সলিলদার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ আলাপ কবে তা আজ আর মনে নেই। তবে নিবিড় সম্পর্ক শ্রীরামপুর হাসপাতালে 'শ্রমজীবী বিদ্যালয়' গড়ে তুলতে গিয়ে। এই বিদ্যালয় গড়তে গিয়ে আমরা বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালে বেশ কয়েকবার শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। বহু মানুষ এই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু সক্রিয় ভাবে আমরা কয়েকজনকেই পেয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে সলিলদা, দীপাঞ্জনদা অন্যতম। দুটি মানুষ শিক্ষা নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় আজীবন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। সেই জীবনের সঙ্গী বিদ্যালয় করে তোলার কাজ করে তাঁরা যেন আনন্দে মেতে উঠলেন।
প্রথম বছর গ্রাম থেকে ক্লাস এইট স্ট্যান্ডার্ডের কুড়িটি ছেলে মেয়েকে আনা হয়েছিল। অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত এবং বুদ্ধিদীপ্ত। এদের পেয়ে নানা ভাবে তাদের শেখানোর চেষ্টা শুরু হলো । আমরা চারজন--- সলিলদা, দীপাঞ্জনদা, তপতীদি এবং আমি সোম-বুধ-শুক্র ওদের পড়াতে যেতাম। অন্যান্য দিনগুলিতে অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়াতেন। সকাল আটটা নাগাদ রওনা দিয়ে আমরা সবাইকে তুলে প্রায় সাড়ে-দশটা এগারোটা নাগাদ স্কুলে পৌঁছতাম। ফেরার সময়ও প্রায় দুঘণ্টা জার্নি। এই দুই দুই চারঘণ্টায় বিস্তর আড্ডা হত। এই স্কুলটি নিয়ে সার্বিকভাবে লেখার জায়গা এটা নয়। সেটা অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে লিখবো। এখানে শুধুমাত্র সলিলদার সঙ্গে স্কুলকে ঘিরে কিছু সুখস্মৃতির কথাই লিখবো। আসলে সলিলদা ছিলেন একজন আদ্যন্ত রসিক এবং আমুদে মানুষ। সলিলদার অজস্র গুণের মধ্যে দুটো মনে হয় সবচাইতে উল্লেখযোগ্য।
আমার সঙ্গে বয়সের পার্থক্য কুড়ি বছরের বেশি কিন্তু মিশতেন একদম বন্ধুর মতো। এমনও হয়েছে প্রচণ্ড বৃষ্টি, দীপাঞ্জনদার শরীর অসুস্থ, ঠান্ডা লেগেছে, তপতীদি আসতে পারছেন না। সলিলদাকে ফোন করলাম, সলিলদা যাবেন? সলিলদা বললেন --- তুমি আসতে পারলে অবশ্যই যাবো, দ্যাখো ওরা আমাদের পথ চেয়ে বসে থাকে, গেলে খুশি হয়। আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ ধরে ক্লাস নেবো।
তখন আমার একটা মারুতি ভ্যান ছিল, তাতে করেই যেতাম। সকালবেলা বেরিয়ে সলিলদাকে বাড়ি থেকে তুলে নিলাম। আমরা দুজন, দীর্ঘপথ। সলিলদা তাঁর জীবনের কত গল্প শোনাতেন। তাঁদের পুরনো বাড়ি, ছবিদির সঙ্গে বিয়ের প্রথম দিন, শিক্ষক আন্দোলন, গঙ্গার ধারে স্কুল করতে গিয়ে খুনের হুমকি, আমেরিকায় বেড়াতে যাওয়া, ওখানকার বন্ধুরা এখানে এলে তাঁদের নিয়ে কলকাতা ঘোরানোর নানা মজার গল্প। আর যেদিন চারজন একসাথে যেতাম সেদিন তো নরক গুলজার। আলোচনায় কী না আসতো। দীপাঞ্জনদা সামনের সিটে বসতেন, পিছনের সিটে একদিকে দিদি, একদিকে সলিলদা মাঝখানে আমি। আমি সলিলদার দিকে আলতো করে পায়ে একটা চাপ দিয়ে দীপানঞ্জনদার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিতাম। সেটা হতে পারতো সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং হচ্ছে না পৃথিবী তুষার যুগের দিকে এগোচ্ছে অথবা 'সময়' কী। এর পর দীপাঞ্জনদা বলতে শুরু করতেন। দিদি জানালার বাইরে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতেন। সলিলদা মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটতেন, আর আমি দীপাঞ্জনদার কোন কোন বক্তব্যের বিরোধিতা করে দীপাঞ্জনদাকে চাগিয়ে দিতাম। আবার অন্য কোন দিন, একদম দুষ্টুমি নয়, মন দিয়ে শুনেছি সলিলদা-দীপাঞ্জনদার কাছে বিকল্প শিক্ষার তত্ত্ব, তার প্রয়োগের সমস্যা, তা সমাধানের উপায়। সময়টা অনেকদিন --- প্রায় চার বছর সপ্তাহে তিনদিন আমরা এই জার্নিটা করেছি। ফলে এই দুজনের কাছ থেকে শিখেছি অনেক।
