দখিন হাওয়ার দেশ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : বিবিধ | ০৮ আগস্ট ২০২০ | ৪৩৭৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ২০
পাইলটের আকাশবাণী হল আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা ক্রাইস্টচার্চের বিমানবন্দরে অবতরণ করব, ঠিক এই সময়ে নজরে এলেন দক্ষিণ আল্পস, পাহাড়চূড়ায় তুষার, যেন সদ্য স্নান করে গায়ে ট্যালকম পাউডার মেখে স্থাণুবৎ গা এলিয়েছেন পশ্চিমতটরেখা বরাবর। তরঙ্গের মতন সাদা বরফের চূড়া, তার অনতিগভীরে কোথাও বা পাহাড়ের কোলে পান্না সবুজ ছোট হ্রদ, তারপরেই ক্যান্টারবেরির প্রশস্ত প্রান্তর জুড়ে এঁকেবেঁকে চলা অজস্র শিরা উপশিরার মতন নদী, দেখতে দেখতে ক্রাইস্টচার্চ ঘিরে আকাশপাখি গোল করে ঘুরতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো প্রশান্ত মহাসাগরের নীল দিগন্তে ম্যাজিক।
দখিন হাওয়ার দেশ - ৩ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৪১৪১ বার পঠিত | মন্তব্য : ১১
অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যাণ্ডের দেশের মানুষের মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা | এই যেমন ধরুণ কথাবার্তায়, উচ্চারণে | আপনি জানেন অজি (অস্ট্রেলিয়ান) আর কিউইদের (নিউজিল্যাণ্ডের মানুষ) ইংরিজি কমনওয়েলথ দেশেরই মতন, বানানবিধি প্রভৃতি সব এক রকমের, কিন্তু উচ্চারণের বেলা কিউই ইংরেজী স্বরবর্ণ এক সিলেবল এগিয়ে আর অস্ট্রেলিয়ান (“অজি”) এক সিলেবল পিছিয়ে। ব্যাপারটা কেমন জানেন? মনে করুন আপনি ফিশ আর চিপস (মাছভাজা আর আলুভাজা) কিনতে অস্ট্রেলিয়ায় গেলেন, সে খাবারের উচ্চারণ সেখানে “ফিঈঈশ” আর “চিঈঈঈপস”, আর ওই একই খাবার, টাসমান সাগর পেরিয়ে কিউইর দেশে তার উচ্চারণ হয়েছে “ফশ” (“ফুশ” ও চলতে পারে) আর “চপস” (“চুপস”) ও দিব্যি চলতে পারে। তারপর ধরুন পাভলোভা নামের মেরাং |
দখিন হাওয়ার দেশ - ৪ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ০৮ অক্টোবর ২০২০ | ৩০২৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবেন, টেকাপো শুধু ক্রাইস্ট চার্চ থেকে শুরু করলে তবেই পথে পড়বে, পুকাকি হ্রদ আপনি যে পথেই আসুন দেখতে পাবেন। পুকাকি থেকে ৫০ কিলোমিটার সড়কপথে মাউন্ট কুক, হাইওয়ে ধরুন। তবে পারলে আর কারও হাতে স্টিয়ারিং-এর ভার তুলে দিন, কারণ বাঁদিকে লেক পুকাকি পড়বে একটু পরেই, আর তার পর সারাটা পথ জুড়ে শুধু মাউন্ট কুক দেখতে পাবেন। সে এক অপার্থিব মনভোলানো দৃশ্য, এক গগনচুম্বী পর্বতমালা আপনার গোটা পথের সামনেটায়, একপাশে লেক পুকাকি, তারপর দু-পাশে উঠেছে অজস্র পাহাড়ের সারি, তাদের কারও কারও মাথায় বরফের চাদর, কোথাও খরস্রোতা নদী আর ব্রিজ পেরিয়ে একসময় আদিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকার মাঝখান দিয়ে গাড়ি চলে দাঁড়াবে মাউন্ট কুক শহরের মাঝখানে।
দখিন হাওয়ার দেশ - ৫ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ৪১৩০ বার পঠিত | মন্তব্য : ১০
তরঙ্গার বিদায়গাথা শুনতে পেয়ে সমুদ্রের দেবতা টাঙারোয়া জেলি ফিশ, সমুদ্রের ফেনা, আর সমুদ্রের শৈবালকে পাঠিয়ে দিলেন শিশুটিকে রক্ষা করার জন্য | তারা তাকে নিয়ে গেল শিশুটির পূর্বপুরুষ টামানুই-টে-রা’য়ের দেশে | সেখানকার লোক শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলল। তারপর টামানুই মাউইকে অদেখা জগতের কত রহস্যই না শেখালেন। মাউই পাখিদের সঙ্গে কথা বলতে শিখল, পাখিরা তাকে দিল ওড়ার ক্ষমতা। মাছেরা তাকে দিল শ্বাস, মাছেদের সঙ্গে সে সাঁতার কেটে বেড়াত। হাওয়া তাকে দিল স্বর, মাটি তাকে দিল আপন পরিচয়, তারারা তাকে দিল দিকনির্ণয়ের ক্ষমতা, আর আকাশের কাছে সে পেল উচ্চাভিলাষ। যখন সে বড়ো হল, একদিন টামানুইয়ের সঙ্গে তার যুদ্ধ হল, সে-যুদ্ধে তার বজ্রের মতন দণ্ড দিয়ে সে আঘাত করল টামানুইকে, টামানুই পড়ে গেলেন। এখন মাউই হল নেতা। তখন টামানুই মাউইকে বললেন, “দ্যাখো, তুমি তো পৃথিবীকে টাঙারোয়ার দেওয়া উপহার। এবারে তুমি নিজেকে নিজে খুঁজে পাও, যাও বেরিয়ে পড়ো, সর্বত্র তোমার নাম প্রচারিত হোক মাউই-টিকি-টিকি-আ-তরঙ্গা বলে।”
দখিন হাওয়ার দেশ - ৬ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ২৪ অক্টোবর ২০২০ | ২৯৬৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিশ্বকবি শুধু নন, এই মহামনীষীর লেখার সূত্রে আমরা অনেকেই জগৎ চিনেছি। অথচ কী আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথ পড়লে আপনার কখনও মনেই হবে না নিউজিল্যান্ড বলে কোনো কহতব্য দেশ আছে, বা সেদেশে ইংরেজ বাদে আর কেউ থাকে, বা আর কোনো পুরোনো সভ্যতা ছিল যার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলি ঘাঁটলে নিউজিল্যান্ডের মাত্র একটি উল্লেখ পাবেন ইংরেজের কলোনি প্রতিষ্ঠার সূত্রে একটি প্রবন্ধে। অথচ দেখুন, রবীন্দ্রনাথের সময়, তাঁর বাল্যকালে বহু ভারতীয় তথা বাঙালি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে পাড়ি জমিয়েছেন, নানা অবস্থায়। রবীন্দ্রনাথ কি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের কথা জানতেন না? রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ক্যাথারিন ম্যানসফিল্ড (তখন ইংল্যান্ডে থাকতেন), নিউজিল্যান্ডে-জাত লেখিকা, রবীন্দ্রনাথ কি তাঁর কথা জানতেন না? নাকি মনে করার মতন কেউ নন বলে মনে করেননি?
দখিন হাওয়ার দেশ - ৭ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ০৭ নভেম্বর ২০২০ | ১৯১৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
আট নম্বর তার আসলে একটি মানসিকতা, একটি মানসিক গঠন বলতে পারেন। কিউয়িদের মানসিক গঠন বোধহয়। খুব সামান্য জিনিসপত্র দিয়ে যতটুকু কাজ সারার সেরে নেওয়ার ক্ষমতা। এই জায়গাটাতে আমি আমাদের ভারতীয় মানসিকতার মিল খুঁজে পাই, আজকাল আবার তাকে অনেকে “জুগাড়” (ইং: Jugaad) নামে অভিহিত করে থাকেন। তবে কিউয়ির ‘Number eight mentality’ আর জুগাড় ঠিক একও নয়। সেভাবে দেখলে আট নম্বর তার একটা আট-গেজ বা চার মিলিমিটার বেড়ের তার বই কিছু নয়, এমনকি ১৯৬৭ সালের আগে অবধি (যে বছর বার্ট মানরো বোনেভিল ফ্ল্যাট রেস জিতে রেকর্ড গড়লেন) সে তার এদেশে আমেরিকা থেকে আমদানি করা হত। এদেশ যেহেতু অনেকটা কৃষি আর পশুপালনের ওপর আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল, জমির বেড় দেবার জন্যই সে তার ব্যবহার করত লোকে। সেখান থেকে আট নম্বর তারের বহুধা ব্যবহারের গল্প এতটাই যে সে লোকসংস্কৃতির জায়গা নিল কীভাবে?
দখিন হাওয়ার দেশ - ৮ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ২০ নভেম্বর ২০২০ | ১৭৭০ বার পঠিত
মাওরী লোককথা অনুযায়ী আকাশপিতা রাঙি আর ধরিত্রীমাতা পাপার সন্তানেরা আমাদের খাবারের সংস্থান করেছেন, খাবার “উপহার” দিয়েছেন | তাঁদের আকাশরূপী সন্তান টানে আমাদের পাখী দিয়েছেন খাবার জন্য; সমুদ্র, আরেক সন্তান, যার নাম টাঙারোয়া, দিয়েছেন মাছ, হাউমিয়া দিয়েছেন জঙ্গলের বুনো খাবারদাবার, আর রঙো দিয়েছেন চাষবাস করে উৎপন্ন খাবার। সেকালে মাওরীরা প্রধানত তিন ভাবে রান্না করত, ঝলসে বা গ্রিল করে, সেদ্ধ করে, আর মাটির নীচে আগুণ জ্বালিয়ে উমু বা হাঙি পদ্ধতিতে।
দখিন হাওয়ার দেশ - ৯ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ২৮ নভেম্বর ২০২০ | ৩১৮৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৭
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট স্থানীয় মহিলাদের বেকিং কম্পিটিশন। তা নিউজিল্যাণ্ড বেকিং এর সবচেয়ে তুখোড় উদাহরণ পাভলোভা আর পাই। আমাদের যেমন রোল, পাটিসাপটা, সিঙারা, যাকে সাদা বাংলায় পথের খাবার বা স্ট্রীট ফুড বলা যেতে পারে, নিউজিল্যাণ্ডের স্ট্রীট ফুড বলতে যদি কিছুকে নির্দেশ করতে হয়, সে হবে পাই | যে কোন মাংস (বীফ, পর্ক, ল্যাম্ব, মুরগী, মাছ, মায় মেটে) এবং শাকসবজি আর মিশিয়ে রান্না করে পাইয়ের খোলের মধ্যে ভরে দিন; তারপর তার ওপরে চীজ কুরিয়ে বা কেটে পরতে পরতে রাখুন, এবার পাইয়ের ময়দার খোলের “ঢাকনা” বন্ধ করে দিন, বন্ধ করার পর ২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ৩০ মিনিট রেখে বেক করুন | পাই তৈরী।
দখিন হাওয়ার দেশ - ১০ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০৮৬ বার পঠিত | মন্তব্য : ৩
পলিনেশিয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে এখানে আসবার পর মাওরিরা দেখলেন যে এ প্রকৃতপক্ষে এক প্রকাণ্ড দ্বীপভূমি, সরাসরি প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বটে, কিন্তু তটরেখা মিলিয়ে দেখলে প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এক দেশ, যার প্রায় সর্বত্র বসতি স্থাপন করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, ভারি বৈচিত্রপূর্ণ ও বর্ণময় এক দেশ - একদিকে যেমন ঘন সমুদ্রতটের জঙ্গল, অন্যদিকে তুষারমণ্ডিত গিরিশ্রেণী। তুষারশুভ্র গিরিশ্রেণী এঁরা এর আগে দেখেন নি, তার নাম দিলেন “হুকা” (বাং: ফেনা) |
দখিন হাওয়ার দেশ - ১১ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ২৩ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০১৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৯
টাসমানরা দুটো জাহাজ নিয়ে এসেছিলেন, একটার নাম জিহান আর অন্যটার নাম হিমসকার্ক যেখানে টাসমান স্বয়ং ছিলেন। এর মধ্যে জিহান নামে জাহাজটি থেকে একটি ছোট নৌকো ডাচরা সমুদ্রে নামিয়ে হিমসকারক জাহাজে নিয়ে এসেছিল, এবার সেটি জিহানের দিকে ফেরত যাবে, এমন সময় আরো তেরো জন মাওরি সম্বলিত আরেকটি নৌকো করে এগিয়ে এসে সজোরে ডাচ নৌকোটিকে ধাক্কা মারে | এর ফলে তিন-চারজন ডাচ নাবিকের মৃত্যু হয়। ডাচরা অবশ্য তৎক্ষণাৎ গুলি গোলা ছোঁড়ে, তবে তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি। মাওরিরা একটি মৃতদেহ নৌকোয় তুলে ফেরৎ যায়। মাইকেল কিং পেঙ্গুইন হিস্ট্রি অফ নিউজিল্যাণ্ডে লিখেছেন মাওরিরা তাদের মানা অনুযায়ী, যেকালে পরাজিত সৈনিকদের মেরে ফেলে খেয়ে নেওয়াই তাদের রীতি রেওয়াজ, খুব সম্ভবত এই মৃত ডাচটিকে রান্না করে তাই খেয়ে ফেলে থাকবে।
দখিন হাওয়ার দেশ - ১২ : অরিন বসু
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ভ্রমণ | ৩০ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০২৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৮
সময়সারণী বেয়ে আরেকটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। সাল ১৮১০, কলকাতা থেকে সিটি অব এডিনবরা নামে একটি জাহাজ পাড়ি দিল নিউজিল্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে এবং বে অফ আইল্যাণ্ডে নোঙর ফেলল। যাত্রী তালিকায় নাম পাবেন না, এমনকি জাহাজের ইংরেজ আর অন্যান্য ইউরোপীয় নাবিকদের তালিকাতেও তাকে খুঁজে পাবেন না, সে এক লশকর। উনবিংশ শতকের সে কালে লশকরদের জাহাজে, বিশেষ করে দক্ষিণ গোলার্ধের মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার জাহাজে বিশেষ খাতির। তাদের নাম-ধাম জানা নেই, শুধু জানা আছে তার সাকিন খুব সম্ভবত বাংলার কোথাও। সে জাহাজ নোঙর করা মাত্র উধাও হয়ে গেল। সেই অঞ্চলে তখন কোরোকোরো নামে মাওরীদের দলের নেতার (রাঙাটিরা) মস্ত প্রভাব, তিনি সেই যুবককে তাঁদের কাছে (নঙাপুহি) আশ্রয় দিলেন।