মাঠ যে আখ্যানের প্রাণসর্বস্বপুরুষোত্তম সিংহঔপন্যাসিক দায়বদ্ধ সময়ের কাছে, ইতিহাসের কাছে, অতীতের কাছে, বর্তমানের কাছে। সময়ের অজস্র চোরাস্রোতকে তিনি যেমন ধবমান করবেন তেমনি কেউ কেউ শিল্পের দায়কে অস্বীকার করে সময়কে প্রত্যাখ্যানও করেন। আবার নিটোল বাস্তব, প্রত্যক্ষ বাস্তবকে শিল্পের বাস্তবে পরিণত করার যে পর্যবেক্ষণ শক্তি, অভিজ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন তা অনেক বাঙালি লেখকেরই নেই। তাই বাস্তবতার নামে কখনো তা ফোটোগ্রাফি হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে তথ্যের বিবরণ, ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি করার দোষে দুষ্ট। ইতিহাসের সত্য, সময়ের সত্য, বাস্তব সত্যকে সাহিত্যের আঙিনায় প্রতিফলিত করতে জরুরি শিল্পদর্শন, নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান, সমাজতাত্ত্বিক প্রজ্ঞা। জমি নিয়ে লিখতে গেলে জানা জরুরি জমির চরিত্র, জমির দেহ, জমির ব্যাস-ব্যাসার্ধ, জমি-মানুষের সম্পার্য ও ... ...
মুসলিম আত্মপরিচয় সংকটের মধ্য দিয়ে এক মানবিক আখ্যানপুরুষোত্তম সিংহবহুত্ববাদী ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতি, খাদ্যাভাস, রুচির দেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দেশ আত্মাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন সোহারাব হোসেন ‘সওকত আলির প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি’ (২০০৯) উপন্যাসে। যুগ যুগ ধরে এদেশে বিবিধ জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতির সম্মিলনে বিভেদ, অসহিষ্ণুতায় ভাঙন যে ধরেনি তা নয় তবুও ভারতীয় কোথায় যেন এক ছিল, টিকে ছিল। কিন্তু দেশভাগ পরবর্তী বিশেষ রাজনৈতিক দলের উত্থানে ধর্মীয় বিভাজনের সীমারেখা এমন ঊর্ধ্বগতিতে তরান্বিত হল যে আজ সমগ্র দেশ বিপন্ন, সমগ্র দেশ আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ভুগছে। আজ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে দাঁড়িয়ে কেন্দ্র, রাজ্য সরকার ধর্মের নামে এমন ন্যারেটিভ গড়ে দিচ্ছে, কাউকে পাশে রাখতে গিয়ে অপরাধকে এমনভাবে আড়াল করছে, ... ...
ইছামতী তীরবর্তী বনবাংলার আখ্যানপুরুষোত্তম সিংহ পাঠকের জন্য পড়া ও শোনা দুই আয়োজনই থাকছে। লেখার শেষে ইউটিউব লিংক রইল। পড়তে না চাইলে শুনতে পারেন।বাঙালি ঔপন্যাসিকের জীবনদর্শনকে, লৈখিক সূত্রকে নানা প্রকরণে ভাগ করা যায়। বলা ভালো লেখকরা নিজেরাই আত্মজবানবন্দিতে সে কৈফিয়ত দান করে কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছেন। সেখানে বিভ্রান্ত যুক্তিও কম নেই। কারো কাছে যথার্থ বাস্তব, ভূগোল চিহ্নিত বাস্তব অপ্রয়োজনীয়। তাদের কেউ কেউ প্রকৃতপক্ষে গ্রাম বাংলার জীবনচরিত থেকে অনেক দূরে থাকেন। আবার কেউ কেউ ভূগোলের প্রত্যক্ষ স্বরকে নানা ভঙ্গিতে নানা বিভঙ্গে বাজাতে সক্ষম। এমনকি অবস্থান সেই প্রান্তজীবনেই। আখ্যানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞানের স্বচ্ছতাকে অস্বীকার করা যায় না। আখ্যানের চরিত্রের সঙ্গে লেখকের অবস্থান যদি একই সমাজ ... ...
যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব যে আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দুপুরুষোত্তম সিংহদেবেশ রায়ের ‘যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ যুদ্ধের ভিতরে’ (২০০৩) পরিচ্ছেদহীন ১০৪ পৃষ্ঠার এক অবিস্মরণীয় টেক্সট। বাংলা উপন্যাসের টেক্সটের গুণগত মান পরীক্ষায় অনিবার্যভাবে দেবেশ রায়ের স্মরণাপন্ন হতে হয়। গদ্যের জোড়ালো গতি, উপমার অবিচ্ছেদ্য অবিরাম প্রয়োগ ও বিশ্লেষণের নব্যত্বে একটা টেক্সট কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। এ আখ্যান যুদ্ধ, যুদ্ধের সজ্জা, যুদ্ধ বিরোধিতা ও যুদ্ধে বলির হিংসাত্মক বিবরণ। নায়ক ফার্সি পুরাণের কিংবদন্তি রুস্তম। নায়কের যুদ্ধ সজ্জা, যুদ্ধ সাধ, যুদ্ধ অভিলাষ, যুদ্ধের আভরণ-আবরণ, যুদ্ধের কৌশল, যুদ্ধের কার্যকারণ, ফলাফল, যুদ্ধের উত্তরাধিকার, যুদ্ধের অতীত, যুদ্ধের গতি, যুদ্ধের বিরাম, পিতা-পুত্রের যুদ্ধের কৌশল পরায়ণ বিবেচনা নিয়ে ক্রমেই যুদ্ধ সরণিতে প্রবেশ-অস্থিরতা-স্থিতাবস্থা। যুদ্ধ নিয়ে পিতা রুস্তম ও ... ...
অস্তিত্বের যুদ্ধে পরিধি ভেঙে যাওয়ার আখ্যানপুরুষোত্তম সিংহবাংলা গদ্যের (ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ধরলে) দুশো বছর পেরিয়ে গেছে, কবিতার পটভূমি আরো বেশি ফলে বাংলা সাহিত্যের গদ্য-পদ্যের উত্তর আধুনিকতা আসতে পারে কিন্তু জীবনের? নবজাগরণের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাঙালির জন্ম হল তা তো কলকাতাকেন্দ্রিক। কলকাতা থেকে সামান্য দূরে গেলেই অন্ধকার। সেই জীবনের সাহিত্যিক বয়ান কেমন হতে পারে? উপনিবেশ পর্বের বয়ানকে নানা রঙে, মিথে, জারণে ঘূর্ণি সৃষ্টি করে একটা নিজস্ব মডেল গড়ে নিয়েছেন পীযূষ ভট্টাচার্য। নিবিড় ডিটেলিং এর বদলে উপনিবেশের ছিন্নসূত্রকে ধরে সাহিত্যিক ডিসকোর্স গড়ে তুলেছেন। কলকাতা থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে তোর্ষা, তিস্তা, কালজানি তীরে প্রান্তজনের বসবাস কেমন, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারের প্রান্তসীমার প্রান্তিক মানবের হালচাল ... ...
অভিষেকেই স্বতন্ত্র উপন্যাসশিল্পীপুরুষোত্তম সিংহসময়ের নিরন্তর চলমানতা থেকে কিছু খড়কুটোকে আখ্যানে সাজিয়ে দিয়েছেন বনমালী মাল। সংস্কার, লোকায়ত জীবন, জনপদ, বাস্তব-অবাস্তব, বানানো বাস্তব, অর্ধ বাস্তব নিয়ে এক দ্বন্দ্বময় বাস্তবের জন্ম দেন বনমালী মাল ‘কালগর্ভ’ (২০২৪) আখ্যানে। সময়ের অসমান্তরাল বিন্যাসের মধ্যে অন্তর্বিশ্বের যাবতীয় সারাৎসার বিন্দুকে বিবিধ সমীক্ষণে নির্মাণের প্রয়াস আখ্যানকে বহুমাত্রিক সত্যে উত্তীর্ণ করেছে। বনমালী মাল ইচ্ছাকৃতই প্রবাহিত বাস্তবতাকে ভেঙে ফেলেন। বলা ভালো নির্মম বাস্তবতার পাঠকে স্বেচ্ছায় ধ্বসিয়ে দেন। অথচ লক্ষ্য কিন্তু জটিল বাস্তবতার নিপুণ পাঠ। বাস্তব-অবাস্তব, লোকায়ত বাস্তব-মিথের বাস্তব, বানানো বাস্তব, অর্ধ বাস্তব নিয়ে শান্তনু ভট্টাচার্য, শতদল মিত্র, বনমালী মালের পথচলা। হীরেনের দাম্পত্য জীবনের সমস্যা থেকে তারির সন্তানহীনতা, সুপুরুষা-কুপুরুষার দ্বন্দ্ব, আলো-অন্ধকারের পথচলা, ... ...
শোষকের দুর্বৃত্তায়নকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার আখ্যানপুরুষোত্তমম সিংহবাংলা উপন্যাসে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের আখ্যান আশিস মুখোপাধ্যায়ের ‘পোকাবিদ্রোহ ও পীমলদের জাতীয় ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)’ (১৯৮৫)। লেখক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক বাংলা আখ্যানের মোড় ফেরাতে চেয়েছেন। ‘ছাঁচ ভেঙে ফ্যালো’ ট্যাগলাইনে নতুন ফরমান জানান দিতে এসেছেন। গত শতকের আটের দশকে বসে বাংলা আখ্যানকে সর্বার্থেই বোধ মস্তিষ্কচর্চার হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসেছেন। সেই অলিখিত বিদ্রোহে তিনি যে সফল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা আখ্যানের দুর্বল ন্যারেটিভ সম্পর্কে কিছু সূক্ষ্ম ব্যঙ্গও ছুঁড়ে দেন। পোকাদের বিবিধ স্তরের কার্যকলাপ, নানা ইঙ্গিত, ক্ষমতাতান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকের ভেঙে পড়া, রাজতন্ত্রের পাঠে নানামাত্রিক ঘুণ ধরা ও ব্যঙ্গ শ্লেষের মধ্য দিয়ে ... ...
মাঠ ও মেদিনী যে আখ্যানের ধাত্রীভূমিপুরুষোত্তম সিংহকোনো কোনো লেখক আখ্যানমাঠ ক্রমেই প্রসারিত করে চলেন। আবার কোনো কোনো লেখক বৃত্তকে ছোট রেখে তার মধ্যেই নানা আঙ্গিকে পাঠককে পাক খাওয়ান। প্রথম পর্বের লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী, মধুময় পাল। দ্বিতীয় পর্বের লেখক তপনকর ভট্টাচার্য, দেবর্ষি সারগী। কেউ কেউ ব্যক্তিকেই চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট বৃত্তের যাবতীয় সারাৎসার, রহস্যবিন্দুসহ মস্তিষ্কের কার্যকলাপ স্পষ্ট করেন, কেউ কেউ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সমষ্টির চিত্রে চলে যান। আনসারউদ্দিন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেও ব্যক্তির সঙ্গে জড়িত যে সমষ্টির মহাভারত তাই প্রতিপন্ন করতে চান। আনসারউদ্দিন, লুৎফর রহমান আখ্যান মাঠ প্রসারিত করলেও দু-জনের মধ্যে প্রভেদ আছে। আবার সোহারাব হোসেন শিল্পমূল্য প্রতিস্থাপনে যতটা কার্যকারী বাকি দু-জন ততটা ... ...
বাঙালি আর কত লাশ বইবে? পুরুষোত্তম সিংহ মধুময় পাল এই দগ্ধ বাংলার অমাবস্যার আলো। সুতীব্র সময়চেতনা, সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অভিজ্ঞান, সুমিষ্ট ভাষা দক্ষতা ও ব্যঙ্গ-শ্লেষের সুকঠোর আঘাতে তিনি যাপিত সময়কে ছিন্নভিন্ন করেন। এই সচেতন আখ্যান পরিক্রমা বিগত তিনদশক ধরে তিনি ধারাবাহিকভাবে করে আসছেন। সময়ের পোড়া চামড়ার যেন কিছুটা শুশ্রুষার মলম লাগাতে চান। আবার বাঙালির আদেখলেপনা, ন্যক্কারজনক রোমান্টিকতা, মেকি ভাবাবাদের ঘোমটা খুলে দেখিয়ে দেন এই তোমার অবস্থা। কোথাও মধুময় ক্রূর, বিধ্বংসী, ঘাতক সময়কে আক্রমণ করেন। হ্যাঁ মধুময় আক্রমণের ভাষা ও আক্রান্তের ভাষা দুইই আয়ত্ত করেছেন। কে আক্রমণ করে? রাষ্ট্র। কে আক্রান্ত হয়? বাঙালি। ভীতু বাঙালি পর্বে-পর্বান্তরে সব হারাচ্ছে। শুধু সংস্কৃতি নয় পরিবেশ, সভ্যতা, ন্যায়বিচার, ... ...
সমকালীন ভারতের গেরুয়া রাজনীতি যে আখ্যানের চালকপুরুষোত্তম সিংহআদ্যন্ত রাজনৈতিক বয়ান গড়ে তুলেছেন সাদিক হোসেন হোসেন ‘ভারতবর্ষ’ (২০২৪) উপন্যাসে। বহুত্ববাদের দেশ ভারতে রাষ্ট্রশক্তি বলপ্রদত্ত নিজস্ব ধর্মকে কীভাবে কেন্দ্রে রেখে অন্যধর্মসহ বিরোধী জনমতকে পরাজিত করতে বদ্ধপরিকর তার গোপন পাঠ আখ্যানকে বহুমুখী সত্যে ভাসিয়েছে। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে জয়ী রাষ্ট্রপ্রধানেরও নির্দিষ্ট ধর্মের ঊর্ধ্বে মানবিক হওয়া প্রয়োজন। অথচ আজকের প্রধানমন্ত্রী ধর্ম নিরপেক্ষতার বদলে ধর্মের বেশে ভেল্কি নাচন দেখাচ্ছেন। পুরো জোকার সুলভ আচরণ করে, ধর্মীয় গোঁড়ামি দ্বারা দেশকে যেমন ধ্বংস করছে তেমনি দেশের সুমহান ঐতিহ্য, সম্প্রীতিকে ধ্বংস করছে। এই ভাঙনকালে একজন লেখক কী করবেন? সাদিক হোসেন এই ভাঙনের ফাঁকফোকর যেমন আবিষ্কার ... ...