প্রথম বৃত্ত
আমার নাম রফিক। পশ্চিমবঙ্গের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে আমার বাড়ি। গ্রামের নাম আর দিলাম না কেন না সেটা আপনারা এমনিতেও চিনবেন না।
আমার গ্রামটা মুসলিম অধ্যুষিত। ফলে, সত্যি কথা বলতে কি আমার গ্রামে বা স্কুলে আমি কখনোই সংখ্যালঘু ছিলাম না বরং সংখ্যাগুরুই ছিলাম। তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুর যন্ত্রণা কিন্তু আমি টের পাই নি। আমার সংখ্যালঘুত্ব ছিল অন্য জায়গায়। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আমার ছোটবেলার সংকটের কারণ ছিল বরং আমার আব্বার ধর্মচেতনা। আমার ছবি আঁকতে ভালো লাগত। ওই ছোটরা যেরকম ছবি আঁকে আর কি। বাড়ি, পাহাড়, সূর্য, গাছ। একবার স্কুলের কম্পিটিশনে প্রাইজ পেলাম। বাড়ি ফেরার পর আব্বু আমায় খুব বকল। বলল, ছবি আঁকা না কি শয়তানের কাজ। আব্বু আমার রং-তুলি সব ফেলে দিল। সেই প্রথম আমার স্বাভাবিক প্রকাশের সাথে আব্বুর ধর্মবিশ্বাসের সংঘাত শুরু হল। পরবর্তীকালে সেই সংঘাত আরও বেড়েছে বই কমে নি।
আব্বু আমায় ভালো স্কুলেই পড়িয়েছিল। সেই স্কুলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজকর্ম হত। আমাদের সপ্তাহে দু দিন গানের ক্লাস হত। আমার গান করতে খুব ভালো লাগত। কিন্তু আব্বু বলল, ইসলামে গান গাওয়াও না কি হারাম। আমাকে গান গাইতে বারণ করা হল। দুটো মাত্র ক্লাস করতে পেরেছিলাম। তারপর বাড়িতে খবর চলে আসে। খুব অশান্তি হয়েছিল। তারপর থেকে চার বছর গানের ক্লাসে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। বুঝলাম আমার প্রকৃতির সঙ্গে আব্বুর এই সংঘাত চলতেই থাকবে।
আমি প্রথম আব্বুর ওপর গলা তুলে কথা বলি যখন আমার পনেরো বছর বয়স। আমি লাইব্রেরি থেকে এনে গল্পের বই পড়তে ভালোবাসতাম। একদিন আব্বু তা দেখতে পেয়ে আমার বই ছিঁড়ে ফেলে দিল। অনেক আজেবাজে কথা বলল। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
নিজের স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবের সাথে এই ক্রমাগত সংঘাতে আমি আস্তে আস্তে ডিপ্রেশানে চলে যাচ্ছিলাম। বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনোর পর এর সাথে যোগ হল অন্য অ্যালিনিয়েশন। আমি বুঝলাম আমি আমার সমবয়স্ক অন্য ছেলেদের থেকে আলাদা। আমার স্বপ্নে যারা আসে, তারা নারী নয়, পুরুষ। আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে প্রানপণ চেষ্টা করতাম। এই নিজের ভেতরের টানাপোড়েনে আমি পড়াশুনো করতে পারছিলাম না। বারবার ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলাম। ক্লাস ইলেভেনে একেবারে শেষের দিকে র্যাংক হলো। সেই সময় আমার জীবনে এল আমার প্রথম প্রেমিক। আমারই ক্লাসের সহপাঠী। যেন নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পেলাম। নিজেকে ভালবাসতে পারলাম। পড়াশুনোয় মন ফিরে এল। ক্লাসে অনেক ভালো রেজাল্ট করলাম। এমনকি আমার প্রেমিকের থেকেও অনেকটা ভাল। সেই অল্প বয়সে আমার প্রেমিক সেটা মেনে নিতে পারল না। ও আমাকে ডাম্প করে দিল।
প্রথম প্রেম ঘুচে যাওয়ার কষ্ট সবাই জানেন, নতুন করে বলবার কিছু নেই। বলার কথা এইটাই যে আমি আক্ষরিক অর্থেই আহার নিদ্রা ত্যাগ করলাম। সাতদিন টানা কিছু খাই নি, জল পর্যন্ত না। শেষমেশ আমাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হল। অবস্থা খুব সিরিয়াস হয়ে যাওয়ায় আমাকে সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হল। সেখানকার ডাক্তাররা আমায় বললেন আমার মনের সব কথা খুলে বলতে। তাঁরা আমাকে গোপনীয়তার আশ্বাস দিলেন। আমি আমার সমস্ত যন্ত্রণার কথা খুলে বললাম। কিন্তু তাঁরা তাঁদের কথা না রেখে আমার বাড়িতে সব জানিয়ে দিলেন। আমি আমার ধর্মীয় রক্ষণশীল বাড়িতে নিজের ইচ্ছার বিরূদ্ধেই আউট হয়ে গেলাম।
দ্বিতীয় বৃত্ত
যতটা ভয় পেয়েছিলাম আব্বুর প্রতিক্রিয়া কিন্তু তেমন হল না। আব্বু খুব শান্তভাবেই ব্যাপারটা নিলেন। বললেন, আল্লাহকে ডাকো, তিনিই তোমাকে পাল্টিয়ে দেবেন। আমি মনপ্রাণে প্রার্থনা শুরু করলাম। প্রচুর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে আস্তে আস্তে ফ্রাস্টেটেড হয়ে যাচ্ছিলাম। তারপর ইন্টারনেট ঘেঁটে পড়াশুনো শুরু করলাম। দেখলাম আর বুঝলাম, সমকামিতা একটা স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। তাতে লজ্জা পাওয়ার বা লোকানোর কিছু নেই।
ভাবলাম, আব্বুকে এইসব দেখিয়ে বোঝালে কাজে দেবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হল। আব্বুর এতদিনের শান্তভাব চলে গেল। আব্বু আমাকে নোংরাভাবে অ্যাটাক করল। বলল, আমার ওপর শয়তান ভর করেছে। আমার যাবতীয় বন্ধুদের নিয়ে সন্দেহ করা শুরু করল। কথায় কথায়, ছোটখাটো ভুলে আমার যৌনতা নিয়ে আমায় খোঁটা দেওয়া শুরু করল।
আমি এর মধ্যে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিলাম। আমার কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। একটা র্যাংকও এল। কিন্তু আব্বু আবার তাঁর ইচ্ছে আমার ওপর চাপিয়ে দিল। নিজের অনিচ্ছায় এবং আব্বুর ইচ্ছেয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলাম।
এইখানেই প্রথম বুঝলাম আমি শুধু যৌন সংখ্যালঘুই নই, আমি ধর্মীয় সংখ্যালঘুও বটে। এক কাঁটাতারের বাইরে আরেকটা কাঁটাতারের গন্ডী তৈরি হল। বাইরে না ভেতরে? কে জানে।
তৃতীয় বৃত্ত
কলেজ হস্টেলে একদিন আমাকে আমার রুমমেটরা জিজ্ঞেস করল আমি বিফ খাই কি না। আমি যথারীতি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ খাই। তারপর বেশ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন। কেন খাই, কিভাবে খাই, না খেলে কি হয়, ইত্যাদি। না, আমি বলছি না যে তারা আমাকে কোনও মারধোর করেছিল বা কোনও খারাপ কথা বলেছিল। কিন্তু এইসব খুঁটিয়ে করা প্রশ্নগুলো তাদেরকে আমার থেকে কেমন যেন দূরে সরিয়ে দিল। আমি প্রথমবার বুঝতে পারলাম আদারাইজেশন কাকে বলে। এইসব আপাতনিরীহ প্রশ্নগুলো যেন আন্ডারলাইন করে দিল, আমি ওদের থেকে আলাদা। এর বাইরে ওইসব খুব কমন কথাবার্তা তো আছেই। যেমন, "তোমায় দেখে বোঝাই যায় না যে তুমি মুসলিম" অথবা "ও, তুমি বাঙালি, তাহলে তোমার নাম এরকম মুসলিম মুসলিম কেন?" ইত্যাদি।
এই আদারাইজেশন আমি এলজিবিটি সমাজের ভেতরেও দেখেছি। অনেক সময় সেটা অকারন প্রশংসা সূচকও হয়। তার একটা অত্যন্ত বিদঘুটে উদাহরন দেই। আমি মুসলিম এটা জানার পর যেমন একজন বলেছিল, "ওয়াও, তুমি মুসলিম। মুসলিমরা শুনেছি ভীষন ভালো সেক্স করে।" হাসবেন না, এমন কথা আপনার চারপাশে অনেকেই বলেন, হয়তো আপনিও। যেমন, "মুসলিমরা খুব অপরিচ্ছন্ন হয়", "গে-রা পার্ভার্ট হয়" ইত্যাদি। আবার প্রশংসাসূচক জেনেরালাইজেশনও আছে। যেমন "গে-রা খুব ভালো ঘর সাজায়" বা "ও, তুমি তো মুসলিম, কবে বিরিয়ানি খাওয়াবে বল।" এগুলোও কিন্তু দূরে ঠেলে দেওয়ার প্রকরণ।
এইসবের মাঝে জীবনে আরও অনেক ওঠাপড়া হল। এক ওঝা-পীরের কথায় আব্বু আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। বিয়ে হলে না কি আমি "ঠিক" হয়ে যাব। আমি মাকে অনেক বোঝালাম। বললাম, যদি আমার বোনের বিয়ে আমার মত এরকম কোনও ছেলের সাথে হত তবে তোমার কেমন লাগত? মা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করল কিন্তু আব্বু আরও রেগে যেতে লাগল। বলতে লাগল, আমি না কি বেশি শিক্ষিত হয়ে গিয়েছি। এখানে একটা কথা বোঝা দরকার। আমাদের গ্রামে আমিই প্রথম যে সায়েন্স নিয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে হয়তো জনা দশেক গ্র্যাজুয়েট পাওয়া যাবে। তাই আব্বুর মুখের এই কথাগুলোর প্রেক্ষাপটটা বুঝতে পারতাম। আচ্ছা, শিক্ষাও কি কাউকে সংখ্যালঘু করে দেয়?
আর এই ক্রমাগত চাপ সহ্য করতে পারছিলাম না। একসময় বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে পালালাম। কোথায় যাব জানি না। কিভাবে যেন গিয়ে পৌঁছলাম মুম্বাই। কন্সট্রাকশন ওয়ার্কারের কাজ নিলাম বেঁচে থাকার জন্য। সেখানে খুব কাছ থেকে দেখলাম শোষণের আরেক রূপ। তবে সেইসব গল্প তোলা থাক অন্য আরেকদিনের জন্য।
সুপ্রিম কোর্ট হোমোসেক্সুয়ালদের বলেছিল মিনিস্কিউল মাইনরিটি। আমাদের মত মানুষদের জন্য কি বলবে জানি না। ন্যানোস্কেল মাইনরিটি? সংখ্যালঘুতর? ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ?
জানি না। এখন এইসব কথা ভাবতে গেলে মাথায় খুব চাপ পড়ে। পুরোনো কথা মনে করতে গেলে মাথায় এতটাই চাপ লাগে যে মনে হয় মাথাটা যেন প্রেশার কুকার হয়ে গেছে, এক্ষুনি সিটি দেবে। তাই আজ এখানেই থামলাম।
ভালো থাকবেন।