নতুন বছরে নতুন বই। কিশোরদের জন্যে নটি গল্পের সংকলন। তেঁনারা। ... ...
পরপর দুটি স্মৃতিকথা পড়া হয়। প্রথম বাশারাত পীর লিখিত ‘কার্ফ্যিউড নাইট’ এবং সেই সূত্রে রেফারেন্স পেয়েই বিপ্রতীপের আখ্যান রাহুল পন্ডিতা লিখিত ‘আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস’। পীরের লেখা আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। আফস্পা নামক আইনটি এবং সেই রক্ষাকবচের আড়ালে কাশ্মীর বা মণিপুরে ভারতীয় সেনার দানবীয় রূপের কিছু কিছু কথা জানা ছিল, জানা ছিল না এই ভয়াবহ অত্যাচার আর অবিশ্বাসের আবহাওয়ার। জানা ছিল না সরকার তথা সেনাবাহিনী অথবা সন্ত্রাসবাদী তথা স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর এই দুই পক্ষের মধ্যে কোন একটির আওতায় থাকতে বাধ্য প্রতিটি মানুষ। জানা ছিল না এমনকি পক্ষাবলম্বনের পরেও সেই পক্ষের মধ্যে থাকতে পারে অজস্র ছোট পক্ষ যাদের মধ্যের বাদানুবাদে যেকোন মুহূর্তে বিপন্ন হতে পারে মানুষের সর্বস্ব। প্রায় নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে পীর লিখে গেছেন কাশ্মীরের অসহায় বিপন্ন দিনরাতের জ্বলেপুড়ে যাওয়ার কাহিনী। পন্ডিতা নিজে কাশ্মিরী পন্ডিত, লেখা সত্যি বলতে কি বড় বেশী পার্টিজান, খুব যে ভাল লেগেছে পড়তে তা নয়, কিন্তু এ বইও আমার জন্য আই ওপনার। কাশ্মীরি পন্ডিতদের আতঙ্ক ও অসহায় পলায়ন ঠিক এভাবে জানা ছিল না। ... ...
১৯৭১ সালে পুলিশ বীনাকে গ্রেপ্তার করে নক্শাল সন্দেহে। সপ্তাহখানেক হাজতে রাখে, জেরার নামে প্রতিদিন, ক্রমাগত মারধোর করে, তারপর রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, অর্ধচেতন অবস্থায় জেলে পাঠায়। কোনরকম একটু সুস্থ হওয়ার পর আবার হাজতে, আবার এক সপ্তাহ জেরা ও নৃশংস মার। আমার সঙ্গে যখন দেখা তখনও বীনার সর্বাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন, কানে চোট লেগে মাথা ঘোরে, যন্ত্রনা আর থেকে থেকে জ্বর। কিন্তু বীনা শক্ত মেয়ে। বীনার সব থেকে বড় রাগ ছিল, পুলিশ ওর ঋতুশ্রাবের সময় কোন কাপড় পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেয়নি। জেলেও অবস্থা তেমন কিছু আলাদা ছিল না। হাজারিবাগে কখনো কখনো নোংরা, উকুনে ভরা কাপড়ের বান্ডিল গরাদের ফাঁক দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হত- বেচেবুছে পরিস্কার করে ঋতুশ্রাবের সময় ব্যবহার করার জন্য। জামশেদপুরে ওসবের আলাদ কোন ব্যবস্থাই ছিল না। মেয়েরা তাদের শাড়ি থেকে, কখনো কম্বল থেকে কাপড় ছিঁড়ে ধুয়ে শুকিয়ে ব্যবহার করতো। বীনার সঙ্গে আমার য্খন দেখা তখন সদ্য ওর বাবা মারা গেছে। বাড়ির কাউকে ও অনেকদিন দেখেনি - কারন জামশেদপুর আসতে দশ টাকা গাড়ি ভাড়া লাগে, আর জেলের দরজায় ঘুষ দিতে হয় - ঐ টাকা জোটানো বীনার বাড়ির লোকের পক্ষে সম্ভব না। ওকে দেখে বুঝতে পারতাম বীনা কখন ওর বাড়ির মানুষের কথা ভাবছে। আবহাওয়ার সামান্য বদলে বীনা বিষন্ন হয়ে পড়তো - ফসলের কী হবে, ফসলের ক্ষতি হলে বাড়ির মানুষের কী হবে। ফসল ভালো না হলে স্থানীয় মহাজনের থেকে ১০০% সুদে ধান কর্জ নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। ... ...
ভ্রমণ নিয়ে যে বিশাল লেখাপত্র ফেঁদে বসব এমনটা খুব বেশ দিন আগেও ভাবি নি। আর আগে তেমনটা আগে ভাবি নি বলেই মোটা ডায়েরী নিয়ে ঘুরেছি বা ঘুরে এসেই সব লিখতে বসে গেছি – এমনটাও হয় নি। অন্যদিকে দেখতে গেলে গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে ঘোরা ঘুরিও কম হল না! এই কুড়ি এত ঘুরেছি যে সেটাই যেন স্বভাবিক এমন ভাবনায় মস্তিষ্ক নর্মালাইজড হয়ে গিয়েছিল! ... ...
এই লেখাটি ভ্রমণবিষয়ক "মনপবন" পত্রিকার পরিচয় জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে রচিত। ... ...
এক সময় কবিতা লজিক্যাল থাকে না – আর থাকার দরকারও তো নেই মনে হয় সবসময়! সব সময় কবিতা দিয়ে সাহিত্যের বাঁকবদল নাই বা হল! কোন নতুন যুগের সূচনা করার জন্য কবিতা লিখতে চায় নি সে। কবিতা ছিল তার প্রকাশ – তার সাময়িক নিঃসঙ্গতার সাথী। ... ...
বিশ্বজুড়ে ধর্ম-অধর্ম নিয়ে রক্তারক্তির ঘটনা চিরকালীন - সত্যি বলতে বিশ্বের সকল মানুষের সেটাই সনাতন ধর্ম - সে তাদের ধর্মমতের নানান নাম-ধাম- গাঞি-গোত্র যাই হোক না কেন। ... ...
টুকটাক ... ...
ডেল্টা অফ ভেনাসের গল্পগুলো অনুবাদ করছি ... ...
বিট আন্দোলন ... ...
অনুবাদকও ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে ... ...
পৃথিবীর বয়স কত? ধরুণ গিয়ে ঐ মোটামুটি ৪.৩ বিলিয়ন ইয়ার, মানে ওই ৪৩০ কোটি বছরের মত আর কি। তো এই এত বছর বয়সে পৃথিবীর বুক থেকে ‘প্রাণ’ নাম জিনিসটার পুরোপুরি অবলুপ্তি হয়েছে বার কয়েক ধরে নেওয়া যাক। ওই যেমন ডাইনোসার রা হাপিস হয়ে গিয়েছিল। সেই অর্থে মনুষ্য প্রজাতির (হোমো স্যাপিয়েন্স) এর অবলুপ্তি পৃথিবীর বুক থেকে এখনো হয় নি। কিন্তু যদি হত? ... ...
১৯৭৩ এর ফেব্রুয়ারিতে দেখলাম অনেকদিন আগে জামিন পাওয়া দুজন কয়েদী জেলে ফিরে এল। বছর পঁচিশেকের বুধনি আর তার শাশুড়ি। বুধনির বর জেলেই আছে, কিন্তু গত বছরখানেকের মধ্যে পয়সার অভাবে ওরা কেউ গ্রাম থেকে দেখা করতে আসতে পারেনি। এই দুই মহিলা "জামিন অমান্য" করার অপরাধে আবার আটক হয়েছে। ওদের গ্রাম থেকে বাসে করে হাজারিবাগ আদালতে আসতে বাস ভাড়া লাগে ছ'টাকা। সেই টাকা ছিল না বলে আদালতের হাজিরার দিন ওরা আসতে পারেনি। ওরা বাড়িতে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র রাখার দায়ে আতক হয়েছিল - কেস মিটমাট করার জন্য জমি, গয়না, জিনিস সবই বেচে দিয়েছে। সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার পরও আদালতে মামলা ওঠেনি। এই ক'দিন দু'জন লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে কোন রকমে দিন গুজরান করেছে। ... ...
ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে জাতপাতের গুরুত্ব নিয়ে আমি রোজই বেশি বেশি করে সচেতন হচ্ছিলাম। বইয়ে পড়া চার বর্ণের সাদাসিধে হিসেবটা পড়েই ভাবতাম ভারতের জাতের ব্যাপারটা আমি জানি। আস্তে আস্তে জানলাম এই সব জাত আবার মোটামুটি আড়াই হাজারের মত আলাদা আলাদা সম্প্রদায়, গোষ্ঠী এসবে ভাগ করা - তাদের বিয়ে টিয়ের অতি জটিল এবং সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুন, আচার, সংস্কার আছে। প্রতিটি জাত অন্য জাতের সঙ্গে কীভাবে আর কতদূর সম্পর্ক রাখতে পারবে তার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সোমরি বলেছিল জেলের বাইরে ও ব্রাহ্মণ বা নিজের জাতের বাইরে কারো রান্না করা ভাত খেতে পারে না, কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু জাতের তৈরি অন্য কিছু কিছু শুকনো খাবার খেতে পারে। ... ...
মোদ্দা কথা টাকা থাকলেই আসবে ক্ষমতা – এবার সেই ক্ষমতা নিয়ে আপনি কি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। টাকা আর ক্ষমতা কাছে চলে এলে আপনি আপনার চারিদিকে যে পাবলিক ঘুরঘুর করছে তাদের কন্ট্রোল করতে পারবেন – এবং তারা আপনার জন্য আপনার চাদিকের পৃথিবী পালটে দেবার চেষ্টা করবে আপনার পছন্দ মত। এবং সেই ক্ষমতা বাড়তে বাড়তে একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আপনি চারপাশের ‘বাস্তবতা’ নিজে ইচ্ছে মত তৈরী করে নিতে পারবেন! এই পর্যায়ে আপনাকে আর সত্যের বিকৃতি ঘটাতে হবে না টাকা উপায়ের জন্য, টাকাই আপনার জন্য সত্যের বিকৃতি ঘটিয়ে দেবে! ... ...
জেলের বাইরে ভারত তখন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। আসামে ভাষা আন্দোলন, পাঞ্জাবে ছাত্র বিক্ষোভ, দেশের অন্যান্য প্রান্তে একেক জায়গায় একেক রকম সমস্যা। একদিন হাজারিবাগ থেকে তিরিশ মাইল দূরে রামগড়ের এক ধর্না আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার হওয়া বিহারের এক বিধায়ক এলো আমাদের এখানে। ও আমাদের সঙ্গে অল্পদিনই ছিল, কিন্তু সেই অল্প কদিনে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম। ও রামগড়ের সিপিআই বিধায়ক। আগে ওর স্বামী বিধায়ক ছিল - নির্বাচনের অল্প ক'দিন পর সে খুন হয়। দল তখন ঠিক করে ঐ আসনে এ দাঁড়াবে, জিতেও যায় - সহানুভূতির ভোটও ছিল বিপুল। আমার ইচ্ছে ছিল ওর সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে একটু কথা বলার। ও দেখলাম মার্কস এঙ্গেলস বা লেনিনের ব্যাপারে কিছু জানে না। সরকারী নীতি নির্ধারন এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম - অকপটে স্বীকার করলো ও ইংরেজি জানে না, আর বিধানসভার কাজকর্ম সব ইংরেজিতে হয় তাই ওখানকার আলোচনা বা বিতর্ক কিছুই ও ধরতে পারে না। ... ...
তিরিশ মাইল দূরের ছাতরার সাব-জেল থেকে একটি অল্পবয়সী মেয়ে এল - কোলে তার কংকালসার ছেলে, শ্বাসটুকুই যা চলছে। হাত পা গুলি সরু কাঠি, ব্যথায় মলিন বড় বড় চোখদুটি যেন মুখ থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। কনুই, গোড়ালি, হাঁটু খোস পাঁচড়ায় ভরা, শরীর রক্তশূণ্য, চামড়া ঝুলে পড়ছে। বাচ্চাটার কাঁদারও শক্তি নেই - এমন ভাবে মায়ের কোল আঁকড়ে থাকে মনে হয় যেন কোনভাবে নতুন করে বাঁচার জন্যে ও মায়ের গর্ভে ফিরে যেতে চাইছে। দুমাস ধরে আন্ত্রিক রোগে ভুগছে - ছাতরায় চিকৎ্সার কোন ব্যবস্থা নেই। বাঁচার আর আশা একেবারেই নেই বোঝার পর ওখানকার জেলার তড়িঘড়ি হাজারিবাগে পাঠিয়েছে "চিকিৎসা"র জন্য। ঠিক মাথায় দু'দিনের ছেলেটা আমার কোলেই মারা গেল। কী দুঃসহ অপচয় একটা জীবনের, আঠারো মাসের একটা শিশুর মৃতদেহ এই প্রথম আমি চোখের সামনে দেখলাম। পাথরের মত বসে তাকিয়ে রইলাম - ডোম এসে কাপড়ে মুড়িয়ে কংকালসার দেহটাকে নিয়ে গেল - জেলখানার দেওয়ালের ঠিক বাইরেই ঝিলের ধারে ওর দাহ হবে। ... ...
কিছুদিন পর সুপার জানালো ২৯শে মার্চ জামশেদপুরে আমার আদালতে হাজিরার দিন ঠিক হয়েছে। বাবা চিঠি লিখেছিল - তাতেও এই খবর ছিল। সুপার বললো একটা চার্জশিট জমা পড়েছে, আরেকটার কাজ চলছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম - দ্বিতীয় কেস বলে কিছু আছে আমার তো তাই জানা ছিল না - কিসের চার্জশিট ! সুপার নিজেও মনে হল ধন্দে পড়ে গেছে। একজন দপ্তরী আমাদের কথা শুনে দেখে বললো সত্যিই আমার বিরুদ্ধে আরেকটা সমন আছে। কাগজপত্র ঘেঁটে সেটা বেরুলো - ঐ কেসটা নিয়ে আমাকে কেউ কিছু জানানোরই প্রয়োজন বোধ করে নি। ওটা প্রথমটা থেকে অনেক বেশি ভয়ানক - রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধঘোষনা। এই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। অভিযোগ, ১৯৭০ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলাম। ওদিকে ঐ সময়ে আমি দু'সপ্তাহ জেলে কাটিয়ে নিয়েছি। ... ...