সলিলদা মনে হয় একটা সত্যকে জীবনের ধ্রুব করে নিয়েছিলেন, সেটা হল --- 'শিক্ষা আমার ব্রত'। বাচ্চাদের ইংরাজি শেখাতেন কিন্তু তাদের সঠিক উন্নতির জন্য, বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেন। 'কোমা গাতা মারু' নামে একটি জাহাজ ব্রিটিশ আমলে বজবজের কোন একটা ঘাটে ভেড়ে, সেখানে বিদ্রোহী জাহাজিদের সঙ্গে ব্রিটিশের যুদ্ধ হয়, অনেকে শহিদ হন। তাদের স্মৃতিস্তম্ভ দেখাতে সলিলদা বাচ্চাদের নিয়ে চললেন। রবীন্দ্রনাথের জোঁড়াসাঁকোর বাড়ি দেখাতে একবার বাচ্চাদের নিয়ে গেলেন। আই এস আই তে ডাইনোসরের একটা ফসিল আছে সেটা দেখাতে একবার নিয়ে গেলেন। সর্বত্রই ওঁর বন্ধুবান্ধব ছিলেন, তাঁরা এই সব কাজে সলিলদাকে সাহায্য করতেন। সলিলদা বাচ্চাদের ইংরাজি গান শোনাতেন ইংরাজি সিনেমা দ্যাখাতেন। আবার সুমনের গানও শোনাতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সলিলদার কোনো দূরত্ব ছিল না।
সলিলদা ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরাজি হাতের লেখা ভালো করতে বলতেন। আমাদের একটা ছোট্ট লাইব্রেরি ছিল সলিলদা তার বই বিতরণ করতেন। লিখতে গিয়ে সলিলদার হাত একটু কাঁপতো, ফলত হাতের লেখা ভালো হচ্ছে না। একটা ছেলে বললো ---- স্যার আপনি আমাদের হাতের লেখা ভালো করতে বলেন অথচ আপনার হাতের লেখা খারাপ কেনো? সলিলদা হেসে বললেন ---- বুড়ো হয়েছি না, এখন তো হাতের লেখা খারাপ হবেই। সলিলদা তাঁর বন্ধুদের বলতেন ---- জানো আমি সাকসেসফুল। আমার ছাত্র আমার সমালোচনা করছে, মৃদু ধমকাচ্ছে--- এর থেকে সাফল্য আর হতে পারে না। নৈঃশব্দের সংস্কৃতি ভাঙার একটা ধাপ এগোতে পেয়েছি বোধহয়।
সলিলদা বাচ্চাদের নিয়ে গ্রামের মধ্যে ছবি তোলাতে যাবেন। আমরাও সঙ্গী। সবাই মিলে হৈ-চৈ করে চলেছি। সলিলদা তাঁর দামি ক্যামেরা অবলীলায় বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। আর তারা প্রাণের সুখে নিজের পছন্দ মতো ছবি তুলছে। কেউ কাকতাড়ুয়ার ওপর কাকের বসে থাকা, কেউ বাবুই পাখির বাসা, কেউ একসাথে পাঁচ সাতটা পুরনো ঝুলে থাকা ঘট, কেউ আদিগন্ত হলুদ সর্ষে ক্ষেতের ছবি তুলছে। পরে সলিলদা সেই ছবিগুলো প্রিন্ট করে মাউন্ট করে বাচ্চাদের দিয়ে ছবির একজিবিশন করিয়েছেন। অসাধারণ সেই একজিবিশন।
একবার আমাদের ক্লাস টেনের দুটি ছেলে মেয়ে পরস্পরের প্রেমে পড়েছে। চারিদিকে ফিসফাস। কথাটা আমাদের কানে এলো। একটা ঘরে তাদের ডাকা হলো। একদিকে তারা দুজন, উল্টোদিকে সলিলদা, দীপাঞ্জনদা এবং আমি। দিদি সেদিন যাননি। দরজাটা আলতো করে বন্ধ করে কথা শুরু হল। সলিলদা এবং দীপাঞ্জনদা বলতে শুরু করলেন --- প্রেম কতো ভালো বিষয়, কিন্তু প্রেমের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি, সেই সঙ্গে আরতিদির সঙ্গে দীপাঞ্জনদার প্রেম, আরতিদির বাড়িতে তা না মেনে নেওয়া ইত্যাদি শোনালেন। সলিলদা ছবিদির সঙ্গে তাঁর প্রেমের গল্প শোনালেন এবং আবারও বললেন প্রেমের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। দুই বৃদ্ধ মাস্টারমশাইয়ের প্রেমের গল্প শুনে ছাত্র-ছাত্রী দুটি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং শেষের দিকে উদ্ভাসিত। শেষে দুই মাস্টারমশাই বললেন তোমাদের প্রেমের বর্তমান অবস্থান কী, ভবিষ্যত নিয়ে কী ভাবছো ইত্যাদি। এতক্ষণে তারা সহজ হয়ে গেছে। সহজভাবেই উত্তর দিল। তাদের বলা হলো খেয়াল রাখবে তোমাদের এই প্রেম যেন স্কুলের ক্ষেত্রে কোন বড় ইস্যু না হয়ে দাঁড়ায়। তারা খুশি মনে চলে গেলো। মাঝে মধ্যে টুকরো টাকরা মন্তব্য করা ছাড়া আমি গোটা বিষয়টা দারুণ উপভোগ করেছিলাম।
সলিলদা বাচ্চাদের এতটাই ভালোবাসতেন যে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন ইন্দুমতী সভাগৃহে ছবিদির লেখা একটা বইয়ের উদ্বোধন বাচ্চাদের হাত দিয়েই করিয়েছিলেন। ছবিদির স্মরণসভায় আমি এবং আমার স্ত্রী অঞ্জলি গিয়েছিলাম। স্মৃতিচারণায় বলেছিলাম বাড়িতে গেলে ছবিদির আন্তরিক আপ্যায়ন এবং নানা কিছু, সঙ্গে দারুণ ভালো চা খাওয়ানোর কথা। আর যে কোন জায়গায় ওঁর উপস্থিতি অত্যন্ত স্নিগ্ধ এবং মাধুর্যপূর্ণ ছিল সে কথা বলেছিলাম। আমি আমার মাকে অনেক কম বয়সে হারিয়েছি। ছবিদির চলনে-বলনে, আকৃতি-প্রকৃতিতে আমি যেন আমার মাকে দেখতে পেতাম। খুব শ্রদ্ধা করতাম ছবিদিকে। সভা শেষে বিদায় নেবার সময় সলিলদাকে হাত দুখানা যখন ধরলাম, ওঁকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখলাম যে মনটা ভয়ঙ্কর রকমের ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।
ন-দশ বছর ঘনিষ্ঠভাবে একসঙ্গে চলার স্মৃতি, অনেক কথাই মনে আসে। তবে সুখস্মৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই।
সলিলদার কথা হবে আর খাওয়ার কথা হবে না এটা হতে পারে না। আমরা শ্রীরামপুরের স্কুলে যেতাম দিল্লি রোড ধরে, ফিরতাম বিকেল জিটি রোড ধরে। সেখানে রাস্তার ওপর 'ফেলু মোদক', 'রাধাবল্লভী', 'অমর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' আরো কতো মিষ্টির দোকান। মাঝে মাঝেই এক এক দিন এক এক দোকানে থামা হতো এবং সিঙাড়ার সঙ্গে নানা ধরনের মিষ্টি খেয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতো। তবে সবচাইতে পছন্দের দোকান ছিল অমর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। সেখানে মিষ্টি খাওয়ার পর মিষ্টি কেনা হতো, আমরা কিছু কিছু মিষ্টি কিনতাম, সলিলদা সবচেয়ে বেশি মিষ্টি কিনতেন। মিষ্টি কেনার পর সলিলদা একটা জিনিস আমার হাতে ধরিয়ে দিতেন, সেটা হচ্ছে ছানার কিউব ভাজা। এটা দিয়ে সুন্দর ছানার ডালনা বানানো যায়। আমি যেমন সলিলদার বাড়িতে যেতাম সলিলদাও আমার বাড়িতে অনেকবার এসেছেন। আমার স্ত্রী অঞ্জলিকে খুব স্নেহ করতেন। অঞ্জলি রাঁধতে ভালোবাসে তাই ওটা তার জন্য সলিলদার উপহার। সলিলদা আমাকে একটা উপহার দিয়েছিলেন। লাদাখ বেড়াতে গিয়ে সেখানে বিরাট একটা বুদ্ধমূর্তির ছবি তুলে দিলেন। ছবিটা এমনভাবে তুলেছেন যে, ছবির একটা কোণায় বুদ্ধ মূর্তিটা আর ছবির অধিকাংশ জুড়ে আদিগন্ত নীল আকাশ। দারুণ সুন্দর করে বাঁধিয়ে ছবিটা আমায় উপহার দিয়েছেন। ছবিটা আমার বসার ঘরে টাঙানো আছে। সলিলদার ব্যক্তিগত স্তরে আমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি রসিকতা, বিকল্প শিক্ষা নিয়ে সলিলদার ভাবনা, যা থেকে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি এবং সলিলদার দেওয়া এই ছবিটি আমার কাছে অমূল্য সম্পদ। ছবিটার দিকে যতবার চোখ পড়ে ততবারই সলিলদার কথা মনে পড়ে। কোনদিন ভুলতে পারবো না আমার এই অসামান্য বন্ধু-শিক্ষককে।