এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নানা রঙের দিনগুলি — ৮

    মানব মীরা দে লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ জুলাই ২০২৪ | ৩১৫ বার পঠিত
  •  
    রোজের মত প্রেয়ার শেষ হল। প্রেয়ার শেষ হবার পর দুর্গাবাবু ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, "ক্লাস নাইন আর ইলেভেন বাদে বাকি ক্লাস শান্তভাবে যে যার নিজেদের ক্লাসে যাবে। আর তোমাদের স্যারেরা একটু পরে ক্লাসে যাচ্ছেন—কেউ কিন্তু ক্লাসে গিয়ে দুষ্টুমি করবে না।"
     
    ক্লাস নাইন আর ইলেভেনের ছাত্ররা বাদে অন্য সবাই চুপচাপ যে যার ক্লাসে চলে যায়। দুর্গাবাবু শান্ত গভীরস্বরে বলেন, "সেদিনের ঘটনার আঘাতে কম-বেশি আমরা সকলেই মানসিকভবে আহত হয়েছি। শুধুমাত্র সেদিন প্রেয়ারের ঘটনার জন্য নয়—পরবর্তীতে যখন তোমরা সব ক্লাসের কাছে গিয়ে নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলে সম্ভবত তখন আমরা আরো বেশি করে আঘাতপ্রাপ্ত হই। তোমাদের একটা বিষয়ে জানা উচিত, সম্ভবত আমার সঙ্গে অন্য স্যারেরাও একমত হবেন। আমরা শিক্ষকরা হয়তো সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত হই তোমাদের ব্যর্থতায় আর সবচেয়ে খুশি হই তোমাদের সফলতায়।"
     
    স্যার থামলেন।  তারপর ছাত্রদের দিকে মর্মভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তার সেই দৃষ্টি যেন এক্স-রে মেশিনের ভেদশক্তির থেকেও অনেকবেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। এক মুহূর্তের নীরাবতা সৃষ্টি হল সমগ্র মাঠ জুড়ে। তারপর দুর্গাবাবু এক শব্দহীন দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার পর আবার বলতে শুরু করলেন, "এরপর আমরা সব স্যারেরা মিলে দফায় দফায় মিটিং করেছি বিষয়টা নিয়ে। তাতে নেগেটিভ-পজিটিভ অনেক দিক উঠে এসেছে। সেই মিটিং থেকে আমরা সকলে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি—কোন বিদ্যালয়ের কোন সিদ্ধান্ত কারুর একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয় তেমনই নেওয়া উচিতও নয়। আর এই বিদ্যালয় ছাত্রদের, সুতরাং কোন ছাত্রকেই আমরা এই বিদ্যালয়ে আয়োজিত কর্মকান্ড থেকে বিরত করতে পারি না। তাই সর্বসন্মতিক্রমে আমরা যে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছি সেটা হল এবারের তবে শুধুমাত্র এবার সরস্বতী পুজোর আয়োজনের নেতৃত্ব দেবে ক্লাস ইলেভেন ও নাইন যৌথ ভাবে।"

    হেড স্যার থামলেন।। হয়তো সিনেমার চিত্রনাট্য হলে ক্লাস নাইনের সব ছাত্ররা চরম উত্তেজনা চিৎকার করে উঠত, একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে, আরেকটু রঙচড়ানো চিত্রনাট্য হলে সবাই মিলে হেড স্যার ও স্যারেদের নামে জয়ধ্বনি দিত—বা ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভেঙচি কাটত। সাউথ ইন্ডিয়ান চিত্রনাট্যের নকলে হলে সুপার স্টার রজনীকান্তের মত ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে চোখ মেরে কেউ একজন ডায়লোগ ছুঁড়ে দিত, "কিউ হিলাডালা না!"

    কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি, কারণ শ্রীকান্তদের স্কুলের ওয়ান এন্ড অনলি সুপার স্টার দুর্গাবাবু তখনও মঞ্চে বিদ্যমান! তাই পুলকিত হলেও সবাই ভাববিহীন অভিব্যক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল! দুর্গাবাবু আবার বলতে শুরু করলেন, "এবার কেউ কোন রকম লাফালাফি, চিৎকার চেঁচামেচি না করে যে যার নিজের ক্লাসে চলে যাও। বাকি কাজের কথা তোমাদের সাথে সরস্বতী পুজোর ভারপ্রাপ্ত স্যারেরা আলোচনা করে নেবেন।"
     
    দুর্গাবাবু চলে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে শ্রীকান্তর উদ্দেশ্যে বললেন, "শ্রীকান্ত, তুমি একটু আমার সাথে দেখা করো।"

    স্যারের কথা শুনে শ্রীকান্ত জড়ভরতের ন্যায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে! তাকে পাশ কাটিয়ে অন্য ছাত্ররা সব এক এক করে দ্রুত নিজ নিজ ক্লাসে চলে গেল—আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে পালিয়ে গেল! কারণ কখন আবার কার ওপর দুর্গাবাবুর কৃপাদৃষ্টি নিক্ষেপ হয়, তার কোন ঠিক নেই! সেদিন মুহূর্তের জন্যেও হলে শ্রীকান্ত প্রথমবার নিজেকে একা অনুভব করে!—পরবর্তীকালে জীবনের কালচক্র তাকে বুঝিয়েছে যে মানুষ জন্মায় একা আর মৃত্যুবরণ করেও একা—মাঝের জীবনট শুধু একাকী হয়েও একা না থাকার অভিনয় করে। শ্রীকান্তর আরো মনে পড়ল কোথায় কোন এক জায়গায় বাবা তাকে আর তার মাকে নিয়ে গেছিলেন, সেখানে কোন এক লরির পেছনে সে এক লেখা ছিল — 'সবই মায়া, বাকিটা অভিনয়। এ পৃথিবীতে কেউ কারুর নয়।।'—তাও বেশ মনে পড়ল শেষের 'নয়'-টা বুঝতে তার বেশ কষ্ট হয়েছিল; কারণ স্থানাভাবে 'নয়'-টা খুব ছোট্টো করে লেখা ছিল! 
     
    হেড স্যারের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল শ্রীকান্ত। স্যার ভেতরে কারুর সাথে কথা বলছিলেন। শ্রীকান্তদের স্কুলের টিচার্স রুম গ্রাউন্ড ফ্লোরেই মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই ডান হাতে। দোতলায় অফিসরুম ও সহকারী প্রধান শিক্ষক মহেশ্বর ভট্টাচার্যের অফিস পাশাপাশি —এই অফিস দুটির অবস্থান বেশ অদ্ভুতুরে, দোতলায় হলেও অফিস দুটি ঠিক দোতলায় নয়—দোতলা ও একতলার মধ্যে অবস্থিত। একটি ছোট সিড়ির মাধ্যমে দোতলা থেকে নেমে অফিস দুটিতে যাওয়া যেত। সিঁড়ি দিয়ে নেমে প্রথমেই পড়ত মহেশবাবুর ছোট অফিসরুম—তারপর একটি ছোট দরজার মাধ্যমে প্রবেশ করতে হত বড় অফিসরুমে। এই অফিসরুম দুটির তলায় ছিল কর্মশিক্ষার ঘর—যেখানে ছাত্ররা মাটির কাজ, কাঠের ব্লক তৈরির কাজ করত।—হেড স্যারের অফিসরুমটা ছিল এই দুটি রুমের ঠিক বিপরীতে প্রকৃতার্থে দোতলায়। রুমের প্রবেশের বড় মুল দরজা সাথে লাগানো ছিল সেলুন—জোর যেটার খোলা আর বন্ধ হওয়া শ্রীকান্ত দেখতে খুব ভালবাসে। কেউ কেউ দরকারে মাঝে মাঝে ঢুকছে আবার বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে যাঁরা স্যারের সাথে মিটিং করছিলেন তারা বেরিয়ে এ‌লেন। এবার শ্রীকান্ত সাহস করে দরজার আলতো করে আঘাত করে। ভেতর থেকে বাজখাই কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, "কে?"

    বাইরে থেকে শ্রীকান্তর ততোধিক শীর্ণ প্রত্যুত্তর, "আমি শ্রীকান্ত। আমায় দেখা করতে বলেছিলেন স্যার।"

    এক মুহূর্তের শূন্য তার পরই ভিতর থেকে সুগভীর আহ্বান ভেসে আসে, "ভিতরে এসো।"
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন