১৯৮৩ সালে কেনা হয়েছিল টিভিটা—ভারত উর্বশী; বিশাল বড় বাক্স টিভি, সাদা-কালো। একটা বড় দু'কিলোর বাটখারার মত চ্যানেল বদলানোর নব আর চারটে পঁচিশ গ্রামের মত নব—ওপরের দুটোর ডানপাশেরটা সাউন্ড বাড়ানোর জন্য আর বাঁপাশেরটা অফ-অন্ নব, নিচের দুটোর ডানদিকেরটা ব্রাইটনেস কন্ট্রোল নব, বাঁদিকের নবটার কাজ শ্রীকান্ত জানত না। আর সবার মাঝে ছিল চ্যানেল বদলানোর বড় নবটা—অবশ্য তখন চ্যানেল ... ...
বাড়ির পরিস্থিতি তখন খুব একটা সুবিধের ছিল না। একদিকে আর্থিক সমস্যা, অন্যদিকে ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্কের দূরত্ব। শ্রীকান্ত যখন ক্লাস সেভেনে পড়ত, তখন ঠাকুরদা গত হন। তার এক বছরের মধ্যে ঠাকুমা। তাদের মৃত্যু শ্রীকান্তর ওপর অতটা প্রভাব ফেলেনি, কারণ শ্রীকান্তর বাবা শ্রীকান্তকে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের অধিবাসী করে রেখেছিলেন। শ্রীকান্ত পাড়ার কারুর সাথে তেমন ভাবে মিশতে পারত না, খেলতে পারত না—শ্রীকান্তর মা-বাবা, বিশেষ করে বাবা, এই বুঝি ছেলে খেলতে গিয়ে চোট ... ...
অতি মৃদু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলল, "স্যার, আমরা এর আগে একা একা ব্যারাকপুর কোনদিনও যাই নি, যেতে যে পারব না তা নয়, সেক্ষেত্রে যেতে পারলেও আমাদের রাস্তা চিনে বিভিন্ন স্কুলে যেতে অনেকটা সময় লেগে যাবে।" "সে তো সবারই লাগতে পারে!—তাই জন্য কি ব্যারাকপুরের স্কুলগুলোকে আর ইনভাইট করাই হবে না?", কাঞ্চন-স্যারের সোজা প্রশ্ন। শ্রীকান্ত বলে, "না স্যার, সবার এ প্রবলেম হলেও একজনের হবে না, তাই তার টিম গেলে ব্যাপারটা আরো ইজি হবে।" কাঞ্চন-স্যার বললেন, "তা কে সেই মহানুভব শুনি?"" শ্রীকান্ত টিম-এ-এর সুভাষকে দেখিয়ে বলল, "সুভাষ স্যার, ও তো গতবছর পর্যন্ত ব্যারাকপুরের স্কুলেই পড়ত। এ বছর আমাদের এখানে ভর্তি হয়েছে। তাই ও অন্ততঃ ব্যারাকপুরের অনেক ... ...
তিনদিন করে টিফিনের পর পুজোর আয়োজন চলত। মূলতঃ ডেকরেসানের দিকেই নজর দেওয়া হত। প্লান ছিল ঠিক পুজোর চারদিন আগে থেকে প্রতিমা সজ্জার কাজে হাত দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী কাজ দ্রূতই হচ্ছিল। অমল-স্যারের আঁকা ছবিকে কেন্দ্র করে নিমন্ত্রণের কার্ড ছাপানো হল। যথারীতি পাঁচটি টিমে সবাইকে ভাগ করা হল, প্রতি টিমে তিনজন করে। শ্রীকান্ত, অনির্বান আর সূর্য এক টিমে পড়ল। আর অনির্বানের পূর্ব নির্ধারিত অনুরোধ রাখত শ্রীকান্ত আর সূর্য নৈহাটি-কাঁকিনাড়ার স্কুলের নিমন্ত্রণের ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাঞ্চন-স্যার আর অমল-স্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লটারীর মাধ্যমে পাঁচ টিমের অঞ্চল নির্ধারণ করবেন। মোট নয়টি স্টেশন আর টিম পাঁচটি—ব্যারাকপুর সদর শহর হওয়াতে স্কুলের সংখ্যা বেশি, তাই ... ...
খেঁকারি দিয়ে ভাস্বর শুরু করে, "কাল সন্ধেবেলা সবে পড়ে বাড়ি ফিরেছি। হঠাৎ বাড়ির ফোনটা বেজে উঠল। তোরা তো জানিস আমার বাড়িতে ফোন শুধু বাপী আর মা-ই ধরতে পারে। আমি বা দিদি তখনই ধরি যখন কেউ বাড়িতে থাকে না।" অতনু অধৈর্য্য হয়ে বলে, "সে জানি আমরা, আমাদের বাড়িতেও তাই—তুই আসল পয়েন্টে আয়!" অনির্বান সুর টেনে বলে ওঠে, "হুমমমম—বোনুর আমার শোনার জন্য আর তার সইছে না!" অতনু অনির্বানের থাইতে একটা রামচিমটি দিয়ে বলে, "মরণ আমার!" অনির্বান রামচিমটি হজম করতে পারে না তারস্বরে চিল্লে ওঠে! চিৎকার করে বলে, "বাবাগো! — মাগো! জ্বরে গেলো! শালা একটা ডাইনী হাতে বড় বড় নখ!" সূর্য বিরক্ত হয়ে বলে, "তোরা একটু থামবি—ভাস্বর ... ...
পরিস্কার বক্তব্য ছিল, "যে যে কোন স্কুলে যেতে পারে—কিন্তু শিবনাথে আমি অবশ্যই যাব, আর টিমে আমার সঙ্গে কোন দু'জন যাবি দেখে নেই।" স্যারেরা নিয়ম করে দিয়েছিলেন ব্যারাকপুর থেকে কাঁচরাপাড়া পর্যন্ত সব স্কুলকে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করতে হবে কিন্তু টিম ভাগ করে নিতে হবে তিন দিনের মধ্যে সব স্কুল কভার করতে হবে। সক্রিয় ভাবে পনেরজন ছাত্র পুজোয় সরাসরি যুক্ত ছিল। প্রথমে সংখ্যাটা ছিল নয়;পড়ে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্ররা স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালে আরো ছয়জনকে যুক্ত করা হয়। তাই তিনজন করে পাঁচটা দলে ভাগ করা হয়েছে। ব্যারাকপুর থেকে কাঁচরাপাড়া মোট নয়টি রেল স্টেশন—মোট স্কুল সংখ্যা প্রায় পঁয়তাল্লিশ—পাঁচটা টিম তিনদিনে সেটা করার করবে। তখনই অনির্বান ... ...
তুমি যে বঞ্চনার কথা বলেছিলে সেটা কি তোমার একার মস্তিষ্কপ্রসূত নাকি সবাই মিলে ভেবেছিস্?", ছোট ডায়েরিতে ঝর্ণা কলম দিয়ে কিছু একটা লিখতে লিখতে দুর্গাবাবু শ্রীকান্তর দিকে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করলেন। তার সর্বাঙ্গ না কাঁপলেও সে তার কম্পিত পা দুটিতে অনুভব করতে পারছিল এবং হাঁটুতে দুটির পারস্পরিক ঘর্ষণজনিত কারণে উৎপন্ন ঘষ্ ঘষ্ শব্দটিও তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছিল। ক্ষণিকের ভীতির আবেশ কাটিয়ে সে বলে ওঠে, " সবাইয়ের।" দুর্গাবাবুর প্রশ্ন, "সেদিন, কথাগুলো বলার জন্য কেউ কি তোমায় উৎসাহ জুগিয়েছিল বা কেউ কি কোন রকম জোর করেছিল? নাকি ওটা তুমি স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই নিজে থেকে বলেছিলে?" শ্রীকান্তর শ্লথগতিতে প্রত্যুত্তর দেয়, "না—নিজে থেকেই বলেছিলাম—" দুর্গাবাবুর প্রশ্ন, "বকা খাওয়ার ভয় করেনি?" শ্রীকান্তর ... ...
মত প্রেয়ার শেষ হল। প্রেয়ার শেষ হবার পর দুর্গাবাবু ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন, "ক্লাস নাইন আর ইলেভেন বাদে বাকি ক্লাস শান্তভাবে যে যার নিজেদের ক্লাসে যাবে। আর তোমাদের স্যারেরা একটু পরে ক্লাসে যাচ্ছেন—কেউ কিন্তু ক্লাসে গিয়ে দুষ্টুমি করবে না।" ক্লাস নাইন আর ইলেভেনের ছাত্ররা বাদে অন্য সবাই চুপচাপ যে যার ক্লাসে চলে যায়। দুর্গাবাবু শান্ত গভীরস্বরে বলেন, "সেদিনের ঘটনার আঘাতে কম-বেশি আমরা সকলেই মানসিকভবে আহত হয়েছি। শুধুমাত্র সেদিন প্রেয়ারের ঘটনার জন্য নয়—পরবর্তীতে যখন তোমরা সব ক্লাসের কাছে গিয়ে নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলে সম্ভবত তখন আমরা আরো বেশি করে আঘাতপ্রাপ্ত হই। তোমাদের একটা বিষয়ে জানা উচিত, সম্ভবত আমার সঙ্গে অন্য স্যারেরাও ... ...
ফিরে শ্রীকান্তর কিছুই ভাল লাগছিল না। এসে হাত-মুখ ধুয়ে খেঁজুরের গুড় দিয়ে দুটো রুটি খেয়ে পড়তে বসে গেল। পড়াতেও মন বসছিল না। তবু পড়তে হল কারণ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সেকেন্ড টার্মের তিনটে পরীক্ষা আছে। সন্ধেবেলা শ্রীকান্তর প্রিয় খাবার মায়ের হাতে তৈরী তেলেভাজা চিঁড়ে ও বাদাম ভাজাও স্বাদহারা মনে হল! নন্টে-ফন্টে-এর বই দেখতে দেখতে খেল সে কিন্তু সেই আমেজটা ঠিক পেল না। এই এক সমস্যা শ্রীকান্তর—ঝগড়া হলে, মারপিট হলে বা কথাকাটাকাটি হলে ওর মনটা বড় নির্জীব হয়ে ওঠে। এ রকম কোন ঘটনার পরবর্তী তিন-চারদিন খাওয়া-দাওয়া, পড়াশুনা , খেলাধূলা সব কিছুর থেকে উদাসীন হয়ে যায়। এই সময় শুধু সুযোগ পেলেই সে ... ...
আমাদের একবার বলতে পারতিস, ডাইরেক্ট চিঠি না করে।", ক্লাস ইলেভেনের সায়েন্সের ফাস্ট বয় গোবিন্দ কথাগুলো বলল স্বর্ণেন্দুর উদ্দেশ্যে। ক্লাস ইলেভেন সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে স্বর্ণেন্দু, সৌমিত্র, শুভাশিষরা গেছিল। সৌমিত্র বলে, " দাদা, তুমিই বলো আমাদের জায়গায় তোমরা থাকলে কি করতে?" গোবিন্দর পাশে বসে থাকা অনামিক বলে, "আমরা হলে কি করতাম সেটা বড় কথা নয়। তোরা তো একবার আমাদের সাথে কথা বলতে পারতিস্। আমরা কি তোদের শত্রু?" তাপস পেছন থেকে বলে, "সব কিছু এত ধপাধপ হয়ে গেল!" অনামিক বলে, "তাই বলে প্রেয়ারে গান না করে স্যারেদের অপমান করবি,!" স্বর্ণেন্দু বলে, "সেই জন্যেই তো ক্ষমা চাইতে এসেছি।" সেকেন্ড বেঞ্চ থেকে সুমন বলে, "কি ভেবেছিস্ এই ক্ষমা চাইলেই সব মিটে ... ...