কাদামাটির হাফলাইফ : ইমানুল হক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : ছেঁড়াকাঁথা | ১৩ আগস্ট ২০২২ | ১৯৭৩ বার পঠিত | মন্তব্য : ৫
আমাদের গ্রামে ডাকাতি কম হয়েছে। আমার মামাদের বাড়িতে একবার হয়। কংগ্রেসের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের ফসল। বড় মামাকে ডাকাতির নামে মেরে ফেলাই ছিল লক্ষ্য। সবাই জানত, কারা ডাকাতি করিয়েছে, কাদের দিয়ে, কিন্তু কিছু প্রতিকার হয়নি। বড়মামা সেদিন 'নীলরক্ত' যাত্রা শুনতে তিন কিলোমিটার দূরের বুড়ুল গ্রামে গিয়েছিলেন।
এই ঘটনার পর মামার বাড়িতে দু নলা বন্দুক এল।
কোনা বলে গ্রামের কংগ্রেসের এক বড় নেতা ডাকাতদের আসল সর্দার। আমাদের গ্রামের কয়েকজন ছিল আলাদা ডাকাত দলে। যে বন্দুক দিত, ডাকাতির ৫০% টাকা তার।
পরে ডাকাতি আমাদের এলাকায় উঠে যায়। ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পরে।
তার আগে ডাকাতির খুব ভয় ছিল।
ডাকাতি ছেড়ে দেওয়া একজন মানুষ আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম। অনেক ডাকাতির গল্প শুনেছি।
কিন্তু সব লিখতে পারব না।
ডাকাতের দলে থাকা লোকদের ছেলেমেয়েরা কষ্ট পাবে।
কাদামাটির হাফলাইফ : ইমানুল হক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : স্মৃতিকথা | ২০ আগস্ট ২০২২ | ১৩৮১ বার পঠিত
পড়া হতো। তার চেয়েও গল্প হতো বেশি।
এই গল্পই একবার আমার প্রাণ বাঁচায়।
পূজার ছুটি। কলেজ হোস্টেলে আমি একা। জ্বর চলছিল। বিকেলের দিকে মনে হল জ্বর ছেড়েছে। গায়ে হাত দিয়ে কোনো উষ্ণতা টের পাচ্ছি না।
বিকেলে হোস্টেলে ফিস্ট।
কৌশিক লাহিড়ী কৌস্তভ সায়ন ওদের আসার কথা।
শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে।
কৌশিক এলো সবার আগে। এসে দেখে বলল, বাবুর্চি সাহেব, শুয়ে কেন?
বললাম, জ্বর এসেছিল। এখন নেই।
কৌশিক তখন ডাক্তারি পড়ছে।
গায়ে হাত দিয়ে বলল, গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে ছোটাছুটি।
কাদামাটির হাফলাইফ : ইমানুল হক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : স্মৃতিকথা | ২৮ আগস্ট ২০২২ | ২১৫৮ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
বাবার গাল শক্ত হলেই আমি সাধারণত দৌড় দিতাম। আজ অসতর্ক। পেয়েছে।
কিন্তু চড় খেয়েই সজাগ হয়ে, দে দৌড় দে দৌড়।
৫০০ মিটার দৌড়ে এসে ধরেছে।
ধরেই গলায় পা, তোকে আজ মেরেই ফেলবো।
আমি কাঁদছিও না, ছাড়তেও বলছি না।
চুপ করে শুয়ে আছি।
এদিকে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কোনোদিন স্কুল কামাই করি না। পরীক্ষা দিচ্ছি না। মোবাইল না থাকলেও সেযুগেও খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছড়াত।
খবর পেয়ে হেডমাস্টার মশাই এসে গেলেন।
বাবা ছাড়বেন না, ওর খুব অহঙ্কার। আমি চাই ফেল করুক।
আমি ওর মধ্যেই বলছি, ইতিহাসে আমি কোনোদিন ফেল করবো না।
বাবা বললেন, তোকে যেতেই দেবো না।
এদিকে অন্য শিক্ষকরাও হাজির।
আধঘন্টা পর হলে গেলাম পরীক্ষা দিতে।
ধুলোটুলো ঝেড়ে।
স্যাররাই কেউ কলম এনে দিলেন।
এই বাবার মতো অসাধারণ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।
কাদামাটির হাফলাইফ : ইমানুল হক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : স্মৃতিকথা | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৯২৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ২
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের 'লালসালু' পড়লেও বোঝা যায়, মানুষের আসল ধর্ম বেঁচে থাকা। ধর্মব্যবসায়ীরা তাকে বদলে ধর্মান্ধ করে তুলতে চায় ধান্দায়।
গ্রামে ধর্ম ছিল ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল না।
১৯৭০ এ গ্রামে কোনো মসজিদ ছিল না।
২০২০র আগে গ্রামে আলাদা করে কোনো স্থায়ী দুর্গামন্দির ছিল না।
গ্রামে একটা ছোট্ট শিবমন্দির ছিল। গাজন বা চড়কে হিন্দু মুসলমান সবাই অংশ নিত। বারোয়ারি পুজো একটা ছিল। দুর্গা নয় ওলাইচণ্ডী পূজা। তাকে ঘিরে মেলা যাত্রা হতো। হিন্দু মুসলমানের মিলিত উৎসব।
তালবড়া, তালের ফুলুরি জেলার খাওয়া হতো তার সঙ্গে কৃষ্ণের কোনো সম্পর্ক আছে কলকাতা না এলে জানতে পারতাম না। গরিব মানুষ তো ভাদর আশ্বিন মাসে তাল খেয়েই বেঁচে থাকতেন। তাল আর শাকপাতা। ভাত, আলু ডাল তো দূরের কথা জুটতো কতজনের? সামান্য জাও বা ফ্যানভাত জুটলেই তাকে উৎসব বলে মনে হতো অনেকের। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মানোয় খাওয়ার কষ্ট পাইনি। কিন্তু অনেকের তো দেখেছি।
কাদামাটির হাফলাইফ : ইমানুল হক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : স্মৃতিকথা | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২১৯৯ বার পঠিত | মন্তব্য : ১০
কেমন করে সময় দেখতাম আমরা? সত্তর দশকে? বাড়িতে প্রথমে একটাই ঘড়ি। যে ঘড়ি বাবা ষাট বছরের বেশি সময় পরেছেন। পরে দাদার একটা ঘড়ি হয়। কিন্তু দাদাও তো বাইরে থাকেন। আমরা সময় মেলাতাম নানা পদ্ধতিতে।
একটা ছিল পাশের বাড়িতে একটা দেওয়াল ঘড়ি ছিল হরিণের শিংয়ের পাশে। কাঠের পেন্ডুলাম দেওয়া ঘড়ি।
সবসময় যেতে ইচ্ছে হতো না।
একটা তো মায়ের ওঠা।
মা কী করে উঠতেন মা-ই জানেন। এছাড়া ভোর চার ১৫ মিনিটে ফজরের আজান। সবসময় শুনতে পেতাম না।
দুই, সকালে গুঁড়ুভাইয়ের হাঁক ডাক করে আসা। ঠিক ছটায়। কই, শাশুড়ি চা কই?
তিন, নোটনমণি ফুলের ফোটা। ঠিক নটায়।
চার, ঝাঁটার কাঠির ছায়া মেপে।
পাঁচ, বালি ঘড়ি করে।
কাদামাটির হাফলাইফ : ইমানুল হক
বুলবুলভাজা | ধারাবাহিক : স্মৃতিকথা | ১২ নভেম্বর ২০২২ | ১৭২৫ বার পঠিত | মন্তব্য : ৪
ও আমার ন্যাংটো বেলার বন্ধু। এ-রকম কথা বলার মানুষ ক্রমেই কমে আসছে। অথচ আমাদের, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে, সবার, 'ন্যাংটো বেলা' ছিল। শহরে হয়তো আলাদা। শহরে ধনী উচ্চমধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত স্বল্পবিত্তদের ক্ষেত্রে আলাদা হতেও পারে, কিন্তু সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনে এখনো গ্রাম বেঁচে আছে। খেলায়, মেলামেশায়-- অভ্যাসে।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় কাউকে কাউকে ঘুরতে আসতে দেখেছি প্যান্ট না পরেই। পুকুরে স্নান করার সময় ছোটদের পোশাকের কোনো বালাই নাই। বর্ষাকালে যত খুশি কাদা ঘাঁটার জল মাখামাখি করার কাদায় গড়িয়ে ফুটবল খেলার প্রভৃতি আজো জমজমাট।