পৃথিবীর সমস্ত রবিবারেরাই খুব বুদ্ধিমান। কেননা একমাত্র তারাই মানুষকে অনেকটা সময় ধরে দেখে। একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস। ঘুম ভাঙার মধ্যে দিয়ে দেখা শুরু হল। তারপর,মানুষটার সমস্ত একাত্মতায়,নিজস্বতায়,ভাবালুতা এবং আবেগ বর্জিত বাস্তবতা ও কাজের মধ্যে দিয়ে এই দেখাটা চলতেই থাকল। এভাবেই মানুষদের সবচেয়ে বেশি করে চিনে নিল রবিবার। সমস্ত দুর্বলতা ও খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে জেনে নিল আমরা কে কেমন,আমাদের বেঁচে থাকা,একাকিত্ম, ও নিজস্ব অভিনয়গুলো ভাল না খারাপ। আমরা এত কিছু বুঝলাম না। শান্তি ও আনন্দ ভেবে নিতে রবিবারই সবচেয়ে প্রিয় হল আমাদের। আর,সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর থেকে ভাললাগা,খারাপ লাগা ধার নিয়ে ক্রমশ তরল,অজৈব এবং জলীয় হয়ে উঠল সে।
ফেসবুক তোলপাড় করছে একটা ছবি। মালালা ইউসুফজাই। তার শরীরে ঢাকা দেয়া চাদরটা রক্তে ছোপানো। মাথায় পট্টি। শুয়ে রয়েছে চোদ্দ বছরের বিদ্রোহী বাচ্চা মেয়ে। এক বন্ধু ছবি দেখে বলল,এই পরিস্থিতিতে আমরা এই রকম হতে পারতাম না। সাহসে কুলাতো না।
আমরা এ'রকম হতে পারিনা। সবাই সবকিছু পারেনা। তবে আজকাল জানতে ইচ্ছে করে যে আমরা কী পারি। ধর্ষণে ধর্ষণে ক্লান্ত পশ্চিমবঙ্গ! মেয়েদের ওপর অত্যাচারে,বধূহত্যায়,ভ্রূণহত্যায় -সবখানেই আমাদের পা। বছর দুই আগে সল্টলেকে এক আইটি ইঞ্জিনিয়ার দুর্ঘটনায় মারা গেলেন -অফিস থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে - অনেক মানুষ ঘিরে দাঁড়িয়েছিল,কেউ জলটুকুও দেয়নি। ক'দিন আগে পুলিশের ডাকাতি করার গল্প পড়লাম। কই,আমাদের তো মেরুদন্ডে কোথাও কোন শিরশিরানি নেই। এই কলকাতাই আমার কলকাতা নাকি ! চিনতে পারিনা কেন তবে! চিনবার চেষ্টাটা আসলে একটা আশ্রয়ের খোঁজ - বয়স হচ্ছে তো। বয়স হচ্ছে ভেবে নিলে একটা সুবিধাও আছে - পরের প্রজন্মের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ানো যায়।
গত এক বছরের ধারাবাহিক খবর - বর্ধমান,পুরুলিয়ায় নাবালিকারা অনেকে বাল্যবিবাহের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। পুলিশকে খবর দিয়ে নিজেদের বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। নিজেরা পড়াশুনা চালিয়ে গেছে তারপরে,আশেপাশের গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রীতিমত আন্দোলন গড়ে তুলেছে। কলকাতায় কোন স্পন্দন নেই। কেন? বিএসএফ নির্দয় ভাবে মেরে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে দিচ্ছে মানুষকে। তাদের পরিচয়, তারা বেআইনী চোরাচালানে লিপ্ত বাংলাদেশী। কিন্তু, অন্যের রক্তে কী অধিকার আছে বন্দুকগ্রস্ত কিছু লোকের? আমাদেরই বা কী অধিকার আছে এত রক্ত দেখেও মুখ ঘুরিয়ে থাকার ! এই নৈশব্দ্য স্তব্ধতার নামান্তর নয় – অবজ্ঞা। বাংলাদেশের মাটি থেকে আমাদের শিকড় আমরা পুরোপুরি উপড়ে নিতে পেরেছি – এটুকু জানানো। এখন তোমরা আর আমাদের কেউ নও। ছিলে নাকি কোনদিন? অবাক লাগে, এপার বাংলার অনেক পরিবারে এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাতেই হাসি-কান্না-ঝগড়াঝাটি-অভিমান ও প্রেম।
নগরজীবনে কোন সামগ্রিক শূন্যতাবোধ থাকলে চলেনা। কেননা, তা গতিকে স্থবির করে। যেটুকু থাকে, তা আমাদের একান্ত নিজস্ব – তাকে ব্যক্তিগত কাচের আরামে সযত্নে লুকিয়ে রাখি। নাগরিক শব্দের কি শূন্যতাবোধ আছে ? আছে ভেবে নিলে একটা ভাল লাগা তৈরি হয় – যা আসলেই আরামদায়ক। মনে মনে অন্তত বলতে পারি, যেখানে আমি পৌঁছতে পারিনা, সেখানে সাহসী পা ফেলে আমার শব্দমুখরতাটুকু পৌঁছে যাক। আমি দূর থেকে দেখি, দোয়া করি, ওদের হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দিই।
ধরো,আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি স্থির জলে। আমার আশেপাশের জলে কম্পন জাগল। স্রোত তৈরি হচ্ছে অল্প করে। নরম স্রোত। আমাকে কাঁপিয়ে দেয়ার মত নয়। কিন্তু আমাকে স্পর্শ করছে তা। আমি আছি,আমি আস্তে বয়ে গেলাম তোমার পাশ দিয়ে। তুমি চাইলে ছুঁতে পার আমায়। আমার সঙ্গে নতুন একটা বৃত্তও তৈরি করতে পার। একসঙ্গে আমরা বৃত্তটিকে আরো বড় করব - আরো নতুন নতুন বৃত্ত তৈরি হতে হতে এক সময় জলের সমগ্রতায় ছড়িয়ে যাব আমরা। নিজেদের ক্ষুদ্রতাকে ভেঙেচুরে প্রবাহিত হব – ভারি স্রোত আসবে। টালমাটাল হব একটু। ধাক্কা লাগবে পাথরে। কিন্তু বয়ে যাব একরোখা টানে। ভাসিয়ে দেব যা কিছু শান্ত,নির্বিবাদী।
ভাসানো হয়না। যা কিছু শান্ত,নির্বিরোধী - যা কিছু আমার ঘরের অঙ্গনকে স্পর্শ করেনা,তা যেন আমার নয়। রিজওয়ানুর রহমান,মোমবাতির কোমল শিখাটি হয়েই থেকে যান স্মৃতিতে - তার মামলাটির মীমাংসা হয়না।
মালালা অজ্ঞান অবস্থাতেও একটা অন্তহীন স্মৃতির নকশা তৈরি করে চলেছে। তার বিনিদ্র কোষ ও চেতনার অন্তিম থেকে কারুকাজ নিয়ে;বুনছে একটি পশমী চাদর। চাদরের নকশায় ফুটে উঠছে বিভিন্ন নাম,ঘটনা। এইসব নাম নিয়ে আমার চর্চা নেই। আমি এদের খবরও রাখিনি কখনো। তবু আমি এদের ভুলতে পারছিনা ! শীতজর্জর চামড়ার আড়াল থেকে,থেমে যাওয়া হৃৎস্পন্দনের উষ্ণতা থেকে,আলতো সুখের বিপরীতে অন্যরকম বাঁচার ভাবনা থেকে এরা জড়িয়ে ধরছে আমাকে। শরতের রোদ ঝাঁঝালো হয়ে উঠছে এদের নিঃশ্বাসে। পোড়া গন্ধ পাই। শুকিয়ে উঠছে মাটি,ফেটে যাবে রাত নামার আগে। মাটির ফাটলে শিকড় প্রোথিত হবে কার? চারা গাঁথবে কে?
পর্দা টেনে দিলাম। ঘর অন্ধকার হোক। অন্ধকারের আয়নায় ছায়া পড়েনা। আমার জন্মদিনকে আমি ছায়ান্ধকার থেকে রক্ষা করব। কেননা এই জন্মদিন ও তার সমস্ত আলোটুকু আমি মালালাকে দিতে চাই। রিজওয়ানুরকেও দিলাম। কাঁটাতারের আড়াল থেকে ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে থাকা মানুষদের দিলাম। গুজরাতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বেঁচে গেছিলেন যে সব নারীরা - তাদেরও দিলাম - ওরা সকলে মা হোক। ওদের কোল থেকে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীময়। এই সমবেত আলো অন্তত একবার জ্বলে উঠুক - স্তব্ধ করে দিক সমস্ত সন্ত্রাসকে। আমরা কেবল আলোকেই ভালোবাসতে,নির্ভর করতে এবং ভয় পেতে শিখি। আতঙ্কের কোন দেশকালসীমানা থাকেনা। আজ থেকে আলোরও থাকলনা।