এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শান্তনীড় রহস্য - ১

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ এপ্রিল ২০২২ | ১০৫১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতোকোত্তর ডিগ্রী আছে সোলাঙ্কির। আধুনিক ইতিহাসে এম এ।

    চাকরি বাকরি করার ঝোঁক কোনদিনই ছিল না তার। চেষ্টাও বিশেষ করে নি। সোলাঙ্কিকে ঠিক ঘরকুনো বলা যায় না। বরং ঘর সংসারে জড়িয়ে থাকতে ভালবাসে সে।  অবশ্য সে মোটেই ঘরে বসে থাকার মেয়ে নয়। গান গাওয়া, ছবির আঁকা , গ্রুপ থিয়েটার করা এইসব নানা কাজে বা অকাজে রাত্রে ঘুমোবার সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়ে সদাব্যস্ত থাকে সে।

    এই সোলাঙ্কির বিয়ে হয়ে গেল একদিন। না, প্রেম করে বিয়ে নয়। বাবা মার দেখেশুনে দেওয়া বিয়ে। ফাল্গুনী হাওয়ার মতো মেয়ে  সোলাঙ্কি অনেক ছেলেরই মনে বসন্তী বাতাস বইয়েছে কিন্তু কেউই তাকে বাঁধতে পারেনি। 

    এসব বারো তেরো বছর আগের কথা। তার হতাশপ্রেমিকরা একসময়ে নানা কাজের আবর্তে পাক খেতে খেতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

    একমাত্র সৌজন্য নামে একজন ছিল যে তাকে সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিল নন্দন চত্বরে দাঁড়িয়ে। সেটা ছিল এক শীতের সন্ধ্যা। তাদের গ্রুপের একটা শো ছিল। নাটকটায় সৌজন্যের একটা বড় চরিত্র ছিল। সোলাঙ্কিরও একটা ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল। সৌজন্য নিঃসন্দেহে খুব প্রতিভাবান এবং প্রতিশ্রুতিময় অভিনেতা।  অনেকেরই ধারণা ছিল যে সৌজন্য খুব তাড়াতাড়ি টি ভি সিরিয়াল প্রযোজক এবং টালিগঞ্জপাড়া থেকে ডাক পাবে এবং  বিরাট ভবিষ্যৎ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
    সৌজন্য সোলাঙ্কির থেকে প্রায় পাঁচ বছরের বড়। 
    সেই ঝিম ধরা শীতের সন্ধেতে নন্দনের একপাশে ফাঁকা জায়গায় একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ঘেমে নেয়ে তোতলাতে তোতলাতে সৌজন্য মিত্রের দেওয়া জুড়ি বাঁধার প্রস্তাব  সোলাঙ্কি পত্রপাট নাকচ করে দেয়। সৌজন্যর মতো ওরকম ম্যাচো ধরণের ডাকাবুকো একটা ছেলে যে যেভাবে ঝড়ে জলে বিদ্ধস্ত একটা অসহায় কোমল পাখির মতো আচরণ করছিল তাই দেখে সোলাঙ্কি ভীষণ অবাক হয়ে গেল।
    ------ ' না না সৌজন্যদা ..... এসব কি বলছ ! আমার একদম ভাল লাগে না এগুলো ..... প্লিজ ..... '
    ------- ' তুই একবার ভেবে দেখিস ..... এক্ষুণি জানাতে হবে না ..... পরে জানালেও চলবে ...'
    ------ ' না না সৌজন্যদা .... পরে জানানোর কিছু নেই ..... আমি তো এখনই জানিয়ে দিলাম ..... আমাকে এসব বোল না  প্লি....জ ... আমার ভাল লাগে না ..... আসছি ..... '
    সোলাঙ্কি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে যায় ওই নির্জন শিরিষ গাছটার তলায় সৌজন্যকে ফেলে রেখে। 
    তার পরদিন থেকে সৌজন্য মিত্র 'গম্ভীরা' থিয়েটার গ্রুপে আসা বন্ধ করে দিল। তার হাতে কাজের অভাব নেই। টালিগঞ্জের একটা বড় প্রোডাকশান হাউস থেকে ডাক পেয়েছে সে।
    আর সোলাঙ্কি যথারীতি আবার নানা শিল্পের পুষ্পরেণু মেখে শশব্যস্ত ওড়াউড়ি করতে লাগল। 

    *************          **********      *********

    সোদপুরের শান্তনীড় আবাসন।
    সোলাঙ্কির স্বামী প্রনবেশ সাদাসিধে লোক। বৈষয়িক বা মানসিক কোন জগতেই জটিলতার ভার বহন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।  সামান্য  জটিল কোন সমস্যার মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা দেখা দিলেই তার হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে। যেমন ধরা যাক বাজার করে এসে দেখল  মাছওয়ালা পচা মাছ গছিয়ে দিয়েছে। এবার একনাগাড়ে স্ত্রীর ভর্ৎসনার চাপ সইতে না পেরে সে মাছের টুকরোগুলো ব্যাগে ভরে বাজারের দিকে চলল মাছওয়ালার সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে নিজের ন্যায্য যুক্তি প্রতিষ্ঠা করে পচা মাছগুলো ফিরিয়ে দিতে। এখন, যতক্ষণ না মাছওয়ালার মুখোমুখি হচ্ছে ততক্ষণ আপনমনে নানারকম কাল্পনিক তর্কবিতর্কের সংলাপ সাজাতে সাজাতে ভীষণ উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তায় ধড়ফড় করতে থাকে। এইরকম আর কি।

    কিংবা ধরা যাক, ব্যাঙ্ক থেকে একটা চিঠি এল কেওয়াইসি বা অন্য কোন রেকর্ড আপডেট করার ব্যাপারে। ব্যাস শুরু হয়ে গেল তার বুকের ভিতর ধুকপুকুনি। কি জানি কি কারণে
    ডেকেছে কে জানে। তেমন পেঁচাল কোন পদ্ধতির সামনে পড়লে কিভাবে সামলাবে ভেবে  আকুল হতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে গুম হয়ে বসে থাকার পর স্ত্রীর শরণাপন্ন  হবে কিনা ভাবতে থাকে। সোলাঙ্কি স্বামীকে হাড়ে হাড়ে চেনে। শেষপর্যন্ত সেই প্রণবেশের সাথী হয়   ব্যাঙ্কে যাবার জন্য।  আবার কখনও হয়ত  কর্পোরেশন অফিসে যাবার দরকার হল  ছোটখাটো কোন কাজে। ফের সেই পেটের ভিতর প্রজাপতির ডানা কাঁপতে শুরু করল। শেষে দেখা গেল ব্যাপারটা একদম সামান্য এবং এবং অতি সহজেই মিটে গেল।  কিন্তু ব্যাপারগুলো ততক্ষণ না মিটছে প্রণবেশ অকারণ উদ্বেগে হয়রাণ হতে থাকে হামেশাই।

    এইভাবেই দিন কাটতে থাকে চিত্রলেখা, প্রণবেশ এবং তাদের আট বছরের ছেলে তানভীর  জীবন। সোলাঙ্কি ইদানীং কোন মনোরোগ  বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হবার কথা ভাবছে স্বামীর স্নায়ু দৌর্বল্যের ব্যাপারে পরামর্শ নেবার উদ্দেশ্যে।   

    কিছুদিন আগে প্রণবেশ  পাড়ার ওষুধের দোকানে গিয়েছিল একটা ওষুধ কিনতে।দোকানে প্রচুর ভিড়।  কোথাও বেশি ভিড় দেখলে প্রণবেশ কেমন ভ্যাবলা মেরে  যায়।

    প্রেসক্রিপশানটা হাতে ধরে দিশাহারা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কখন ভিড়টা একটু পাতলা হবে এবং সে কাউন্টার সংলগ্ন হয়ে তার প্রেসক্রিপশানটা পেশ করার সুযোগ পাবে। আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রনবেশ রণে ভঙ্গ দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এই সময়ে ভুসস্ করে একটা সাইকেল এসে থামল দোকানের একপাশে। সাইকেল থেকে নামল শ্রীদুর্গা লন্ড্রীর মালিক কাল্টু ( ভাল নামটা ঠিক জানা নেই প্রনবেশের )। প্রনবেশকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ' দাদা ..... এখানে দাঁড়িয়ে ? ওষুধ কিনতে এসেছেন বুঝি ? '
    প্রনবেশ বেশ কুন্ঠিত ভঙ্গীতে বলল,  ' হ্যা ..... ওই ..... মানে দুটো ইমারজেন্সি ওষুধের দরকার ছিল ...... কিন্তু এত লোক .... খুব দরকার ছিল..... '
    ----- ' ও আচ্ছা ...... ইমারজেন্সি ওষুধ .....তো এখান থেকে চেঁচিয়ে বলুন না .....দেবে না মানে ...... অই সাধন ..... অ...ই  সা..ধন ...শোন শোন ' 
    তারপর কি মনে হল কাল্টুর, খুব সম্ভবত প্রনবেশের আনাড়িপনা অনুভব করে বলে উঠল, ' আচ্ছা ..... ঠিক আছে .... ছেড়ে দিন .... দিন আমাকে দিন ....  টাকাটা .... ঠিক আছে.....পরে দিলেও চলবে .... '
    প্রনবেশ বলে উঠল , ' না না .... সে কি কথা ! এই নাও .... ' বলে কাল্টুর হাতে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিল।
    কাল্টু প্রনবেশের হাতের প্রেসক্রিপশানটা ঝট করে নিয়ে মাছ যেভাবে ডাঙা থেকে জলে ছিটকে পড়ে , সেভাবে জমে থাকা ভিড়ে ঝাঁপ মারল এবং দ্রুতবেগে সাঁতার কেটে কাউন্টারের উপকূলে পৌঁছে সাধন নামক দোকানকর্মীটির মুখোমুখি হল। 
    কার্যোদ্ধার করতে মিনিট সাতেকের বেশি সময় লাগল না কাল্টুর।
    প্রনবেশের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। সে পরম কৃতজ্ঞতায় কাল্টুর নিজের দুহাতের মধ্যে কাল্টুর একটা হাত নিয়ে বলল , ' বড় উপকার করলে ভাই ..... '
    কাল্টুর পক্ষে এসব অতি সহজ সরল কাজ। সে খুব লজ্জা পেয়ে বলল ' না না .... এতে কি আছে ..... কি এমন করলাম ...... আপনাদের ফ্যামিলিটাকে আমার খুব ভাল লাগে ..... কিছু দরকার থাকলে বলবেন .....'
    ------ ' হ্যা .... নিশ্চই নিশ্চই .... অনেক ধন্যবাদ ....'
    এই ধরণের ঘটনা প্রনবেশ মুখার্জীর জীবনে প্রায়শই ঘটে থাকে। 
       হোলির দিন রঙ মেখে ভূত হয়ে বেলা দুটোর সময় বাড়ি ফিরল প্রনবেশ। সোলাঙ্কি বলল,
    '  ও: .... কি যে করনা ..... এই ভর দুপুরে ভাল লাগে এসব। তান একটা ছোট ছেলে ...… সে কখন চলে এসেছে। আর তোমার আর রঙ খেলা শেষ হয় না ..... যাও যাও ... একেবারে বাথরুমে ঢুকে চান টান করে বেরোও .... '
    প্রণবেশ কথা না বাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মতো বাথরুমে ঢুকে গেল।   
    সোলাঙ্কি দরজা বন্ধ করতে গেল। তান মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সোলাঙ্কির চোখে পড়ল তাদের ঠিক উল্টোদিকের সুইটে ঢোকার জন্য  দরজার লক খুলছে একজন লম্বা মতো ভদ্রলোক। কি আশ্চর্য ! ঠিক সেই মুহূর্তেই ঝট করে পিছনে ফিরে তাকাল। যেন জানতই যে সোলাঙ্কি এই সময়ে দরজার মুখে আসবে। নির্বিকারভাবে হাসিমাখা মুখে তাকিয়ে রইল সোলাঙ্কির মুখের দিকে। সোলাঙ্কি তো  অবাক। দরজাটা বন্ধ করে দিল তাড়াতাড়ি। ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল।   

    দুদিন বাদে সোলাঙ্কির দিদি ঐন্দ্রিলা এল। ওরা থাকে কালীঘাটে। দক্ষিণভারতে বেড়াতে  গিয়েছিল। মাইসোর থেকে সোলাঙ্কির জন্য একটা চন্দনকাঠ নিয়ে এসেছে। দেড়শো গ্রামের মতো ওজন হবে। মোড়ক থেকে বার করতেই সুরভিতে ভরে গেল ঘরের বাতাস। প্রণবেশ বলল, ' আ: ... দারুণ গন্ধ তো ! কোন   চন্দনকাঠে আমি  কখনও এরকম গন্ধ পাইনি, তা সে যত দামীই হোক না কেন। '  সোলাঙ্কি বলে , ' সত্যি .... দা..রুণ ... '। ঐন্দ্রিলা বলল,  ' মাইসোর থেকে এনেছি ঠিকই , এটা কিন্তু আসলে পেরুর কোন এক ফরেস্টের  চন্দনকাঠ। মাইসোরে আমার এক এক্স ক্লাসমেট থাকে , সে দিয়েছে আমাকে। তার নিজের কাছেও একটা আছে। কলেজ লাইফে আমরা হরিহর আত্মা ছিলাম তো ....এটার বিশেষত্ব হচ্ছে কোন জায়গায় রাখার পর এটা সরিয়ে নিলেও অন্তত এক সপ্তাহ পর্যন্ত গন্ধ থেকে যায়। কোন  অর্ডিনারি চন্দনকাঠ নয়। '  এরপর  ঐন্দ্রিলা অন্য প্রসঙ্গে যায়  ---- ' চল .... পুজোর পরে কুলু মানালি যাই। আমার জায়েরা গিয়েছিল। বলল, দারুণ জায়গা .... '
    প্রণবেশ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল , ' যাব যাব ..…. অ্যরেঞ্জ কর তো ..... খুব যেতে ইচ্ছে করছে।'
    সোলাঙ্কিও তাল মেলালো , ' সেই .... অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি। বড্ড একঘেয়ে  লাগছে .... '
    তান প্রবল উৎসাহে খুশিভরা মুখে একবার বাবার মুখের দিকে, একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাতে লাগল।  
    সারাদিন হাসি গল্প আড্ডার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ ঐন্দ্রিলা বেরোবার জন্য তৈরি হল  -----  ' আজ আসি রে ..... প্রণবেশ তোমরা একদিন যেও। লোকজন বাড়িতে এলে বেশ ভাল লাগে। চল ..... ' 
    প্রণবেশ আর তান নীচে নেমে গেল ঐন্দ্রিলাকে ক্যাবে তুলে দেবার জন্য।  শোলাঙ্কি সিঁড়ির মুখ থেকে পিছন ফিরল ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য। দরজা খোলা রয়েছে। পিছন ফিরেই দেখল পাশের ফ্ল্যাটের ওই লম্বামতো ভদ্রলোক  প্যাসেজের একপাশে রেলিং-এ হেলান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে সেই একইরকম মৃদু হাসি। চোখের দৃষ্টি নির্বিকার। সোলাঙ্কির বুক ধড়াস করে উঠল। তার পা যেন পাথরের মতো ভারি হয়ে গেল। কেমন যেন ঘাম দিতে লাগল। এই সময়ে কার যেন জুতোর আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগল। ওপরের ফ্লোর থেকে মনোতোষ ভট্টাচার্য্য ধীর গতিতে নীচে  নামলেন। শান্তনীড় আবাসনের মূল সমস্যা হল বিল্ডিং-এ লিফট বসেনি এখনও। তবে কাজ চলছে। মনোতোষবাবু প্যাসেজ দিয়ে সিঁড়ির  দিকে এগোতে লাগলেন। শোলাঙ্কিকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একগাল হেসে বললেন , ' ভাল তো .... ' 
    সোলাঙ্কি কোন কথা না বলে প্রায় ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। মনোতোষবাবু বেশ অবাক হয়ে ঘুরে তাকালেন। তাকিয়ে দেখলেন প্যারাফেটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে একটা লোক যাকে তিনি চেনেন না। বোধহয় নতুন এসেছে এই অ্যপার্টমেন্টে। শান্ত ঠান্ডা চোখ। ভাবলেশহীন চতুর মুখ।
    মিনিট পনের পরে প্রণবেশ আর তানভি ফিরে এল। সোলাঙ্কি দরজা খুলে দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাল। কাউকে দেখা গেল না।      

    সোলাঙ্কির মনের বাতাসে একটা অস্বস্তির কালো মেঘ জমাট বেঁধে রইল।  অস্বস্তিটা প্রণবেশের সঙ্গে ভাগ করে নেবার কথা ভাবল একবার। তারপর ভাবল , কাজ নেই। প্রণবেশ
    একেই নড়বড়ে চিত্তের লোক, কোন অন্যরকম ভাবনা তার ওপর চাপানো ঠিক হবে না। তাতে সমস্যা আরও বাড়বে। 
    চুপচাপ খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল। প্রণবেশ আর তান আবোলতাবোল বকবক করছে। তান মাঝেমাঝে খিলখিল করে হাসছে।
    আলো নিভে গেল। বাপ ব্যাটা দুজনেই একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল। দেয়াল আলমারির তাকে রাখা চন্দনকাঠটা থেকে মৃদু সুবাস ভেসে এসে ঘরের বাতাসে পাক খাচ্ছে।  প্রণবেশের নাসিকা গর্জন শুরু হল।   
    সোলাঙ্কি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে সে এত ভেবে মরছে কেন। তাকে কি প্রণবেশের রোগে ধরল নাকি !  ব্যাপারটা হয়ত কিছুই নয়। ভদ্রলোক এখানে নতুন এসেছেন। হয়ত তার সঙ্গে আলাপ করতে চান। নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে পরিচয় করতে চাইতেই পারেন। এতে অন্যায়ের কি আছে। তার এতটা উদভ্রান্ত হওয়া মোটেই উচিত হয়নি। তাছাড়া এও হতে পারে ভদ্রলোক একটু পাগলাটে ধরণের কিংবা লাজুক স্বভাবের, যে কোন অপরিচিত লোকের দিকে তাকিয়ে উনি এরকম মিটমিট করে হাসেন। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে কথা বলার মতো সপ্রতিভতা নেই। এইসব সাতপাঁচ ভাবনার বাতাসে মনের মেঘ খানিকটা উড়ে গিয়ে বেশ হালকা লাগতে লাগল  সোলাঙ্কির।  বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছে। সেই  আধোঘুমে আচমকা ফিরে এল দুটো শান্ত এবং খর চোখ।  ঘুরে যেতে লাগল চিন্তাগুলো। যে পরিচয় ইচ্ছুক হবে, সে একজন অপরিচিত মহিলার দিকে অমন বেপরোয়াভাবে তাকিয়ে থাকবে কেন। সোলাঙ্কির ঘুমের ঘোর ছিঁড়ে গেল। হঠাৎ মনে হল, এই দেয়ালের ওপাশেই তো লোকটা রয়েছে। সোলাঙ্কি ঘরের সিলিং- এর দিকে তাকিয়ে নানা গোলমেলে চিন্তার স্রোতে সাঁতার কাটতে লাগল।  

    দুদিন বাদে বিকেলে ওরা তিনজন রথতলায় নজরুল মঞ্চে গেল একটা নাটক দেখতে। একটা বিখ্যাত গ্রুপের একটা বিখ্যাত  প্রোডাকশান। প্রণবেশ আজ অফিস ছুটি নিয়েছে।      

