এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নানা রঙের দিনগুলি — ৯

    মানব মীরা দে লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ জুলাই ২০২৪ | ৩৬৫ বার পঠিত
  •  
    "সেদিন তুমি যে বঞ্চনার কথা বলেছিলে সেটা কি তোমার একার মস্তিষ্কপ্রসূত নাকি সবাই মিলে ভেবেছিস্?", ছোট ডায়েরিতে ঝর্ণা কলম দিয়ে কিছু একটা লিখতে লিখতে দুর্গাবাবু শ্রীকান্তর দিকে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করলেন।
     
    তার সর্বাঙ্গ না কাঁপলেও সে তার কম্পিত পা দুটিতে অনুভব করতে পারছিল এবং হাঁটুতে দুটির পারস্পরিক ঘর্ষণজনিত কারণে উৎপন্ন ঘষ্ ঘষ্ শব্দটিও তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছিল। ক্ষণিকের ভীতির আবেশ কাটিয়ে সে বলে ওঠে, " সবাইয়ের।"
     
    দুর্গাবাবুর প্রশ্ন, "সেদিন, কথাগুলো বলার জন্য কেউ কি তোমায় উৎসাহ জুগিয়েছিল বা কেউ কি কোন রকম জোর করেছিল? নাকি ওটা তুমি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই নিজে থেকে বলেছিলে?"
     
    শ্রীকান্তর শ্লথগতিতে প্রত্যুত্তর দেয়, "না—নিজে থেকেই বলেছিলাম—"
     
    দুর্গাবাবুর প্রশ্ন, "বকা খাওয়ার ভয় করেনি?"
     
    শ্রীকান্তর আড়ষ্ট উত্তর, "হ্যাঁ করেছিল।"
     
    দুর্গাবাবু ড্রয়ার থেকে একটা পেনসিল বের করে পেনসিল কাটার দিয়ে পেনসিল ছুলতে ছুলতে  বলেন, "তবু বললে!—আচ্ছা ভয় পাওয়ার পরও বললে কেন? মানে ভয় পেয়েও কি ভেবে বলে দিলে?"
     
    শ্রীকান্ত আমতা আমতা করে বলে, "ভেবেছিলাম যা হবার হবে। আর যাই হোক মিথ্যে বলছি না তো—সবাই এটা জানে, বোঝে কিন্তু বলার সাহস করে না।"
     
    দুর্গাবাবু বলেন, "শাস্তির ভয় হল না?"
     
    শ্রীকান্ত বলে, ,"হয়েছিল।"
     
    দুর্গাবাবুর পেনসিল ছুলা শেষ হয়ে গেছিল,কাটারটা আবার ড্রয়ার রেখে শ্রীকান্তকে বললেন, হাতটা এদিকে বাড়াও।"
     
    সে সময়ের স্যারেদের এক বহুল প্রচলিত শাস্তি ছিল একটা পেনসিল দুই আঙুলের মাঝে ঢুকিয়ে আঙুল দুটোকে চেপে দেওয়া। আর স্যারেরা শাস্তিটা দিতেন বাঁ হাতে, ডান হাত দিয়ে ছাত্ররা লেখে; তাই ডান হাতে শাস্তি দিলে ছাত্রদের লেখার ওপর পড়াশুনার ওপর প্রভাব করতে পারে, ল্যাটাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক বিপরীতে ছিল। ফলতঃ শ্রীকান্ত আসন্ন শাস্তির পদ্ধতির কথা বিবেচনা করে বাঁ হাতটি এগিয়ে দেয়। কিন্তু  দুর্গাবাবু ধমক দিয়ে বললেন,  "বাঁ হাত নয় ডান হাত দাও।"
     
    শ্রীকান্ত কম্পিত ডান হাত পেতে দেয়, মনে মনে ভাবে নিশ্চয়ই বেত্রাঘাত হবে ডান হাতের তালুতে! কিন্তু শ্রীকান্তকে হতভম্ভ করে দিয়ে দুর্গাবাবু পেনসিলটা তার হাতের তালুতে রেখে বললেন, "সত্যি কথাটা স্পষ্ট ভাবে বলার জন্য এটা তোমার পুরস্কার। এবার ক্লাসে যাও।"
     
    এক মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে শ্রীকান্ত স্যারের অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। সত্যি আজ যেখানে মানুষের চাওয়া-পাওয়া বাস্তবতার সীমাকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে সেখানে সেই সময় মানুষের চাওয়া-পাওয়ার থেকেও মানবিক মূল্যবোধ অনেক বেশি ছিল! 
     
    এরপর কিছুদিনের জন্য শ্রীকান্ত ক্লাসের হিরো হয়ে গেল! সূর্ষের ভাষায়, "সিংহের গুহ্য থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা!"
     
    অনির্বান সূর্যের কথার সংশোধন করে বলে, "ভাই, বোধহয় ওটা গুহ্য নয় গুহা হবে।"
     
    সূর্য মুখ বেঁকিয়ে জবাব দেয়, "ওরে আমার বাংলার পন্ডিত এল রে!—আমি জেনে বুঝেই গুহ্য বলেছি—আর এটাও জানি গুহ্য মানে কি।"
     
    আশেপাশের সবাই হো হো করে হেসে ওঠে! অনির্বান মুখ বেঁকিয়ে বলে ওঠে, "বাল-বিচি-বটব্যাল।"
     
    শুরু হয়ে যায় সরস্বতী পুজোর তোড়জোড়! কাঞ্চন-স্যার আর অমল-স্যার ক্লাস নাইন ও ইলেভেনের বাছাই করা ছাত্রদের নিয়ে একটা দুটো টিম বানান। ইলেভেনের নেতৃত্বে রইলেন অমল-স্যার আর ক্লাস নাইন রইলেন কাঞ্চন-স্যারের অধীনে। এখানে দেখার বিষয় দুই ক্লাস থেকেই কোন ফাস্ট বেঞ্চার বা ব্যাক বেঞ্চাররা সরাসরি টিমে যুক্ত থাকতে চাইনি। কারণ ফাস্ট বেঞ্চাররা ভেবেছিল পুজোর সাথে  অতিরিক্তযুক্ত থাকলে পড়াশুনার ক্ষতি হতে পারে। আর ব্যাক বেঞ্চাররা ভেবেছিল পুজোর সাথে যুক্ত হওয়া মানে বাড়তি দায়িত্ব পালন করা। এখানে একটা মজার ব্যাপার হল শ্রীকান্তর স্কুলের স্যাররা এই ব্যাক বেঞ্চার আর ফাস্ট বেঞ্চার তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। তাঁরা বলতেন, "এই পৃথিবীতে ব্যাক বেঞ্চার বা ফাস্ট বেঞ্চার বা মিডিল বেঞ্চার বলে কিছু হয় না—কারণ আসলে এই পৃথিবীতে কোন বেঞ্চই নেই।"
     
    যাই হোক, যেমন যুগ যুগ ধরে মধ্যবিত্ত সমাজ সর্বক্ষেত্রে সামাজিক মিউটেশানের অনুঘটকের কাজ করেছে ঠিক তেমনি ক্লাসের মধ্যমমানের (?) ছাত্ররা সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।
     
    কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়—কোন এক অজানা কারণে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র নিজেদের ধীরে ধীরে এই কর্মযজ্ঞ থেকে সরিয়ে নিল। অনেকে বলে তাদের থেকে পুজোর সম্পূর্ণ একক দায়িত্ব সরিয়ে নিয়ে ক্লাস নাইনের সাথে যুগ্ম ভাবে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত তারা মেনে নিতে পারেনি। আবার অনেকে বলে ক্লাস ইলেভেন ছাত্রজীবনের প্রথম স্বাধীনতা আস্বাদনের মুহূর্ত, নতুন করে জীবনকে বোঝার মুহূর্ত —তাই সেই মুহূর্তকে উপভোগ করতে ইলেভেনের ছাত্রদের মধ্যে কেউই তেমন ভাবে নতুন করে সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব গ্রহন করতে চাই নি। ফলতঃসেবারের সরস্বতী পুজোর কর্ণধার হয়ে ওঠে ক্লাস নাইন-ই—মূলতঃ সূর্য, অতনু, অশেষ, অনির্বান, শ্রীকান্ত এরাই।
     
    সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ঠাকুরেরচারপাশ থার্মোকলের শিকল দিয়ে সাজানো হবে। সেযুগে তখন থার্মোকল মন্ডপসজ্জায় এক যুগান্তকারী ছাপ ফেলতে শুরু করেছে।—তার আগে বাণিজ্যিক ভাবে থার্মোকল এত পরিমানে পাওয়াও যেত না।
     
    ও আরেক ব্যাপার বলতে ভুলেই গেছিলাম সেযুগে সরস্বতী পুজো আয়োজনের প্রতি ছাত্রদের উৎসাহের আরেকটি কারণ ছিল, কার্ড নিয়ে বিভিন্ন স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে যাওয়া। বিশেষতঃ বালিকা বিদ্যালয়ে বা গার্লস স্কুলে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন