“স্মার্ট” এবং ঝাঁ চকচকে ড্রইং রুম, জেন-ওয়াই অভ্যেস লালিত কষ্ট-কল্পনা, কর্পোরেট বিবশ মিলেনিয়্যাল রুচির ন্যোয়ার অথবা মধ্য বা উচ্চবিত্ত দুটি নারী বা পুরুষের পৌনঃপুনিক বিষাদ, যৌনতা আর মনস্তত্ত্বে্র নিটোল আখ্যান আঙিনায় হালের বাংলা ফিল্মের তথাকথিত নাগরিক মূল ধারা মোটামুটি ভাবে সীমাবদ্ধ । এহেন বাজার বেসাতির নন্দনকাননে মানস মুকুল পালের সহজ পাঠের গপ্প (২০১৬) নিঃসন্দেহে একটা ডিপারচার মোমেন্ট বা নিষ্কৃতি মুহুর্ত তৈরি করে। এই নিবন্ধের ঝালায় যাওয়ার আগে একটি স্পষ্ট স্বীকারোক্তি করে নেওয়া সুবিধেজনক হতে পারে বলে মনে হয়। কথাটা এই যে, পরিচালক মানসমুকুল পালের নিখাদ বাস্তবতার ছবি সহজ পাঠের গপ্প নিয়ে ছোটখাটো আলোচনা খুব সহজে সেরে ফেলাটা প্রায় অসম্ভব একটি আয়াস। ছবিটি প্রথম দর্শনে যতটা সরলরৈখিক দেখায় ততটা একতলবিশিষ্ট আদপে নয়, এবং ঠিক সে কারণেই পরিসর বা বিনির্মিত বিষয় বৈচিত্রে গাঢ় মনোযোগ ও বিশ্লেষণ দাবী করে। ছবি দেখে ফেলার পর যে চিন্তা ভাবনার অবশ্যম্ভাবী বুদবুদ ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে দর্শকের মন এবং মগজকে। তার এক সুদূরপ্রসারী আমেজ আর কথাজাল তৈরি হয়। অনেকটা সময় ধরে সে আমেজের বিস্তার, অনেকগুলি কথামুখের ধাপে তার অবধারিত আলোকপাত। মানসমুকুলের গপ্প তৈরি করার উপাদান অথবা গপ্পের বুননের ধরন, তার বাধাহীন এগিয়ে চলা, বাঁক নেওয়া বা ন্যারেটিভের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে উপনীত হওয়া, সমস্তটাই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় গল্পের মেজাজ, অনুভূতির ভিত্তি এবং বিষয়ের সংগে। বলার ধরন এবং কি বলা হচ্ছে সেই বিষয়ের সনির্বন্ধ সমণ্বয়ে যে অভূতপূর্ব নির্মাণ প্রকল্পের ছায়াপ্রতিমা ক্রমপ্রতীয়মান হতে থাকে এই আপাত সহজ অথচ গভীর চলচ্ছবি-আখ্যানের সরল দ্রুতির চালে ছন্দে, বিষাদে, হরষে – সেই একান্ত শিল্পরূপটিই সহজ পাঠের গপ্প-কে চলচ্চিত্র হিসেবে একুশ শতকের বাংলা সংস্কৃতির চালচিত্রে অসাধারন করে তুলেছে।
এমনিতে একটি ছবি দেখার গড়পড়তা প্রাথমিক অভিজ্ঞতা বেশীর ভাগ সময়ে ওই ছবির দৃশ্য-শব্দ-ইমেজ, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদির আবেশে খানিকটা বাড়াবাড়ি রকমের আশ্লিষ্ট থাকে। একই সংগে এও ঠিক যে অধিকাংশ দর্শকই যে ছবিটি দেখলেন, নিজের মত করে তার মূল রূপটি তাৎকালিক অভিজ্ঞতার ঘোরের ওপরে ভর করেই নির্মাণ করে রাখেন স্মৃতিতে। সময়ের সাথে সাথে ওই নির্মিত রূপটি একটা সাধারন ধারনার আদল নেয়, নির্দিষ্টতা হারায়, আর স্মরণ, বিস্মরণ অথবা প্রতিস্মরণে একধরনের জ্যামিতিক অবয়বহীন বোধ অথবা সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই নিয়মের বাত্যয় ঘটে। নিয়ম যখন আছে একটা, সুতরাং সে নিয়মের অন্যথা থাকবেই। এই বাত্যয় বা অভিজ্ঞতার অন্যরূপ, নিয়মের অন্যথা, যে ছবিগুলো ঘটিয়ে থাকে বা বেশ সাবলীল ভাবে ঘটায়, সে নানা কারণেই হতে পারে, সেসব সৃষ্টিগুলো দর্শকের মনের একটেরে চলনে সমূহ আলোড়ন তোলে। বক্তব্য বলার ধরনে যে প্রায় নিখুঁত চারুকর্ম থাকে, শৈলির অনবদ্য স্বাভাবিকতায় তারা ভাবতে বাধ্য করে বারবার। মানস মুকুল পালের প্রথম পূর্ণাংগ চলচ্চিত্র সহজ পাঠের গপ্প (২০১৬) প্রাথমিক ভালো লাগা বা খারাপ লাগা জাতীয় গা-আলগা আবেশের তাৎক্ষণিকতাকে অনায়াসে অতিক্রম করে। একাগ্র দর্শক/পাঠক মনে দীর্ঘ ভাবনা রেশ স্থায়ী করে। মনের মাঝে নিপুণ উসকে দেয় মাটিলগ্ন মানুষের আর্থ-সামাজিক অস্তিত্বের তিরতিরে অস্থিরতা। বস্তুত, সহজ পাঠের গপ্প-এর কাছাকাছি চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতা রায়-ঘটক-সেন জমানার পরবর্তী বাংলা ফিল্ম জগতে শেষ কবে হয়েছে সেকথা অনেককেই মনে করে বলতে হবে।
নানা কারনে এই ছবিটি আলোচনার জলচিত্রে ঢেউ তৈরি করে। অধিকাংশ আলোচনা পরিসরে মেধা, মনন, বিষয়, ভাবনা, নন্দন বা উপস্থাপনার মুন্সীয়ানা সবই স্থান পাবে নিশ্চিত। এই সবক’টি আলোচ্য শীর্ষকেই অন্তর্ভুক্ত থাকবে ছবিটির সুনিশ্চিত সামাজিক আবহের নির্ভেজাল বাস্তব চিত্রণ প্রসঙ্গ, বাংলার পল্লীগ্রামে্র আর্থসামাজিক বিড়ম্বনার অসহ্য সত্যিটুকু। যদি নিখাদ একটা টেক্সট হিসেবে এর নির্মাণ প্রকল্প এবং নির্মিত শৈল্পিক ভাষাটিকে নিয়ে কোনো প্রতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করা যায়, তবে একটি আপাতগ্রাহ্য কিন্তু অনুচ্চার সংলাপের প্রসরণ পাঠকের গোচরে আসতে বাধ্য। সীমিত পরিসরের এই নিবন্ধে সহজ পাঠের গপ্প-এর এই নিরুচ্চার অথচ প্রবলভাবে উপস্থিত ডায়ালগ ফর্মেশন-এর নিরন্তর আন্তর্গ্রন্থীয় অভীপ্সাটিকে হালকা চালে অল্প বুঝে নেওয়ার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।
মানসমুকুলের সহজ পাঠের গপ্প-এর ইন্টারটেক্সচ্যুয়াল ডায়ালগ ফর্মেশন বা আন্তর্গ্রন্থীয় সংলাপ নির্মিতির চালটি কোনও ধ্রুপদী খেয়ালের আলাপ বিস্তারের চাইতে কিছু কম সুললিত নয়। যে মুহূর্তে তিনি ছবির গল্পটি বেছে নিচ্ছেন বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলার পল্লী গ্রামের জীবন নির্ভর কথা-কাহিনী গুলোর সংগ্রহ থেকে, অথবা যখন “তালনবমী” গল্পের কুশীলব হিসেবে চিত্রনাট্যে এসে পড়েছে দুটি অল্পবয়সী বালকের চরিত্র, দাদা এবং ভাই, ঠিক সে মুহূর্তেই এই চলচ্ছবির বয়ানে একটি অবধারিত প্রভাব উদ্বেগ বা অ্যাংক্সাইটি অব ইনফ্লুয়েন্স সীমাহীন প্রশ্ন এবং অযুত সম্ভাবনা নিয়ে তিল তিল করে ঘনিয়ে উঠেছে। একধাপ এগিয়ে দাবী করাটা বোধহয় অসংগত হবেনা যে এই প্রভাবের উদ্বেগ লেখক (যদি ফিল্মকে একটি টেক্সট হিসেবে ধরে পরিচালককে লিখন ক্রিয়ার আদি ইচ্ছাকারী সত্ত্বা হিসেবে নিই) নিজেও অনুভব করেছেন শিরা উপশিরায় নিশ্চিত। অন্তত সহজ পাঠের গপ্প-এর সাবলীল মুহুর্তগুলির নির্মাণ তো সে ইংগিতই বহন করে। আর পাঠকের কাছে সে প্রভাব-উদ্বেগ কে অতিক্রম করা শুধু দুরূহই নয়, রীতিমত অসম্ভব। এবং ছবিটি দেখলে বোঝা যায় যে অতিক্রমের চেষ্টা ততটা দরকারিও নয়। কারণ সহজ পাঠের গপ্পে মানসমুকুলের সচেতন টেক্সট নির্মিতি কখনোই এর পূর্ববর্তী ছবিচিহ্ন পথের পাঁচালী-কে অস্বীকার করে তো নয়ই, বরং সত্যজিত রায়ের অসামান্য কীর্তিটিকে নিখুঁতভাবে স্মরণে রেখে, নির্ভেজাল রেফারেন্স ফ্রেম বা কাঠামো ভিত্তির মর্যাদায় অণ্বিত করে তবেই ভিন্নতা প্রয়াসী। আর এই সংযোগ বিন্দুতেই দুটি ছবির পারস্পরিক সংলাপ নির্মাণ। এইখানেই আন্তর্গ্রন্থীয় কথোপকথনের গমকী চালে সহজ পাঠের গপ্প-এর স্বপ্নের উড়ান। দায়বদ্ধ চলচ্চিত্র চিন্তায় ইতিহাসকে নতুনভাবে দেখতে চেয়ে কাহিনীচিত্রটিকে দেশ কাল পরিসরে স্থাপন করেও তার কাল মুক্তি ঘটানো সম্ভবপর হলো এই আলাপের মধ্য দিয়ে। এইখানেই, অন্তত এ ছবির ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্রকার হিসেবে মানসমুকুলের পরম সিদ্ধি।
এমন দাবী করাটা বোধহয় খুব অসংগত হবে না যে সহজ পাঠের গপ্প নামক ২০১৬’র এই আধুনিক ছবিটিতে উদ্দিষ্ট কাহিনীবিন্যাস করবার জন্য বাংগালী দর্শকের কৌম বা সমষ্টি-স্মরণ কে যে ইতিহাসনিষ্ঠ সৃজন প্রকল্পে ধরার চেষ্ঠা করা হয়েছে, তেমনটি হালের সিনেমা জগতে রীতিমত বিরল বা অদৃশ্য ঘটনা। পল্লীগ্রামের সমাজ, ব্যথা, বেদনা, বিষময় দারিদ্র এবং মায়াময় স্নেহ মানবতার যে মরমী মূর্তিতে প্রকাশ হয়েছিলো সত্যজিত রায়ের হাত ধরে ১৯৫৫ সালে, পথের পাঁচালী ছবিতে, সে প্রত্ন-স্বর ও প্রতীককে অস্বীকার করে প্রায় এক ধরনের পল্লীজীবন নির্ভর একটি কাহিনীচিত্রে প্রেক্ষিত ও বিষয়-আবহের বিন্যাস কার্যত অসম্ভব। কিন্তু একই সংগে গ্রামভিত্তিক শৈশবের নিস্পাপ সারল্যের অন্য একটি গল্প বলতে গেলে, যেখানে অনটনের অস্তিসংকট এবং ক্ষিদের প্রসংগ প্রধান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আখ্যানের ভরকেন্দ্রে, অনুপুঙ্খ দৃশ্যরূপের নিষ্প্রাণ পুনঃনির্মাণ ততটাই ক্লান্তিকর হয়ে ওঠার আশংকা যথেষ্টই বেশী। পরিচালক হিসেবে মানসমুকুলের সবচাইতে বড় সাফল্য এই দুই সহজ বিপদকে নিখুঁতভাবে পরিহার করা। একই সংগে তিনি সত্যজিতের প্রত্নরূপটিকে সর্বদা মাথায় রেখে যেভাবে একেকটি দৃশ্য এবং সিকোয়েন্স নির্মাণ করেছেন, প্রায় অঞ্জলি দেওয়ার ঢংয়ে, যত্নবান দর্শক মনে যেভাবে জাগিয়েছেন অনুস্মৃতি, আবার নিজস্ব আখ্যানের চাহিদা মেনে নিরলস ভেংগেছেন ছাঁদ, গল্পকে গড়িয়ে দিয়েছেন তার নিজস্ব ঢালে, কোনো ধরনের প্রভাব বা পূর্ব নির্মানের দায়ভার ছাড়াই, তাতে করে মানসমুকুলের গোটা ছবিটির আড়ালে আরোও একটি অন্যপাঠের নিভৃত ম্যুরাল শরীরী হতে শুরু করে প্রথম থেকেই। প্রায় অলক্ষ্যে।
মানসমুকুলের সহজ পাঠের গপ্প একটি সম্পূর্ণ নিজস্ব স্বর এবং গায়কী সমণ্বয়ে তৈরি কাহিনীচিত্র, যার চিত্রনাট্যের অবলম্বন বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতিদীর্ঘ গল্প তালনবমী। কিন্তু শুধুই এটুকু বললে সম্ভবত অর্ধসত্য উচ্চারিত হয়। একই সংগে গোটা ছবিটিই মানসমুকুলের একান্ত নিজস্ব সত্যজিত পাঠের ভিস্যুয়াল নিষ্কাশনও বটে। অর্থাৎ সহজ পাঠের গপ্প ছবিটি একটি স্বাধীন টেক্সট হিসেবে তার নিজের চলার পথ বাঁক সব ঠিক করে নেয়। ইতিহাসে তন্নিষ্ঠ চোখ রেখে, নিজের পূর্বজ সঠিক নির্ধারন করে। সত্যজিতের কালজয়ী পথের পাঁচালী-র প্রত্ন-টেক্সটটির অসামান্য ইমেজ এবং বয়ান বিধৃতিকে মানসমুকুল বুঝে নিতে চান আজকের আলোয়। আর তারপর পথের পাঁচালী-র সংগে শুরু হয় তার প্রতিমুহূর্ত দিনরাতের অক্লান্ত কথোপকথন।
প্রথম দৃশ্যের মাছধরার ছবি আর ফড়িং ওড়া পুকুর মুহূর্ত থেকেই সহজ পাঠের গপ্প-র আত্মীয় কথন শুরু, শুরু দুই ফিল্মের স্বোপার্জিত শিল্প স্বাধীনতায় নিবিড় আলাপ। আলাপ চলে ইতিহাসের পথ ধরে। প্রায় প্রতিটি দৃশ্যের নির্মাণে মানসমুকুল পাঠ করেন সত্যজিতের বলা/না-বলা সৃষ্টি দর্শন, তাঁর ছবির নন্দন বা বাস্তবকে দেখার অতি নিজস্ব দৃষ্টিকোণটিকে। কথা বলেন। বিনির্মাণ করেন জীবনের সুখ দুঃখের স্বতস্ফূর্ত ছন্দটাকে, যে ছন্দের সার্থক প্রকাশ দুটি ছবিকেই যুগভেদে আলাদা মাত্রা, আলাদা প্রাণ দেয়। মানসমুকুল কিছু মানেন, কিছু পরিহার করেন সময়ের চাহিদা মেনে। অন্যভাবে অন্য তারে বাঁধেন ঘটনা পরম্পরা। সংলাপ এগোয় সহজ স্বাভাবিক ছন্দে। বিভূতিভূষণের তালনবমী অবলম্বনে ছবি তৈরি হতে থাকে, এগিয়ে চলে নির্বাচিত গল্পটির আখ্যান সূত্র ধরে, কিন্তু পাশাপাশি জারি থাকে সত্যজিতের পথের পাঁচালী-র সংগে নির্ণিমেষ সংলাপ। সহজ পাঠের গপ্প একদেহে হয়ে ওঠে দুটো ছায়াছবি। দুটোই নিজের নিজের চৌহদ্দিতে সম্পূর্ণ। সাবলীল। আবার ভীষন ভাবে সংলাপ সাহচর্যে ভাস্বর, বিষয়ের গভীরতা স্পর্শ করবার লক্ষ্যে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।
এই পারস্পরিক ভাষ্য নির্মাণে খুব গুরুত্বপূর্ণ এই যে, সহজ পাঠের গপ্প কখনোও পথের পাঁচালী হয়ে উঠতে চায়নি। পরিচালক সচেতন ভাবেই তেমনটি চাইবেন না, বলাই বাহুল্য। কিন্তু তিনি পথের পাঁচালী-কে অস্বীকারও করেননি। বরং সহজ পাঠের গপ্প দেখে প্রথম ধাক্কাতেই এই প্রতীতি স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি বুঝেই নিয়েছেন, যে জীবনের রস রূপ তিনি নির্মাণ করছেন ছবিটিতে সেটিকে নির্ভুল আস্বাদ করতে গেলে যেকোনো দর্শকের মনে পথের পাঁচালী-র স্মৃতি উসকে উঠতে বাধ্য। ইতিহাস নিষ্ঠ মানসমুকুল তাই বেছে নিয়েছেন অপূর্ব ইন্টারটেক্সচ্যুয়াল গ্রন্থনশৈলি, যেখানে সত্যজিতের দেখার চোখ একটি অদৃশ্য চরিত্র হিসেবে উপস্থিত ছবিটিতে। মানসমুকুল সে চোখকে কখনোও কাজে লাগাচ্ছেন, কখনও সযত্নে অনুমতি নিয়ে সরিয়ে রাখছেন নিজের বর্ণনার খাতিরে। এক মীথোজৈবিক সৃজন ক্রিয়ায় পথের পাঁচালী-র বিনির্মাণ ঘটছে সহজ পাঠের গপ্প-তে। আর পথের পাঁচালী-তে বিধৃত সব দৃশ্যকল্প, চিত্রনাট্যের মোড় অবলীলায় ধরিয়ে দিচ্ছে সহজ পাঠের গপ্প-এর অন্তঃসলীলা আদি শিল্প সত্যটিকে। বিশ শতকের মাঝের দিকের পল্লিগ্রাম সমাজ আরোও একবার ভাষা পাচ্ছে একুশ শতকের অনটন লাঞ্ছিত সাম্প্রতিক বাস্তবতায়।
সহজ পাঠের গপ্পে মানসমুকুলের আলাপী প্রয়াস শুধমাত্র বাহ্যিক চিত্রকল্প বিন্যাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গোটা ছবিটার ঘটনা পরম্পরার নির্মাণ এবং নানা ছড়িয়ে থাকা যৌগিক সূত্রচিহ্ন গুলিও পথের পাঁচালীর সংগে অনর্গল সংলাপ জারি রেখে এগিয়ে চলে। একটি দৃশ্য থেকে অন্যটিতে, অথবা একটি সিকোয়েন্সের উৎপত্তি লহমা থেকে অপরটিতে মিলিয়ে যাওয়ার সমস্ত যোগাযোগ রেখাচিত্রে ছড়িয়ে থাকে এই নিভৃত আলাপের গড়ন অভিজ্ঞান। একেবারে প্রথম দৃশ্যে যে পুকুরে মাছ ধরার দৃশ্য আমরা দেখি, স্থির নিষ্কম্প শালুক আর পদ্ম ডাঁটার পাশে ছিপ ফেলে প্রত্যাশী দুটি বালকের মুখে ছবির প্রাথমিক প্রেক্ষিত যে দৃশ্যে পূর্ণ নির্মিত স্বমহিমায়, সেখানে পথের পাঁচালী-র পুকুরের জলের ওপর ক্যামেরা প্যান করানোর স্মৃতিগুলো আবছা দাগ কাটে। সম্ভাবনা তৈরি হয় একটি মোহময় আলাপ বিস্তারের। কিন্তু সম্ভাবনাই মাত্র। তার বেশী কিছু নয়। কেননা এই সাদৃশ্য শুধুই বাহ্যিক রূপকল্পে। বস্তুগত। আখ্যানের আত্মগত নিজস্ব আকার খানা তখনও বিশদে রচিত হয়নি। মোড় টা ঘুরলো ঠিক এর পরের সিকোয়েন্স গুলি থেকে প্রায় ছিলা ছেঁড়া জ্যা’র গতিবেগে যখন আমরা একধাক্কায় হেলাফেলার অতি সাধারণ মাটির বাড়ির দাওয়ায় কাঁদতে দেখি ছোটু-গোপালের অসহায় মা’কে, আশেপাশে দেখি সহমর্মী প্রতিবেশী বধূদের, আর শিশু দুটির দুর্ঘটনা আক্রান্ত বাবার যন্ত্রণাকে দেখি সংসারটির নির্মম দারিদ্র আর অজানা ভবিষ্যতের আশংকার সংগে চোখের জলে মিলিয়ে যেতে। ছোটু-গোপালের মায়ের আত্মমর্যাদা আহত হয় দাক্ষিণ্য গ্রহনে, কিন্তু নিরুপায় কর্ত্রী পরিস্থিতির চাপে দানের অন্ন নিতে বাধ্য হন শুধুমাত্র সন্তান দুটির ক্ষুন্নিবৃত্তির সুরাহা আশা করে। এই আত্মমর্যাদা বোধটিকে আবারও মানসমুকুল সামনে আনেন ডিম নিয়ে ভাইয়ের সংগে গোপালের বাড়ি ফেরার দৃশ্যে। ডিম চুরীর কিনা সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য মায়ের প্রবল শাসন বর্ষিত হয় অভাগা শিশুদুটির ওপর আর মা ফেড আউট করে পথের পাঁচালী-র সর্বজয়া ফুটে ওঠেন সহজ পাঠের গপ্প-এর প্রাথমিক বিষয় অবতারনার আবহে। শুরু হয় দুটি ছবির একান্ত নিজস্ব বৈভাষিক সংলাপ। সংলাপ ধীরে ধীরে আকৃতি নেয় আলাপের। শ্রাবন মাসে ছোটু-গোপালের হঠাৎ অবগাহনে রেশ লাগে অপু-দুর্গার বৃষ্টি ভেজা দিনাবসানের। সর্বজয়ার অতিকষ্টে চালাতে না পারা সংসারে আত্মীয়ার স্নেহপরশে কুন্ঠা প্রকাশ মায়ের চরিত্রে স্নেহা বিশ্বাসের মারাত্মক জীবন্ত অভিনয়ে নতুন মাত্রা পায় সহজ পাঠ-এর সাম্প্রতিকতায়। অভুক্ত পেটের প্রকৃতি কণ্যা দুর্গার চুরি করা পেয়ারা জোর শাসনে সেজখুড়িকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে বলেন সর্বজয়া। মায়ের ভয়ে এবং অভিমানে দুর্গা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু আজ এতদিন পরে গোপালের চরিত্রে দুর্গার ছায়াপাত পালটাতে বাধ্য, একথা ভালোই জানেন মানসমুকুল। পথের পাঁচালী-র দুটি শিশুর মূল জীবন যাত্রার সংগে সহজ পাঠ-এর শিশুচরিত্রের অর্থনৈতিক বা পল্লীগত বাহ্যিক যাপনের দৃশ্যত মিল থাকলেও সামাজিক স্থানাংকে তারা ভিন্ন বৃত্তের বাসিন্দা। তার ওপর দুর্গা মেয়ে, কিন্তু গোপাল ছেলে। বয়ঃসন্ধীর কিশোর তাই মায়ের শাসনে রাগে ফেটে পড়ে চেঁচিয়ে, ডিম ছূঁড়ে ফেলে বেড়িয়ে যায় তার প্রতিবাদ জানান দিয়ে। অবাধ্য কৈশোর বহুমাত্রিক ভাষা পায় পরিচালকের অন্তর্দর্শী পরশে।
মানসমুকুল পথের পাঁচালী-কে পাঠ করেছেন একেবারে নিজস্ব ভংগিমায়, তাঁর নির্বাচিত গল্পের সাধারণ চাহিদাকে মাথায় রেখে। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন তার বেশী কোনো অযথা ভার তিনি আরোপ করেন নি সহজ পাঠের গপ্প-এর স্বকীয় গতি বা চলনে। স্বাভাবিক ভাবেই সমস্ত দৃশ্যকে সাজিয়ে গুছিয়ে সহজ পাঠ-এর মোড়কে জোর করে সেঁধিয়ে দেওয়ার কোনো অনৈতিহাসিক পরিকল্পনা তাঁর ছিলোনা। দুর্গার মৃত্যু দৃশ্য বা তার নির্মাণের কোনো বিষয়গত প্রয়োজনও সেক্ষেত্রে ছিলোনা এই ছবিটিতে। একথা সহজেই বলা যায় যে সহজ পাঠের গপ্প আর যাই হোক পথের পাঁচালীর পুনঃসৃষ্টি কখনই নয়। কিন্তু সরল রেখায় দৃশ্য গুলিকে পুনঃনির্মাণ না করেও তিনি নিখুঁত মনোবিশ্লেষনের নিমগ্নতায় এমন ভাবে চরিত্রগুলি নির্মাণ করেছেন তাঁর ছবিতে, যে পথের পাঁচালী-র সংগে নিরন্তর চলতে থাকা কথোপকথনটি এক বিপুল বিস্ময় সমারোহে ভরিয়ে তোলে দর্শক মনকে। এই অপূর্ব আন্তর্গ্রন্থিয় কাজটি তিনি সমাধা করেছেন নিপুণ মুন্সীয়ানায়, ইতিহাস নিষ্ঠ সত্যজিত পাঠের মাধ্যমে, অলক্ষ্যে, কিন্তু স্থির নিশ্চিত ভাবে। দুর্গার সংগে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য গোপালের অনাবশ্যক অকাল মৃত্যু এ গপ্পে নেই। কাহিনীর মান্যতা মেনেই নেই। কিন্তু বালকটির কৈশোরের অকালমৃত্যু আছে । তার পড়া বন্ধ হয়ে যায়, তার ক্ষিদের বাস্তবে আনমনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিড-ডে মিলের বন্দোবস্ত, তাকে তার মা নিয়ে যায় অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন গ্রামবাসীর বাড়িতে, মাস মাইনেয় কাজ করে অভাবের সংসারে কিছুটা সুরাহা আনার আশায়। সহজ পাঠ-এ হরিহর বা ইন্দির ঠাকরুন নেই। এঁদের সমগোত্রীয় কোনো চরিত্র বিভূতিভূষণের তালনবমী-তে ছিল না। সুতরাং আখ্যান অবলম্বনের টেক্সটে এদের জন্য সায় নেই। কিন্তু সত্যি কি সহজ পাঠের গপ্প-তে এই দুই অতি জরুরী চরিত্র নেই? যদি বলা যায়, আছেন, তবে আড়ালে, গল্পটির বিশ্লেষিত নির্মাণের উপরিকাঠামোটির আবছায়ায়, প্রায় বায়বীয় উপস্থিতিতে। কেননা ভুললে চলবে না যে তালনবমী অবলম্বনে সহজ পাঠের গপ্প তৈরি হলেও তার চলচ্চিত্রগত চলনে পথের পাঁচালী-র সংগে সচেতন সংলাপ স্থাপনার প্রকল্পটিও বেশ ভালো ভাবেই উপস্থিত। অর্থাৎ, পাঁচালী ঘুরে ফিরে আসবেই সহজ পাঠ-এ। কখনো প্রত্যক্ষে, আবার কখনো পরোক্ষে।
সহজ পাঠের গপ্প-তে একেবারে প্রথম থেকেই খুব সূক্ষ্ম ভাবে ছোটু-গোপালের দুর্ঘটনাগ্রস্থ বাবার চরিত্র আছে, যিনি শয্যাশায়ী বলে প্রায় পুরো ছবিটি জুড়েই চাক্ষুষ ভাবে অদৃশ্য। তিনি আছেন, কিন্তু একই সংগে থেকেও নেই। হাতে গোণা যায় এমন কিছু মুহূর্তে আবছা ঘরের ছায়া ছায়া বিছানার ওপর তাঁর উপস্থিতি। সত্যজিতের পথের পাঁচালী ছবিটিতে হরিহরের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেকটাই তুলনীয়, যিনি সর্বজয়ার অভাবী বারোমাস্যায় দীর্ঘক্ষন অনুপস্থিত। দারিদ্রের সংগে লড়াই করতে থাকা সর্বজয়ার পাশে তাঁর না থাকা, অথবা বেশ কিছুদিন চিঠিপত্র না পাঠিয়ে প্রায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় সমগোত্রীয় একধরনের অনুপস্থিতি আছে যা কিনা পাঁচালী-র বাস্তবতাকে আরোও নির্মম, আরোও জীবন নির্ভর করেছে। সহজ পাঠে শিশুদুটির বাবা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অযাচিত অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে দেন, অনিচ্ছায় অনুপস্থিত হয়ে যান অভাবী দুই সন্তানের মায়ের ভাংগাচোরা সংগ্রাম আংগিনায়। টানাটানির সংসারে মূর্তিমান বোঝার মত ছোটু-গোপালের কোনো বৃদ্ধা পিসি বা ইন্দির ঠাকরুন নেই ঠিকই, কিন্তু অভাব এবং আহত বাবার অপারগ প্রতিবন্ধী অবস্থান, উপার্জনের অক্ষমতা ইত্যাদি সংসারে যে অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়, সেই অনিশ্চয়তাই এক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বোঝা। সর্বজয়ার ইন্দির ঠাকরুনের মত। অর্থাৎ শয্যাশায়ী বাবার চরিত্রে হরিহর এবং ইন্দির ঠাকরুন একাকার হয়ে যান, আর সর্বজয়ার বিরক্তি এবং অনুভূতির মিলিত প্রকাশের সমান্তরাল সংলাপ নির্মাণে আমরা সহজ পাঠের গপ্প-তে ছোটু-গোপালের মায়ের মুখে অভিব্যক্তিহীন সুশ্রুষার চিন্তাণ্বিত ভাঁজ দেখি গোটা আখ্যান জুড়ে। জীবন যন্ত্রনার অসহ্য চাপে সেখানে আলাদা করে কোমল অনুভূতির কোনো প্রকাশ আশা করাটাও বৃথা। এর ঠিক পরপরই আসে ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যু দৃশ্য। সহজ পাঠে সে প্রসংগের অবতারনা স্বপ্নদৃশ্যে, ছোটু-গোপালের বাবার সাদা কাপড়ে শেষ শয়ানের মোক্ষম প্রয়োগের মাধ্যমে। ঠিক যেভাবে আসে রেলগাড়ির দৃশ্যে মায়ের আত্মহত্যার চেষ্টা আর স্বপ্নে অস্থির গোপালের হাহাকার কান্না। এখানেও পাঁচালী-কে আলাপে আনা, এবং তার চাইতে ভিন্নতায় নিজস্ব পথ নির্বাচন, একটি প্রস্থান বিন্দু ঠিক করে নিয়ে সহজ ছন্দে গল্পকে এগোতে দেওয়া। কাশের বনে রেলগাড়ি দেখার চিরকাব্যিক দৃশ্যটিকে মানসমুকুল টেনে হিঁচড়ে এনে ফেলেন দ্বিধাহীন বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে। গোপালের আতংকগ্রস্থ অনুনয়ে সাড়া না দিয়ে মায়ের আত্মহননে ছুটে যাওয়ার নিরূপায় কিন্তু রণরংগিনী সিদ্ধান্ত স্বপ্নকে চুরমার করে। রেললাইন এবং রেলগাড়ির আয়োজন, মাঠ ধরে দৌড়তে থাকা দুটি, এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবে, ঠিক দুটিই চরিত্র, এসবের সমূহ স্মৃতি সুনিপুণ হাতে জাগানো হয় সহজ পাঠে। কিন্তু সে স্মরণ আয়োজন শুধুই পূর্বস্মৃতির রোম্যান্টিক মেদুরতাকে ইচ্ছে করে দুমড়ে মুচড়ে নতুনতর প্রাসংগিকতায় ঢেলে সাজাবার নিখুঁত সংলাপী প্রয়াস। এই দৃশ্যে যে আকস্মিকতা এবং তীব্রতা জমেছে, তার বৈধতা আসে সহজ পাঠের গপ্প-এর মূল সুরের বিষয় অবস্থান থেকে। সেই সুর কাশবনের নরম আবহকে ফালাফালা করে ছিঁড়ে স্বর অসংগতি তৈরি করে দর্শকের মনে। অসংগতি ক্ষিদের জ্বালার, অসংগতি নিষ্কৃতিহীন অভাবের, যে তাড়নায় মানব জীবনের যাবতীয় স্বরসংগতি নষ্ট, ধ্বস্ত হতে বাধ্য। তা সে ছোটূ-গোপালের ছবির জীবনেই হোক বা দর্শকের বাস্তব জীবনে। মানসমুকুল অনর্গল কথা বলে চলেন সত্যজিতের স্রষ্টা-সত্ত্বার সংগে, পথের পাঁচালি-কে পাঠ করেন সহজ পাঠের গপ্প-এর দেহে মনে প্রাণে। শুষে নিতে চান হাড়ে মজ্জায়। আবার তালনবমী গল্পের দাবী মেনে সহজ পাঠ-কে সার্বভৌম নিজস্বতায় ভরে তোলেন অকুন্ঠ অমলীন। প্রয়োজনে আনলার্ন করতেও দ্বিধা করেন না অপুর জীবনের প্রত্ন মুহূর্তগুলিকে। দুটি ভিন্ন আংগিকের টেক্সট, লিখিত গল্প এবং নির্মিত কাহিনীচিত্র, একইসাথে সম্বোধিত হয় সহজ পাঠের গপ্প-তে। প্রতিসরণ বিন্দুতে আলাদা হয় আবহ সংগীতের সুচিন্তিতি প্রয়োগ। পথের পাঁচালী-র সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে নৈঃশব্দকে অনেক বেশী বাঙময় করে তোলা হয় সহজ পাঠের গপ্প-তে। একইসংগে পাঁচালি হয়ে ওঠা এবং না-হয়ে ওঠায় একটি সজীব ও দ্বান্দ্বিক চলমানতা পায় ছোটু-গোপালের সহজ পাঠের গপ্প। অপু আর ছোটু স্বাভাবিক নিয়মেই মিলে মিশে যেতে চায় একে অপরের মধ্যে। একুশ শতকের অভাবী শৈশবে রঙ লাগে মহাজাগতিক সারল্যের যার কোনো দেশ কাল থাকতে পারেনা। নেই। সহজ পাঠের গপ্প সত্যিই একটু একটু করে হয়ে ওঠে সারল্যের নিজস্ব রঙ, সঙস অব ইনোসেন্স।
ছবিটির দৃশ্য পরম্পরায় সত্যজিত রায়ের মৌলিক ট্রিটমেন্ট কোনোভাবেই পুনরাবৃত্ত নয়। আবার অন্যদিকে, মানসমুকুল মূল গল্প, অর্থাৎ তালনবমী-র লিখিত পর্য্যায়ক্রমও একনিষ্ঠ ভাবে অনুসরন করেন নি। যেহেতু নির্মিত ছবিটি অক্ষরশিল্প নয়, মাধ্যম আলাদা, কাজেই তার শিল্প-স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে মানসমুকুল সচেতন। লিখিত গল্পকে শব্দ থেকে যতিচিহ্নে অনুকরণ করাটা যে তাঁর কাজ নয় একথা তিনি ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন সহজ পাঠে। সুতরাং গোটা ছবির চলন দৈর্ঘ জুড়ে দর্শকের তরফেও সে ধরনের একরৈখিক দাবী তৈরি হওয়ার সুযোগ হয়নি কোথাও। বরঞ্চ সহজ পাঠের গপ্প-এর চিত্ররূপ বা ঘটনার অনুক্রমে পথের পাঁচালী-র অবশ্যম্ভাবী স্বরের ঊঁকিঝুঁকি গুলোকে পরিচালকের তরফে কুশলী যুঝে নেওয়ার প্রয়াস জমাট কৌতূহল জাগায়। সে কৌতূহল তাঁরই তরফে তালনবমী গল্পের কাঠামো শৃংখলাকে নিয়মানুবর্তিতায় অনুসরনের চেষ্ঠার চাইতেও অনেক বেশী আকর্ষনীয়। মানসমুকুল একাজে এতটাই সফল যে তাঁর সত্যজিতকে প্রণিপাত, বা মেনে নেওয়া, রেপ্লিকেশনের ধাঁচে কাছাকাছি অনুমুহূর্তের নির্মাণ, দর্শকের পথের পাঁচালী নির্ভর স্মৃতিভান্ডারকে চাগিয়ে তোলা, অথবা অন্যদিকে, জরুরী প্রতিসরন স্থানাংক খুঁজে নেওয়া, প্রত্নরূপটিকে প্রশ্ন করা, হালকা ছোঁয়ায় কোথাও এড়িয়ে যাওয়া, আবার কখনো ছবির প্রয়োজনে সম্পূর্ণ অন্যভাবে ধরার চেষ্টা করা, আজকের আবহে তৈরি ছবির চাহিদা মেনে নিজস্ব প্রস্থান বিন্দুর নির্বাচন – সবটাই ছবিটির গ্রহন উপযোগী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অসম্ভব জরুরী হয়ে ঊঠতে পেরেছে। সহজ পাঠের গপ্প দেখা/পড়ার সময় ছবির বিষয়ের সংগে কিভাবে কি বাগধারায় ছবিটি নির্মিত হচ্ছে, কোন আর্কিটাইপ বারবার গড়ছে, ভাংগছে, নেগোশিয়েটেড হচ্ছে বা বিনির্মিত হচ্ছে, সেসব কথাবার্তাও অত্যন্ত প্রাসংগিক হয়ে ওঠে। যে কারণে মানসমুকুল যখন ইচ্ছে করে তালনবমী গল্পের লিখিত রূপের পাঠ্যান্তরে বা পাঠনির্ভর দৃশ্যায়নে যান, গল্পকে কিঞ্চিত মেজে, ঘষে, ছেঁটে, জুড়ে নিজের মত একটা রূপ দেন চিত্রনাট্যে, যা কিনা দিতেই হয় মাধ্যমের পার্থক্যের কারণে, তখন ছবির ভেতর পথের পাঁচালী-র দৃশ্যক্রমগুলির হালকা চালে ছায়া নির্মাণ অন্যতর মাত্রা আনে সহজ পাঠে। আবছা প্যালিম্পসেস্টের মত অসম্ভব গতিময় গল্পটা এগোয়। ইমেজগুলো আসে, কিছু ভেংগে যায়, কিছু থাকে, পাঁচালীর স্মৃতি কে জাগিয়ে তুলে সাবলীল ভাবে অন্য সুর লাগে সারল্যের রঙে।
পথের পাঁচালী ছবিতে অপুর শৈশবে গ্রামে প্রমোদের একমাত্র স্পেস হিসেবে আসে প্রতিবেশী বাড়ির কিশোরী কন্যার বিয়ের আয়োজন। আসে গ্রামের যৌথ বিনোদন হিসেবে যাত্রার দৃশ্য। সহজ পাঠে সেসব সুযোগ নেই। আনুভূমিক যুক্তিতে বলা যায়, নেই, কারণ তালনবমী গল্পে ছিলোনা। কিন্তু সাম্প্রতিক ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে নিজের গাঢ় ভাবনার ওপর আস্থা রেখে মানসমুকুল সঠিক ভাবেই একটি মৃদু হাসির আয়োজন, কষ্টের চেপে বসা আবহের মাঝে হালকা হাসির একটি দ্যুতিময় মুহূর্ত রচনা করেন দুই ভাইয়ের পারস্পরিক নির্ভরতার দৃশ্যে। আবেগতাড়িত, হতাশ এবং ক্ষুব্ধ গোপাল যখন পুকুরের পাশে বসে চোখ মুছছে, তাকে চাঙ্গা করার দায়িত্ব তখন নিচ্ছে ছোটু। তার অতি সীমিত অভিজ্ঞতার ভান্ডার হাতড়ে সে গ্রামের পড়শী বাড়ির টেলিভিশনে দেখা হিন্দি সিনেমার নায়কের মত হাত পা ছুঁড়ে নাচার চেষ্টা করে আর হিন্দি গানের কলি আওড়ায় “লাকি ভাইই / লাকি ভাইই”। ভাইয়ের সাদা সিধে কিন্তু একান্ত আবেগের চেষ্টায় গোপাল না হেসে থাকতে পারেনা, আর তার ঘাড় ঘুরিয়ে হঠাৎ হেসে ফেলায় আচমকা ভেসে ওঠে দুর্গার খুনসুটি মাখা হাসিমুখের ছবি। পথের পাঁচালী-তে অপুর সংগে দুর্গার যাত্রা দেখা, একরাশ বিস্ময়ে ঠায় তাকিয়ে থাকা রাংতা মোড়া সাজসজ্জার দিকে। সে বিস্ময়ে তবু একটা অন্য ধরনের স্বস্তি ছিলো। হরিহর-সর্বজয়ার পরিবারে অভাবের অস্বাচ্ছন্দ্য ছিলো, কিন্তু বাসিন্দা হিসেবে গ্রামের যৌথ বিনোদনের ওপর আর সকলের মত তাদেরও একটা সহজাত দাবী ছিলো নিশ্চিত। কাজেই যাত্রাপালার আসরে বাকিসব শিশুদের সংগে অপুও প্রথম সারিতেই বসে। প্রাণভরে এক্সোটিকের মজা নেয়। কিন্তু সহজ পাঠে সে গল্প বলার সময় আরোও অনেকটা ক্লিন্ন সমাজ বৈষম্যের পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে মানসমুকুলকে। তিনি এই দশকের ফারাকে দূরে চলে আসার ক্লান্তি সম্বন্ধে সচেতন। সচেতন শৈশবের রঙ হারানো বাস্তবতা থেকে জাত-পাত-শ্রেনীর অন্যান্য দেওয়ালের মত দাঁড়িয়ে থাকা জগদ্দলের চাপে হতশ্রী ভারতবর্ষের গ্রামীন চেহারা টা নিয়ে।
পথের পাঁচালী-তে এঁকে দেওয়া অপুর পৃথিবীতে সম্পর্কের টানাপোড়েন, অনটনের জ্বালা, সম্পন্ন জ্ঞাতির চোখট্যারানো ছোট মনের প্রকাশ ছিল। কিন্তু সবচাইতে বড় করে ছিল মানবতার মরমী বাঁশির সুর, যে সুরের মায়ায় আক্ষরিক ভাবেই গোটা ছবিটার দুঃখ-সুখের আবহটা নিটোল বাঁধা। বিশ্ববাজারের ‘বীভৎস মজা’ তখনও বাংলার পল্লী সমাজের আংগিনাকে ততটা বৈচিত্র্যহীন, ততটা অমানবিকতায় কলুষিত করেনি। তখনও যৌথজীবনের মূল্যবোধের স্রোতোৎসারগুলি শুকিয়ে যায়নি সম্পূর্ণ, যেমনটি শুকিয়ে এসেছে আজকের পণ্যসভ্যতার মাঝদরিয়ায়। অপুর নিষ্পাপ সারল্যের মনকাড়া জয়গান পথের পাঁচালী-তে সেজন্যই বয়ে চলে সেই সজল আবহে। সংগে আছে আরো একটি অমিল। নিশ্চিন্দীপুরের গ্রামে নগর সভ্যতা থাবা বসায় নি। বিভূতিভূষণের নিশ্চিন্দীপুরে তো নয়ই, সত্যজিতের পাঁচালী ক্যানভাসেও নয়। নাগরিক দূষণের ছোঁয়া বাঁচানো পথের পাঁচালী-র নিশ্চিন্দীপুরে সেকালে শিশুর সারল্য অনেকটাই সুরক্ষিত ছিলো, তা সে যতই দারিদ্রের জ্বালায় ন্যুব্জ থাকুক না কেন। কিন্তু একবিংশ শতকে সে নাগর দূষণের অসুখে গ্রাম বা শহর সবাই অন্ধ। অবধারিত ভাবে তাই সহজ পাঠ-এর ছোটু্র জীবনে কোনো যাত্রা বা উৎসব আসেনা। মহাসমারোহে তো নয়ই। যাত্রা শিল্পও আজকের উদার নীতির চোখে ধাঁধাঁ লাগানো বিপণন কার্নিভ্যালে ক্রম অবলুপ্তির পথে। সিনেমা এবং তার নক্ষত্রসম নায়ক নায়িকার ঝলকানি টেলিভিশনের পর্দায় গ্রাম, পল্লী, প্রান্তর হয়ে বনবাংলোর নিভৃত অবকাশেও সহজলভ্য। সংস্কৃতির নগর দূষণে আক্রান্ত ছোটুর ছোটবেলায় তাই পৌরাণিক যাত্রাপালার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বদলে নায়কের অঙ্গভঙ্গিমা নকল করে নাচ এবং টুকরো হিন্দি বাক্যে “লাকি ভাইই / লাকি ভাইই” গান একমাত্র হাসির বা আনন্দের দুর্লভ লহমা নিয়ে আসে সহজ পাঠের গপ্প-তে। তুলনীয় দুটি দৃশ্য আবারও পাশাপাশি বসে দর্শক মনে অন্যান্য প্রশ্নগুলিকে খুঁচিয়ে তোলে। একথা অনস্বীকার্য যে অপুর বাস্তবতার সংগে ছোটুর বাস্তব প্রেক্ষিতের একটা বড়সড় অমিল আছে। সে অমিল ইতিহাসের তো বটেই, সময় এবং সংস্কৃতিরও বটে। কাজেই ছোটুকে আজকের অপুর ভূমিকায় পেতে গেলে, অথবা সেকালের অপুকে একালের ছোটুর মধ্যে খুঁজে নিতে গেলে একটা রদবদল ঘটাতেই হতো মানসমুকুলকে। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ছোটুকে করে নিতে হতো বিশ্বাসযোগ্য, যা তিনি অবশ্যই করতে পেরেছেন সহজ পাঠের গপ্প-তে, অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পাঠের পুনঃবিন্যাসের মাধ্যমে।
পথের পাঁচালী-তে অপু কার্যত নির্বাক। বাবার চিঠি আসার দৃশ্য বা পড়া বলা বাদে তার সংলাপ নেই বললেই চলে। সমস্ত পৃথিবীকে সে দেখে দুর্গাদিদির ভাষায় আর শব্দে সাজিয়ে। নগর স্পর্শে দূষিত না হওয়া গ্রামীন পরিবেশ তার সারল্যকে ধারন করে, সুরক্ষা দেয়। অপু কথা না বলে থাকতে পারে। কিন্তু সহজ পাঠে সে স্তব্ধতা অসম্ভব। নাগরিক সব উপাদানই প্রায়, সে হিন্দি গান বা টেলিভিশন, মিড-ডে মিল চালু হওয়া স্কুল বা স্কুলের ইউনিফর্ম, যাই হোক না কেন, পল্লীগ্রামের জীবনের অঙ্গাঙ্গী এখন। সেখানে ছোটুর কথা না বলে উপায় কি। কাজেই এই পালটে যাওয়া জগাখিচুড়ি ভারতবর্ষের বাণিজ্যিক পণ্য তার সহজ বিশ্বাসী মনে নতুন ধরনের বিস্ময়ের জন্ম দেয়। জন্মনিরোধক কন্ডোমকে সে বেলুন বলে চিহ্নিত করে। আহ্লাদে নিয়ে আসে দাদার কাছে, আর পরমুহূর্তে বাড়িওয়ালীর মুখঝামটা খেয়ে খাবার না পেয়ে হতভম্ব প্রস্থান করে কাজ করতে যাওয়া বাড়িটির কুয়ো পাড় থেকে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা যে কেন তাদের প্রতিশ্রুত খাবারটকু কাজের বিনিময়ে দেওয়া হলোনা। অসহ্য ক্ষিদের পেটে সে প্রশ্ন করে করে গোপালকেও বিরক্ত করে তোলে। ক্ষিদে না মেটার হতাশায় তার চোখে মুখে ফোটে অপলক বিস্ময় । কিন্তু পথের পাঁচালী-তে কবিতার মেজাজে আঁকা অপার বিস্ময়ের সংগে সহজ পাঠে ছোটুর চোখেমুখে ফুটে ওঠা বিস্ময়বোধের উপাদানিক পার্থক্য যোজন বিস্তারি। ভারিক্কি ভারত রাষ্ট্রের স্বাধীনতা্ পরবর্তী সমস্ত অপদার্থতা, সব নাগরিকের ক্ষুন্নিবৃত্তির আয়োজনে সম্যক ব্যর্থ হওয়ার যাবতীয় দায়ের চিহ্ন লেগে আছে ছোটুর বেলুন-বিস্ময়ে। অপুর বিস্ময়বোধ নিষ্পাপ। সেখানে বয়ঃসন্ধী প্রসংগ প্রবেশ করেনি। অথচ দেশ এবং সময়ের ভীষন বদলে যাওয়া পরিস্থিতির চাপে সে প্রসংগের জোর করে অন্তর্ভুক্তি হয়ে গেছে একুশ শতকের ছোটুর বিস্ময় বলয়ে। তার বিস্ময়ে অপমানবোধ, অবাক করা আকস্মিকতা, হতাশা আর ক্ষিধে মাখামাখি হয়ে লেগে থাকে। ছোটুর বিস্ময় অপুর তুলনায় অনেক বেশী বিপন্ন। সেখানে সারল্যের রংগে অনেক ধূসর আভা, অনেক নাম না জানা ঘটনা স্রোতের অবাধ চলাচল।
এবং ঠিক একারণেই পথের পাঁচালী-র পিকনিক বা অন্য খাওয়ার দৃশ্যের আনন্দ আর বিবাহ বাসরে দুর্গার অব্যক্ত কান্না মাখা বিষাদ মুখচ্ছবির মত বিপরীত মেজাজের দুটি দৃশ্যের সাহসী মেলবন্ধন ঘটে সহজ পাঠ-এর জমিদার বাড়িতে তালনবমীর পুজোর ভোজ খাওয়ার স্বপ্ন দৃশ্যে। ছোটু-গোপাল সে বাড়িতে নেমন্তন্ন পায়না। গ্রামে প্রায় অপাংক্তেয় ভূমিকায় থাকা ওই দুটি শিশুর খেতে পাওয়া বা না পাওয়ায় বাকি পড়শীদের বিশেষ কিছু গত্যন্তরও হয়না। দাদাকে না জানিয়ে গিন্নি মা’কে বিনে পয়সায় তাল দিয়ে আসা ছোটুর প্রত্যাশী কৌশলটিও মাঠে মারা যায়। দাদার কাছে প্রহারও জোটে তার। নিরূপায় অভিমান হয়। কান্নায় ফেটে পড়ে সে এঁটো হাতে উঠে এসে নেমন্তন্ন না পাওয়ার লজ্জায় ফুঁপিয়ে গলা তুলে ঝগড়া করে আর দুটি নেমন্তন্ন পাওয়া সমবয়সীর সংগে। শৈশবের এই নির্মম লাঞ্ছনায়, হেরে যাওয়ার গ্লানিতে ছোটু-গোপালের প্রাত্যহিকী গোটা দেশের সমস্ত অভুক্ত সারল্যের বড় বড় চোখের নিস্পাপ চাহনির সামনে উলংগ করে দাঁড় করায় দর্শকের বিবেক কে। নেমন্তন্ন বাড়িতে কাংখিত “পুলুয়া” খাওয়ার কাজটি আর স্থায়ী হতে পারেনা ছোটুর স্বপ্নে। সেখানেও পেছনে মা এসে দাঁড়ান। ক্লান্ত ব্যস্ত মুখে তিনি জিজ্ঞাসু ডেকে নেন সন্তানদের। ছোটু-গোপালের “পুলুয়া” খাওয়া, এমনকি স্বপ্নদৃশ্যেও, পূর্ণতার সম্ভাবনাহীন একটি অলীক কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় আজকের অবাক বৈষম্যের জ্বালা ধরানো সংসারে। সর্বজয়া সে জ্বালা ভালোই বুঝেছিলেন। কিন্তু ছোটু-গোপালের মা হিসেবে সহজ পাঠের গপ্প-তে আজকের সর্বজয়ার সে উপলব্ধি বোধহয় একটু বেশীই অনন্যোপায়, নিষ্কৃতিহীন।
ভারতবর্ষ নামক রাষ্ট্রের আদি অকৃত্রিম ব্যধি, ক্ষিদে এবং অভাব, আরোও একবার আমাদের অপরাধী হিসেবে মাথা নুইয়ে দেয় এমনকি আজও এই একুশের দ্বিতীয় দশকে। যেমনটি দিয়েছিলো আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে, ১৯৫৫’য়, পথের পাঁচালী-তে সত্যজিত রায়ের নির্ভিক বাস্তব চিত্রনে। শুধু এইবারে, সহজ পাঠ-এ, আরোও বেশী তীব্রতায়, গ্লানিতে আর অসহায়তায়। কেননা ছোটু-গোপালের এখনও আধপেটা রাত, নির্ঘুম চোখে নেমন্তন্ন না পাওয়ার দুঃখ মাখা কান্না জল, আর তাদের অসহায় মায়ের পাগলের মত আত্মহত্যার দুঃস্বপ্ন অজান্তে বাজারসাম্রাজ্যের সমস্ত অসাম্যের উপচারকে প্রশ্নের সামনে ঠেলে দাঁড় করায়। আমাদের শান্তিকল্যান হয়ে থাকা পাথুরে চেতনায় লাগায় তাড়নার সপাট চড়।
পথের পাঁচালী-র সময়ে, স্বাধীনতার মাত্র ক’বছর পরেই, যে দারিদ্রের চিত্রায়ন ছিলো দেশটা ঠিক কি সেটা বোঝানোর জন্য, তবে আজ এত বছর পর সেই একই দারিদ্রের অনপনেয় চিত্রে, সহজ পাঠের গপ্প-এর ক্ষিদে আর অভাবের সংসার, দেশটা যে এখনও একই রকম রয়ে গেলো সেই ভয়াবহ হতাশার এবং ক্ষোভের বোধটাকে চাগিয়ে দিলো অনেক বেশী বেশী করে। মানসমুকুল ভাবিয়েছেন, সেটাই বড় নয়, তিনি পরম মায়াভরে হাতে ধরে জীবন পথের পাঁচালী শুনিয়েছেন আজকের দর্শককে। এই পাঁচালীর অপ্রাপ্তির উপার্জনে আমাদের ঝুলিও হয়তো একই রকম শূণ্যতায় ভরা বলে ছবির শেষে আমরা অনুধাবন করি। সকল দুঃখযাপনের পর একই মানবিক জিজ্ঞাসায় হয়তো একে অপরের কাছে খুঁজে নিতে চাই জীবনের অমেয় ওম। সমস্ত প্রিয়জনের নাম নেওয়া হয়ে গেলে আকুলতায় ভাগ করে নিতে চাই পারস্পরিক নিবিড়তার সজল আকাঙ্ক্ষা। ছবির শেষ দৃশ্যে ছোটু স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গোপালকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে চায় যে সহোদর তাকে ভালোবাসে কিনা। নিশ্চিত করে নিতে চায় আলতো কিন্তু সোচ্চার দাবীতে। অনুচ্চারে গলা মিলিয়ে আমরাও অজান্তে শুধোই, শুধোতেই হয়, “আর আমাকে?”