    দুর্দান্ত লাগল সোলাঙ্কির। রাত নটা নাগাদ সোলাঙ্কিরা অ্যপার্টমেন্টে এসে ঢুকল।  সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে।  নাটকটার নানা মন তোলপাড় করা দৃশ্য মনে আসছিল সোলাঙ্কির।  হঠাৎ সোলাঙ্কির বুকটা ধড়াস করে উঠল। সেই ভদ্রলোক নীচে নামছেন। একটা বোতল সবুজ রঙের ফুলশার্ট এবং একটা মাখন রঙা প্যান্ট পরে আছে। ঠিক তার পাশ ঘেঁসে মাথা নীচু করে নীচে নামছে। তাদের পেরোবার সময়  চকিতে চোখাচোখি করল সোলাঙ্কির সঙ্গে। প্রণবেশের কিছু চোখে পড়বার কথা নয়।

    থিয়েটার দেখার রেশ এক নিমেষে মুছে গেল সোলাঙ্কির মন থেকে। সে কোনরকমে ঘরে গিয়ে পৌঁছল। খাটে ধপ করে বসে পড়ল।  কেমন যেন হাঁফ ধরল। মাথা নীচু করে কবার শ্বাস নিল। প্রণবেশ সদ্য দেখে আসা নাটকটা সম্বন্ধে কি একটা বলতে যাচ্ছিল। সোলাঙ্কিকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বলল, ' কি হল !  শরীর খারাপ লাগছে নাকি ? '  
    সোলাঙ্কি নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল , ' না কিছু না .... ঠিক আছে .... '
    তার নিজের ওপর রাগ হতে লাগল। ভাবল, সে একটা অপদার্থ। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে সে অর্থহীনভাবে ভেবে আকুল হচ্ছে। এতে এত ভয় পাবার আছেটা কি। তার তো এর মধ্যেই ভদ্রলোকের মুখোমুখি হয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল, কি বলতে চান উনি।  সোলাঙ্কি ভাবল সে তো এত ভীতু কোনদিন ছিল না। তার এরকম মানসিক রূপান্তর হলটা কি করে ! শান্তনীড় লোকজনে ভর্তি। ফ্ল্যাটে সেৎ তার পরিবার নিয়ে থাকে। এ অবস্থায় ভয় বা বিপদের সামান্যতম সম্ভাবনাও সোলাঙ্কি আবিষ্কার করতে পারল না। তান বলে উঠল, ' মা খেতে দাও .... ক্ষিদে পেয়েছে '
    সোলাঙ্কি স্বাভাবিক সাংসারিক জগতে ফিরে এল। বলল, ' এই তো চাওমিন খেয়ে বাড়ি ঢুকলি .... এর মধ্যে ক্ষিধে পেয়ে গেল ? এ হল দৃষ্টিখিদে। শরীর খারাপ হয় এরকম ওপর ওপর খেলে ....'
    তান বলল, ' দূ....র , তুমি দাও তো .... বলছি ক্ষিদে পেয়েছে .... '   

    পরদিন রবিবার সকাল সাড়ে নটা নাগাদ বাজার করতে বেরোল প্রণবেশ। সপ্তাহে এই একটা দিনই জমিয়ে বাজার করে প্রণবেশ। প্রণবেশের ফিরতে একটু দেরি হচ্ছে দেখে ফ্ল্যাটের পিছন দিকের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল সোলাঙ্কি। ‌ দেখল যে , অ্যপার্টমেন্টের গেটের ঠিক সামনে,  রাস্তায় বাজারের থলে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পাশের সুইটের সেই লম্বামতো  লোকটার সঙ্গে কি সব  কথা বলছে প্রণবেশ।

    ( ক্রমশঃ) 
    ...........................…...................................
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ২৫ এপ্রিল ২০২২ ১৯:১০506891
  • দারুণ সূচনা পর্ব। এই রকম ধীরে সুস্থে বিস্তারিত করে লিখুন। 
     
    এখনিই রহস্যের আভাস পাচ্ছি। মন দিয়ে পড়ছি...
  • Mousumi Banerjee | ২৬ এপ্রিল ২০২২ ১৭:৪০506924
  • বেশ বেশ। চলুক ভালো করে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন