রেখেছিলো। কাদম্বরী। তাঁর মিউজ। "এ জন্মের মতো আর ঘটে গেছে যা হবার"...

    অনিঃশেষ যন্ত্রণাও তো রূপকথাই। এ গান লেখার বহু বছর পরে, জীবনের প্রান্তলগ্নে ১৯৩৯ এ প্রকাশিত 'আকাশপ্রদীপ' কাব্যগ্রন্থের 'শ্যামা' কবিতায় সেই অনিঃশেষ যন্ত্রণার অনির্বাণ রূপকথা

    "নবকৈশোরের মেয়ে,
    ছিল তারি কাছাকাছি বয়স আমার।
    স্পষ্ট মনে পড়ে ছবি।
    একদিন বলেছিল, "জানি হাত দেখা"
    হাতে তুলে নিয়ে হাত নতশিরে গণেছিল রেখা
    বলেছিল, "তোমার স্বভাব...
    প্রেমের লক্ষ্মণে দীন"
    দিই নাই কোনোই জবাব।
    পরশের সত্য পুরস্কার
    খণ্ডিয়া দিয়েছে দোষ মিথ্যা সে নিন্দার।"

    আর হ্যাঁ, কাদম্বরী তাঁর সাহিত্যের সঙ্গীটির থেকে বয়সে বোধকরি চার বছরের বড়ো ছিলেন। অনাবশ্যক কতো কিই তো মনে পড়ে...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ২৪৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন