ভারতে একবিংশ শতকের গোড়ার দিকেও মেডিক্যাল শিক্ষা এবং সাধারণ শিক্ষায় প্রধানত ব্রিটিশ/ইউরোপীয় মডেলকে অনুসরণ করা হত। ২০১৪ সালের পরে এটা প্রায় সম্পূর্ণত আমেরিকার মডেলের অনুসারী হয়ে ওঠে – ‘নতুন শিক্ষানীতি’ এবং ৪ বছরের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্স চালু করা যার ভালো উদাহরণ। ব্রিটিশ মডেলে ক্লিনিকাল শিক্ষার ওপরে জোর দেওয়া হত। হাউসস্টাফশিপ ছিল বাধ্যতামূলক যাতে একজন ডাক্তার স্পেশালিস্ট না হলেও যেকোন ধরনের রোগীর সাধারণ চিকিৎসায় দক্ষ একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনার হয়ে উঠতে পারত। এখনো ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, গ্রামেগঞ্জে এধরনের চিকিৎসকেরাই রোগীদের প্রধান ভরসা। আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথা রাখতে হবে। চিকিৎসক এবং চিকিৎসার এ ধারার মধ্য দিয়ে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কের একটি দীর্ঘকালীন বনিয়াদ জন্মায়। রোগীরা পারিবারিক, ব্যক্তিগত এবং সামজিক সমস্যা সম্পর্কে মন খুলে কথা বলতে পারে। এখানে একজন রোগী চিকিৎসার বাজারের (কর্পোরেট জগতের থাবায় যা ক্রমাগত সমস্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করছে) অর্থনৈতিক ‘ভোক্তা’ নয় – একজন মানুষ, যে ঘটনাচক্রে রোগী হয়েছে। ... ...
বাঙালির নববর্ষ নিয়ে অদ্ভুত কিছু বিতর্ক উত্থাপন করা হয়েছে। কে এই নববর্ষের উদ্গাতা—আকবর, নাকি শশাঙ্ক? এর পুরোটাই চলছে, প্রায় হাওয়ায় হাওয়ায়—হোয়াটস-অ্যাপ প্রচার যেমন হয়। তাই ঝট করে একবার দেখে নেওয়া যাক, আইন-ই-আকবরি-তে এই নিয়ে কী লেখা আছে। ... ...
শেষ বয়সে জনগণের ওপরে কেশবচন্দ্রের প্রভাব দৃশ্যত কমে গিয়েছিল; কিন্তু তাঁর প্রচারিত আর্যতত্ত্বের রেশ থেকে যায় বুদ্ধিজীবি মহলে। আর্যতত্ত্ব প্রচারে কেশবচন্দ্রের প্রভাব আজও এতটাই গুরুত্বের, যে এখনও প্রায় প্রত্যেকটি জাতীয় দল/গোষ্ঠীকে আর্যতত্ত্ব বিষয়ে নির্ণায়ক অবস্থান নিতে হয়। কেশবচন্দ্র সেন এবং ব্রাহ্ম সমাজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই। মুলার শেষ বয়সে তার সন্তান আর্যতত্ত্বকে নিয়ে কী করবেন সে বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি, যদিও তিনি আর্যতত্ত্বের দাঁত-নখ উপড়ে দিয়েছেন। আধুনিককালে আর্যতত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তার দ্বিধা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর্যতত্ত্বকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার, সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষার কাজে সফল হয়েছে। খ্রিস্ট মিশনারি, প্রাচ্যবাদী এবং ব্রিটিশ সরকার যৌথভাবে মুলার এবং কেশবচন্দ্রের এই তত্ত্বকে তাদের স্বার্থে বারংবার ব্যবহার করেছে ... ...
... সাম্রাজ্যের মানুষেরা যে কেশবচন্দ্রকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে চায়, সেটা কোনও গোপন এজেন্ডা ছিল না। কেশবের খ্রিস্টধর্মে মতি দেখে ম্যাক্সমুলার প্রকাশ্যে বলেছিলেন, একমাত্র বিশপ কটন কেশবচন্দ্রকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে পারেন। কেশবচন্দ্রকে যে সাম্রাজ্য উপনিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রজা হিসেবে গণ্য করছে, সেই ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হয়ে যায় সাম্রাজ্য-কর্ত্রী ভিক্টোরিয়া তাঁকে দু’টি বই উপহার দেওয়ায়। সাম্রাজ্য তাঁকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ায় তিনি ৪০টা ব্রিটিশ শহর এবং আমেরিকা থেকে বক্তৃতা দেওয়ার ডাক পাবেন ... ... ...
রামকমল যখন কলকাতার শাসক কেষ্টুবিষ্টুদের সঙ্গে দিনরাত ওঠাবসা করছেন, সেই সময় ১৮৩০-এর অগাস্টের গোড়ার দিকে কলকাতায় পাদ্রি হিলের প্রথম বক্তৃতা। বক্তা একে প্রণম্য ইওরোপীয় পাদ্রি, তায় বক্তৃতার বিষয় রাজার ধর্ম, [কলকাতার] হিন্দু সমাজের পাঁজর পর্যন্ত কেঁপে উঠল। কলকাতার সমাজ কাঁপল ইয়ং বেঙ্গলিদের নতুন খাদ্যাভ্যাসে। রায়বাহাদুর প্রমথনাথ মল্লিক, কলিকাতার কথায় লিখছেন, ‘... হিন্দু কলেজের ছেলেরা হেনরী ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং হেয়ার সাহেবের শিক্ষায় প্রকাশ্যভাবে অখাদ্য খাইতে আরম্ভ করিয়াছিল ও হিন্দুধর্মের প্রতি অনাস্থা দেখাইতে লাগিল। মহেশচন্দ্র ঘোষ ও কৃষ্ণ[মোহন] বন্দ্যোপাধ্যায় খৃষ্টান হইল। রামমোহন ব্রাহ্মধর্ম (তখনও ধর্ম হয়নি) প্রচার করিলেন। সমাজে ও কলিকাতার হিন্দুধর্ম গেল গেল রব পড়িয়া গেল। রামকমল সেন হিন্দু কলেজ হইতে উক্ত ডিরোজিওকে ছাড়াইতে গেলেন, কিন্তু উইলসন, হেয়ার ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহের (কালীপ্রসন্ন সিংহের পিতামহ) জন্য তাহা পারিলেন না। উক্ত সেনকে মিন্টের ও ব্যাঙ্কের দেওয়ান করিয়া কোম্পানি বশ করিয়া ফেলিল। ডিরোজিও নিজে ইহাদের ধন্যবাদ দিয়া চাকরি ছাড়িয়া দিলেন। ... ডিরোজিওর ছাত্রেরা সকলেই কোম্পানির বড় চাকরীয়া ডিপুটি কলেক্টর হইল’। ... ...
১৮৫৭-র যুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে ম্যাক্সমুলারের রান্না করা ‘ভারতভূমিতে ককেসাসিয় আর্য আগ্রাসন তত্ত্ব’ (এখন থেকে আর্যতত্ত্ব) ঔপনিবেশিক বাজারে সভ্যতা-বিস্তার আর সাম্রাজ্যরক্ষার ককটেল বানিয়ে খাইয়ে দেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে প্রাচীন আর্যতত্ত্বের নবতম রূপকার ম্যাক্সমুলার প্রথমে আর্যকে জাতিবাচক অভিধায় অভিহিত করে যতদূর-সম্ভব ভুল করেছিলেন। কিছু পরে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সংস্কৃত ভাষায় বডিন অধ্যাপনার প্রতিযোগিতায় ছিটকে গিয়ে তিনি পূর্বের নিজ-অবস্থান সংশোধন করে, আর্য শব্দের জাতিবাদিতা কেড়ে, তার নখ-দাঁত বিচ্ছিন্ন করে নিরীহ ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিলেন। কিন্তু ততদিনে আর্যতত্ত্ব মোটামুটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি তৈরি এবং তাকে জোরদার করার কাজে সহায়ক হয়েছে। কেশবচন্দ্র শুধু যে ‘বৈজ্ঞানিক’ আর্যতত্ত্ব অবলম্বনে ব্রিটিশদের ভারতবর্ষের ‘বিছড়ে হুয়ে ভাই’ বলবেন না, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ‘গডসেন্ড, ভগবৎ-ইচ্ছা’ আখ্যায় ভূষিত করে ব্রাহ্ম ভাইবেরাদারদের উপনিবেশ লুঠে ছোটতরফ ভদ্রবিত্তের চাকুরি, দালালি, উমদোরির অংশিদারিত্বও নিশ্চিত করবেন.... ... ...
“আপনার নির্বাচনী কেন্দ্রে বিজেপি বিরোধী যার জয়ের সম্ভাবনা বেশি তাকে ভোট দিন”—এই স্লোগানের কার্যকারিতা নিয়েও আমাদের সন্দেহ আছে, সাধারণ মানুষ সেফোলজিস্ট নন জ্যোতিষও নন। তাহলে তাঁরা কীভাবে জানবেন কে জিতবে? গত লোক সভা নির্বাচনে ভাবা গিয়েছিল কংগ্রেস ফিরছে, কিন্তু বিজেপি আরও শক্তি নিয়েই ফিরেছে। ... ...
No Vote to BJP - এই স্লোগানের মধ্যে চমক আছে। ভাবনার গভীরতা নেই। বাস্তববুদ্ধি নেই। No Vote to BJP'র উদ্যোক্তারা আবেগের স্রোতে ভেসে গিয়েছেন। কোনও কিছুই তলিয়ে ভাবেন নি। তাই "বিজেপিকে ভোট নয়"- এই স্লোগান বিজেপি বিরোধী শিবিরে একরাশ বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। ... ...
ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করতে গণআন্দোলনই একমাত্র পথ—একথা ঠিক। কিন্তু ৯৫ বছর ধরে চাষ করে যে ফসল আজ তারা তুলছে এবং যখন দেশের সংসদীয় বামপন্থী দলগুলোর এরকম দুর্বল অবস্থা, তখন কিছু প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রতিবাদী মানুষ একজোট হয়ে মাত্র তিনমাসের প্রচার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আরএসএস–বিজেপির অগ্রগতির রথ আটকে দেবেন, এমন চিন্তা অবাস্তব বলেই মনে হয়। নির্বাচন যেখানে দরজায় কড়া নাড়ছে, সেখানে আশু কর্তব্য হওয়া উচিত সেই পথের খোঁজ করা কীভাবে আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে পরাস্ত করা যায়। ... ...
সমস্যা সম্ভবত সিপিএমের দৃষ্টিভঙ্গিতেই লুকিয়ে আছে। কদিন আগে একটা মিম, সিপিএমের লোকজন হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে ছড়িয়েছে, কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে কোনও এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, কেরালার কোনও এক জায়গায় বিজেপি মিউনিসিপালিটির এক আধটা আসন জিতেছে, কী ভাবছেন বিজয়ন? তিনি নাকি বলেছেন, ঐ এলাকার মানুষের শিক্ষাগত মান বাড়ানোর ব্যাপারটা আমরা চিন্তা করছি। বিজেপির মত এক ফ্যাসিস্ত দল, কেরালায় সামান্য হলেও সংগঠন বাড়াচ্ছে কারণ মানুষ অশিক্ষিত, মানুষের বোধ বুদ্ধি নেই, মানুষ ভুল করছেন। এই ঔদ্ধত্য কোথা থেকে আসে? ... ...