ভালোয় মন্দয় মিলিয়ে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে অনেক বিচিত্র ঘটনা ঘটেছে, তবে এবার যা হলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের আরেক প্রস্থ কফির অর্ডার দিয়ে ইস্তভান কিছু লিখলেন একটা কাগজে, তার পর বললেন ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে তিনি সিটি ব্যাঙ্ককে একটি আন্তর্জাতিক ঋণের মৌখিক ম্যানডেট দিতে আগ্রহী। আমরা যদি তাঁদের শর্ত মেনে নিই, ইস্তভান তাঁর বোর্ডের সম্মতি বিধায় আমাদের ফর্মাল চিঠি দেবেন, তাতে কিছু সময় লাগতে পারে। এবার তিনি তাঁর টেবিলে লেখা চিরকুটে চোখ রেখে উইশ লিস্ট, চাহিদার তালিকা জানালেন- এক। কাম্য ঋণের পরিমাণ তিরিশ মিলিয়ন ডলার। দুই। মেয়াদ তিন বছর, আসলটা শোধ দেওয়া হবে ঋণচুক্তি সই করার তিন বছর বাদে, কোনো কিস্তিতে নয়। তিন। সুদ প্রত্যর্পণ করা হবে প্রতি ছ মাস অন্তর। চার। সুদের হার লন্ডনের ইন্টার ব্যাঙ্ক অফার রেট বা লাইবরের ওপরে ২% (সে সময় ৪% প্লাস ২=৬%), ফিক্সড নয়, ফ্লোটিং, ছ মাস অন্তর নির্ধারিত হবে। পাঁচ। আমাদের পারিশ্রমিক তিরিশ মিলিয়ন ডলারের ওপরে ১% অথবা ৩০০,০০০ ডলার, সেটি ঋণচুক্তি সই হবার দিনে দেয়, আপ ফ্রন্ট। সুখবর ! খদ্দেরের আজ্ঞাপত্র বা ম্যানডেট পেতে কত যে ঘোরাঘুরি করতে হয়, জুতোর সুখতলা খোয়াতে হয়! টাটা স্টিলের বর্তমান অধ্যক্ষ কৌশিক চাটুজ্জে তার সাক্ষী। তাঁর কোম্পানির ইংল্যান্ডের কোরাস স্টিল অধিগ্রহণের ডিলের সন্ধানে বম্বে হাউসের লবিতে, প্রয়াত রতন টাটার স্নেহধন্য সতত বিচরণরত কুকুরগুলিকে পাশ কাটিয়ে লিফটে চড়ে তিনতলায় কৌশিকের অফিসে কতদিন যে হত্যে দিয়ে বসে থেকেছি (তাঁর তৎকালীন সুযোগ্য সহকারী সন্দীপ অবশ্য আমাদের আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখে নি)। এই বুদাপেস্ট ব্যাঙ্ক পয়লা মিটিঙেই বললেন, চরৈবেতি? মানে আমাদের কপালে ডিল নাচছে, না আমরা বোকার মতন বীরদর্পে কোন গভীর গাড্ডার দিকে এগুচ্ছি? চ্যালেঞ্জের তালিকা নিম্নরূপ: পূর্ব ইউরোপের বাজার খুলেছে সবে কিন্তু এই কয়েক বছরে কোনও দেশের কোনো ব্যাঙ্কই আন্তর্জাতিক ঋণ বাজারে আসে নি। ব্যাঙ্কের বয়েস সাত বছর, ব্যবসার ফলাফল ভদ্রসমাজে বড়ো গলা করে বলার মতন নয়; লাভের মুখ কখনো দেখেনি, দেখছে লোকসানের মুখ। মালিকানা সরকারি, জানি। কিন্তু ঋণের অনাদায়ের অপরাধে হাঙ্গেরি সরকারকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় না। সরকারের একটি কবচ-কুণ্ডল থাকে, তার নাম সভারেন ইমিউনিটি, সরকার অবধ্য। ঋণের দর কি হবে ব্যাঙ্ক নিজেই স্থির করে দিয়েছে। সেটা তাদের ইচ্ছে, পাবলিক সেটা মানবে? বেচব কাকে? কোনো তুলনামূলক বাজারি দর আমাদের অজ্ঞাত, ওয়াল স্ট্রিটের কেতাবি ভাষায় যার নাম মার্কেট রিড। মার্কেট কোনও ডিলই দেখে নি অতএব কোনো কিছু রিড করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব! জিজ্ঞেস করব কাকে? পশ্চিমে ঋণের বাজারে হাঙ্গেরি ও বুদাপেস্ট দুইই অপরিচিত। ... ...
মায়াকে সংক্ষেপে জানালাম চেক আলফাবেটে যদিও অক্ষর বেয়াল্লিশটি, স্বর বর্ণ সাতটি, তারা এই সীমিত স্বর বর্ণগুলি অনেক ভেবে চিন্তে খরচা করেন, যেমন মৃত্যুর প্রতিশব্দ Smrt, শোনায় স্মরত্। এর পিছনে মুখের ব্যায়াম ছাড়া আর কোন যুক্তি আছে জানি না। BRNO উচ্চারণ বরনো অথবা ব্রনো। জার্মানরা অবশ্য এর একটা সহজ ভার্শন রেখে গেছে, ব্রুইন। এই রাজ্যের নাম মোরাভিয়া, চেকে মোরাভা, সেখানে ভাওয়েল আছে মাঝে ও শেষে। জার্মান আরও সহজ, মেহরেন। মেয়েকে আরেকটা ট্রিভিয়া শোনানোর সুযোগ ছাড়া গেলো না। চেক ভাষায় আনো (ano, শুনলে নো মনে হয়) হলো হ্যাঁ! আরেকটিমাত্র ইউরোপীয় ভাষায় এমনি গোলমেলে ব্যাপার আছে - গ্রিকে নে মানে হ্যাঁ! ব্যবসায়ের নামে পূর্ব ইউরোপ বেড়ানোর দিন ফুরিয়েছে। ভিয়েনায় আমার অনাদি ব্যাঙ্কের বোর্ড মিটিং সেরে গাড়ি ভাড়া করেছি চেক সন্দর্শনের বাসনায়। প্রথম স্টপ ব্রুইন, ভিয়েনা থেকে মাত্র একশ মাইল। গাড়িতে বা ট্রেনে দেড় ঘণ্টা (ভাড়া আটশো টাকা!) ইতিহাসে পড়া হাবসবুরগ সাম্রাজ্যের দিগন্ত খুলে যায় চোখের সামনে, তাকে সত্বর চেনা হয়ে যায়। ভিয়েনার শোয়েখাত হাওয়াই আড্ডা থেকে বেরিয়ে শহরে যাবার পথে নির্দেশিকা চোখে পড়ে – এই দিকে প্রাগ, ব্রুইন,ওই বুদাপেস্ত, জাগ্রেবের রাস্তা- হাবসবুরগ রাজত্বের পুরনো জেলা সদর! এককালে কাঁটাতার, ওয়াচ টাওয়ার ছিল এখন সীমানা অবধি নেই। চেনা অচেনা জায়গা পার হয়ে যাই, এমনি হঠাৎ কখন পার হয়েছি আর্কডিউক ফ্রান্তস ফারদিনান্দের স্ত্রী সোফি ফন হোহেনবুরগের পৈত্রিক জমিদারি। চেকোস্লোভাকিয়া নামের দেশ কোন কালে ছিল না; ছিল কয়েকটি রাজ্য বোহেমিয়া, মোরাভিয়া, চেক সাইলেসিয়া, আপার হাঙ্গেরি (আজকের স্লোভাকিয়া), আটশ বছর পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, তারপর হাবসবুরগ এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজত্বের (১৮৬৭-১৯১৮) অংশ। আমরা বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়াকে বেশি চিনি, এদের নাম প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে থাকে। বোহেমিয়া আয়তনে বড়ো, প্রাগ তার রাজধানী, ব্যাভেরিয়ার সঙ্গে গায়ে লাগা, জার্মান ভাষা সংস্কৃতি ও শিক্ষার পীঠস্থান; মোরাভিয়া আজকের চেক রিপাবলিকের এক তৃতীয়াংশ, রাজধানী বরনো, চেকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর,ইউরোপের ষাট নম্বরে। ... ...
একি! এখানেও এত জন উঠবে নাকি? আমরা তালে বসব কোথায়?, মহারাজ রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছেন কাণ্ড দেখে। ঘাবড়ে যাওয়ার কারণ আছে বৈকি। এইটুকু ট্যাক্সির সামনের সিটে টপাটপ চার জনকে উঠে বসতে দেখে তিনি হাঁ হয়ে গেছেন। আগের গাড়িগুলোতেও কেমন আট দশজন করে লোক ঠেসেঠুসে উঠে পড়ছিল। এই গাড়িতে যে এত লোক ধরতে পারে এটাই মহারাজের ভাবনার বাইরে। এবার কি হবে ভেবেই ওনার দম আটকে আসছে। মামা পাশ থেকে আশ্বাস দিলো, না না, চিন্তা নেই, পেছনে শুধু চার জনই উঠবে আমাদের গাড়িতে, একটা সিট বেশি নেওয়া হয়েছে দিদিমার জন্য। পিছনে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথ, মামা আর দিদিমাকে ঠেলেঠুলে আরও এক জন এসে চেপে বসল। মালপত্র যা কিছু ছিল সব ডিকিতে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে। ওদিকে সামনে চারজন বসেছে বললে ভুল হয়, কোনমতে এঁটে গেছেটাই সঠিক কথা, কিন্তু এর পর ড্রাইভারকাকুই বা বসবে কোথায়? দেখা গেল ড্রাইভার তো উঠলই আরেকজন লোকও উঠে পড়ল, সে নাকি সামনে নেমে যাবে। উঠে তো সবাই পড়েছে, এদিকে গাড়ির দরজা তো কিছুতেই বন্ধ হয়না। মহারাজ ভাবছিলেন, এ নিয়ে সবাই বুঝি ভয়ানক চিন্তায় পড়বে, কিন্তু কোথায় কি, দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে একটা মোটকা মতো নারকেলের দড়ি বের করে ড্রাইভারকাকু খুব কষে দরজাটা আটকে দিল। আটকে দিল মানে একেবারে গাড়ির সথে ফট করে লেগে গেল, তা কিন্তু নয়, দরজা হাওয়াতেই দাঁড়িয়ে, তবু গাড়ির ফ্রেমের কিছুটা কাছাকাছি আনা গেল, সেটাই সান্ত্বনা। গাড়ি জোরসে ঝাঁকুনি দিলে কেউ অন্তত যাতে ছিটকে পড়ে না যায়। পড়ে গেলে ড্রাইভারেরই মুশকিল, একটা সিটের টাকা মার যাবে, তাই এই ব্যবস্থা - মামা উবাচ। এদিকে ড্রাইভারকাকুও অর্ধেক সিটের বাইরে বেরিয়ে আছে, কোনোমতে বাঁ হাত বাড়িয়ে স্টিয়ারিং ধরে আছে। ওইদিকটা পরের গাড়ির ড্রাইভার এসে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে গেছে। শেষমেশ দড়িদরা বেঁধেছেঁদে গাড়ি ধানবাদ স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করল। রাস্তায় একগাদা ধুলো ওড়াতে ওড়াতে গাড়ি ছুটে চলেছে আর খানাখন্দে চাকা পড়লেই সব যাত্রীরা মিলে শূন্যে লাফিয়ে উঠছে। ... ...
কিন্তু সিনেমা ছেনুকে ছাড়লে তবে তো। আবার কিছুদিন পর একদিন খবর এলো জামাইবাবুদের অফিস থেকে নাকি পূরবীতে 'ঝিন্দের বন্দি'-র স্পেশ্যাল শো এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। জামাইবাবু ছেনুকে এসে বলল, "দেখো এটাতে কিন্তু ভূতটুত কিচ্ছুটি নেই। খুব বিখ্যাত সিনেমা, ভীষণ ভালো লাগবে। আর সিনেমাহলে ভয় পাওয়ার দুর্নাম ঘোচানোর এটাই সুবর্ণ সুযোগ।" তা ছেনুও সেই শুনে রাজি। জামাইবাবুর অফিসের অনুষ্ঠান বলে কথা, সেজেগুজে যেতে হবে। এই বারের পুজোয় ওকে যে সুন্দর কোটটা কিনে দিয়েছিল জামাইবাবু, ওটাই পরে যাওয়া মনস্থির করল। যাওয়ার দিন সকাল থেকে ছেনু চান টান করে চুল আঁচড়ে তৈরি। হাফ প্যান্টের সাথে কোটটা মানিয়েছেও খুব ভালো। টাইম মতো জামাইবাবু চলে এলো ওকে নিতে। ওখানে গিয়ে হলটা দেখে তো ছেনুর ভারি ভালো লাগল। অনেক লোকও এসেছে। সবার সাথে প্রথম বারের মতো ছেনু কোনো সিনেমা হলের মধ্যে ঢুকল। ঢুকেই দেখে সামনে বিশাল সাদা পর্দা। এখানেও সেই ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট এর মতো পরপর চেয়ার পাতা। প্রথমে বেশ কয়েকজন মিলে প্রদীপ জ্বালানোর পর, হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শুরু হল। সেটা শেষ হতেই নানারকম গুরুগম্ভীর বক্তৃতা। একে একে সব মিটলে, শুরু হল আসল আকর্ষণ - সিনেমা। ... ...
সেই হুকুম শিরোধার্য করে ছেনুকে পা দিয়ে আওয়াজও করতে হচ্ছে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কি আর করা যাবে? চমচম আংটির জন্য এটুকু তো করতেই হবে। যেখানে সেই দ্বাপর যুগে স্বয়ং কেষ্ট মহারাজ স্যমন্তক মণির জন্য আকুলি বিকুলি করতেন, কোহিনুর পেতে নাদির শা থেকে রঞ্জিত সিং সবাই হাত বাড়িয়েছেন সেখানে ছেনু তো কোন ছার! ছোট্ট থেকেই ওর চোখ দিদির হাতের নানা কারুকাজময় চমচমের মতো দেখতে চকচকে সোনার আংটিটার দিকে। সোনা কাকে বলে, তার কত দাম বা বদ্দিই বা কোথা থেকে আংটিটা পেয়েছে কিছুই ছেনুর জানা ছিলনা। কিন্তু আংটিটা হাতে পরলে ছেনুর মনে ভারি আনন্দ হতো। বারবার বদ্দির থেকে চমচম আংটিটা (ছেনুরই দেওয়া নাম) নেওয়ার জন্য বায়না করলেও বদ্দি এমনিতে কিছুতেই সেটা হাতে দিত না। ... ...
তার পুব দিকের ঢালের উঁচুতে বড় বড় ওটের ঘাস জন্মেছে। ওই ঘাসবনের পরেই খাড়া পাহাড় সোজা নেমে গেছে কোশি নদীর পাড় অবধি। একদিন খাড়াই পাহাড়ের উত্তর দিকের গ্রাম থেকে একদল মেয়েবউ ওখানে ঘাস কাটছিল। হঠাৎ এক বাঘ তাদের মধ্যে এসে পড়ে, হুড়োহুড়িতে এক বয়স্কা মহিলা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঢাল বরাবর গড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাঘটা যেমন হঠাৎ আসে তেমনই চিৎকার চেঁচামেচিতে রহস্যময় তার পালানো। খানিকটা ভয় কাটলে খোঁজাখুঁজি শুরু করে মেয়েরা আর ঘেসো জমির ঢাল ধরে খানিকটা নেমে এক সরু ধাপিতে ওনাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেল। মহিলা কোঁকাতে কোঁকাতে বলেন তিনি মারাত্মক চোট পেয়েছেন। ... ...