এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • যাইদূর

    শ্রীমল্লার বলছি লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৯৬ বার পঠিত
  • | | |
    “আমারই ভুল। ভুল আমারই। প্রশ্ন করতে শিখিনি। যা শিখেছি, তাকে প্রশ্ন করা বলে না। তবে শোনো, আমরা যখন কোনও কিছুকে একেবারের জন্যই ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবি বা মনে করি, তখন আরও বেশি ক’রেই থেকে যেতে চায় মন সেইখানে। ছাড়তে দিতে চায় না। কিন্তু যদি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারো, তখনই সমুদ্রে পড়লে! তবুও জেনো, সমুদ্রে পড়ার আগে ছোট ছোট সাঁতার শিখে নিতে হয়। প্রস্তুতি সেই অর্থে তিন রকমের— পুকুর, নদী আর সমুদ্র। ছেড়ে দেওয়ার ভাবনা যখন আসে, তখন তুমি পুকুরের কাছে এসে এক পা এগোও সাঁতারে। ছেড়ে যখন দেবে ভাবছ, তখন তোমাকে নদীর কাছে এসে আরও এক পা এগোতে হয় এই কারণেই যে, সমুদ্রে যাওয়ার আগে অর্থাৎ তুমি ছেড়ে দেওয়ার আগমুহূর্তে কতটা তৈরি হতে পেরেছ, দিতে হয় তার পরীক্ষা। যদি উত্তীর্ণ হও এই পরীক্ষায় তবেই তুমি সেই সম্পর্কে ইতি টেনে সাঁতারের অনুমতি পাবে সমুদ্রে। আর সমুদ্রে পৌঁছনোর পরেই তুমি প্রবেশ করলে এক অমীমাংসিত ঘটনার কাছে। ঘটনাই বলব একে। ঘটনাই বলা যায়। সেই ঘটনা দু’মাত্রার— কিন্তু তুমি আরও একটা জীবন পেলেও এর কোনও কিনারা পাবে না। সেই দু’মাত্রার ঘটনার নাম: ‘ভয়’! আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একটা গোটা সমুদ্রের সমান ভয় লুকিয়ে আছে। সমুদ্রের কাছে পৌঁছনোর পরে তোমার নিজের কাছেই সবচে’ বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ভেতরের ভয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাইরের অবাধ্য সমুদ্রের প্রতি মুহূর্তের, প্রতি পদক্ষেপের আচরণের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। যদি মানিয়ে নিতে পারো, তবে তোমার গন্তব্য নিজে এসে তোমার পায়ের সামনে ধরা দেবে। আর যদি ফাঁকি দাও, তাহলে ডুবতে ডুবতে টুকরো হ’য়ে কোথাও এমন হারিয়ে যাবে, যেখান থেকে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কেউ নেই। এমনকী তুমি নিজেও না। কেননা, তখন তুমি বাইরের দুনিয়ার কাছে না মৃত, না জীবিত— সোজা কথায় নিখোঁজ! আমরা ছাড়ার পরেও যে বেঁচে আছি, তার কারণ— ফাঁকি আমাদের মধ্যে কেউই দিইনি। যদি দিতাম, তাহলে বাইরের দুনিয়ার কাছে আমরা না মৃত, না জীবিত— নিখোঁজ হ’য়ে যেতাম সোজা কথায়। একটু আগেই যা বললাম তোমাকে।”
    রোশনাই সংকেতকে কথাগুলো এমনভাবে বলল, যেন সদ্য জন্ম নেওয়া কয়েক মাসের ছোট্ট শিশুকে মা-পাখি বড় ধীরে, বড় যত্ন ক’রে সেই শিশুর চাইতেও আরও ছোট্ট একটুকরো খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। যাতে ক’রে তার গিলতে সুবিধে হয়, এবং দ্রুত হজম করতে পারে। তবুও সংকেত যে ঘোড়া আর খরগোশের মাঝামাঝি কিছু একটা, সেকথা ভালই বোঝে রোশনাই। তাই সে খেয়াল রাখে, নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে সে যেন সংকেতকে কোনওভাবে আঘাত না দিয়ে ফ্যালে। 
    “কলেজের বাংলার ক্লাসে মন ছিল না। অথচ বাংলাকে, বাংলা বিষয়কে ভালবাসতাম। ভালবাসি। নিন্দে করব না, যা দেখেছি, সেটাই বলি— কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে প্রথমদিকে অনেকেরই পড়ায় মন ছিল। দিন যত এগোতে লাগল, হাতেগোনা কয়েকটা প্রতিভা বেরিয়ে এল, বাকিরা হারাতে বসল। সেই হারানোর দলে আমিও ছিলাম। কেমন সে হারানো? কলেজ যাওয়ার আগে বাড়ি থেকে যখন তৈরি হতাম, তখনই মনটা চুপ মেরে যেত। তার পা রাখার ইচ্ছে থাকত না কলেজের গণ্ডিতে। মনেরও হাত আছে, পা আছে, চোখকানঠোঁটনখপিঠঘাড় সঅব, সব