ঈদ উৎসবের বিবিধ উপকরণের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ঈদ সংখ্যার সাহিত্য সম্ভার। ঈদ আর ঈদ উপলক্ষ্যে তৈরি সেমাই, পায়েশ, কোর্মা পোলাও আর অন্যান্য আনন্দ সকল ফুরিয়ে গেলেও ওমর খৈয়ামের উপমার আল ধরে অনন্ত যৌবনের তীব্র সম্ভাবনা নিয়ে সাহিত্য প্রিয় পাঠকের জন্য ঈদের আনন্দ যূথবদ্ধ করে নিয়ে আসে ঈদ সংখ্যা সাহিত্যসম্ভার। সারা বছর অপেক্ষায় থাকা লেখক পাঠকের কাছে ঈদের সাহিত্য সংখ্যা ভীষণ আরাধ্যের বস্তুবিশেষ। এক সময় ঘরে ঘরে এই উৎসব কেন্দ্রিক সাহিত্যের প্রথম পাঠক হবার লড়াই চলতো রীতিমত চর দখলের কায়দায়। তখনকার ঈদ সংখ্যার কারিগরিমান যেমনই থাকুক না কেন গুণগত মান আজকের চেয়ে অনেকগুণ বেশিই ছিল বলে মনে করেন প্রাচীন- বোদ্ধা পাঠক শ্রেণী। আজকের বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিক তাঁদের সোনার কলমে সৃষ্টি করেছিলেন কত সব স্বর্ণালী সাহিত্য। তাঁদের মধ্যে শওকত আলী, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, হুমায়ূন আহমেদ, সেলিনা হোসেন, প্রমুখেরা উল্লেখযোগ্য। ঈদকে ঘিরে শিল্প সাহিত্য বর্তমানেও সংস্কৃতির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। ... ...
রামু দীপালি রেখা রহিম তৌফিক বুদ্ধুরাম সবাই জানে অন্ধকার থাকতে খেয়ে নিয়ে সারাদিন উপোস থাকতে হয়। সারাদিন উপোসটা অবশ্য এদের অনেকের জন্য আলাদা কিছু না। সন্ধ্যার সময় পেট ভরে খেতে হয় তারপর একদিন আসে চাঁদের দিন, সেদিন ঈদ। নামাজ পড়তে হয়। আকাশে একফালি চাঁদের ওপর সুন্দর তারাটি জাগে সেদিন ঈদ। কোলাকুলি করতে হয়।বন্ধুদের কিছু দিতে হয়। মনিপুরী বস্তির গোরাচাঁদ আর ললিতা জানে চাঁদের রাতেই রাসপূর্নিমা নাচের উৎসব কিন্তু সেই চাঁদ বড় আর গোল । সে উপোস হলো কি হলো না, কিন্তু সন্ধ্যায় ইফতার হোলো। একদিন ঘরঘর থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে আনা মুড়ি, কজন এনেছিলো জমানো পয়সায় কেনা তেলেভাজা। একদিন খাওয়া দাওয়া হোলো কলা আর জাম। আর একদিন মিষ্টি আলু পুড়িয়ে খুব ভালো ইফতার হোলো। আজ চাঁদের উৎসব। ... ...
গভীরে ক্ষতটা আমরা দেখি, যারা দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের অন্দরমহলের বাইরে থেকে গেছি। পূজা ও ঈদের মাঝে আমরা কোথাও খুঁজে পাইনি নিজেদের।যে একফালি চাঁদ এত আনন্দের তাকে ছুঁতে পারিনি আবার বিসর্জনের সময় দুর্গামাকেও সাথ দেওয়া হয়নি একবার।উৎসবে অবগাহন অধরা থেকে গেছে।মানুষ হওয়ার বোধহয় এটাই ট্রাজেডি।তাকে হিন্দু নয় মুসলিম হতেই হয়।মুসলিম জন্মায় না।মুসলিম হয় বিশ্বাসে।সে বিশ্বাসের আবার ৫ স্তম্ভ।তা চর্চার বাইরে আমি।তাই চাঁদ রাত আমার কাছে এক গল্পমাত্র ।আর আমি যদি বলি সিন্ধুর তীরের হিন্দু আমি, কে দেবে আমায় দুর্গা ঠাকুর পছন্দ করে মণ্ডপে আনতে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেই সরস্বতীদেবীকে তো হোষ্টেল সুপার আনতে দিতে বাদ সেধেছিলেন।জানিয়ে দিয়েছিলেন এক অহিন্দুর কখনো ঠাকুর চয়েস করার কাজ করতে পারে না!আমার মত অনেকের উৎসবের চেনা পথ তাই নির্জন,ব্যতিক্রমী।তবু আনন্দ জাগে………… ... ...
কালের নিয়মে একদিন বিয়ে করলাম। নতুন বৌকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। রাস্তায় দেখা লালি পিসির সঙ্গে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। দেখলাম কাল্টুদের বেড়ার ঘর পাকা হয়েছে, ছাদ হয়েছে। আমাদের দুজনকে বসিয়ে প্লেটে করে দুটি সন্দেশ আর জল দিলেন। তাকের ওপরের কৌটো থেকে একটা দোমড়ানো ময়লা কুড়ি টাকার নোট বার করে দিলেন আমায় বৌয়ের হাতে। বললেন, "বৌমা, কিছু কিনে খেও"। বৌকে নিয়ে গেলাম একদিন ইমাম সাহেবের ডেরায়। আমার স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। হাতে তুলে দিলেন একটি দশ টাকার নোট। চলে আসবার সময়ে বৃদ্ধ মানুষটার চোখের কোনাটা কি চিকচিক করছিল। ... ...
সময় হলে মৌলানাসায়েব নামাজ শুরু করবেন।নামাজে আমরা সবার জন্যে মঙ্গলকামনা করবো। আমাদের চলে যাওয়া সবার ভালো চাইবো। যে বৃদ্ধ মানুষটি ভয় পাচ্ছেন যে আগামী ঈদের নামাজে তিনি হয়ত থাকতে পারবেন না তিনি সবার কাছে কোনো ভুল করে থাকলে ক্ষমা চাইবেন। আমরা তার দীর্ঘ জীবন চাইবো।মৌলানা প্রতিটি মানুষের মঙ্গল চাইবেন খোদাতলার কাছে।আপনি দেখবেন এইসময় আমাদের প্রবীণ মৌলানা মানুষটি কেঁদে ফেলেন।আমার মতন উদাসীন লোকেরও বুকের বাম দিকে কোথাও হাল্কা ব্যথা শুরু হয়। নামাজ শেষ। আসুন, এবার আমরা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করি। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে। সমস্ত বৈরিতা দূর হোক। আমার-আপনার সবার কুশল হোক। এবার চলুন বাড়ির দিকে হাঁটি।আব্বার জন্য দাঁড়াতে হবেনা। উনি সবার শেষে ঈদগাহ থেকে বের হবেন। প্রত্যেকটি মানুষের সাথে আলিঙ্গন ক'রে। ... ...
কটা একটা করে বছর আব্বুলিশ বলতে যখন ব্যস্ত, আড়ম্বরের কাছে সরলতা কোটোয় বন্দী বোকা-জীবন তখন রকমফেরের পরখ পেতেই ঈদ সে যাপনমুখী। এখানে হলে সলমন থাকে, গুজরাটে - কেরালায় কাজ করা আজিজুল- মোক্তার এরা থাকে সপ্তাহ খানেকের ছুটির আনন্দে। এখানে মাঠে সার্কাস বসে, বিকেলে চপ-রোল-চাউমিন-জিলিপি-বাদামের মেলা থাকে। ঈদগাহ সাজানোর রঙিন কাগজী বেলাভূমিতে মিতায়ু সুর্মা উদ্বেল থাকে আনন্দে - তিতিক্ষায়। এখানে লালবাগে প্রেম থাকে ফুরফুরে, ইতিহাস মেখে উথালপাতাল অধুনা থাকে বেমিশাল....। আদতে তো একটাই দিন। সমস্ত কুশল সংবাদ, ভালবাসা, খুশি, মুহূর্ত সময় আগলে অহেতুক প্রশ্রয় দেওয়ার দিন...এমন গচ্ছিত মায়াদিন - ... ...
কাকদ্বীপ থেকে হাওড়ার গ্রামের বাড়িতে ঈদ কাটাতে এসে ঈদের দিন আব্বার কাছ থেকে আমি আর মেজো দশটাকা করে পেতাম। নামাজ শেষে ঈমাম সাহেবের সাথে হাত মেলানোর সময় তা দিয়ে দিতে হতো। কিছু টাকাপয়সা মানে দু চারটাকা জমিয়ে রাখতাম আলমগির-বাসুনদের জন্য। আলমগির-বাসুন সাড়ে আটটার জামাতে নামাজ পড়ে নিতো ভাঙা মসজিদতলায়। আমাদের মসজিদে জামাত শুরু হতো নটায়। নামাজ শেষ করে বড়দের সালাম করে, বন্ধুদের সাথে কোলাকুলির পর দেখতাম আলমগির-বাসুন ঘুগনির পশরা নিয়ে বসে থাকতো মসজিদের গেটের সামনে। ছোট কলাপাতায় একটাকার ঘুগনি। তালপাতার পাতা কেটে বানানো চামচে তুলে খেতে হতো। ক্ষীর, লাচ্ছা-সিমুইয়ের জয়জয়কারের মাঝে হাতে হাতে ঘুরতো আলমগির আর বাসুনের ঘুগনি। যেন আলুকুচির মধ্যে গলে যাওয়া মটরের চিত্রনাট্যে সেলিম-জাভেদের জুটি। অজ পাড়াগাঁয়ে ঘুগনিটুকুই যেন ঈদের উপরি পাওনা। ঘিরে ধরা বাচ্চাকাচ্চার ভিড়, হইচই। আধঘণ্টায় ফুরিয়ে যেতো সব। ... ...