নিজের জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে কোনো এক শীতকালে তিনি নাকি বুঝতে পেরেছিলেন যে পরের বছর অলিভের ফলন খুব ভালো হবে। অতএব, নিজের সামান্য জমা টাকাপয়সা অগ্রিম জমা দিয়ে তিনি খিওস ও মাইলেটাস-এর সমস্ত অলিভ-ঘানি ভাড়া নিয়ে রাখলেন। শীতের অসময়ে তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে কেউ তেমন নিলামেও দাঁড়ালো না, তাই বেশ কম দামেই ভাড়া পেলেন থেলিজ়। পরবর্তী ফলনের সময় যখন এল, একসঙ্গে সব ঘানির চাহিদা তৈরি হল, থেলিজ় নিজের ইচ্ছেমতো দামে সেগুলি অন্যদের ব্যবহার করতে দিলেন, আর এভাবে বেশ অনেক অর্থই উপার্জন করলেন। এইভাবে দুনিয়াকে দেখালেন, যে দার্শনিকরা চাইলেই ধনবান হতে পারেন, নেহাত তাঁদের উচ্চাশার বিষয় একেবারেই অন্য গোত্রের। ... ...
যতক্ষণ কোনো প্রকল্প ধর্ম, ধর্মতত্ত্ব এবং ধর্মীয় মৌলবাদের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায় ততক্ষণই তা ভালো। ধর্মনিরপেক্ষতার সীমাবদ্ধতার বিপরীতে বিপুল ধার্মিক জনতার নৈতিক বোধকে অসাম্প্রদায়িক লক্ষ্যে চালিত করার এ এক উপায় হতে পারে। তবে এই উপমহাদেশে রাষ্ট্রশক্তির কাছে মৌলবাদ প্রশ্রয় পায়। সেখানে লোকধর্ম তার বিরুদ্ধে কতটা শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়তে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ... ...
দূরদর্শিতা ব্যক্তির আত্ম-নিয়ন্ত্রণের উদাহরণ। সভ্যতা কেবল ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই প্রবৃত্তিকে লাগাম পরায়নি, সে কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল আইন, আচার আর ধর্ম। এগুলি বর্বর জীবনেরই উত্তরাধিকার, তবে প্রবৃত্তির প্রভাব এখানে কম, প্রকরণের বেশি। কিছু কার্যকলাপকে অপরাধ বলে দাগানো হল, আর যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থাও হল; অন্য কিছু কাজ—যদিও আইনের চোখে অপরাধ নয়—সমাজের চোখে ন্যক্কারজনক বলে চিহ্নিত হল। জমির ব্যক্তিগত মালিকানা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার ফলে তার পিছু নিয়ে এল নারীর বশ্যতা স্বীকার, আর প্রায়শই, একটি দাস-শ্রেণীর নির্মাণ। একদিকে যেমন গোষ্ঠীর ভালোমন্দের ভার ব্যক্তির ওপর চাপানো হল, অন্যদিকে তেমনই—নিজের গোটা জীবনকে নিয়ে ভাবার অভ্যেস তৈরি হওয়ার ফলে—ব্যক্তি আরো বেশি করে ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে বিসর্জন দিতে শুরু করল। ... ...
“প্রায় সব দেশের দেবতারাই দাবি করেন যে তাঁরা জগৎ সৃষ্টি করেছেন। অলিম্পিয়ানদের কিন্তু তেমন কোনো দাবি নেই। তারা যদি কিছু করে থাকে, তবে তারা সেই জগৎ জয় করেছে... এইসব দেশ জয়ের পরে তারা করলো কী? সরকার গঠন করলো? কৃষির প্রসার করলো? শিল্প-বাণিজ্য – এসবের বিস্তার করলো? মোটেই না। গায়ে গতরে তারা কেন খাটতে যাবে? খাজনার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা আর বেয়াদব প্রজার মাথায় আক্ষরিক বজ্রাঘাত করা বরং অনেক সহজ। এরা সব যুদ্ধজয়ী সর্দার, রাজানুগ্রহে পুষ্ট দস্যু। এরা লড়াই করে, ভোজ দেয়, এরা ক্রীড়ামোদী, সঙ্গীতপ্রেমী; এরা আকণ্ঠ পান করে, ফরমায়েশি ভৃত্যকে নিয়ে তামাশা করে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে। নিজেদের রাজা ছাড়া তারা আর কাউকে ভয় পায় না। এরা প্রেম আর যুদ্ধ ছাড়া কখনো মিথ্যাচার করে না।” ... ...
জগত কি সত্যিই দুটি ভাগে বিভক্ত – মনোজগৎ আর পার্থিব / বস্তু জগৎ? এ যদি সত্যি হয়, তবে ‘মন’-ই বা কী আর পদার্থ-ই বা কী? মনোজগৎ কি পার্থিব জগতের ওপর নির্ভরশীল, নাকি তার কোনো স্বতন্ত্র ক্ষমতা আছে? এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কি আদৌ কোনো মোক্ষ / মহত্তর উদ্দেশ্য আছে? কোনো বিশেষ লক্ষ্যের দিকে কি এগিয়ে চলেছি আমরা, আমাদের মহাবিশ্ব? ভৌতবিজ্ঞানের সূত্রগুলির কি সত্যিই অস্তিত্ব আছে, নাকি আমাদের অন্তরে গ্রন্থিত শৃঙ্খলার কারণেই আমরা সেই সূত্রগুলি খুঁজে পাই? একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর চোখে মানুষ যেমন—একটি ক্ষুদ্রকায়, নগণ্য গ্রহের ওপর অসহায়ভাবে চরে বেড়ানো, ভেজাল-মেশানো কার্বন আর জলের মিশ্রণ—মানুষ কি সত্যিই তাই? নাকি হ্যামলেট তাকে যেভাবে দেখেছিল, তা-ই মানুষের আসল রূপ? নাকি একাধারে দুই-ই? এ কি সত্য, যে, জীবনধারণের কিছু পথ মহৎ, আর কিছু ইতর? নাকি, সবই রাস্তাই আদতে অর্থহীন? কোনো জীবনযাপন যদি সত্যিই মহত্তর হয়, তবে সে রাস্তার ধরন কেমন, আর আমরা কীভাবে সেই রাস্তায় চলতে পারি? যা ভালো—তা কি অনন্তকালই ভালো, নাকি গুটি গুটি পায়ে অবশ্যম্ভাবী প্রলয়ের দিকে চলতে থাকা এই ব্রহ্মাণ্ডেও ‘ভালো’-কে বেছে নেওয়ার অর্থ আছে? প্রজ্ঞা বলে কোনো বস্তু কি আদতে আছে, নাকি তা মূর্খামিরই পালিশ করা চকচকে রূপ? ... ...