আছে। তাছাড়া তো জানোই, মন কথা বলতে পারে এক অননুকরণীয় ভঙ্গিতে। যা মনের একমাত্র নিজের, একমাত্র আইডেণ্টিটি। তো যা বলছি, টেনে হিঁচড়ে সেই মনকে বাড়ি থেকে কলেজ অব্দি নিয়ে যখন পৌঁছতাম— ততক্ষণে মন আমার আহত। রক্ত ঝরছে। অথচ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইলেও কোনও এক কারণে পারতাম না, মনকে আমার, আমার মনকে সাহায্য দিতে। মনে রেখো, আমি মনের বিরুদ্ধে যেতাম। গিয়েছিলাম, মনের বিরুদ্ধে। এখন এই অবস্থায় মন কী ক’রে পারে কলেজের ক্লাসে মন বসাতে? তখন তো সে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে প’ড়ে আছে নিশ্চুপ! তার মধ্যেও মনকে জোর দিতাম, গায়ের জোর দিতাম— যেন সে অন্তত প্রথম ক্লাসটায় কিছুটা সজাগ থাকে। পারত না। আর তাই, মন হারিয়ে পেছনের দিকের বেঞ্চে কালো ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে হাঁ ক’রে তাকিয়ে ব’সে থাকতাম। যেমনটা মানুষ স্মৃতি হারিয়ে থাকলে ক’রে থাকে। আর তাই, দু’টো-তিনটে ক্লাস হওয়ার পরেই, পালিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। মন তখন ঘুমোচ্ছে, তাই আর বিরক্ত করতাম না ওকে। এভাবে একবছর চালানোর পরেই সিদ্ধান্ত নিই, কলেজ ছাড়তে হবে। মনের বিরুদ্ধে যদি এভাবেই যেতে থাকি, তবে একদিন মনকে হারিয়ে ফেলব। তখন আর আমার বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না।”
    ঠিক ঘোর নয়, বলা যেতে পারে সচেতন অবস্থায় সাবলীলভাবেই সংকেত কথাগুলো বলল। ব’লেই ফেলল। রোশনাইয়ের কথা শেষ হতেই সংকেত কথা শুরু ক’রে দিয়ে যখন থামল, দেখল যে বিছানা গুছিয়ে ফেলেছে সে রোশনাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই। খেয়াল হয়নি। আসলে, কথার মধ্যে ছিল তো... কথার খুব গভীরে ছিল সংকেত। সংকেত যেভাবে বিছানা গুছিয়েছে, যদি এমন কোনও সম্পাদক থাকতেন, যিনি শুধুই বিছানা সম্পাদনা করতে পারেন, তাহলে তিনি সংকেতের এই বিছানা গোছানোয় কোনও সম্পাদনা করতে পারতেন না। সংকেত সে জায়গা রাখেনি। কাজের সঙ্গে আত্মাকে মিশিয়ে দিলে যে ম্যাজিকটা ঘটে, সেটা সংকেতকে না দেখলে বিশ্বাস করা একপ্রকারের মুশকিল। সংকেতের কাজের প্রতি এই যত্ন, সংকেতকে তার বয়েসি আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা ক’রে তুলেছে। 
    “নিজের ইচ্ছেকে মেরে যে ফ্যালোনি, বরং ঝুঁকি নিয়ে লড়াইয়ের স্বাদ পেতে ছুটে চলেছ— এখানেই তুমি আসলেই ‘তুমি’। ইচ্ছেরা তো রোদ্দুরে ঝলমল করা সবুজ গাছেদের মতোই। যাদেরকে দেখতে ভারি মিষ্টি লাগে, আর যাদেরকে ছুঁতে লাগে আন্তরিকতা। এই ইচ্ছের পাশে পাশেই হেঁটে চলে সাহস। তাই ব’লে ভেবো না যেন ইচ্ছের সাহস কম। সাহস ইচ্ছের পাশে পাশেই থাকে এই কারণেই, ইচ্ছে কখনও দ্বন্দ্বে পড়লে, কিংবা কোন পথে যাবে বুঝে উঠতে না পারলে, সাহস তাকে কেবল ইশারায় দিক নির্দেশ ক’রে দেবে। ইচ্ছেকে এইটুকু বুঝে নিতে হবে। নিতেই হবে।”
    না, আত্মবিশ্বাস নয়। যুক্তি যতদূর দৌড়তে পারে, রোশনাই ততদূর অব্দি দৌড়ে এসে, সংকেতকে জানালো এইসকল কথা৷ 
    রোশনাই থামতেই সংকেত বলল, “তুমিও কোনও পথ পেয়েছিলে, পেয়েছ নিশ্চই বলো? আর সেই কারণেই...”

     
     
     
    (ক্রমশ)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Manali Moulik | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:০৭734457
  • সুন্দর এগোচ্ছে
  • শ্রীমল্লার বলছি | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:১৩734489
  • ভরসা পেলাম মানালি! আসলে গদ্য কীভাবে লিখতে হয়, আমার জানা নেই। কিছু কথা আমার বলার আছে, সেটা একমাত্র গদ্যেয় সম্ভব। তাই চেষ্টা করছি। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন