এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • বেশ তো, চটি চাটা। তাই সই

    মালবিকা মিত্র
    আলোচনা | রাজনীতি | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২০৫৪ বার পঠিত | রেটিং ৩.৬ (৫ জন)
  • বাংলা শব্দ ভান্ডারে "পা চাটা" শব্দটা বেশ চেনা। শুনতে খারাপ লাগলে এটাকে একটু পোশাকি ভদ্র ভাবে বলা হত "পদলেহি"। "পা চাটা" বলতে বোঝাতো নিকৃষ্ট মানের চাটুকার। কেমন উদাহরণ দেব? এই ধরুন, সঞ্জয় গান্ধী যখন কংগ্রেসের যুব নেতা তখন তিনি মঞ্চের একটু উঁচু ধাপে উঠতে পারছেন না বলে, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কুঁজো হয়ে মাটিতে বসে পিঠ পেতে দেন। সঞ্জয় গান্ধী সেই পিঠ বা সিঁড়িতে পা দিয়ে উপরে উঠে যান। এটাকে বলা যায় পা চাটা। অথবা ধরুন সবাই দেখছে রাজার কাপড় নেই। রাজা উলঙ্গ। কিন্তু কেউই বলছে না। কেউ কেউ বলছে রাজ বস্ত্র অতীব সুক্ষ্ম। তাই দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে না। কবি নীরেন চক্রবর্তী, এই ধরনের যে স্তাবকের ছবি এঁকেছেন, তাকে বলা হয় চালু বাংলায় পা চাটা। আর পোশাকি বাংলায় বলা হয় পদলেহি। শুনতে একটু ভদ্র এবং গম্ভীর।

    পা চাটা শব্দটা দিয়ে একটা সর্বজনীন নিকৃষ্ট মানের চাটুকারদের চিহ্নিত করা যেত। একটা হীনমানের মনোবৃত্তিকে চিহ্নিত করা যেত। তার ভেতরে পৃথক কোন দল গোষ্ঠী সম্প্রদায় বোঝাতো না। ধরুন পা চাটা বললে সিদ্ধার্থ শংকরের পা চাটা হতে পারে, আবার জ্যোতি বসুর পা চাটা হতে পারে, দুইই। ধরুন না, দেবকান্ত বড়ুয়া যখন বলেন "ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা এন্ড ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া" এটা পা চাটার একটা নমুনা বলা যায়। কিন্তু পা চাটা শব্দটা নিজে দেবকান্ত বড়ুয়া বা ইন্দিরা গান্ধী এদের নির্দিষ্ট করে না। আবার যখন সম্বিত পাত্র বলেন "জগন্নাথ দেব নিজেই নরেন্দ্র মোদির ভক্ত" কেউতো পা চাটলো। কিন্তু পা চাটা শব্দটা নিজে এখানে সম্বিত বা মোদি কে নির্দিষ্ট করে না। সেই বিচারে চটি চাটা শব্দটা অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট। আপনি বলতেই পারেন তর্কের খাতিরে বুদ্ধদেব বাবুও চটি পড়তেন। তবে কি চটি চাটা বলতে অন্ধ সিপিএম ভক্তকে বোঝায়? নিশ্চয়ই না, বোঝায় না।

    কেন বোঝায় না, কারণ চটি চাটা শব্দটার মধ্যে একটা শব্দ উহ্য আছে, তা হল হাওয়াই চটি চাটা। এটা খুব সুনির্দিষ্ট। পা চাটায় এদের আপত্তি নেই যারা চটি চাটা শব্দটি আমদানি করেছেন, হাওয়াই চটি চাটায় তাদের বেজায় আপত্তি। আর হাওয়াই চটির কথায় প্রথমেই মনে পড়ে "মেঘে ঢাকা তারা" সিনেমার প্রথম দৃশ্য। ফটর ফটর শব্দ তুলে হাওয়াই চটি পরে নীতা চলেছে। হঠাৎই একটা ফিতে ছিঁড়ে গেল। আর ওই দৃশ্যটা মনে গেঁথে যায়। কারণ আমাদের স্কুল কলেজ জীবনেও হাওয়াই চটি ছিল প্রধান অবলম্বন, অন্তত আমার। সে চটির স্ট্র্যাপ দুটো এত বড় হয়ে যেত যে চটিটা পা থেকে খুলে খুলে যেত। ফটর ফট শব্দ তুলত। আমি ছিলাম হাওড়া গার্লস এর ছাত্রী। ট্রেন ধরতে আসতাম মেইন লাইন ব্যান্ডেল বা বর্ধমান। কিন্তু বার কয়েক ভুল করে হাওড়া থেকে তারকেশ্বর লোকাল বা বর্ধমান কর্ড ধরে ফেলেছি। আমার বান্ধবী আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, ট্রেনের প্যাসেঞ্জার কেমন চটি পড়ে আছে, তা দেখেই নাকি গাড়ি চেনা যায়। বর্ধমান কর্ড বা তারকেশ্বর লোকাল হলে প্যাসেঞ্জারদের পায়ে অনিবার্যভাবে হাওয়াই চটি। সেদিন আমার বন্ধুর চোখে মুখে বাক্যে দেখেছিলাম হাওয়াই চটির প্রতি কি তাচ্ছিল্য। আর তখন থেকেই হাওয়াই চটিকে একটা বিশেষ ক্লাসের অন্তর্গত করেছিলাম। আর আমি সেই ক্লাসের একজন হয়ে উঠেছিলাম।

    কালক্রমে আমি যে রাজনীতির সাথে যুক্ত হলাম। সেই রাজনীতিতে জমায়েতে ভিড় বাড়ানোর জন্য হাওয়াই চটির গুরুত্ব থাকলেও পার্টিতে পাম্প সু, কোলাপুরি চটি, রাজেশ খান্নার বিশেষ স্টাইলের চটি, ক্যুয়োভাদিস অ্যাম্বাসাডর ইত্যাদি জুতোর প্রাধান্য দেখেছি। আমি হাওয়াই চটির প্রতিনিধি হিসেবে, পাম্প সু যা আজীবন জ্যোতি বসুর পায় শোভা পেতো, জঘন্য লাগতো। আরো বিরক্ত লাগতো এই কারণে যে, শ্রীকান্তের বন্ধু ইন্দ্রনাথের দাদা নতুনদা র পাম্প সু কাহিনী মনে পড়ে যেত বলে। টিপিকাল বাঙালি বাবু সাথে জড়িয়ে আছে পাম্প সু। পা চাটা দের সাথে এই পাম্প সু চাটা বা কোলাপুরি চাটা শব্দ যুক্ত হয়নি। কারণ ওনারা বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার, কেউবা প্রেসিডেন্সির ইন্টেলেকচুয়াল, কাম্যু কাফকা পড়া, মার্কেজ পড়েন। তাই পা চাটা গোত্র ভূক্ত পাম্প সু বা কোলাপুরি চাটা যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। ওগুলো তৈরিই হয়েছে চাটার জন্য। কিন্তু হাওয়াই চটি পাদুকা সমাজের সর্বনিম্নবর্গে অবস্থান করে এখানেই চটি চাটা শব্দের মাহাত্ম্য। পা চাটা বলতেই বোঝায় পাম্প সু চাটা কুয়োভাদিস চাটা কোলাপুরি চাটা। কিন্তু চটি চাটা মানে হাওয়াই চটি চাটা।

    অর্থাৎ এক কথায় চটি চাটার মধ্যে একটা শ্রেণী ঘৃণা লক্ষ্য করা যায়। সেই শ্রেণী ঘৃণা টা হচ্ছে হাওয়াই চটির প্রতি ঘৃণা। উনি মার্কেস অনুবাদ করেন না। ওনার ছড়া এপাং-ওপাং ঝপাং। কিন্তু সেই ছড়াটা আপনি আমি না বুঝলেও যে বোঝার সে বোঝে, বুঝে হেসে গড়ায়। উনি দারুণ চোস্ত ইংরেজি তো বলেনই না, বরং ভুল ইংরেজিও বলেন। অম্বিকেশ মহাপাত্র ভিন্ন ভিন্ন ছবিকে সুপার ইম্পোস করে সোনার কেল্লার সংলাপ দিয়ে কার্টুন করলেন। হাওয়াই চটির দিদিমনি বলেছিলেন ভিন্ন ভিন্ন ছবি ডি কম্পোজ করা হয়েছে। ব্যাস সেটাই মিম হয়ে গেল। এজন্যই তো হাওয়াই চটিকে একটু হীন চোখে দেখা হয় তাই না। তা ধর্মতলায় একুশে জুলাই এর মঞ্চে উনি "সাঁরে জাঁহা সে আচ্ছা" নজরুলের লেখা বলে দেন অবলীলায়। পাশ থেকে কেউ যখন ভুল সংশোধন করেন "ওটা ইকবাল", তিনি ওই মঞ্চেই তাকে জানিয়ে দেন তিনি ভুল বলেন নি, ওটা নজরুলেরই লেখা। এই নিয়ে তো মিম হয়। এই জন্যই হাওয়াই চটি, হাওয়াই চটি, চটি চাটা শব্দ ও শব্দবন্ধের আমদানি।

    আসুন এবার একটু অন্য কথা বলি সাইন্স সিটিতে জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস হচ্ছে সেই বিজ্ঞান কংগ্রেসে হোস্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বললেন অ্যাস্ট্রোনমি ইজ নট অ্যাট অল এ সায়েন্স, ইট ইজ পিওরলি এ সুপারস্টিশন। অনেকেই মুখ চাপা, ঠোঁট টেপা হাসি হেসেছিল। কিন্তু সেটা মিমের যুগ ছিল না। পরের দিন বুদ্ধ বাবুর নামে প্রেস রিলিজ করা হলো, অ্যাস্ট্রলজি আর অ্যাস্ট্রোনমি গোলমাল হয়ে গেছে। আবার মনে করে দেখুন পুরুলিয়ায় গিয়ে দুই বন্ধু তাদের একজন সৌম্যদীপ বসু আর একজন এই মুহূর্তে নামটা মনে পড়ছে না তারা মাওবাদীদের হাতে অপহৃত হলেন। তাদের পরিবার উদ্বিগ্ন, বাড়ির ছেলেদের খবর না পেয়ে। সেই সময় সাংবাদিক সম্মেলনে বুদ্ধবাবু বললেন দুজন পর্যটক যুবককে পুরুলিয়ায় হত্যা (কিল্ড) করা হয়েছে। এই শুনে তো পরিবার দিশেহারা। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে, কেন পুলিশ এই সত্য গোপন করেছে। পুলিশ বলে চলেছে অপহৃত, আর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন হত্যা। পরদিন বুদ্ধ বাবুর প্রেস রিলিজ, কিডন্যাপড বলতে গিয়ে কিল্ড বলা হয়েছে ।

    না না এসব নিয়ে মিম হয় না। কারণ ওনারা তো কেউ হাওয়াই চটি পড়ে না। আসলে জন্মসূত্রে না হলেও, জীবন যাপনে ও চর্চায় আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাওয়াই চটি শ্রেণীর অন্তর্গত। ওই হাওয়াই চটি শ্রেণী, যাদের নিয়ে বুদ্ধ বাবুরা ভোট করেন, বুথ দখল করেন। সেই হাওয়ায় চটি শ্রেণী, যাকে দিয়ে জ্যোতি বাবু সাতগাছিয়ায় বিপুল মার্জিন তৈরি করেন। কিন্তু নিজেরা ওই শ্রেণীর ভুক্ত নয়। মমতা ব্যানার্জির হাওয়াই চটির শাসনে ওই হাওয়াই চটির শ্রেণীটা অন্যের হয়ে বুথ দখল করে না। নিজেই ক্ষমতাসীন হয়েছে, নিজেই নিজের বুথ দখল করে। এটা একটা বড় পার্থক্য ঘটে গেছে। এলিট সম্প্রদায়ের এটা একটা গাত্রদাহ। হাওয়াই চটির শাসনে পাম্প সু কোলাপুরি। সুভাষ চক্রবর্তী যার জোরে ভোটে জিততেন তৃণমূল আমলে, সেই মানুষটা নিজেই ভোটে দাঁড়ায় ও যেতেন। আগের মুখ্যমন্ত্রীরা হলেন ডাক্তার ব্যারিস্টার প্রেসিডেন্সি কলেজ সেন্ট জেভিয়ার্স। একমাত্র ব্যতিক্রম প্রফুল্ল চন্দ্র সেন ছিলেন মাটির কাছাকাছি। ফলে এলিট বামেরা তাকে নিয়ে কম হাসির খোরাক করেননি। উৎপল দত্ত তো প্রফুল্ল সেনের বাংলা কথায় আঞ্চলিক উচ্চারণ ভঙ্গি টাকেও প্রতিনিয়ত বিদ্রুপ করেছেন (পিরতিনিধি, পেরেত্যেক, পকিরতি ইত্যাদি)। সেই কারণেই যোগমায়া দেবী কলেজের হাওয়াই চটি পরা মেয়েটা, যে দুধের ডিপোয় কাজ করে, একটা টালির বাড়িতে, মাকে নিয়ে সংসার চালায়, সে হাসির খোরাক হবে। আর সেই কিনা মাত্র ২৮/২৯ বছর বয়সে জাঁদরেল ব্যরিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় কে হারিয়ে হাজির রাজনীতির আলোক বৃত্তে। এ কি সহ্য হয়?

    ঠিক এইখানে আমি রাজনীতির দার্শনিক বা তাত্ত্বিক দিক থেকে নয়, জীবনযাপন, সাধারণের সহজবোধ্যতা, ইজি অ্যাক্সেসেবল, সরাসরি দেখা করে সমস্যার কথা বলা যায়। আবার মুখোমুখি সমস্যার ফার্স্ট হ্যান্ড সলিউশন করতে তিনিও হাওয়াই চটি পড়ে সরাসরি বিক্ষোভকারীদের সামনে হাজির হতে পারেন। কোভিডের দিনে দিব্যি পথে নেমে রেশন দোকানে রাস্তাঘাটে দাঁড়ানোর নিয়ম শেখাচ্ছেন, রং তুলি দিয়ে এঁকে এঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সোজা কথায় বলতে গেলে ১৯৭৭ সালে জ্যোতি বসু বলেছিলেন "আমরা রাইটার্স বিল্ডিং থেকে বসে বসে রাজ্য শাসন করব না" -- বাস্তবে সেটা শুরু হলো হাওয়াই চটির শাসনে ২০১১ সালের পর। জ্যোতি বসুর পাম্পসু র কথা বললেই মনে পড়ে দৃশ্যটা -- কলকাতায় বৃষ্টিতে জলমগ্ন। জ্যোতিবাবুর পদ্মিনী প্রিমিয়ার গাড়িটা একটু নিচু বলে জল উঠে যাওয়া সম্ভাবনা। তাই পদ্মিনী প্রিমিয়ারের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো পুলিশের পাইলট ভ্যানটা। জ্যোতি বসু নিজের গাড়ির থেকে একটি পা বাড়িয়ে দিচ্ছেন পাইলট ভ্যানের পাদানি তে। বুঝতেই পারছেন এখন তখন পরি মরি অবস্থায় বিব্রত পুলিশকর্তারা। সেই ছবি কাগজে বেরিয়েছিল। হাওয়াই চটি হলে এত সমস্যা ছিল না। সোজা একটা পা জলে দিয়ে আর একটা পা দিয়ে জিপে উঠে যাওয়া। এখানেই হলো ক্লাসের প্রশ্ন।

    সাধারণভাবেই জেমস মিল, জেরেমি বেন্থামরা মনে করতেন শাসকের প্রতি শাসিতদের একটা প্রজাসুলভ আনুগত্য থাকা প্রয়োজন। তা না হলে শাসন করা যায় না। কিন্তু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাজা হরিশচন্দ্রের শাসনকেও শাসকের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয়। সেই প্রথম দৃষ্টিকোণ থেকেই বিক্ষুব্ধ জুনিয়র ডাক্তারদের মহাকরণের ডেকে জ্যোতিবাবু, ধমকাতে পারেন। সে ধমকানি বড়ই মধুর। আর দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই হাওয়াই চটি সরাসরি বিক্ষোভকারীদের অবস্থান মঞ্চে হাজির হন। যা ভারতের ইতিহাসে বিরল। এর ফলে আনুগত্যের ভাবটা কেটে যায়। সহ মতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। তা না হলে, "আমি তোমাদের দিদি হিসেবে এসেছি" এই কথা বলার পরেও কোন জুনিয়র ডাক্তারের মনে এতটুকু দাগ কাটল না! আরো অবাক হলাম যখন কালীঘাটের বাড়িতে প্রথম দিন আলোচনা হলো না। নানান অছিলায় জুনিয়র ডাক্তাররা আলোচনা ভেস্তে দিল। তারপর মুখ্যমন্ত্রীর সেই ছবি, আটপৌরে শাড়ি, এক মধ্যবয়সী মহিলা, দরজায় দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ কারীদের বলছেন "তোমরা অন্তত বৃষ্টিতে ভিজো না, ভেতরে এসো, কথা না বলো, একটু বসে চা খেয়ে যাও"। এই আন্তরিক মানবিক ডাক কেও কি সহজে অসৌজন্যের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিল জুনিয়র ডাক্তাররা। ওই সময় ঋত্বিক ঘটক হলে অবশ্যই ব্যাকগ্রাউন্ডে দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে গানটি বাজাতেন "কেন চেয়ে আছো ..... এরা চাহে না তোমারে চাহে না গো। আপন মায়েরে নাহি জানে"।

    মুখ্যমন্ত্রী প্রতি জুনিয়র ডাক্তারদের ওই আচরণে অসৌজন্য মূলক ব্যবহারে আমি নিজে সেদিন অত্যন্ত ব্যথিত হয়েছিলাম, লজ্জিত হয়েছিলাম। কিন্তু একদিন পরেই আমার ব্যথা বেদনা কেটে গিয়েছিল উপশম হয়েছিল। কারণ সারা রাত ভেবে দেখলাম,
    ১)মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে আলোচনার শেষে আন্দোলনকারীরা ফিরে আসছে। ধর্না মঞ্চে তুমুল হইহল্লায় চলছে নাচাগানা হয়তো আরো কিছু।
    ২)ফিরে আসা প্রতিনিধি দল আলোচনার 'সার বস্তু জানাবেন, তার জন্য মাইক্রোফোন নিয়ে তিন নেতার কাড়াকাড়ি চলছে। অনিকেত কিছুতেই মাইক্রোফোন ছাড়বেন না অন্যদের হাতে।
    ৩)এইসব টা দেখে চরম ঘেন্নায় নাকে চাপা দিয়েছিলাম। যাদের সহকর্মী ধর্ষিতা হয়ে খুন হয়েছেন, তার সুবিচারের দাবিতে ধরনা। আর সেই ধরনায় এমন অসভ্য আচরণ। তাহলে এরা আর মুখ্যমন্ত্রীকে, একজন দিদিকে এই সম্মান জানাবে কোথা থেকে? এদের কাছে সম্মান ব্যাপারটাই জানা নেই। আসলে কাউকে সম্মান জানানোর প্রথম শর্ত হলো আত্মসম্মান থাকা চাই। আত্ম টাই অনুপস্থিত।
    ৪) এর উৎস খুঁজতে হবে ১৯৮৭, রাজীব গান্ধীর তৈরি শিক্ষা নীতিতে এবং ১৯৯০ সালের শিক্ষা বেসরকারি করণের নীতির মধ্যে। ভালো নার্সারি স্কুলে ভর্তির জন্য আড়াই বছর বয়সেই রিমি ম্যাম আর নিশা মিসের কোচিং শুরু। এরপর নার্সারি স্কুল থেকে একের পর এক কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। ফ্রম কেজি টু পিজি। বিদ্যালয়, কলেজ শিক্ষা, পিজি কোনোটি কোচিং ব্যতিরেকে সম্পন্ন করেনি। এমনকি ডাক্তারি ইউজি, পিজি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রেও লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে আকাশ ফিটজি তে কোচিং নিয়েছে। ছাত্রদের কাছে শুনেছি মেডিকেল কলেজে পড়া কালীন সময়েও এরা কোচিং নেয়।

    একজন ডাক্তারি পড়ুয়া আমার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, ফোনে কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, ফার্মাকোলজি টা একদম বুঝতে পারছে না। ওকে বললাম, তোদের কলেজে পিজি ট্রেনি আছে আমাদের স্কুলেরই ছাত্র অমুক। তাকে আমার কথা বল, সে বুঝিয়ে দেবে। পরে একদিন ওই সিনিয়র ছাত্র আমাকে ফোন করে বলছে : আমাকে পুরো কেস খাইয়ে দিলেন বাচ্চা ছেলের সামনে। কি লজ্জা। সেএএ ই এমবিবিএস সেকেন্ড ইয়ারে ফার্মাকোলজি পড়েছিলাম। এতদিনে সব ভুলে গেছি। ওকে কি করে বোঝাবো, আমি নিজেই বুঝিনি। মুখস্ত করে পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি, ব্যাস, ভুলে গেছি। মনে পড়ল ডাক্তার নবারুণ ঘোষালের সেই উক্তি "বেশিরভাগ ডাক্তার নিজের লেখা ওষুধ কিভাবে কাজ করে তা জানেন না। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা এখন আমাদের শিক্ষক। তারা আমাদের যে ওষুধ লিখতে বলেন, আমরা তাই লিখি। আগে তা লিখতাম উপহারের বিনিময়ে, এখন লিখি নগদ টাকার বিনিময়ে"। সেই সমস্ত ডাক্তার, তারা আন্দোলন নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও প্রাইভেট কোচিং নির্ভর হবেন এটাতে অস্বাভাবিকতা নেই। ফলে ওদের দোষ দিই না। তাই এত সিদ্ধান্তহীনতার প্রাধান্য। আর এই সিদ্ধান্তহীনতা থেকে কাউকে এত সহজে অসম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব। আত্ম কি জানেনা, সম্মান কি জানেনা।

    অনেক প্রাইভেট টিউটরের কথাই তো সারা জীবন শুনলে, সেই ছেলেবেলা থেকে। না হয় একবার এই চটি চাটা প্রাইভেট টিউটরের কথাটা শোনো। সব আন্দোলনের একটা দাবি পত্র থাকে। সেই দাবি পত্রের একটি চরম লক্ষ্য, আরেকটি ন্যুনতম লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকতে হয়। বাজারের দর কষাকষির মত। আলোচনায় বসে একটা মধ্যস্থ জায়গায় এসে পৌঁছতে হয়। তবেই তো ভবিষ্যতে অপূরণীয় দাবিগুলি নিয়ে আরো দীর্ঘ আন্দোলনের সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমার মনে হচ্ছে তোমাদের দাবি পত্রে এমন সর্বোচ্চ সীমা ও ন্যুনতম সীমা নির্দিষ্ট নেই। বরং যে যেমন খুশি পাঁচ দফা কে আট দফা, সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হাফ দফা ছাত্র সংসদের দাবি। এভাবে সাড়ে আট দফা দাবিপত্র কে অসমধানযোগ্য দাবিপত্রে পরিণত করছো। রোগীর ডায়াগনোসিস এর ক্ষেত্রেও তো ডাক্তারকে প্ল্যান এ, প্ল্যান বি, রাখতে হয় এবং সেইমতো ওষুধ প্রয়োগ ও ওষুধের রেসপন্স লক্ষ্য রাখতে হয়, তাই না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২০৫৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • :|: | 174.25.***.*** | ২১ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৫৫538736
  • "ঘুনপোকাটা কে ওরা মারতে চাইছে" -- সমস্যা হলো, যদ্দুর জানি, ঘুনপোকা দিয়ে ঘুনপোকা মারা যায়না। আসলে যাঁরা এই আন্দোলন করছেন, খবর বলছে, তাঁরাই এই বিশেষ "পরিষেবা"র সূচক-ধারক-বাহক। তাই এই রকম এক অদ্ভুত আশা করে নিজের বুদ্ধির "অপমান" না করাই কাম্য।
  • খবর বলছে | 2405:8100:8000:5ca1::ea:***:*** | ২১ অক্টোবর ২০২৪ ১১:৩০538737
  • তাঁরাই স্বাস্থ্য সচিব, তাঁরাই স্বাস্থ্য মন্ত্রী। তাঁরাই ভুষি ওষুধ রক্তমাখা গ্লাভসের সাপ্লায়ার। তাঁরাই হাসপাতালের দালালচক্র।
  • dc | 2402:e280:2141:1e8:a4e3:57af:d863:***:*** | ২১ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৫০538738
  • ইয়ে, মা-মেয়ে-বৌ না হয়ে বাবা-ছেলে-পুরুষ পার্টনার হলে হবে? 
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:

RGKar
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন